কে বাঁচায়, কে বাঁচে

উচ্চমাধ্যমিক বাংলা |কে বাঁচায়, কে বাঁচে গল্প|মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

Question: “…মানবসভ্যতার সবচেয়ে প্রাচীন ও সবচেয়ে পচা ঐতিহ্য আদর্শবাদের কল্পনা-তাপস বলে।”- নিখিল কার সম্পর্কে এরকম ভেবেছে? এই ভাবনার প্রসঙ্গ কি? তার ভাবনা যথার্থ ছিল কি না উল্লেখ করাে।

Ans: ভাবনার লক্ষ্য : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কে বাঁচায়, কে বাঁচে গল্পে নিখিল গল্পের মুখ্য চরিত্র মৃত্যুঞ্জয় সম্পর্কে এরকম ভেবেছে।

প্রসঙ্গ : অফিসে মৃত্যুঞ্জয় এবং নিখিল প্রায় সমপদস্থ। দুজনেরই মাইনে সমান হলেও একটা বাড়তি দায়িত্বের জন্য মৃত্যুঞ্জয় পঞ্চাশ টাকা বেশি পায়। নিখিল মৃত্যুঞ্জয়কে খুব পছন্দ করে, “হয়তো মৃদু একটু অবজ্ঞার সঙ্গে ভালােও বাসে।” এর কারণ মৃত্যুঞ্জয় শুধু নিরীহ, শান্ত, দরদি এবং ভালােমানুষ বলে নয়, এমনকি মৃত্যুঞ্জয় অত্যন্ত সৎ ও সরল বলেও নয়, আদর্শের প্রতি তার যে প্রবল আকর্ষণ—মৃত্যুঞ্জয় চরিত্রের এই বিশেষ গুণটিই তার প্রতি নিখিলকে আকৃষ্ট করে। এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন প্ত মন্তব্যটি করা হয়েছে।

যথার্থতা বিচার : মৃত্যুঞ্জয় সম্পর্কে নিখিলের এই ভাবনা যে অত্যন্ত যথার্থ ছিল তা গল্পের কাহিনি থেকেই স্পষ্ট হয়। দুর্ভিক্ষে মানুষের মৃত্যু মৃত্যুঞ্জয়কে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে সে প্রথম পর্যায়ে তার মাইনের সব টাকা দুর্ভিক্ষপীড়িতদের জন্য গঠিত ত্রাণ তহবিলে দান করে দিতে চায়। পরবর্তীকালে তাদের সঙ্গে আরও একাত্ম হবে বলে সে নিজের নিশ্চিন্ত জীবনযাপন ছেড়ে ফুটপাথেই দিন কাটানাে শুরু করে। এভাবে তার জীবন দিয়ে মৃত্যুঞ্জয় সহমর্মিতা এবং আদর্শের এক অনন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করে দিয়ে যায়।

Question: ছোট গল্প হিসেবে ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ কতখানি সার্থক তা আলােচনা করাে।

Ans: ছোট গল্প হিসেবে সার্থকতা : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ ছোটগল্পে আমরা দেখি যে, এর প্রধান চরিত্র মৃত্যুঞ্জয় পঞ্চাশের (১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে) মন্বন্তর সকালে অফিস যাওয়ার পথে একদিন ফুটপাথে অনাহার-মৃত্যুর এক বীভৎস দৃশ্য দেখে ফেলে। এই দৃশ্য দেখে সে এতটাই আঘাত পায় এবং অপরাধবােধে দীর্ণ হয়ে পড়ে যে, তারপর থেকে ভালাে করে খেতে ও ঘুমােতে পারে না সে। অনাহারীদের বাঁচানাের জন্য সে ও তার স্ত্রী তাদের একবেলার আহার বিলিয়ে দিতে থাকে। মাইনের দিন সে মাইনের পুরাে টাকাটা সহকর্মী-বন্ধু নিখিলের মাধ্যমে ত্রাণ তহবিলে দান করে দেয়। শহরের ফুটপাথে কিছুদিন যাবৎ ঘুরে ঘুরে দুর্ভিক্ষ পীড়িত দের লক্ষ করতে থাকে সে। এরপর ক্রমে ক্রমে একদিন সে অফিস এবং শেষে বাড়ি যাওয়াও বন্ধ করে দেয় এবং অনাহারীদেরই একজনে পরিণত হয়। মৃত্যুঞ্জয় ছেড়া ন্যাকড়া পরে, মুখ-ভরতি দাড়ি নিয়ে, মগ হাতে লঙ্গরখানায় গিয়ে মারামারি করে খিচুড়ি খায় আর ফুটপাথে পড়ে থেকে দুর্ভিক্ষপীড়িত সঙ্গীর মতো একঘেয়ে সুরে বলতে থাকে- “গাঁ থেকে এইছি। খেতে পাইনে বাবা। আমায় খেতে দাও!”

