গল্প :কে বাঁচায়, কে বাঁচে

কে বাঁচায়, কে বাঁচে’|মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়|HS BENGALI

Question: “…শার্সিতে আটকানাে মৌমাছির মতো সে মাথা খুঁড়ছে সেই স্বচ্ছ সমস্যার অকারণ অর্থহীন অনুচিত কাঠিন্যে।” -‘মৌমাছি’ বলতে এখানে কাকে বােঝানাে হয়েছে? উদ্ধৃতিটি ব্যাখ্যা করাে।

Ans: মৌমাছির প্রকৃত পরিচয় : এখানে মৌমাছি বলতে ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ গল্পের মুখ্য চরিত্র মৃত্যুঞ্জয়কে বােঝানাে হয়েছে।

ব্যাখ্যা : মন্বন্তরের সময় একদিন বাড়ি থেকে অফিস যাওয়ার পথে ফুটপাথে একটি অনাহার জনিত মৃত্যুর দৃশ্য দেখে আবেগপ্রবণ মৃত্যুঞ্জয় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এই মানসিক আঘাতের ফলে মৃত্যুঞ্জয় শারীরিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়ে। অফিসে গিয়ে নিজের কাজের ঘরে ঢুকে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে সে। তারপর বাথরুমে গিয়ে বাড়ি থেকে খেয়ে আসা যাবতীয় খাবার বমি করে ফেলে। বাথরুম থেকে ফিরে এসে কাচের গ্লাসে জল খেতে খেতে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দেয়ালের দিকে। ‘পচা ঐতিহ্য আদর্শবাদের কল্পনা-তাপস’ মৃত্যুঞ্জয়ের এই মৃত্যুদৃশ্য দেখার পর থেকেই বিবেক দংশন শুরু হয়। তার মনে অনাহার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নানা প্রশ্ন জাগে। সে ভাবতে চেষ্টা করে খিদের জ্বালা আর মৃত্যু যন্ত্রণার মধ্যে কোনটি বেশি কষ্টকর। সে আরও ভাবে যে, দরিদ্র মানুষের জীবনপ্রণালী সম্পর্কে তার উদাসীনতাই হয়তাে এইরকম মৃত্যুর কারণ। কিন্তু এই সমস্যার সমাধান বা প্রায়শ্চিত্তের কোনাে যথাযথ উপায় সে খুঁজে পায় না। কঠোর বাস্তবের সমাধানহীন এক প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে বিভ্রান্ত মৃত্যুঞ্জয় শার্সিতে আটকে-পড়া মৌমাছির মতাে মাথা খুঁড়তে থাকে।

Question: ছোট গল্প হিসেবে ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ কতখানি সার্থক তা আলােচনা করাে।

Ans: ছোট গল্প হিসেবে সার্থকতা : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়– এর ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ ছোটগল্পে আমরা দেখি যে, এর প্রধান চরিত্র মৃত্যুঞ্জয় পঞ্চাশের (১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে) মন্বন্তর সকালে অফিস যাওয়ার পথে একদিন ফুটপাথে অনাহার-মৃত্যুর এক বীভৎস দৃশ্য দেখে ফেলে। এই দৃশ্য দেখে সে এতটাই আঘাত পায় এবং অপরাধবােধে দীর্ণ হয়ে পড়ে যে, তারপর থেকে ভালাে করে খেতে ও ঘুমােতে পারে না সে। অনাহারীদের বাঁচানাের জন্য সে ও তার স্ত্রী তাদের একবেলার আহার বিলিয়ে দিতে থাকে। মাইনের দিন সে মাইনের পুরাে টাকাটা সহকর্মী-বন্ধু নিখিলের মাধ্যমে ত্রাণ তহবিলে দান করে দেয়। শহরের ফুটপাথে কিছুদিন যাবৎ ঘুরে ঘুরে দুর্ভিক্ষ পীড়িত দের লক্ষ করতে থাকে সে। এরপর ক্রমে ক্রমে একদিন সে অফিস এবং শেষে বাড়ি যাওয়াও বন্ধ করে দেয় এবং অনাহারীদেরই একজনে পরিণত হয়। মৃত্যুঞ্জয় ছেড়া ন্যাকড়া পরে, মুখ-ভরতি দাড়ি নিয়ে, মগ হাতে লঙ্গরখানায় গিয়ে মারামারি করে খিচুড়ি খায় আর ফুটপাথে পড়ে থেকে দুর্ভিক্ষপীড়িত সঙ্গীর মতো একঘেয়ে সুরে বলতে থাকে- “গাঁ থেকে এইছি। খেতে পাইনে বাবা। আমায় খেতে দাও!”

মন্বন্তরের কলকাতাকে কেন্দ্র করেই এই কাহিনিটি গড়ে উঠেছে। এই কাহিনিতে দেখা যায় দু-তিন মাসের স্বল্প পরিসরে মধ্যবিত্ত, সংসারী যুবক মৃত্যুঞ্জয় ক্রমে ক্রমে স্বেচ্ছায় ফুটপাথ-জীবনকে গ্রহণ করেছে। ছােটো আয়তনের এ গল্পে স্থান-কাল-ঘটনাগত ঐক্য ভালােভাবেই রক্ষিত হয়েছে। তিনটি চরিত্রের এই গল্পে ‘ঘটনার ঘনঘটা’, ‘অতিকথন’, ‘তত্ত্ব’ বা উপদেশ অনুপস্থিত। গল্পশেষে মৃত্যুঞ্জয়ের বলা ছােটো বাক্য তিনটি পাঠককে চমকিত করে দ্রুত গল্পের ক্লাইম্যাক্সের চরমে পৌঁছে দিয়েছে। সুতরাং ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ নিঃসন্দেহে একটি শিল্প সার্থক ছোটগল্প।

