জীববৈচিত্র্য (Biodiversity)
ভূমিকা : – পৃথিবী হল বহু বিচিত্র রকমের লক্ষ লক্ষ জীব প্রজাতির আবাসস্থল । পৃথিবী সৃষ্টির বহু কোটি বছর পরে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বহু বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এই বৈচিত্র্য এসেছে । এমনকি উন্নততর প্রাণী হিসাবে মানুষও এসেছে বহু বিবর্তনের পর । জীব জগতের এই বিবর্তন এক গতিশীল প্রাকৃতিক প্রকৃতিক প্রক্রিয়া । প্রকৃতির নিয়মেই সৃষ্টি ও ধ্বংসের মধ্যেই এই জীববৈচিত্র্য গড়ে উঠেছে । মানুষের নিজের টিকে থাকার তাগিদে এদের সংরক্ষণ করা অবশ্যই উচিত ।
সংজ্ঞা : – প্রাকৃতিক পরিবেশে আণুবীক্ষণিক জীবসহ উদ্ভিদ ও প্রাণীকুলের সমাবেশে যে বৈচিত্র্যময় জীবমন্ডল গড়ে ওঠে তাকে জীববৈচিত্র্য বলে । অন্যভাবে বলা যায় কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে উদ্ভিদ, প্রাণী ও আণুবীক্ষণিক জীবসমূহের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে যে বাস্তুতন্ত্র গড়ে ওঠে, সেই বাস্তুতন্ত্রে অগণিত নানা ধরনের জীব প্রজাতির সমাহারকে বা সমাবেশকে জীববৈচিত্র্য বলে । 1986 খ্রিস্টাব্দে ওয়াল্টার রোজেন স্মিথ সোমিয়ান ইন্সটিটিউটের ন্যাশানাল ফোরামে সর্বপ্রথম ‘জীববৈচিএ্য’ তথা ‘Biodiversity’ শব্দটি ব্যবহার করেন । পরবর্তীকালে IUCN (International Union of Conservation of Nature Resources) ও UNEP (United Nations Environment Programme)
Biodiversity শব্দটি গ্ৰহণ করে জীববৈচিত্র্যের যে সংজ্ঞা প্রদান করে তা হল-
“কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের সমস্ত জিন, প্রজাতি ও বাস্তুতন্ত্রের বৈচিত্র্য ও সমগ্ৰতাকে জীববৈচিত্র্য বলে ।”
জীববৈচিত্র্যের শ্রেণিবিভাগ : – প্রকৃতিগত পার্থক্য অনুযায়ী জীববৈচিত্র্যকে তিনটি পর্যায়ক্রমিক স্তরে বা শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায় । যথা –
ক. জিনগত বা জন্মগত বৈচিত্র্য,
খ. প্রজাতিগত বৈচিত্র্য এবং
গ. বাস্তুতান্ত্রিক বৈচিত্র্য ।
ক) জিনগত বা জন্মগত বৈচিত্র্য : – কোনো জীব প্রজাতির মধ্যে জিনের সমবায়গত পার্থক্যের জন্য জীবের যে গঠনগত ও প্রকৃতিগত পার্থক্য লক্ষ করা যায় তাকে জন্মগত বা জিনগত বৈচিত্র্য বলা হয় । জিনের সমবায়গত পার্থক্যের কারণে মানব প্রজাতির মধ্যে প্রতিটি মানুষ দৈহিক ও মানসিক গঠন অনুযায়ী আলাদা । জিনগত পার্থক্যের কারণে সারা বিশ্বে প্রায় 50,000 ধরনের ধান দেখা যায় । অন্যদিকে Magnifera indica হল আম প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম । ভারতে এই প্রজাতির আমের প্রায় 200 টি প্রকারভেদ আছে । যেমন – ফজলি, ল্যাংরা, গোলাপখাস, চৌসা, তোতাপুরি প্রভৃতি
খ) প্রজাতিগত বৈচিত্র্য : – কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীকুলের সমাবেশকে প্রজাতিগত বৈচিত্র্য বলে । প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রে উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির সংখ্যা সর্বাধিক । অন্যদিকে মনুষ্য নিয়ন্ত্রিত বাস্তুতন্ত্রে প্রজাতিগত বৈচিত্র্য সর্বাপেক্ষা কম ।পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাকৃতিক অঞ্চলগুলির মধ্যে নিরক্ষীয় অঞ্চলের প্রজাতিগত বৈচিত্র্য সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধশালী । আধুনিক কৃষি পদ্ধতিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অনুপ্রবেশ ঘটায় জীববৈচিত্র্য ভীষণভাবে কমে গেছে । আধুনিক কৃষি ব্যবস্থায় কেবলমাত্র একটি প্রজাতির ফসল উৎপাদনের দিকে জোর দেওয়া হয় । স্বাভাবিক অরণ্যের উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল বহু প্রজাতির প্রাণীগোষ্ঠীরও সমাবেশ ঘটে । রোপিত বনভূমিতে কেবলমাত্র নির্দিষ্ট প্রজাতির উদ্ভিদ রোপন করা হয় বলে এইরুপ বনভূমিতে জীববৈচিত্র্য খুবই কম ।
প্রজাতিগত বৈচিত্র্যের সূচকসমূহকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় ।
১) প্রজাতিগত সমৃদ্ধি : – কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে উপস্থিত প্রজাতি সংখ্যাকে প্রজাতিগত সমৃদ্ধি বলে ।
২) প্রজাতি প্রাচুর্য : – কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে উপস্থিত প্রজাতিসমূহের মধ্যে প্রজাতিগুলির সংখ্যাগত আপেক্ষিক প্রাধান্যকে প্রজাতি প্রাচুর্য বলে ।
৩) আন্তঃসম্পর্কযুক্ত বৈচিত্র্য : – একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে উপস্থিত প্রজাতিসমূহের মধ্যে একটি সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক গড়ে ওঠে । বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের পার্থক্যকে আন্তঃসম্পর্কযুক্ত বৈচিত্র্য বলে ।
গ) বাস্তুতান্ত্রিক বৈচিত্র্য : – পৃথিবীর বিভিন্ন জলবায়ু অঞ্চলে জলবায়ু ও ভূমিরূপের পার্থক্যের জন্য বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদের সমাবেশে বিভিন্ন ধরনের বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠেছে । এইরুপ বাস্তুতন্ত্রের ভিন্নতাকে বাস্তুতান্ত্রিক বৈচিত্র্য বলে ।
পৃথিবীতে উপস্থিত বাস্তুতন্ত্রগুলির স্বতন্ত্রতা অনুযায়ী বাস্ততন্ত্রগুলিকে প্রধানত 4 টি ভাগে ভাগ করা যায় । যথা-
১) অরণ্যের বাস্তুতন্ত্র, ২) তৃণভূমির বাস্তুতন্ত্র, ৩) মরুপ্রায় ও মরু অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র, ৪) জলভাগের বাস্তুতন্ত্র ।
জীববৈচিত্র্যের গঠন : –
পৃথিবীর মোট আনুমানিক জীব প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ১ থেকে ৩ কোটি । তবে জ্ঞাত জীব প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ২১ লক্ষ ৩১ হাজার ১ শত । মোট জীবিত প্রজাতির ৭০ শতাংশ অমেরুদণ্ডী প্রাণী । আবার অমেরুদণ্ডী প্রাণীর প্রায় ৭০ শতাংশই হল কীটপতঙ্গ । যদিও সংখ্যায় অল্প, তথাপি পক্ষীকুল ও স্তন্যপায়ী প্রাণীই জীববৈচিত্র্যের মূর্ত প্রতীক তথা প্রতিভূ ।
জীববৈচিত্র্যের দৈশিক বণ্টন : –
সারা বছরব্যাপী অধিক উষ্ণতা ও পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টিপাতের কারণে নিরক্ষীয় অঞ্চলে সর্বাধিক জীববৈচিত্র্য লক্ষ করা যায় । নিরক্ষরেখা থেকে উওর ও দক্ষিণে উচ্চ অক্ষাংশের দিকে প্রতিকূল জলবায়ুর জন্য ও হিমযুগগুলিতে হিমবাহের বিস্তৃতির কারণে বহু উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটেছে । তাই নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে ও এর উত্তর ও দক্ষিণে মেরু অঞ্চলের দিকে জীববৈচিত্র্য অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে । ইউরোপ নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে অবস্থান করায় প্রতি হেক্টর অরণ্যে প্রায় ৩০ টি প্রজাতির উদ্ভিদ লক্ষ করা যায় । আবার নিরক্ষীয় অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় আমাজন অরণ্যের প্রতি হেক্টর বনভূমিতে ২০০-এর অধিক উদ্ভিদ প্রজাতির সমাবেশ লক্ষ করা যায় । পৃথিবীর মোট জীবিত উদ্ভিদ প্রজাতির ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ কেবলমাত্র ১৭ টি ক্রান্তীয় দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ । স্বল্প পরিসর স্থানে সর্বাধিক জীব প্রজাতির কেন্দ্রীভবনকে মেগা জীববৈচিত্র্য বা অতি জীববৈচিত্র্য কেন্দ্র বা অঞ্চল বলে । পৃথিবীর মোট ১২ টি মেগা জীববৈচিত্র্য কেন্দ্রের বা অঞ্চলের মধ্যে ভারতের স্থান দশম । মেক্সিকো, কলম্বিয়া, ব্রাজিল, পেরু, ইকুয়েডর, জাইরে, মাদাগাস্কার, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, চিন ও অস্ট্রেলিয়া মেগা জীববৈচিত্র্যের উদাহরণ ।
ক্রান্তীয় অঞ্চলে জীববৈচিত্র্যের সমৃদ্ধির কারণসমূহ :
১) উচ্চ তাপমাত্রা ও অধিক আর্দ্রতা এই অঞ্চলে সর্বাধিক জীববৈচিত্র্যের অন্যতম কারণ ।
২) জলবায়ুগতভাবে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের তুলনায় ক্রান্তীয় অঞ্চল বেশি স্থিতিশীল । তাই ক্রান্তীয় অঞ্চলের জীব প্রজাতিগুলি বহুদিন একই অঞ্চলে বাস করার সুযোগ পায় । ইতিমধ্যে নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের জলবায়ু বহুবার পরিবর্তিত হয়েছে । তাই এ অঞ্চলের প্রজাতিগুলি একেএে স্থান পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছে ।
৩) ক্রান্তীয় অঞ্চলের জীবগোষ্ঠীগুলি অতি প্রাচীন হওয়ায় বিবর্তনের জন্য অনেক সময় পেয়েছে । তাই তারা স্থানীয়ভাবে অভিযোজিত হয়েছে ।
৪) ক্রান্তীয় অঞ্চলে প্রজাতিগুলির সংকরায়ণের মাএা অধিক । তাই এই অঞ্চলে প্রজাতিগুলির জন্মগত বৈচিত্র্যও বেশি ।
৫) ক্রান্তীয় অঞ্চলে সূর্যালোকের প্রাপ্তি বেশি হওয়ায় উদ্ভিদ গোষ্ঠীর উৎপাদনশীলতা বেশি । তাই এই অঞ্চলের জীব প্রজাতির ধারণ ক্ষমতা অধিক ।
৬) ক্রান্তীয় অঞ্চলে কীটপতঙ্গ ও পরজীবী বিভিন্ন ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটায় এই অঞ্চলে কোনো একটি প্রজাতি প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে না । বিভিন্ন প্রকার জীব প্রজাতি একএে একই অঞ্চলে অবস্থান বা বাস করে ।
জীববৈচিত্র্যের পরিমাপসমূহ : – জীববৈচিত্র্যের সমৃদ্ধি, পরিবেশের পরিবর্তন অভিমুখে জীববৈচিত্র্যের পরিবর্তন মাত্রা, সমধর্মী পরিবেশের বিভিন্ন অংশে জীববৈচিত্র্যের ভিন্নতা প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যগুলি যেসব পরিমাপক গুলির দ্বারা নির্ণয় করা হয় সে সম্বন্ধে নীচে আলোচনা করা হল –
১) আলফা বৈচিত্র্য : – একটি নির্দিষ্ট জীবগোষ্ঠীতে উপস্থিত জীব প্রজাতির সংখ্যাকে আলফা বৈচিত্র্য বলে । এটি প্রজাতিগত সমৃদ্ধির একক ।
২) বিটা বৈচিত্র্য : – পরিবেশের বিশেষ কোনো উপাদানের পরিবর্তনের অভিমুখে প্রজাতিগত পরিবর্তনের মাত্রাকে বিটা বৈচিত্র্য বলে । পর্বতের পাদদেশ থেকে শিখর অভিমুখে কোনো উদ্ভিদ গোষ্ঠীর প্রজাতিগুলির সংখ্যা পরিবর্তিত হয় । এইরুপ অবস্থায় বিটা বৈচিত্র্যের মাত্রা বেশি ধরা হয় । আবার ওইরুপ পর্বতঢালে বিভিন্ন পরিবেশে প্রজাতির সংখ্যা এক হলে ধরা হয় বিটা বৈচিত্র্য কম ।