মন্বন্তরের কলকাতাকে কেন্দ্র করেই এই কাহিনিটি গড়ে উঠেছে। এই কাহিনিতে দেখা যায় দু-তিন মাসের স্বল্প পরিসরে মধ্যবিত্ত, সংসারী যুবক মৃত্যুঞ্জয় ক্রমে ক্রমে স্বেচ্ছায় ফুটপাথ-জীবনকে গ্রহণ করেছে। ছােটো আয়তনের এ গল্পে স্থান-কাল-ঘটনাগত ঐক্য ভালােভাবেই রক্ষিত হয়েছে। তিনটি চরিত্রের এই গল্পে ‘ঘটনার ঘনঘটা’, ‘অতিকথন’, ‘তত্ত্ব’ বা উপদেশ অনুপস্থিত। গল্পশেষে মৃত্যুঞ্জয়ের বলা ছােটো বাক্য তিনটি পাঠককে চমকিত করে দ্রুত গল্পের ক্লাইম্যাক্সের চরমে পৌঁছে দিয়েছে। সুতরাং ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ নিঃসন্দেহে একটি শিল্প সার্থক ছোটগল্প।

HS BENGALI|কে বাঁচায়, কে বাঁচে | উচ্চমাধ্যমিক বাংলা গল্প

Question: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ ছোটগল্পের সম্বন্ধে সমালোচক বলেছেন যে, এটি “মৃত্যুঞ্জয়ের বিকারের সার্থক শিল্পরূপ”—মন্তব্যটি পর্যালোচনা করো।

Ans: পঞ্চাশের মন্বন্তরের পটভূমিতে লেখা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ গল্পের নায়ক মৃত্যুঞ্জয় অফিস যাওয়ার পথে একদিন ফুটপাথে অনাহার-মৃত্যুর এক বীভৎস দৃশ্য দেখে ফেলে। এই দৃশ্য তাকে এমনই বিপর্যস্ত করে দেয় যে, ক্রমে ক্রমে সে ভেতরে বাইরে পালটে যেতে থাকে। প্রথমে নিজের খাবারের বরাদ্দ কমিয়ে এবং তারপর মাইনের পুরােটা ত্রাণ তহবিলে দান করেও তার হতাশা কাটে না। এরপর ক্রমে ক্রমে সে নিজের পেশা, পরিবার ও সমাজ সম্বন্ধে উদাসীন হয়ে পড়ে কলকাতা শহরের ফুটপাথ ও লঙ্গরখানাগুলিতে ঘুরে ঘুরে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের লক্ষ করতে থাকে। এইভাবে একদিন সে জীবনের সব কিছুকে ত্যাগ করে ফুটপাথবাসীতে পরিণত হয়। সিল্কের জামা ও ধুতির বদলে ছেড়া ন্যাকড়া পরে, খালি গায়ে, একমুখ দাড়ি-গোঁফ নিয়ে সে মগ হাতে লঙ্গরখানায় যায়। সেখানে কাড়াকাড়ি করে সে খিচুড়ি খায় এবং বাকি সময়টা ফুটপাথে পড়ে থাকে। অনাহারী ফুটপাথবাসীদের মতােই সেও একদিন একঘেয়ে সুরে বলতে শুরু করে- “গাঁ থেকে এইছি। খেতে পাইনে বাবা। আমায় খেতে দাও।”

সুতরাং গল্পটিতে নায়ক মৃত্যুঞ্জয় মধ্যবিত্তের খােলস ত্যাগ করে অনাহারক্লিষ্ট মানুষদের সঙ্গে যে মিশে যেতে পেরেছে এটি চরিত্রটির ইতিবাচক দিক। কিন্তু ওইসব মানুষগুলিকে প্রতিরােধ-সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে সে যে সচেষ্ট হয়নি-এটি চরিত্রটির নেতিবাচকতা। নিজের পেশা-সংসার ত্যাগ করলেও মৃত্যুঞ্জয় কিন্তু প্রতিবাদ হীনতার গড্ডলিকা-প্রবাহেই গা ভাসিয়ে দিয়েছে। সুতরাং গল্পটি ‘মৃত্যুঞ্জয়ের বিকারেরই সার্থক শিল্পরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Question: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ ছোটগল্পে মন্বন্তর জনিত অনাহার এবং অনাহার-মৃত্যুর সম্বন্ধে নায়ক মৃত্যুঞ্জয়ের ভাবনাচিন্তাগুলি লিপিবদ্ধ করাে।

Ans: পটভূমি : ১৩৫০ বঙ্গাব্দে (১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে) অবিভক্ত বঙ্গদেশে যে মর্মান্তিক মন্বন্তর হয়েছিল, তা পঞ্চাশের মন্বন্তর’ নামে পরিচিত। সেই মন্বন্তরের পটভূমিতেই রচিত হয়েছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’।