গল্প : কে বাঁচায়, কে বাঁচে| উচ্চমাধ্যমিক বাংলা গল্প|HS BENGALI

Question: ফুটপাথে অনাহারে-মৃত্যু দেখার পর থেকে মৃত্যুঞ্জয় কীভাবে সম্পূর্ণ পালটে গেল, তা ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ ছোট গল্প অবলম্বনে লেখাে।

অথবা, “তারপর দিন দিন কেমন যেন হয়ে যেতে লাগল মৃত্যুঞ্জয়।” মৃত্যুঞ্জয় ধীরে ধীরে যেভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল তা গল্প অবলম্বনে লেখাে।

অথবা, “তারপর মৃত্যুঞ্জয়ের গা থেকে ধূলিমলিন সিল্কের জামা অদৃশ্য হয়ে যায়।”—মন্তব্যটির আলােকে ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ গল্পের মৃত্যুঞ্জয়ের ভূমিকা বিশ্লেষণ করাে।

কথামুখ: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কে বাঁচায়, কে বাঁচে ছোট গল্পের নায়ক মৃত্যুঞ্জয় একদিন বাড়ি থেকে অফিস যাওয়ার পথে ফুটপাথে অনাহার মৃত্যু দেখে। সেই দৃশ্য দেখেই তার শারীরিক ও মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হতে শুরু করে।

মানসিক পরিবর্তন: অনাহার-মৃত্যু দেখে নিজেকে চরম অপরাধী বলে ভাবতে শুরু করে মৃত্যুঞ্জয়। দুর্ভিক্ষের দেশে চারবেলা পেট ভরে খাওয়া এবং অবসরযাপনের সুখকল্পনায় দিন কাটানাের গ্লানিতে তার মন ভরে ওঠে। বাড়িতে ভালাে করে খেতে ও ঘুমােতে পারে না সে। সস্ত্রীক একবেলা না খেয়ে ওই খাবার সে অভুক্তদের বিলােনাে শুরু করে। কিন্তু এতেও তার হতাশা দূর হয় না। নিখিলের মাধ্যমে পুরাে মাসের মাইনেটা সে ত্রাণ-তহবিলে দান করে দেয়।

শারীরিক পরিবর্তন: ক্রমশ সে অফিসে অনিয়মিত হয়ে পড়ে, কাজে ভুল করে, প্রায়ই চুপচাপ বসে ভাবে। শহরের গাছতলায়, ডাস্টবিনের ধারে বা ফুটপাথে পড়ে থাকা দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষগুলিকে দেখতে ঘুরে বেড়ায়। এভাবে ধীরে ধীরে ফুটপাথই হয়ে ওঠে তার আস্তানা। এরপর তার গা থেকে ধূলিমলিন সিল্কের জামা ও ধুতি অদৃশ্য হয়ে তার পােশাক হয়ে দাঁড়ায় ছেড়া কাপড়। আদুল গায়ে জমে মাটির স্তর, দাড়িতে মুখ ঢেকে যায়। একটি ছােটো মগ হাতে আরও দশজন অনাহারীর মতাে সেও লঙ্গরখানায় লাইন দিয়ে কাড়াকাড়ি করে খিচুড়ি খায়, গ্রাম থেকে আসা দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষ গুলোর মতাে একঘেয়ে সুরে সে বলা শুরু করে- “গাঁ থেকে এইছি। খেতে পাইনে বাবা। আমায় খেতে দাও!”

শেষের কথা: এভাবেই মৃত্যুঞ্জয় মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই তার পেশা, পরিবার ও সমাজকে ত্যাগ করে ফুটপাথের জীবনে মিশে যায়।

Question: ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ ছোট গল্প অবলম্বনে প্রথম অনাহার-মৃত্যু দেখার দিন মৃত্যুঞ্চয়ের সঙ্গে নিখিলের যে সাক্ষাৎকার হয়েছিল, তা নিজের ভাষায় বিবৃত করাে।

Ans: মৃত্যুঞ্জয়ের সঙ্গে নিখিলের সাক্ষাৎকার : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কে বাঁচায়, কে বাঁচে ছোটগল্পে অনাহারে মৃত্যু দেখার পর মৃত্যুঞ্জয় যখন সাময়িক অসুস্থ অবস্থায় অফিসে নিজের চেয়ারে বসেছিল, তখনই সেই ঘরে তার সহকর্মী-বন্ধু নিখিল প্রবেশ করে।

মৃত্যুঞ্জয়ের আর্তনাদ : মৃত্যুঞ্জয়ের সংকটাপন্ন চোখ-মুখ এবং দেহভঙ্গি দেখে কৌতুহলী নিখিল তাকে কী হয়েছে প্রশ্ন করলে অন্যমনস্কভাবে, আর্তনাদের সে বলে ওঠে, “মরে গেল। না খেয়ে মরে গেল”।

নিখিলের উপলব্ধি : আরও কিছু আনুষঙ্গিক প্রশ্ন করে নিখিল বুঝতে পারে যে, ফুটপাথে অনাহার-মৃত্যুর ব্যাপারটা মৃত্যুঞ্জয় কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। তার মাথার মধ্যে ঘুরছে নানা কথা, নানা প্রশ্ন। ফুটপাথে অনাহার-মৃত্যুর কদর্যতা, ক্ষুধার কষ্ট ও মৃত্যুর কষ্টের মধ্যে কোন্টা বেশি যন্ত্রণাদায়ক সেই ভাবনা তার মনকে আলােড়িত করছে।

মৃত্যুঞ্জয়ের প্রতিক্রিয়া : ছলছল চোখে মৃত্যুঞ্জয় জানায় যে, সে বেঁচে থাকা সত্ত্বেও একজন মানুষ যে না খেতে পেয়ে মারা গেলে অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত সে কীভাবে করবে। এতদিন ধরে সব জেনেশুনেও নিতান্ত স্বার্থপরের মতাে সে চারবেলা পেটপুরে খেয়ে এসেছে। কাজের লােকের অভাবে ত্রাণকার্য যেখানে ঠিকমতাে চালিত হচ্ছে না, সেখানে এতদিন ধরে সে নির্লজ্জের মতাে তার অফুরন্ত অবসর কাটানাের কথা ভেবেছে।