৩) গামা বৈচিত্র্য : – একই প্রকার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন একটি বৃহৎ ভৌগোলিক অঞ্চলের প্রজাতিগত ভিন্নতাকে গামা বৈচিত্র্য বলে । এইরুপ পরিবেশে প্রজাতির ভিন্নতা বেশি হলে গামা বৈচিত্র্য বেশি হয় এবং সর্বত্র প্রজাতির সংখ্যা প্রায় এক হলে গামা বৈচিত্র্য কম হয় ।
জীববৈচিত্র্যের বিনাশ : – কোনো প্রজাতির সর্বশেষ জীবটির দেহস্থিত জীবের বি এন এ (DNA) পৃথিবী থেকে চিরতরে অপসৃত হয় । কোনো একটি প্রজাতির বংশ দুই বা ততোধিক বংশে বিশ্লেষিত হলে মূল প্রজাতিটির বিনষ্ট হওয়ার ঘটনাকে বলে জীববৈচিত্র্যের বিনাশ । বিলুপ্তির প্রকৃতি অনুযায়ী প্রজাতির বিনাশকে প্রধানত ৪ টি ভাগে ভাগ করা যায় । যথা-
১) সম্পূর্ণ বিলুপ্ত : – পৃথিবীতে কোনো প্রজাতির সর্বশেষ জীবটি মারা গেলে তার দেহস্থিত জিনের DNA ধ্বংস হলে পৃথিবীতে ওই জীব সম্প্রদায়ের পুনরায় আবির্ভাবের কোনো সম্ভাবনা থাকে না । এইরুপ অবস্থায় জীবটি বিলুপ্ত হওয়ার ঘটনাকে প্রজাতিটি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হিসাবে বিবেচনা করা হয় ।
২) বন্য অবস্থা থেকে বিলুপ্ত : – কোনো একটি প্রজাতির কয়েকটি মাত্র সদস্য সংরক্ষণের জন্য মনুষ্য নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে বন্দি অবস্থায় রাখা হয়, তখন ওই প্রজাতিটিকে বন্য অবস্থা থেকে বিলুপ্ত হিসাবে বিবেচনা করা হয় ।
৩) স্থানীয়ভাবে বিলুপ্ত : – কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে পূর্বে একটি প্রজাতি উপস্থিত থাকলেও পরবর্তীকালে তা বিলুপ্ত হতে পারে । কিন্তু এই প্রজাতির সদস্য পৃথিবীর অন্যত্র অবস্থান করলে প্রজাতিটিকে স্থানীয়ভাবে বিলুপ্ত প্রজাতি হিসাবে বিবেচনা করা হয় ।
৪) বাস্তুতান্ত্রিকভাবে বিলুপ্ত : – কোনো একটি নির্দিষ্ট বাস্তুতন্ত্রে কোনো একটি প্রজাতির সদস্য ভীষণভাবে কমে গেলে ওই প্রজাতিটির বাস্তুতন্ত্রের ওপর বিশেষ কোনো প্রভাব থাকে না । ফলে, প্রজাতিটিকে বাস্তুতান্ত্রিকভাবে বিলুপ্ত প্রজাতি হিসাবে বিবেচনা করা হয় ।
জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব : – মানব জীবনে জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব অপরিসীম । জীববৈচিত্র্য এক দিকে যেমন পরিবেশের ভৌমজল ভান্ডার পূরণে, জলবায়ুর স্থায়িত্ব রক্ষায়, মৃত্তিকার ক্ষয় রোধে, ভৌত-রাসায়নিক স্থিতাবস্থায় ও বায়ুর রাসায়নিক গঠন ইত্যাদির স্থিতিশীলতা বজায় রেখে বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য রক্ষা করে তেমনি জীববৈচিত্র্য বিভিন্ন জীব প্রজাতির ধারক ও বাহক হিসাবে কাজ করে । বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য ও মানবজীবনের অস্থিত্ব রক্ষায় জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব আলোচনা করা হল –
১) জলবায়ুর স্থায়িত্ব রক্ষায় জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব : – আবহাওয়া বিশুদ্ধকরণ, বৃষ্টিপাত নিয়ন্ত্রণ, জলীয়বাষ্প নির্গমন, অক্সিজেন প্রস্তুত প্রভৃতি কাজে উদ্ভিদ আবহাওয়ার মূল বৈশিষ্ট্যগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে । উদ্ভিদ মাটি থেকে জল শোষণ ও বায়ুতে নির্গমন করায় পৃথিবীর জলচক্রকে সচল রাখতে সাহায্য করে ।