মৃত্যুঞ্জয়ের অনাহার জনিত চিন্তাভাবনা : বাড়ি থেকে অফিস যাওয়ার পথে ফুটপাথে অনাহার-মৃত্যুর দৃশ্য দেখার মতাে সাধারণ সহজবােধ্য ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না মৃত্যুঞ্জয়। তার সেদিনের উদ্ভ্রান্ত আচরণ বলে দিচ্ছিল যে, একজন মানুষ না খেতে পেয়ে মরলে কীরকম কষ্ট পায়, সেকথা সে ক্রমাগত ভেবেই চলেছে। খিদের যন্ত্রণা না মৃত্যু যন্ত্রণা কোন্টা বেশি কষ্টদায়ক প্রশ্নও তাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। তার সহকর্মী-বন্ধু নিখিলকে সে বলেছিল যে, একজন মানুষ না খেতে পেয়ে মারা গেল, সেটা আসলে তারই অপরাধ। কারণ মন্বন্তরকালে সব জেনেশুনেও প্রতিদিন সে চারবেলা করে খেয়েছে। তা ছাড়া, ত্রাণকার্যে লােকাভাব থাকা সত্ত্বেও মৃত্যুঞ্জয় এতদিন তার অফুরন্ত অবসর কাটানাের চিন্তায় মশগুল ছিল। এসব কারণে নিখিলের সামনে নিজেকে ধিক্কার দিয়েছে সে। টুনুর মার বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পারি, দুঃসহ মন্বন্তর থেকে মানুষকে বাঁচানাের চিন্তাতেই মৃত্যুঞ্জয়ের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় হয়েছে। সে বুঝতে পেরেছে, যথাসর্বস্ব দান করলেও এই অনাহারক্লিষ্ট মানুষগুলাের কিছু ভালো করতে পারবে না সে। এসব চিন্তা করেই হতাশ মৃত্যুঞ্জয় অনাহারক্লিষ্ট মানুষের ভিড়ে ক্রমে ক্রমে নিজেকে বিলীন করে দিয়েছে।

কে বাঁচায়, কে বাঁচে
কে বাঁচায়, কে বাঁচে

Question: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ ছোট গল্পের নামকরণের সার্থকতা বিচার করাে।

Ans: ব্যক্তি মানুষের নামের ক্ষেত্রে কানা ছেলের নাম পদ্মলােচন হলে ক্ষতি নেই। কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে নামকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ কোনাে সাহিত্যকর্মের সার্থক নাম সেই রচনাটির প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি বিশেষ সহায়ক হয়ে ওঠে। অনেক সময় নামের মধ্য দিয়েই লেখক তার অভিপ্রেত বক্তব্যের ইঙ্গিত দিয়ে থাকেন। কাজেই সাহিত্যের ক্ষেত্রে দরকার হয় সার্থক নামকরণের। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আলােচ্য গল্পটির নাম দিয়েছেন ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’। এই গল্পের বিষয়বস্তুতে আছে বাঁচা-মরার প্রসঙ্গ, আছে বাঁচা, বাঁচাতে চাওয়া এবং বাঁচাতে না পারার কথা।

গল্পের প্রধান চরিত্র মৃত্যুঞ্জয় একদিন অফিস যাওয়ার পথে ফুটপাথের উপর অনাহারে মৃত্যুর দৃশ্য দেখতে পায়। এই দৃশ্য তাকে এতটাই আহত করে যে, তারপর থেকে তীব্র অপরাধবােধে ভুগে থাকে। অনাহারক্লিষ্ট মানুষের কথা ভেবে তার দৈনন্দিন আহারনিদ্রা ব্যাহত হয়। আদর্শবাদী চাকুরিজীবী যুবক মৃত্যুঞ্জয় স্ত্রী এক বেলা খাওয়া কমিয়ে সেই খাবার অভুক্তদের বিলিয়ে দিতে শুরু করে। এমনকি অফিসের পুরাে মাসমাইনেটা সহকর্মী বন্ধু নিখিলের হাতে তুলে দেয় ত্রাণ তহবিলের জন্য। শহরের ফুটপাথে ঘুরে ঘুরে দুর্ভিক্ষ পীড়িত দের দুঃসহ যন্ত্রণার শরিক হয়। শেষ পর্যন্ত চাকুরি, পরিবার, সমাজ সবকিছু পরিত্যাগ করে না-খেতে পাওয়া মানুষদের দলে ভিড়ে তাদেরই একজন হয়ে ওঠে। তাদেরই মতা মুখ ভরতি দাড়ি নিয়ে মগ হাতে মারামারি করে লঙ্গরখানার খাবার খায় আর ফুটপাতে পড়ে থাকে।

অত্যন্ত সংবেদনশীল মৃত্যুঞ্জয় এবাবে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের জন্য সমব্যথী হয়ে তাদেরই একজন হয়ে উঠলেও শেষ পর্যন্ত সে কিন্তু কাউকেই বাঁচাতে পারে না। ভয়ংকর এই সমস্যার কোনাে সমাধান করতে পারে না। গল্পটি পড়তে পড়তে বােঝা যায়, একক মানুষের আন্তরিকতায় আত্মত্যাগে কিংবা সমানুভূতিসম্পন্ন হয়ে ওঠার মধ্যে এই সমস্যার প্রকৃত সমাধান নেই। এভাবে কেউ কাউকে বাঁচাতে পারে না, বাঁচতে পারে না নিজেও।