শেষের কথা : নিখিলকে এসব কথা বলে মৃত্যুঞ্জয় আসলে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষগুলির প্রতি নিজের উদাসীনতাকেই ধিক্কার জানিয়েছে।

গল্প : কে বাঁচায়, কে বাঁচে

Question: “সেদিন আপিস যাবার পথে মৃত্যুঞ্জয় প্রথম মৃত্যু দেখল— অনাহারে মৃত্যু।”—এই দেখার ফলে মৃত্যুঞ্জয়ের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল?

Ans:

প্রেক্ষাপট : প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ ছোট গল্পের প্রধান চরিত্র মৃত্যুঞ্জয় অফিস যাওয়ার পথে একদিন ফুটপাথে অনাহারে মৃত্যুর দৃশ্য দেখে। মন্বন্তরের সময়ে এরকম মৃত্যু নিয়মিত ঘটলেও তা ছিল মৃত্যুঞ্জয়ের জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা।

শারীরিক প্রতিক্রিয়া : আবেগপ্রবণ আদর্শবাদী মৃত্যুঞ্জয় তাই করুণ এই দৃশ্যটি দেখার কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রচণ্ড মানসিক বেদনাবােধের সঙ্গে শারীরিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়ে। রীতিমতাে কাহিল অবস্থায় অফিসে পৌঁছে সে অফিসের বাথরুমে বাড়ি থেকে খেয়ে-আসা খাবার বমি করে বের করে দেয়।

মানসিক প্রতিক্রিয়া : পাশের কুঠুরি থেকে খবর নিতে আসে তার সহকর্মী বন্ধু নিখিল। নিখিল দেখে মৃত্যুঞ্জয় ভাবলেশহীন চাহনিতে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে, সামনে টেবিলের ওপর শূন্য কাচের গ্লাস রাখা। তাকে দেখে নিখিলের মনে হয় যে, নিশ্চয়ই কোনাে-এক বড়াে সমস্যায় পড়েছে মৃত্যুঞ্জয়। সেই সমস্যার নিরর্থক, অন্যায্য কঠোরতায় শার্সিতে আটকে-পড়া মৌমাছির মতাে মৃত্যুঞ্জয় মাথা খুঁড়ছে। লেখক নিখিলের এই দেখার মধ্য দিয়ে মৃত্যুঞ্জয়ের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ার একটা স্বচ্ছ ধারণা সুন্দরভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। এককথায় মৃত্যুঞ্জয়ের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল হতাশার, যন্ত্রণার এবং অস্থিরতার।

Question: ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ ছোট গল্প অবলম্বনে প্রথম অনাহার-মৃত্যু দেখার দিন মৃত্যুঞ্চয়ের সঙ্গে নিখিলের যে সাক্ষাৎকার হয়েছিল, তা নিজের ভাষায় বিবৃত করাে।

Ans: মৃত্যুঞ্জয়ের সঙ্গে নিখিলের সাক্ষাৎকার : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কে বাঁচায়, কে বাঁচে ছোটগল্পে অনাহারে মৃত্যু দেখার পর মৃত্যুঞ্জয় যখন সাময়িক অসুস্থ অবস্থায় অফিসে নিজের চেয়ারে বসেছিল, তখনই সেই ঘরে তার সহকর্মী-বন্ধু নিখিল প্রবেশ করে।

মৃত্যুঞ্জয়ের আর্তনাদ : মৃত্যুঞ্জয়ের সংকটাপন্ন চোখ-মুখ এবং দেহভঙ্গি দেখে কৌতুহলী নিখিল তাকে কী হয়েছে প্রশ্ন করলে অন্যমনস্কভাবে, আর্তনাদের সে বলে ওঠে, “মরে গেল। না খেয়ে মরে গেল”।

নিখিলের উপলব্ধি : আরও কিছু আনুষঙ্গিক প্রশ্ন করে নিখিল বুঝতে পারে যে, ফুটপাথে অনাহার-মৃত্যুর ব্যাপারটা মৃত্যুঞ্জয় কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। তার মাথার মধ্যে ঘুরছে নানা কথা, নানা প্রশ্ন। ফুটপাথে অনাহার-মৃত্যুর কদর্যতা, ক্ষুধার কষ্ট ও মৃত্যুর কষ্টের মধ্যে কোন্টা বেশি যন্ত্রণাদায়ক সেই ভাবনা তার মনকে আলােড়িত করছে।

মৃত্যুঞ্জয়ের প্রতিক্রিয়া : ছলছল চোখে মৃত্যুঞ্জয় জানায় যে, সে বেঁচে থাকা সত্ত্বেও একজন মানুষ যে না খেতে পেয়ে মারা গেলে অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত সে কীভাবে করবে। এতদিন ধরে সব জেনেশুনেও নিতান্ত স্বার্থপরের মতাে সে চারবেলা পেটপুরে খেয়ে এসেছে। কাজের লােকের অভাবে ত্রাণকার্য যেখানে ঠিকমতাে চালিত হচ্ছে না, সেখানে এতদিন ধরে সে নির্লজ্জের মতাে তার অফুরন্ত অবসর কাটানাের কথা ভেবেছে।

শেষের কথা : নিখিলকে এসব কথা বলে মৃত্যুঞ্জয় আসলে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষগুলির প্রতি নিজের উদাসীনতাকেই ধিক্কার জানিয়েছে।