২) ভূ-পৃষ্ঠস্থ জলের পরিশ্রুতকরণে জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব : – কচুরিপানা, বিভিন্ন প্রকার শৈবাল প্রভৃতি জলজ উদ্ভিদ জলাভূমির জলে মিশ্রিত বিভিন্ন ক্ষতিকারক ধাতব কণা ও ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ শোষণ করে জলকে পরিশ্রুত করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে । তাই জলাভূমিকে প্রকৃতির বৃক্ক বা কিডনি বলে ।
৩) মৃত্তিকা সৃষ্টিতে জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব : মৃত্তিকা সৃষ্টিতে জীববৈচিত্র্যের ভূমিকা অপরিসীম । মৃত্তিকা সৃষ্টিতে প্রথম পর্যায়ে উদ্ভিদ ও প্রাণী শিলাসমূহ চূর্ণ-বিচূর্ণ করে।এরপর জল ও বায়ুর উপস্থিতিতে বিভিন্ন প্রকার ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, কীটপতঙ্গ, কেঁচো জাতীয় প্রাণী মৃত্তিকা গঠন সম্পূর্ণ করে ।
৪) সামাজিক গুরুত্ব : – অর্থনীতিবিদগণ জীববৈচিত্র্যকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নতির হাতিয়ার হিসাবে চিহ্নিত করেছেন । যে দেশের জীববৈচিত্র্য যত বেশি ভবিষ্যতে তাদের উন্নতির সম্ভাবনাও তত বেশি । অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে তাদের জীবনযাত্রার মানেরও উন্নতি ঘটবে ।
৫) নৈতিক গুরুত্ব : – জীববৈচিত্র্য যেহেতু বিভিন্ন জীব প্রজাতির ধারক ও বাহক, মানুষ তাই জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব অনুধাবন করে পৃথিবীর প্রত্যেক জীবকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছে ।প্রয়োজনে নির্দিষ্ট প্রজাতিগুলিকে সংরক্ষণের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখতে পারলে মানব সভ্যতা দীর্ঘস্থায়ী হবে ।
৬) খাদ্যের জোগান : – পৃথিবীতে প্রায় ৩০ হাজার উদ্ভিদ আছে, যা প্রাণীর খাদ্যরুপে ব্যবহার করে । ১৮-২০ প্রকার উদ্ভিদ প্রজাতি থেকে মানুষ প্রায় ৯০% খাদ্য সংগ্রহ করে
৭) অর্থনৈতিক মূল্য : – মানুষ তার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, ওষুধ প্রভৃতির জন্য সরাসরি প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল । জীববৈচিত্র্যের জন্যেই মানুষ তার চাহিদা প্রকৃতি থেকে মেটাতে সক্ষম ।
৮) নান্দনিক মূল্য : – প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ পাহাড়, সমুদ্র সৈকত, বনাঞ্চল, জাতীয় উদ্যান প্রভৃতিতে ভ্রমণ করতে যায় ।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ব্যবস্থাপনা : – পৃথিবীতে কোনো একটি নির্দিষ্ট বিশ্বব্যাপী অনুসরণযোগ্য পদ্ধতি নেই যার সাহায্যে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা সম্ভব । একটি পদ্ধতির পরিবর্তে একাধিক পদ্ধতি অনুসরণ করে পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ করা সম্ভব । জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে নিম্নলিখিত ব্যবস্থাপনা গ্ৰহণ করা হয়েছে –
১) প্রজাতি সংরক্ষণ : – বিপন্ন প্রজাতি, আহত প্রজাতি, স্বল্পজ্ঞাত প্রজাতি ও বিরল প্রজাতিকে অন্তঃক্ষেত্রীয় ও বহিঃক্ষেত্রীয় সংরক্ষণ এবং জিন ভান্ডার সৃষ্টির মাধ্যমে সংরক্ষণ সম্ভব ।
২) জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি : জাতীয় ভূমিব্যবহার নীতি নির্ধারণ ও তার যথাযথ প্রয়োগ বিপন্ন ও বিপদগ্ৰস্ত প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ।
৩) প্রজাতি ও বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ আইন :
আইন প্রণয়ন ও তার প্রয়োগ করে প্রজাতি ও বাস্তুক্ষেত্র সংরক্ষণ করা উচিত । পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করছে ।
জীববৈচিত্র্যের হটস্পট :
জীববৈচিত্র্যের প্রাচুর্যপূর্ন সর্বাধিক বিপদগ্রস্ত বাস্তুতান্ত্রিক অঞ্চলকে জীববৈচিত্র্যের হটস্পট বলে
ভারতের হটস্পট অঞ্চলসমূহ:-
ভারতের চারটি হটস্পট অঞ্চল বর্তমান। সেগুলি হল———
A. পূর্ব হিমালয়
B. ইন্দো-বার্মা
C. পশ্চিমঘাট ও শ্রীলঙ্কা এবং
D. সুন্দাল্যান্ড।
[A] পূর্ব হিমালয়:-
ভারতের উওর-পূর্বের রাজ্যগুলি, যেমন—সিকিম, অসম, অরুণাচল প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গের উওরাংশ এর অন্তর্ভুক্ত।
(i) বৈশিষ্ট্য:- ভারতীয় অংশে 5800 উদ্ভিদ প্রজাতি বিন্যস্ত, যার 2000টি প্রজাতি এনডেমিক। এখানে 45টি স্তন্যপায়ী, 50টি , 17টি সরীসৃপ এবং 36টি উদ্ভিদ প্রজিতিসহ মোট 163টি বিপন্ন প্রজাতি বাস করে
(ii) উদাহরণ:- কলসপএী (উদ্ভিদ), একশৃঙ্গ গন্ডার , সোনালি লাঙুর (প্রাণী)।
[B] ইন্দো-বার্মা:-
ভারতের উপর-পূর্ব রাজ্য, মণিপুর, মিজোরাম, এিপুরা, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড ও দক্ষিণ অসম এর অন্তর্ভুক্ত। এ ছাড়া দক্ষিণ চিন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এর অন্তর্ভুক্ত
(ii) বৈশিষ্ট্য :- এই অঞ্চলে 13500 প্রজাতির উদ্ভিদ আছে যার মধ্যে 7000টি প্রজাতি এনডেমিক। এখানে স্তন্যপায়ী প্রণীর প্রজাতি সংখ্যা প্রায় 430 (70 টি এনডেমিক), পাখি প্রজাতির সংখ্যা 1260 (60টি এনডেমিক)।
(ii) উদাহরণ:- বিভিন্ন প্রকার অর্কিডের প্রজাতি (উদ্ভিদ), সোনালি গ্রীবা ময়না, সায়ামিস কুমির (প্রণী)।
[C] পশ্চিমঘাট ও শ্রীলঙ্কা:-
দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতমালা এবং উওর-পশ্চিম শীলঙ্কার উচ্চভূমির বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এর বিস্তার। ভরতের গুজরাট, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক এবং কেরল রাজ্য এই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত।
(i) বৈশিষ্ট্য:- এই অঞ্চলে 5000 প্রজাতির সংবহনকলাযুক্ত উদ্ভিদ (1700টি এনডেমিক), 140টি স্তন্যপায়ী (প্রায় 20টি এনডেমিক), 450টি পাখি প্রজাতি (35টি এনডেমিক) বর্তমান।
(ii) উদাহরণ:- ম্যাগনোলিয়া নিলাগিরিকা, ইক্সোরা ইলংগাটা প্রভৃতি উদ্ভিদ এবং মালাবার লার্জ-স্পটেড সিভেট এবং লায়ন-টেল্ড ম্যাক্যাক প্রভৃতি প্রাণী।
[D] সুন্দাল্যান্ড:-
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সুমিত্রা, বোর্নিও এবং ভারতের নিকোবর দ্ধীপপুঞ্জ এর অন্তর্ভুক্ত।
(i)বৈশিষ্ট্য:- এই অঞ্চলে মোট 25,000 প্রজাতির সংবহনকলাযুক্ত উদ্ভিদ (15,000টি এনডেমিক), 380টি স্তন্যপায়ী (170টি এনডেমিক), 770টি পাখি প্রজাতি (150টি এনডেমিক) বর্তমান।
(ii) উদাহরণ:- হেরিটিয়েরা লিটোরালিস (সুন্দরী গাছ), অ্যাব্রোমা অ্যাংগাস্টা প্রভৃতি উদ্ভিদ এবং নিকোবরি পায়রা, নিকোবরি হর্নবিল, ওটাং প্রভৃতি প্রাণী।