গল্পকার এই গল্পের মধ্যে একক মানুষের সেই ব্যর্থ প্রয়াস এবং দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ পরিণামকে প্রশমিত করার জন্য সমবেত স্বার্থত্যাগের একান্ত অভাব, এই দু-দিকেই অঙ্গুলি সংকেত করেছেন। আর সেখানেই ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ নামটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।

কে বাঁচায়, কে বাঁচে|HS BENGALI

Question: “ধিক। শত ধিক আমাকে।”- বক্তা কে? বক্তার চরিত্র সম্পর্কে সংক্ষেপে আলােচনা করাে।

Ans: উদ্দিষ্ট বক্তা : প্রশ্নোধৃত অংশটি বক্তা হলেন মৃত্যুঞ্জয়।

বক্তার চরিত্র : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়– এর ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ ছোটগল্পের নায়ক মৃত্যুঞ্জয়ের চরিত্র পর্যালোচনা করতে গেলে নীচের বিষয়গুলি চোখে পড়ে।

ন্যায়নীতিপরায়ণতা : মৃত্যুঞ্জয় একজন সৎ, মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী। নিরীহ, শান্ত, দরদি, ভালা মানুষ এই যুবকটি ন্যায়নীতিবােধের অবক্ষয়ের যুগেও বুকের ভেতরে আদর্শবাদের প্রায় হারিয়ে যাওয়া এক ঐতিহ্য পুষে রাখে।

আবেগপ্রবণতা : মৃত্যুঞ্জয় একদিন অফিস যাওয়ার পথে হঠাৎই ফুটপাথে অনাহারে মৃত্যুর দৃশ্য দেখে ফেলে। দুর্ভিক্ষের সময় এমন দৃশ্য খুব স্বাভাবিক হলেও আবেগপ্রবণ মৃত্যুঞ্জয় এই দৃশ্য দেখে প্রচণ্ড আঘাত পায়। তারপর থেকে সে ক্রমে ক্রমে ভিতরে বাইরে পালটে যেতে শুরু করে। অপরাধবােধে অস্থির মৃত্যুঞ্জয় ও তার স্ত্রী একবেলা না খেয়ে সে-খাবার দুর্ভিক্ষপীড়িতদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়। এমনকি, মাসের পুরো মাইনেটা সে ত্রাণ-তহবিলে দান করে দেয়।

বিকারগ্রস্ততা : কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় অচিরেই বাস্তব চিত্রটা বুঝতে পারে যে, যথাসর্বস্ব দান করলেও অনাহারী মানুষগুলাের কিছুমাত্র ভালাে করতে পারবে না সে। এই ব্যর্থতাই তাকে মানসিকভাবে আরও বিপর্যস্ত করে তােলে। দিন দিন মুষড়ে যেতে থাকে মৃত্যুঞ্জয়। এরপর তাই সে অন্নপ্রার্থীদের ভিড়ে ঘুরতে ঘুরতে একসময় তাদেরই একজন হয়ে যায়। অফিসে এবং ধীরে ধীরে বাড়িতে যাওয়াও বন্ধ করে দেয় মৃত্যুঞ্জয়। ছেড়া ন্যাকড়া পরে, খালি গায়ে সে অনাহারীদের সঙ্গে ফুটপাথে পড়ে থাকে এবং লঙ্গরখানার খিচুড়ি কাড়াকাড়ি করে খেতে শুরু করে।

শেষের কথা : মৃত্যুঞ্জয় চরিত্রটি দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের প্রতিবাদে, প্রতিরােধে বা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে না পারলেও সে মধ্যবিত্তের খােলস ত্যাগ করে সর্বহারা শ্রেণির মধ্যে বিলীন হতে পেরেছে, এখানেই চরিত্রটির বিশিষ্টতা।

Question: ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ ছোটগল্পের টুনুর মা চরিত্র পর্যালোচনা করাে।

Ans: টুনুর মার চরিত্র : ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ ছোটগল্পে টুনুর মা চরিত্রটি অতি সামান্য পরিসরে উপস্থাপিত হলেও গল্পের বিষয়বস্তুর প্রেক্ষিতে চরিত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

স্বামী-অন্ত-প্রাণ : মৃত্যুঞ্জয়ের স্বামী-অন্ত-প্রাণ সহধর্মিণী হল মমতাময়ী নারী টুনুর মা। শারীরিকভাবে শীর্ণা ও রোগ ণা হয়েও মন্বন্তরের বীভৎসতায় স্বামীর অস্থিরতাকে কেবল মেনেই নেয়নি, মনেও নিয়েছে। স্বামীর ভাবনার শরিক হয়ে নিজেও একবেলা অভুক্ত থেকেছে।

মমতাময়ী : সে যে তার স্বামীকে ভালােবাসত এবং তার আদর্শকে সম্মান করত—তাই নয়, সে নিজেও ছিল উদার-হৃদয়ের অধিকারিণী এবং মমতাময়ী। শয্যাশায়ী অবস্থায় সে বারবার স্বামীর খোঁজখবর করেছে, স্বামীর সহকর্মী-বন্ধু নিখিলকেও সকাতর অনুরােধ করেছে তার স্বামীর খেয়াল রাখতে, সঙ্গে থাকতে। দু-তিনবার সে স্বামীর সঙ্গে ফুটপাথের দুর্ভিক্ষপীড়িত অনাহারক্লিষ্ট মানুষগুলােকে দেখেও এসেছে। সে নিখিলকে জানিয়েছে, “উঠতে পারলে আমিই তাে ওর সঙ্গে ঘুরতাম ঠাকুরপাে।”