Question: “অন্য সকলের মতাে মৃত্যুঞ্জয়কে সেও খুব পছন্দ করে।”- কার কথা বলা হয়েছে? তার মৃত্যুঞ্জয়কে পছন্দ করার যে কারণ লেখক আলােচনা করেছেন এই প্রসঙ্গে সেটির বিবরণ দাও।

Ans:

উদ্দিষ্ট ব্যক্তি: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ ছোট গল্প থেকে সংকলিত এই উদ্ধৃতিটিতে মৃত্যুঞ্জয়ের সহকর্মী-বন্ধু নিখিলের কথা বলা হয়েছে।

মৃত্যুঞ্জয়কে পছন্দ করার কারণ: মৃত্যুঞ্জয় ছিল ন্যায়নীতিবােধসম্পন্ন, ধীরস্থির, নির্বিরােধী, সহানুভূতিশীল এক সাদাসিধে যুবক। কিন্তু শুধু তার এইসব ইতিবাচক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্যই যে নিখিল তাকে পছন্দ করত, তা নয়। মানব সভ্যতার নষ্ট হয়ে যাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন যে ঐতিহ্য আদর্শবাদের, তার কল্পনায় এবং সাধনায় মৃত্যুঞ্জয় নিজেকে সঁপে দিয়েছিল বলেই নিখিল তাকে খুব পছন্দ করত। অবশ্য, মৃত্যুঞ্জয় যদি দুর্বল-মনের কল্পনাবিলাসী আদর্শবাদী যুবক হত, তাহলে তাকে পছন্দ করার প্রসঙ্গ আসত না। দুটো কথার দ্বারা তাকে উত্ত্যক্ত করলেই তার মনের রাশি রাশি অন্ধকার বেরিয়ে এসে তাকে অবজ্ঞার পাত্র করে তুলত। মৃত্যুঞ্জয়ের মনের গঠন-প্রকৃতি তেমন নির্জীব বা শিথিল নয়। তার হৃদয় ও মস্তিষ্ক যথেষ্ট গতিশীল। তার হৃদয়ে শক্তির একটা উৎস রয়েছে। অসম্ভবকে সম্ভব করতে যে শক্তির প্রয়ােজন হয়, সেই চেষ্টায় জগতে যে শক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে গেছে, তেমনই এক শক্তির অধিকারী ছিল সে। এই বিশেষ শক্তির অধিকারী বলেই মৃত্যুঞ্জয়ের প্রতি নিখিল মৃদু হিংসা পােষণ করত, ভাবত, সে নিজে মৃত্যুঞ্জয় হলে খারাপ হত না। নিখিল যে মৃত্যুঞ্জয়কে খুব পছন্দ করে এবং ভালাও বাসে, তার কারণ হিসেবে লেখক এ বিষয়গুলিই উল্লেখ করেছেন।

গল্প : কে বাঁচায়, কে বাঁচে

Question: “অথচ নিখিল প্রশ্ন করলে সে জবাবে বলল অন্য কথা।”- নিখিল মৃত্যুঞ্জয়কে কেন প্রশ্ন করেছিল? মৃত্যুঞ্জয় কেন অন্য কথা বলে?

Ans:

নিখিলের প্রশ্নের প্রেক্ষাপট : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ গল্পে ফুটপাথে অনাহার-মৃত্যু দেখে মৃত্যুঞ্জয়ের মধ্যে এক তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। এই দৃশ্য তাকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে তুলেছিল। সমস্ত বিষয়টা খতিয়ে দেখে নিখিলের মনে হয়েছিল, ফুটপাথে অনাহারে মৃত্যুর বিষয়টি সম্পর্কে মৃত্যুঞ্জয় আসলে স্পষ্ট ধারণা করতেই পারছে না। মৃত্যুঞ্জয় হয়তাে ফুটপাথের মানুষগুলির জীবনযাপনের বীভৎসতা, ক্ষুধা অথবা মৃত্যুর রূপ বােঝার চেষ্টা করছে। “না খেয়ে মরা কী ও কেমন?”- এ প্রশ্নের উত্তরও সে খুঁজে চলেছে। তাই সমস্ত বিষয়টি ভালােভাবে জেনে নেওয়ার জন্যই নিখিল মৃত্যুঞ্জয়কে প্রশ্ন করেছিল।

মৃত্যুঞ্জয় ‘অন্য কথা’ বলার কারণ : নিখিল যখন এই প্রশ্নগুলি মৃত্যুঞ্জয়ের সামনে রাখে, তখন জবাবে সে অন্য কথা বলে। সে পালটা নিখিলকে জিজ্ঞাসা করে যে, সে নিজে দিব্যি খেয়েপরে বেঁচে রয়েছে অথচ একটা লোক না খেয়ে মরে গেলে অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত কী। সে নিজে চারবেলা খাচ্ছে আর কিছু মানুষ একবেলাও খেতে পাচ্ছে না এই বৈষম্য তাকে কাতর করে তােলে। একদিকে সে তার ধরাবাঁধা জীবনে দৈনন্দিন কাজ শেষ করে নিশ্চিন্ত অবসর কাটায়, অন্যদিকে লোকের অভাবে ত্রাণকার্য সঠিকভাবে চালানাে যায় না এ কথা মনে হতেই মৃত্যুঞ্জয় নিজেকে ধিক্কার দেয়।

গল্প : কে বাঁচায়, কে বাঁচে
গল্প : কে বাঁচায়, কে বাঁচে

Question: “মরে গেল। না খেয়ে মরে গেল।”- বক্তা কে? এর মধ্য দিয়ে বক্তার চরিত্রের কোন্ দিক ফুটে উঠেছে?