আদর্শবাদী : মৃত্যুঞ্জয়ের ব্যাপারে টুনুর মা আরও জানিয়েছে, “একেবারে মুষড়ে যাচ্ছেন দিনকে দিন।” নিখিলকে সে বলেছে, “উনি পাগল হয়ে যাচ্ছেন, আমারও মনে হচ্ছে যেন পাগল হয়ে যাব। ছেলেমেয়েগুলির জন্য সত্যি আমার ভাবনা হয় না। কেবলই মনে পড়ে ফুটপাথের ঐ লােকগুলির কথা।” এভাবেই টুনুর মা মৃত্যুঞ্জয়ের আদর্শবাদের সঙ্গী হয়ে ওঠে।

ইতিকথা : সুতরাং, টুনুর মা এ গল্পের এক অপ্রধান চরিত্র হলেও গল্পের প্রধান চরিত্র মৃত্যুঞ্জয়কে উজ্জ্বল করে তুলতে চরিত্রটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।

Question: ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ ছোট গল্পের নিখিল চরিত্রটি পর্যালোচনা করাে।

Ans: নিখিলের চরিত্র : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ ছোটগল্পের অন্যতম প্রধান চরিত্র নিখিলের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিম্নলিখিতভাবে আলােচনা করা যায়।

সংসার-উদাসীন : মৃত্যুঞ্জয়ের অফিসের সহকর্মী-বন্ধু ছিল নিখিল। প্রখর বুদ্ধিমান, রােগা চেহারার এই যুবকটি ছিল কিছুটা অলস প্রকৃতির। দুই সন্তানের পিতা নিখিলের সংসারে বিশেষ মন ছিল না বলে কেউ কেউ মনে করতেন। বইপত্র পড়ে এবং নিজের ভাবনার জগতে বিচরণ করেই অবসর সময় কাটাত এই অন্তর্মুখী যুবকটি।

বন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাবােধ : অফিসের সমপদস্থ সহকর্মী মৃত্যুঞ্জয়ের মাইনে নিখিলের থেকে সামান্য কিছু বেশি হলেও অন্য সকলের মতাে নিখিল তাকে বেশ পছন্দই করত। হয়তাে তাতে কিছুটা অবজ্ঞামিশ্রিত ভালোবাসা জড়িয়ে থাকত। তবে মৃত্যুঞ্জয়ের মানসিক শক্তির কাছে নিখিল কিছুটা যেন নিস্তেজ ছিল। মাঝেমাঝে তার এই ভেবে আপশােশ হত যে সে যদি নিখিল না হয়ে মৃত্যুঞ্জয় হত, তাহলে মন্দ হত না।

বন্ধুবৎসল : নিখিল স্বার্থপর ছিল না। সে প্রতিমাসে তিন জায়গায় অর্থসাহায্য পাঠাত। তা ছাড়া, দীর্ঘদিন ধরে সে মৃত্যুঞ্জয়কে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট থেকেছে। সে মৃত্যুঞ্জয়ের পরিবারের খোঁজখবর নিয়েছে এবং মৃত্যুঞ্জয় অফিস যাওয়া বন্ধ করলে তার ছুটির ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

সৎ এবং বাস্তববাদী : নিখিল দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা উপলব্ধি করেলও প্রিয় বন্ধু মৃত্যুঞ্জয়ের মতাে ভেঙে পড়েনি। সে মৃত্যুঞ্জয়ের মতাে বাস্তব জ্ঞানহীন ছিল না। মৃত্যুঞ্জয় মাইনের পুরাে টাকা রান-তহবিলে দান করলে সে তার প্রতিবাদ করেছে এ কথা ভেবে “এ ভাবে দেশের লােককে বাঁচানাে যায় না।” মৃত্যুঞ্জয়ের পরিবারের প্রতি আন্তরিক ভাবনাও তার কথায় প্রতিফলিত হয়েছে। বাস্তববাদী মানুষের মতােই সে বলেছে- “নিজেকে না খাইয়ে মারা বড়াে পাপ”।

ইতিকথা : সুতরাং, নিখিল চরিত্রের বিভিন্ন দিকগুলি পর্যালোচনা করে বলা যায় যে, সে এ গল্পের হৃদয়বান এক বাস্তববাদী চরিত্র।

কে বাঁচায়, কে বাঁচে

Question: “দিন দিন কেমন যেন হয়ে যেতে লাগল মৃত্যুঞ্জয়।”- মৃত্যুঞ্জয় কেমন হয়ে যেতে লাগল? তার এমন হয়ে যাওয়ার কারণ কী?

Ans: মৃত্যুঞ্জয়ের পরিবর্তন : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ ছোটগল্প থেকে উদ্ধৃতিটি সংকলিত হয়েছে। অনাহারে মৃত্যু দেখার কিছুদিন পরই অফিসের মাইনের তারিখ আসে। সে-দিন মৃত্যুঞ্জয় তার মাইনের পুরাে টাকাটা নিখিলের মাধ্যমে রিলিফফান্ডে দান করে দেয়। সে-দিনের পর থেকেই মৃত্যুঞ্জয় কেমন যেন হয়ে যেতে থাকে। অফিসে আসতে দেরি করে, কাজে ভুল করে, প্রায়ই চুপচাপ বসে বসে ভাবে, তারপর একসময় বেরিয়ে যায়। বাড়িতেও তাকে বিশেষ একটা পাওয়া যায় না। দিনরাত শহরের ফুটপাথ ধরে সে হেঁটে বেড়ায়। বড়াে গাছের নীচে, ডাস্টবিনের ধারে বা খােলা ফুটপাথে যেসব দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষ পড়ে থাকে, তাদের শুধু দাঁড়িয়ে থেকে লক্ষ করে সে। এইসব অনাহারীরা সন্ধ্যা থেকেই শুয়ে থাকে, কিন্তু অনেক রাতে, দোকানপাট বন্ধ যাওয়ার পর হামাগুড়ি দিয়ে সামনের কোনাে রােয়াকে উঠে সেখানে শুয়ে পড়ে। এরাই ভোর চারটের সময় লঙ্গরখানায় গিয়ে খাবারের জন্য লাইন দেয়। সকালের দিকে মৃত্যুঞ্জয় তাই বিভিন্ন পাড়ার লঙ্গরখানায় গিয়ে অন্নপ্রার্থীদের ভিড় লক্ষ্য করে।

মৃত্যুঞ্জয়ের পরিবর্তনের কারণ : মন্বন্তরকালে নিজের চোখে ফুটপাথে ঘটা অনাহার-মৃত্যুর দৃশ্য দেখে ভীষণ রকমের মানসিক আঘাত পেয়েছিল মৃত্যুঞ্জয়। একজন মানুষ না-খেতে পেয়ে মরার সময় কীরকম কষ্ট পায়, খিদের যন্ত্রণা না মৃত্যু যন্ত্রণা কোনটা বেশি কষ্টদায়ক এসব প্রশ্ন তাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। মন্বন্তরকালে মৃত্যুঞ্জয় সপরিবারে চার বেলা খেয়ে চলেছে এবং ত্রাণকার্যেও কখনও এগিয়ে যায়নি বলে নিজেকে ধিক্কার দেয় মৃত্যুঞ্জয়। দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের বাঁচাতে তাই সে মাইনের সব টাকাটা ত্রাণ তহবিলে দান করে দেয়। এমনটা করেও তার অপরাধবােধ না কমায় সে অমন হয়ে গিয়েছিল।

Question: “কারো বুকে নালিশ নেই, কারাে মনে প্রতিবাদ নেই।”— ‘কারাে’ বলতে কাদের কথা বলা হয়েছে? কার, কীভাবে এ কথা মনে হয়েছে? এই নালিশ ও প্রতিবাদ না থাকার কারণ কী?

Ans: উদ্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গ : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ গল্পের উল্লিখিত অংশে ফুটপাথবাসী দুর্ভিক্ষপীড়িত নিরন্ন মানুষের কথা বলা হয়েছে।

এরকম মনে হওয়ার কারণ : মৃত্যুঞ্জয়ের একথা মনে হয়েছে। ফুটপাথের একটি মৃত্যুদৃশ্য মৃত্যুঞ্জয়কে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে, তারপর থেকে ফুটপাথের মানুষেরা হয়ে উঠেছিল তার নিবিড় পর্যবেক্ষণের বিষয়। পাড়ায় পাড়ায় লঙ্গরখানা খুঁজে নিয়ে মৃত্যুঞ্জয় অন্নপ্রার্থীদের ভিড় দেখত। ডাস্টবিনের ধারে, গাছের নীচে বা খােলা ফুটপাথে যারা পড়ে থাকত, হামাগুড়ি দিয়ে গভীর রাত্রে বন্ধ দোকানের রােয়াকে উঠে যারা আশ্রয় খুঁজত কিংবা ভাের চারটে থেকে যারা লাইন দিত খাবারের জন্য, তারাই মৃত্যুঞ্জয়ের মনোযোগের কেন্দ্রে ছিল। কিন্তু প্রথম দিকে তাদের সঙ্গে আলাপের চেষ্টা করলেও পরে তা মৃত্যুঞ্জয় বন্ধ করে দেয়। কারণ একই ভঙ্গিতে তারা সকলেই একই দুঃখের কাহিনি বলে যেত। তাদের কোনাে নালিশ কিংবা প্রতিবাদ ছিল না।