Ans:

বক্তা : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ গল্পের উল্লিখিত মন্তব্যটির বক্তা কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্র মৃত্যুঞ্জয়।

চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য : অফিসে যাওয়ার সময় মৃত্যুঞ্জয় জীবনে প্রথমবার যেদিন ফুটপাথে অনাহারে মৃত্যুর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করল, সেদিন তার মনের মধ্যে প্রবল প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। প্রাথমিভাবে মানসিক বেদনাবােধের সঙ্গে শারীরিক কষ্টবােধের শিকার হয়েছিল সে। তারপরে এক শূন্যতা যেন তাকে গ্রাস করেছিল। বন্ধু ও সহকর্মী নিখিল বুঝতে পেরেছিল যে, “শার্সিতে আটকানাে মৌমাছির মতাে সে মাথা খুঁড়ে সেই স্বচ্ছ সমস্যার অকারণ অর্থহীন অনুচিত কাঠিন্যে।” নিখিল এই বিষয়টি বুঝে নিতে চায় বন্ধু মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে। তার প্রত্যুত্তরেই যেন মৃত্যুঞ্জয় অন্যমনস্কভাবে অস্পষ্ট ভঙ্গিতে আর্তনাদ করে ওঠে। মৃত্যুঞ্জয় যেন এই মৃত্যুকে, বিশেষত ক্ষুধার কারণে মৃত্যুকে মানতে পারে না। মৃত্যুঞ্জয়ের মধ্যবিত্ত জীবনদর্শনে অভাব থাকলেও অনাহার ছিল না। ক্ষুধার যন্ত্রণায় মৃত্যু তাই এক বীভৎস চেহারা নিয়ে সম্ভবত তার সমস্ত চেতনাকে অধিকার করে নেয়। নিজের চারবেলার উদরপূর্তিতে তার আত্মগ্রানি হয়। এক অসহায় মানুষের আত্মবিলাপ যেন শােনা যায় মৃত্যুঞ্জয়ের মন্তব্যে। আবার তার মধ্যেই তার সংবেদশীল, সহমর্মী, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

Question: “এ অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত কি?”- কোন অপরাধের কথা বলা হয়েছে? বক্তার এই অপরাধবােধের কারণ কী?

Ans:

উদ্দিষ্ট অপরাধের পরিচয় : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ গল্পে মৃত্যুঞ্জয় অফিসে যাওয়ার পথে ফুটপাথে এক অনাহারে মৃত্যুর দৃশ্য দেখে। নিজেদের চারবেলা পেট ভরে খাওয়া এবং দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের মৃত্যু বিষয়ে উদাসীনতাকে মৃত্যুঞ্জয়ের অপরাধ বলে মনে হয়।

অপরাধবােধের কারণ : মানুষের অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা মৃত্যুঞ্জয়ের সমস্ত চেতনাকে আচ্ছন্ন করে তােলে। শারীরিক কষ্টবােধের সঙ্গে মানসিক যন্ত্রণা তীব্র হয়ে ওঠে। বন্ধু ও সহকর্মী নিখিল তাকে বলেছে- “মানবসভ্যতার সবচেয়ে প্রাচীন ও সবচেয়ে পচা ঐতিহ্য আদর্শবাদের কল্পনা-তাপস”। এই আদর্শের কারণেই সে মৃত্যুযন্ত্রণা, ক্ষুধার যন্ত্রণা ইত্যাদি নিয়ে ভাবতে শুরু করে। তারা ভালােভাবে বেঁচে আছে, অথচ কিছু মানুষ না খেয়ে মরে গেল- এই বেদনা ও বৈষম্যে সে ভাবিত হয়। আর সব জেনেশুনেও সে যে চারবেলা পেট ভরে খেয়েছে তা তাকে গ্লানিজর্জর করে তােলে। আদর্শবােধের তীব্র তারণা। সব মিলিয়ে নিজের ব্যক্তিগত এবং শ্রেণিগত উদাসীনতা মৃত্যুঞ্জয়কে অনুশােচনায় বিদ্ধ করে। যখন একদিকে লােকের অভাবে যথেষ্ট ত্রাণকার্য চালানাে যাচ্ছে না- সেই সময়ে কিছু লোক সময় কাটানাের উপায় খুঁজে পাচ্ছে না- এই আচরণ মৃত্যুঞ্জয় মেনে নিতে পারেনি। নিজেকে ধিক্কার জানিয়েছে সে। আদর্শবােধের তীব্র তাড়নাই মৃত্যুঞ্জয়কে অপরাধী করে তুলেছে।

গল্প : কে বাঁচায়, কে বাঁচে

Question: “নিখিল ভাবছিল বন্ধুকে বুঝিয়ে বলবে, এ ভাবে দেশের লােককে বাঁচানাে যায় না।”- কোন প্রসঙ্গে নিখিলের এই ভাবনা? এই ভাবনার মাধ্যমে নিখিলের চরিত্রের কোন বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে?

Ans:

প্রসঙ্গ : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ ছোটগল্পে আমরা দেখি যে, ফুটপাথে অনাহার মৃত্যু দেখার পর অফিসের মাইনের দিন মৃত্যুঞ্জয় সব টাকা নিখিলের হাতে দেয় ত্রাণ তহবিলে দান করার জন্য। বিস্মিত নিখিলের প্রশ্নের উত্তরে সে জানায় যে তারা সস্ত্রীক একবেলার ভাত না খেয়ে নিরন্ন মানুষদের দান করে দিচ্ছে। টুনুর মা অসুস্থ বলে মৃত্যুঞ্জয় তাকে খেতে বললেও পতিব্রতা স্ত্রী তা শােনে না। এই প্রসঙ্গেই নিখিল এমনটা ভাবছিল।