নালিশহীনতা ও প্রতিবাদ হীনতার কারণে : দুর্ভিক্ষে উদবাস্তু হয়ে যাওয়া মানুষগুলি ফুটপাথের জীবন কি তাদের ভবিষ্যৎ মেনে নিয়েছে। নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই তারা বুঝেছে যে, তারা আসলে ক্ষমতাবান মানুষদের শােষণের শিকার। এই সমাজে তাদের জীবনযাপনের অধিকার, মর্যাদা কোনােটাই স্থায়ী নয়। তাই তারা মেনে নিয়ে চলতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। ফলে তারা নালিশ ও প্রতিবাদহীন হয়ে যায়।

কে বাঁচায়, কে বাঁচে

Question: “কারো বুকে নালিশ নেই, কারাে মনে প্রতিবাদ নেই।” মন্তব্যটির প্রসঙ্গ আলােচনা করাে। ভাবনাসূত্রটি বিশ্লেষণ করাে।

Ans: প্রসঙ্গ : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ গল্পে দুর্ভিক্ষের কারণে মৃত্যুর ঘটনা মৃত্যুঞ্জয়ের মনে তীব্র প্রভাব ফেলে। মৃত্যুঞ্জয় শহরের আদি-অন্ত ফুটপাথ ধরে ঘুরে বেড়ায়। বিপন্ন মানুষগুলির দুরবস্থা এবং অন্নকাতরতা তাকে প্রভাবিত করে। কিন্তু সেই মানুষদের আচরণ ও মনােভাব সে মেনে নিতে পারে না। এই প্রসঙ্গেই মন্তব্যটি করা হয়েছে।

ভাবনা সূত্রটির বিশ্লেষণ : দুর্ভিক্ষে মানুষের দুরবস্থা মৃত্যুঞ্জয়কে প্রভাবিত করেছিল। সেই ফুটপাথবাসী মানুষগুলির প্রতিদিনের জীবন-যন্ত্রণা, বেঁচে থাকার অসম লড়াই ছিল তার পর্যবেক্ষণের বিষয়। এই মানুষগুলির সঙ্গে প্রথম দিকে যতটা সম্ভব সে আলাপ করত, কিন্তু পরবর্তীতে তা বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ, মৃত্যুঞ্জয় দেখেছে যে, তারা সকলে একই কথা বলে এবং তাদের ভাষা ও বলার ভঙ্গি পর্যন্ত একইরকম। নেশাগ্রস্ত আচ্ছন্ন মানুষের মতাে সেই একই ভাগ্যের এবং দুঃখের কাহিনী— নালিহীন, প্রতিবাদহীন। কীভাবে তাদের জীবনের সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেল তা তারা জানতে কিংবা বুঝতে চায়নি কিন্তু সব কিছুই মেনে নিয়েছে। ভাগ্যের কাছে এই অসহায় আত্মসমর্পণ মৃত্যুঞ্জয়ের পছন্দ হয়নি। সে চেয়েছিল সমস্যার প্রকৃত উৎসগুলি এই মানুষরা বুঝুক, নাহলে তার সমাধান অসম্ভব। সেই কারণেই প্রতিবাদহীন এই মানুষগুলির সঙ্গে কথা বলা সে বন্ধ করে দিয়েছিল।

Question: “মৃত্যুঞ্জয়ের বাড়ির অবস্থা শোচনীয়।”- মৃত্যুঞ্জয় কে? তার বাড়ির অবস্থা শােচনীয় কেন?

Ans: মৃত্যুঞ্জয়ের পরিচয় : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ ছোট গল্পের প্রধান চরিত্র হল মৃত্যুঞ্জয়।

বাড়ির অবস্থা শােচনীয় হওয়ার কারণ : মৃত্যুঞ্জয় ফুটপাথে অনাহার মৃত্যুর দৃশ্য দেখার পর থেকে ভেতরে-বাইরে ক্রমশ পালটে যেতে থাকে। অপরাধবােধে দীর্ণ হয়ে সে বাড়িতে ভালাে করে খেতে ও ঘুমােতে পারে না। একবেলা সস্ত্রীক না খেয়ে সেই খাবার সে অভুক্তদের বিলােনাে শুরু করে। এমনকি, মাইনের দিন নিখিলের মাধ্যমে পুরাে বেতনটাই সে ত্রাণ তহবিলে দান করে দেয়। এদিকে অফিসে তার আসা যাওয়ার ঠিক থাকে না। কাজে ভুল করে, প্রায়ই চুপচাপ বসে থেকে ভেবে চলে সে। বাড়িতেও বিশেষ না থেকে শহরের গাছতলায়, ডাস্টবিনের ধারে বা ফুটপাথে পড়ে থাকা মন্বন্তর গ্রস্ত মানুষগুলিকে দেখতে সে ঘুরে বেড়াতে থাকে। মৃত্যুঞ্জয়ের এমন অবস্থার জন্যই তার বাড়ির শােচনীয় অবস্থা হয়েছিল। মৃত্যুঞ্জয়ের এই অবস্থায় তার স্ত্রী শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে। মৃত্যুঞ্জয়ের ছেলেমেয়েরা খিদের জ্বালায় মাঝে মধ্যেই চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। মৃত্যুঞ্জয়ের অনুপস্থিতিতে তার পরিবারের লােকেদের এমন শােচনীয় অবস্থাই হয়েছিল।

কে বাঁচায়, কে বাঁচে

Question: “..তার অভিজ্ঞতার কাছে কথার মারপ্যাচ অর্থহীন হযে গেছে।”—কার অভিজ্ঞতা? এমন বলার কারণ কী?

Ans: উদ্দিষ্ট ব্যক্তি : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ গল্পের উল্লিখিত মন্তব্যটিতে গল্পের মূল চরিত্র মৃত্যুঞ্জয়ের কথা বলা হয়েছে।

বলার কারণ : ফুটপাথবাসী দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের সহমর্মী মৃত্যুঞ্জয় তাদের দুঃখ কষ্ট, জীবনযাপনকে একেবারে কাছ থেকে দেখতে দেখতে নিজেও ফুটপাথের বাসিন্দা হয়ে যায়। সে অফিস যাওয়া বন্ধ করে, এমনকি নিশ্চিন্ত গৃহকোণও ত্যাগ করে। প্রথমদিকে শহরের আদি-অন্তহীন ফুটপাথ ধরে ঘুরে বেড়ালেও কালক্রমে সে ফুটপাথেরই বাসিন্দা হয়ে যায়। তার মধ্যে এইসময় চেতনাগত পরিবর্তন ঘটে, মৃত্যুঞ্জয়ের স্ত্রীর মন্তব্যের মধ্যে যার আভাস মেলে। সে বলে “কেমন একটা ধারণা জন্মেছে, যথাসর্বস্ব দান করলেও কিছুই ভাল করতে পারবেন না। দারুণ একটা হতাশা জেগেছে ওর মনে। একেবারে মুষড়ে যাচ্ছেন দিনকে দিন।” দুর্ভিক্ষের রূঢ় বাস্তবতা মৃত্যুঞ্জয়ের মানসিক শৃঙ্খলাকে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত করে দেয়। এর কোনাে যথাযথ সমাধান বা প্রতিকারের উপায় তার কাছে না থাকায় সে হতাশ হয়ে পড়ে। নিখিল চেষ্টা করে মৃত্যুঞ্জয়কে বুঝিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে, কিন্তু তার চোখ দেখলেই বােঝা যায় যে, তার কথার অর্থ মৃত্যুঞ্জয় বুঝছে না। একদিন ফুটপাথবাসী বুভুক্ষু মানুষদের সাথে কাটিয়ে যে বিপুল অভিজ্ঞতা সে সঞয় করেছে সেখানে মানসিক শৃঙ্খলা বজায় রেখে চলা সম্ভব হয় না। কোনাে তত্ত্বকথাই তার সেই ভয়ংকর বাস্তব অভিজ্ঞতাকে ভুলিয়ে দিতে পারে না। আর তার ফলেই নিখিলের বলা কথাগুলি মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে অর্থহীন হয়ে যায়।

Question: “ভুরিভােজনটা অন্যায়, কিন্তু না খেয়ে মরাটা উচিত নয় ভাই।”— বক্তা কে? এই বক্তব্যের মধ্যে বক্তার চরিত্রের কোন্ দিক আভাসিত হয়েছে?

Ans: বক্তা : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ গল্পে উল্লিখিত মন্তব্যটির বক্তা মৃত্যুঞ্জয়ের বন্ধু ও সহকর্মী নিখিল।

বক্তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য : দুর্ভিক্ষের কারণে ফুটপাতে মানুষের অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা মৃত্যুঞ্জয়ের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। সে তার মাইনের সমস্ত টাকাটাই নিখিলের মাধ্যমে ত্রাণ তহবিলে দিয়ে দিতে চায়। কিন্তু নিখিল এই বাস্তববােধহীন ভাবাবেগের বিরােধী। মাইনের টাকায় যার নিজেরই সংসার চলে না, তার এই জনসেবার আকুলতা নিখিলের কাছে অর্থহীন বলে মনে হয়। তার মনে হয় যে, এভাবে দেশের লােককে বাঁচানাে যায় না। যে রিলিফ চলেছে। তা আসলে “একজনের বদলে আরেকজনকে খাওয়ানাে।” একই সঙ্গে আত্মপ্রবঞ্চনা মানতে পারে না নিখিল। বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু প্রয়োজন। ততটুকু খেতেই হবে। নিখিল বেশ জোরের সঙ্গেই বলেছে “দেশের সমস্ত লােক মরে গেলেও যদি সেইটুকু সংগ্রহ করার ক্ষমতা আমার থাকে, কাউকে না দিয়ে নিজেই আমি তা খাব।” মৃত্যুঞ্জয়ের ভাবাবেগের বিপরীতে নিখিলের ভাবনা ও বক্তব্যকে অনেক বেশি বাস্তববাদী মনে হয়। নিখিল মন থেকেই বিশ্বাস করে যে, নীতি ধর্মের দিক থেকে না হলেও সমাজ ধর্মের দিক থেকে দশজনকে খুন করার চেয়ে নিজেকে না খাইয়ে মারা বড়াে পাপ। এভাবেই নিখিলের বাস্তববুদ্ধির পরিচয় গল্পে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।