নিখিলের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য : মৃত্যুঞ্জয়ের সহকর্মী নিখিলও একজন হৃদয়বান, সামাজিক মানুষ। কিন্তু অনাহার-মৃত্যু দেখে ভেঙেপড়া মৃত্যুঞ্জয়কে লক্ষ করে তার মনে হয়েছে যে, সব মানুষের সব সহানুভূতি অনাহারীদের খিদের আগুনে ঢাললেও তা নিভবে না, উলটে তা ইন্ধনই পাবে। তার মতে ভিক্ষাদানের মতাে পাপকর্ম সাধারণ মানুষের কাছে সৎকর্ম হিসেবে বিবেচিত হয় বলেই মানুষের অন্নের দাবি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। ত্রাণের ফলে কিছু লােক খেতে পেলেও আড়ালে থাকা আরও অনেক মানুষ না খেতে পেয়েই মারা যায়। তার মতে, এই অবস্থায় আহার বিলাসিতা অন্যায় হলেও উপােস করে মারা যাওয়াটাও একান্তই অনুচিত। কারণ, নীতি ধর্ম নয়, সমাজ ধর্মের দিক থেকেই নিখিল মনে করে, দশজনকে খুন করার থেকে বড় অপরাধ হল নিজে না খেয়ে মরা। মৃত্যুঞ্জয়ের ভাববাদী আদর্শের বিপরীতে এই ভাবনার মাধ্যমে নিখিলের চরিত্রের বাস্তববাদী বৈশিষ্ট্যই প্রকাশিত হয়েছে।

Question: “সেদিনের পর থেকে মৃত্যুঞ্জয়ের মুখ বিষয় গম্ভীর হয়ে আছে।”—কোন দিনের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে? সেদিনের পর থেকে মৃত্যুঞ্জয়ের মুখ কেন বিষয় গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল?

Ans: উদ্দিষ্ট দিন : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ ছোট গল্পের প্রধান চরিত্র মৃত্যুঞ্জয় মন্বন্তরের সময় কালে যেদিন বাড়ি থেকে অফিস যাওয়ার পথে ফুটপাথে একটি অনাহার মৃত্যুর বীভৎস দৃশ্য দেখেছিল, সেই দিনটির কথাই প্রশ্নোদ্ধৃত অংশে বলা হয়েছে।

মৃত্যুঞ্জয়ের মুখ বিষন্ন ও গম্ভীর হয়ে ওঠার কারণ : এতকাল অবধি মৃত্যুঞ্জয় না-খেতে-পেয়ে মরার কথা কেবল শুনেছিল বা পড়েছিল। মন্বন্তরের সময় প্রায়শই ফুটপাথে অনাহার-মৃত্যু ঘটলেও মৃত্যুঞ্জয়ের জীবনে প্রথমবারের জন্য সেই অভিজ্ঞতা হয়েছিল।

মৃত্যুর বীভৎসতা : মৃত্যুঞ্জয় ছিল ন্যায়নীতিবােধসম্পন্ন, অনুভূতিশীল, সাদাসিধে ভালো মানুষ। মানব সভ্যতার নষ্ট হয়ে যাওয়া যে সুপ্রাচীন ঐতিহ্য আদর্শবাদ তার কল্পনায় এবং সাধনায় মৃত্যুঞ্জয় নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সঁপে দিয়েছিল। জীবনে প্রথম ফুটপাথে অনাহার মৃত্যুর বীভৎস দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার পরে মৃত্যুঞ্জয়ের মনে এই অনাহার-মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নানা প্রশ্ন জেগে ওঠে।

উদাসীন জীবন যন্ত্রণা : খিদের যন্ত্রণা না মৃত্যু যন্ত্রণা কোন্টা বেশি কষ্টকর তা নিয়েও তার মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। তার মনে হয় তার মতাে স্বচ্ছল মধ্যবিত্তদের দরিদ্র মানুষের জীবন যন্ত্রণা সম্পর্কে উদাসীনতাই হয়তাে এর কারণ। এই মৃত্যুর ঘটনাটা মৃত্যুঞ্জয়কে এমন আহত করেছিল, অপরাধবােধে দীর্ণ করে দিয়েছিল যে, তারপর থেকেই সে বিষয় ও গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল।

Question: “ওটা পাশবিক স্বার্থপরতা।”- বক্তা কে? কোন্ কাজকে পাশবিক স্বার্থপরতা বলা হয়েছে?

Ans: বক্তা : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ ছোট গল্প থেকে সংকলিত এই উদ্ধৃতিটির বক্তা হল মৃত্যুঞ্জয়।

উদ্দিষ্ট পাশবিক স্বার্থপরতার বিশ্লেষণ : পঞ্চাশের মন্বন্তরকালে হঠাৎই একদিন ফুটপাথে অনাহারে-মৃত্যু দেখে মৃত্যুঞ্জয় অপরাধবােধে দীর্ণ হয়ে পড়ে। তার প্রিয় বন্ধু নিখিলের এতে মন খারাপ হয়। তবুও সে ভাবে যে, সব মানুষের সকল সহানুভূতি একত্রিত করে অনাহারীদের খিদের আগুনে ঢাললেও তা নিভবে না, উলটে তা ইন্ধনই পাবে। তার মতে, ভিক্ষা দানের মতাে পাপকর্ম সাধারণ মানুষের কাছে সৎকর্ম হিসেবে বিবেচিত হয় বলেই মানুষের অন্নের দাবি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। এরপর মাইনের দিন মৃত্যুঞ্জয় যখন তার মাইনের সব টাকা নিখিলের মাধ্যমে ত্রাণ তহবিলে দান করে দেয়, তখন আর নিখিল স্থির থাকতে পারে না। পরিবারের প্রতি মৃত্যুঞ্জয়ের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে সে মৃত্যুঞ্জয়কে জানায় যে, মন্বন্তরকালে ভূরিভােজ অন্যায় হলেও উপােস করে মৃত্যুবরণ করাও একেবারেই উচিত নয়। তাই বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু খাদ্যের প্রয়ােজন, ততটুকুই সে গ্রহণ করে। নিখিল আরও জানায় যে, যতদিন অবধি আত্মরক্ষার উপযােগী ন্যূনতম খাদ্য সে জোগাড় করতে পারবে, ততদিন অবধি সে সেই খাদ্য গ্রহণ করবে। দেশের সমস্ত লােক মরে গেলেও সে অন্যকে সেই আত্মরক্ষার উপযােগী খাবার দিতে পারবে না। সমাজধর্মের দিক থেকেই বলা যায় যে, দশজনকে হত্যা করার চেয়ে নিজে উপােস করে মৃত্যুবরণ করা আরও বেশি অপরাধ। নিখিলের এই ভাবনাকেই মৃত্যুঞ্জয় ‘পাশবিক স্বার্থপরতা’ বলে অভিহিত করেছে।

গল্প : কে বাঁচায়, কে বাঁচে

Question: “মৃত্যুঞ্জয়ের চোখ ছল ছল করছে দেখে নিখিল চুপ করে থাকে।”- মৃত্যুঞ্জয়ের চোখ ছলছল করতে থাকার কারণ কী? চুপ করে থাকা সত্ত্বেও নিখিল মনে মনে কী ভাবতে লাগল?

Ans:

মৃত্যুঞ্জয়ের চোখ ছলছল করার কারণ : ফুটপাথে অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা মৃত্যুঞ্জয়ের মানসিক ও শারীরিক কষ্টের কারণ হয়েছে। নিখিলের কাছে এই ঘটনা সাধারণ ও সহজবােধ্য বলে মনে হলেও মৃত্যুঞ্জয়ের তা মনে হয়নি। সে এতদিন এই ব্যাপারে মাথা না ঘামিয়ে ভূরিভােজ করে নিশ্চিন্তে দিন কাটিয়েছে। নিজের এই উদাসীনতার জন্য সে বেদনাহত এবং অনুতপ্ত। সে নিজেকে অপরাধী বলে মনে করে। ওই অপরাধের কী প্রায়শ্চিত্ত হতে পারে, সেই ভাবনা তাকে আলােড়িত করে। এই নির্লজ্জ অমানবিক আচরণের জন্য নিজেকে ধিক্কার জানাতেও মৃত্যুঞ্জয় পিছপা হয় না। মানসিকভাবে বিষন্ন মৃত্যুঞ্জয়ের অনুতাপে চোখ ছলছল করে।

নিখিলের ভাবনা : মৃত্যুঞ্জয়ের ছলছল চোখ দেখে নিখিল চুপ করে থাকে। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয়ের দরদের ছোঁয়ায় তারও মন খারাপ হয়। তার মনে হয় দুর্ভিক্ষের দেশে সমস্ত দরদ, সব সহানুভূতি উজাড় করে ঢেলে দিলেও অপরিসীম ক্ষুধার আগুন নিভবে না বরং তা ক্ষুধার আগুনকে ইন্ধন জোগাবে। নিখিলের মতে ভিক্ষে দেওয়া অস্বাভাবিক পাপ কাজ, কিন্তু তাকে পুণ্য কাজের পর্যায়ে উন্নীত করার ফলে মানুষের জীবনধারণের অন্নের প্রতি ন্যায্য দাবি জন্মায় না। ভিক্ষে দিয়ে দেশব্যাপী ক্ষুধার অন্ন জোগানাে যায় না। এই রূঢ় বাস্তবতা আধ্যাত্মিক নীতি করে মধুর প্রলেপ দেওয়া আসলে অনিয়মের নামান্তর। চিতার আগুনে কোটি কোটি মৃতদেহ পােড়ানাে হলেও পৃথিবীতে যত জ্যান্ত মানুষ আছে, তাদের পুড়িয়ে ছাই করার ক্ষমতা চিতার আগুনের আছে। আসলে মানুষের সীমাহীন খিদে সেই আগুনে জ্বালানি রূপেই কাজ করে।

Question: “কদিন পরেই মাইনের তারিখ এল।”—মাইনের দিনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিখিল ও মৃত্যুঞ্জয়ের বক্তব্য ও মনোভাব বিশ্লেষণ করাে।

Ans: কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ গল্পে মৃত্যুঞ্জয় ও নিখিল একই অফিসের কর্মী। প্রতি মাসে নিখিল তিন জায়গায় কিছু কিছু টাকা পাঠাতে হয়। টাকা পাঠানাের জন্য মানি-অর্ডার ফর্ম লিখতে গিয়ে নিখিল ভাবল যে, এবার তিনটে সাহায্যই পাঁচ টাকা করে কমিয়ে দেবে কিনা। এমন সময় মৃত্যুঞ্জয় নিখিলের ঘরে এসে একতাড়া নোট বের করে। টাকাটা দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের জন্য কোনাে রিলিফ ফান্ডে দিয়ে আসার অনুরােধ জানায়। নিখিল ধীরে ধীরে গুনে দেখে মৃত্যুঞ্জয় সমস্ত মাসমাইনেই দান করেছে। বন্ধু হিসেবে নিখিল তাকে বােঝায় যে তার ওপর সংসারে ন-জন লােকের দায়িত্ব রয়েছে। মাইনের টাকায় মাস চলে না। প্রতি মাসেই তাকে ধার করতে হয়। সেই পরিস্থিতিতে সারা মাসের বেতন রিলিফ ফান্ডে দেওয়া মােটেই সমীচীন নয়। মৃত্যুঞ্জয় জানায় যে সে কিছু একটা করতে চায়। তার রাতে ঘুম হচ্ছে না। খেতে বসলে খেতে পারছে না। তারা স্বামী-স্ত্রী একবেলা খায়, আর-এক বেলার খাবার ক্ষুধার্তদের বিলিয়ে দেয়। এ কথা শুনে নিখিল বলে মৃত্যুঞ্জয়ের স্ত্রী টুনুর মায়ের যা স্বাস্থ্য তাতে একবেলা না খেয়ে পনেরাে কুড়ি দিনই কাটাতে পারবে।

নিখিল ভাবছিল সে মৃত্যুঞ্জয়কে বােঝাবে যে এভাবে দেশের লােককে বাঁচানাে যায় না। রিলিফ বা ত্রাণকার্য প্রকৃতপক্ষে একজনের খাবার আর-এক জনকে খাওয়ানাে। এতে চোখের সামনে যারা আছে তারাই বাঁচবে, দূরের মানুষ খাবার না পেয়ে মরবে। কিন্তু এসব কোনাে কথাই তার মুখ থেকে বেরােল না। নিখিল জানায় যে ভূরিভােজ করে খাওয়া অন্যায়। তা বলে না খেয়ে মরাও উচিত নয়। নীতি ধর্মের দিক থেকে নয়, সমাজ ধর্মের দিক থেকে বিচার করলে দশজনকে খুন করার পাপের চেয়ে না খেয়ে নিজেকে মেরে ফেলা বড়াে পাপ। নিখিলের এই মনোভাব ও বক্তব্যে ক্ষুদ্ধ হয়ে মৃত্যুঞ্জয় জানায় যে, এরূপ আচরণ পাশবিক স্বার্থপতার পরিচয়।

গল্প : কে বাঁচায়, কে বাঁচে

Question: “দরদের চেয়ে ছোঁয়াচে কিছুই নেই এ জগতে।”—কে, কোন্ প্রসঙ্গে এ কথা বলেছে? মন্তব্যটির কারণ কী?

Ans: বক্তা : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ গল্পে নিখিলের মনোভাব উল্লেখ করতে গিয়ে স্বয়ং লেখক মন্তব্যটি করেছেন।

প্রসঙ্গ : অফিসে যাওয়ার সময় ফুটপাথে অনাহারে মৃত্যুর দৃশ্য দেখে মৃত্যুঞ্জয়ের মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া হয়। শরীরিক কষ্টবােধের সঙ্গে তীব্র মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয় সে। তার অবচেতন মন এই মৃত্যুর বীভৎসতায় আর্তনাদ করতে থাকে। দুর্ভিক্ষের দিনে খাদ্যের অভাবে মানুষের মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে তার নিজের ভালাে থাকা মৃত্যুঞ্জয়ের মনে অনুশােচনা সৃষ্টি করে। তার চোখে জল আসে আর তা ছুঁয়ে যায় বন্ধু ও সহধর্মী নিখিলকেও। এই প্রসঙ্গেই মন্তব্যটি করা হয়েছে।

মন্তব্যটির কারণ : যে নিখিল তার অবসর জীবন “বই পড়ে আর একটা চিন্তা জগৎ গড়ে তুলে” কাটিয়ে দিতে চেয়েছিল— তার নিজস্ব মানসিক গড়ন নিয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়। সেকারণে সে বন্ধু মৃত্যুঞ্জয়ের ভাবনার সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত না হলেও তার আদর্শবােধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে। সেকারণেই মৃত্যুঞ্জয়ের চোখের জল তার মন খারাপ করে দেয়, তাকে ভাবায়। নিখিল ভাবতে থাকে যে, দেশের সব দরদ পুঞ্জীভূত করে ঢাললেও ক্ষুধার আগুন নিভবে না, “অন্যের বদলে বরং সমিধে পরিণত হবে।” মৃত্যুঞ্জয়ের প্রতি সহমর্মিতার উল্লেখ করতে গিয়েই উল্লিখিত মন্তব্যটি করা হয়েছে।

Question: “ভুরিভােজনটা অন্যায়, কিন্তু না খেয়ে মরাটা উচিত নয় ভাই।”— বক্তা কে? এই বক্তব্যের মধ্যে বক্তার চরিত্রের কোন্ দিক আভাসিত হয়েছে?

Ans: বক্তা : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ গল্পে উল্লিখিত মন্তব্যটির বক্তা মৃত্যুঞ্জয়ের বন্ধু ও সহকর্মী নিখিল।

বক্তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য : দুর্ভিক্ষের কারণে ফুটপাতে মানুষের অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা মৃত্যুঞ্জয়ের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। সে তার মাইনের সমস্ত টাকাটাই নিখিলের মাধ্যমে ত্রাণ তহবিলে দিয়ে দিতে চায়। কিন্তু নিখিল এই বাস্তববােধহীন ভাবাবেগের বিরােধী। মাইনের টাকায় যার নিজেরই সংসার চলে না, তার এই জনসেবার আকুলতা নিখিলের কাছে অর্থহীন বলে মনে হয়। তার মনে হয় যে, এভাবে দেশের লােককে বাঁচানাে যায় না। যে রিলিফ চলেছে। তা আসলে “একজনের বদলে আরেকজনকে খাওয়ানাে।” একই সঙ্গে আত্মপ্রবঞ্চনা মানতে পারে না নিখিল। বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু প্রয়োজন। ততটুকু খেতেই হবে। নিখিল বেশ জোরের সঙ্গেই বলেছে “দেশের সমস্ত লােক মরে গেলেও যদি সেইটুকু সংগ্রহ করার ক্ষমতা আমার থাকে, কাউকে না দিয়ে নিজেই আমি তা খাব।” মৃত্যুঞ্জয়ের ভাবাবেগের বিপরীতে নিখিলের ভাবনা ও বক্তব্যকে অনেক বেশি বাস্তববাদী মনে হয়। নিখিল মন থেকেই বিশ্বাস করে যে, নীতি ধর্মের দিক থেকে না হলেও সমাজ ধর্মের দিক থেকে দশজনকে খুন করার চেয়ে নিজেকে না খাইয়ে মারা বড়াে পাপ। এভাবেই নিখিলের বাস্তববুদ্ধির পরিচয় গল্পে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।