বিবেকানন্দ : চিকাগো বক্তৃতার প্রাসঙ্গিকতা

বিবেকানন্দ : চিকাগো বক্তৃতার প্রাসঙ্গিকতা ও তাৎপর্য

ভূমিকাঃ                                                                 

“বহুরূপে সম্মুখে তােমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?

জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।”

অর্থাৎ জীব সেবাই শিব সেবা। এই বাণী যে-বাঙালি মহাপুরুষ শুধুমাত্র কণ্ঠে উচ্চারণই করেননি, নিজের জীবনে অক্ষরে অক্ষরে এই বাণীর মর্মসত্যকে পালন করে গেছেন তিনি হলেন স্বামী বিবেকানন্দ। কবি চণ্ডীদাস গেয়েছিলেন সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই। শ্রীচৈতন্যও প্রেমানন্দে আচণ্ডাল মানুষকে
কোল দিয়েছিলেন। এ যুগের কবি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় মানুষের যিনি ঈশ্বর তিনি বললেন                    

    “জগতে দরিদ্ররূপে ফিরি দয়া তরে                    

     গৃহহীনে গৃহ দিলে আমি থাকি ঘরে। ”  

কবিদের এই সম্মিলিত চিন্তাকেই বিবেকানন্দ তার কর্মধারার মধ্যে রূপায়িত করেছেন। অনাথ আতুর দুঃখী মানুষের সেবাকেই তিনি জীবনের মুলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি গৈরিকধারী সন্ন্যাসী ছিলেন, কিন্তু আত্মীয় পরিজন পরিবৃত সংসারকে তিনি মায়া বলে পরিত্যাগ করেন নি; বরং অসংখ্য বন্ধন মাঝে মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করতে চেয়েছেন, চেয়েছেন মানুষের মাঝে ভগবানকে অনুভব করতে।

জন্ম, বংশ পরিচয় ও শিক্ষা :

১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১১ জানুয়ারি কলকাতার সিমুলিয়া অঞ্চলের বিখ্যাত দত্ত পরিবারে বিবেকানন্দের জন্ম হয়। সন্ন্যাস গ্রহণের পূর্বে তার নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ এবং বাল্যের ডাক নাম বিলে। পিতা বিশ্বনাথ দত্ত এবং মাতা ভুবনেশ্বরী দেবীর দুরন্ত সন্তান বিবেকানন্দ খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। বাল্যকাল থেকে তার প্রবল ধর্মভাবও দেখা যায়। চোদ্দ বছর বয়সে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে জেনরেল এসেব্লি কলেজে অধ্যয়ন করে বি. এ. পাশ করেন।

রামকৃষ্ণের সান্নিধ্য লাভ ও দীক্ষাগ্রহণ :

দর্শন ছিল বিবেকানন্দের প্রিয় বিষয়। দর্শনের গভীর অধ্যয়ন তাকে বিশ্বসৃষ্টির সত্যাসত্য সম্বন্ধে জিজ্ঞাসু করে তােলে এবং তিনি হয়ে ওঠেন সংশয়বাদী। শেষ পর্যন্ত দক্ষিণেশ্বরের পরমহংস শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে তিনি আসেন এবং নিজের আন্তরিক প্রবর্তনায় ও রামকৃষ্ণদেবের ইচ্ছায় তিনি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। দীক্ষা গ্রহণের পর বিবেকানন্দ প্রথম প্রথম নিজের মুক্তির জন্য জপতপে মনােনিবেশ করেন। কিন্তু গুরুর নিকট তিরস্কৃত হয়ে সর্বমানবের মুক্তিসাধন ও দুঃখমােচনে ব্রতী হলেন।

ভারত ভ্রমণ :

ইতােমধ্যে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে রামকৃষ্ণদেবের তিরােধানের পর বিবেকানন্দের বন্ধন যেন খুলে গেল। গুরুভাইদের নিয়ে তিনি গঠন করলেন এক সংঘ। জনসেবাই হল এই সংঘের প্রধান কাজ। দেশকে না জানলে দেশের কাজ করা যায় না। বিবেকানন্দ পদব্রজে বেরিয়ে পড়লেন ভারত ভ্রমণে। আসমুদ্র হিমাচল-ভারতের এক বিরাট ভারত ভ্রমণ রূপ সন্ন্যাসীর দৃষ্টিতে প্রতিভাত হল। তিনি দেখলেন অন্নহীন, বস্ত্রহীন, আশ্রয়হীন, রােগ-ব্যাধিতে কঙ্কালসার, নিরক্ষরতা ও অন্ধ কু-সংস্কারে আচ্ছন্ন পরাধীন ভারতবর্ষকে। তার অন্তর কেঁদে উঠলাে। দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে দেশকে মুক্ত করাকেই তিনি জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করলেন।

বিবেকানন্দ : চিকাগো বক্তৃতার প্রাসঙ্গিকতা

চিকাগো মহাসভায় যোগদান ও ভাষণ :

কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের চারশত বৎসর পূর্তি উপলক্ষ্যে আমেরিকার চিকাগাে শহরে হচ্ছিল এক ধর্মমহাসভার অনুষ্ঠান। ইহুদি, মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ প্রভৃতি ১০টি ধর্মের প্রতিনিধিরা সেই মহাসভায় নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। ভারত থেকে হিন্দুধর্মের কোন প্রতিনিধিকে নিমন্ত্রণ জানানাে হয়নি। বিবেকানন্দ তাঁর শিষ্য ও বন্ধুদের অনুরােধে একরকম রবাহূতভাবেই সেই ধর্মসভায় যােগ দিলেন। ১৮৯৩-এর
যােগদান ও ভাষণ। ১১ সেপ্টেম্বর এই সভা আরম্ভ হয়, শেষ হয় ২৭ সেপ্টেম্বর। প্রথম দিনের এবং শেষ দিনের বিদায়ী ভাষণ নিয়ে মােট ছয়টি ভাষণ বিবেকানন্দ দিয়েছিলেন। প্রথম দিনের তিন মিনিটের ভাষণে স্বামীজী যখন তার পরিচিত দৃপ্ত ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে বললেন “Sisters and brothers of America’ তখনই বলা যায় এই অশ্রুতপূর্ব আন্তরিক সম্বােধনের দ্বারাই একটি পরাধীন দেশের একজন অপরিজ্ঞাত সন্ন্যাসী বিশ্ববিজয়ী মহানায়কে পরিণত হলেন। চার হাজার শ্রোতা নিমেষে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেল। বিবেকানন্দ বলেছেন, প্রেম অসম্ভবকে সম্ভব করে। সেদিনের মহাসভায় তিনি সেই প্রেমের বাণীর স্পর্শে অসম্ভবকেই সম্ভব করেছিলেন। সেই ভাষণে তিনি বলেছিলেন— ‘আমরা কেবলমাত্র বিশ্বজনীন সহনশীলতাতেই বিশ্বাস করি না, আমরা সব ধর্মকেই সত্য বলে গ্রহণ করি

বিবেকানন্দ : চিকাগো বক্তৃতার প্রাসঙ্গিকতা

ভাষণের তাৎপর্য ও প্রভাব :

এই ‘সহনশীলতা এবং গ্রহণ ক্ষমতার কথা বলে বিবেকানন্দ সেদিন হিন্দুধর্মের উদারতা ও শ্রেষ্ঠত্বের কথাই বলেছিলেন। সব ধর্ম যখন নিজেকে সত্য বলে ঘােষণা করছে, স্বামীজী বললেন, সব ধর্মই সমান সত্য। বিবেকানন্দের এই ভাষণ যেন শুধুমাত্র ভাষণ নয়, এ ছিল ধর্মবিদ্বেষে রক্তাক্ত পরস্পর বিবদমান বিশ্বমানবের কাছে দূরদর্শী ঋষির এক অমােঘ শান্তিবাণী।বিশ্বজনীনতা এবং বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণী এই আমরা প্রথম তার কাছেই শুনলাম। তিনি জেহাদ ঘােষণা করলেন সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামি এবং ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে।
মহাসভায় তৃতীয় দিনের ভাষণে স্বামীজী বিশ্বমানবকে ডেকে বললেন ‘মর্ত্যভূমির দেবতা তােমরা! তােমরা পাপী, মানুষকে পাপী বলাই মহাপাপ’।

  বিখ্যাত দার্শনিক উইলিয়ম আর্নেস্ট হকিং তাঁর আত্মকথায় লিখেছেন, বিবেকানন্দের এ কথা শুনে তার সমস্ত সত্তা যেন বজ্রাহত হয়ে গেল। এমন অপূর্ব, অসম্ভব কথা তারা কখনও শােনেননি। মহাসম্মেলনের
শেষ দিনে বিদায়ী ভাষণে স্বামীজী বললেন, খ্রীষ্টানকে হিন্দু বৌদ্ধ হতে হবে না, অথবা হিন্দু ও বৌদ্ধকে খ্রীষ্টান হতে হবে না; কিন্তু প্রত্যেক ধর্মই অন্যান্য ধর্মের সারভাগগুলি গ্রহণ করে পুষ্টিলাভ করবে এবং স্বকীয় বিশেষত্ব বজায় রেখে নিজ প্রকৃতি অনুসারে বর্ধিত হবে। অর্থাৎ বৈচিত্র্য সত্ত্বেও সর্বধর্ম সমন্বয় সম্ভব হবে। ঐ ঐক্যসূত্রই হবে সকলের ধারক। সব ধর্মের পতাকার উপর লিখিত হবে—বিবাদ নয় সহায়তা, বিনাশ নয়, পরস্পরের ভাব গ্রহণ; মতবিরােধ নয়, সমন্বয় ও শান্তি। চিকাগাে মহাসভার শতবর্ষ অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু মহাঋষির মহাবাণীর ঐতিহাসিক তাৎপর্য ও আধুনিক জীবনে তার প্রাসঙ্গিকতা যে অপরিহার্য তা আমরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারি।

বিবেকানন্দ : চিকাগো বক্তৃতার প্রাসঙ্গিকতা

প্রত্যাবর্তন :

ধর্ম সম্মেলনের শেষে আমেরিকা ইউরােপ ভ্রমণ করে অস্ত্র নয়, সৈন্যদল নয়, শুধুমাত্র মেধা ও মৈত্রীর বাণীতে বিশ্ববিজয় সেরে স্বামীজী ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ফিরলে তাকে বিপুল সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। এরপর তিনি রামকৃষ্ণভক্তদের
প্রত্যাবর্তন নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘রামকৃষ্ণ মিশন’ এবং গঙ্গার পশ্চিমতীরে বেলুড় মঠ। ইউরােপ ভ্রমণকালে দেখা পেয়ে ছিলেন মিস্ মার্গারেট নােবেলের। ইনিই পরে তার শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতা। ভারতসেবার জন্য কবিগুরুর কাছে তিনি আখ্যা পান ‘লােকমাতা’।

তিরােধান :

কঠোর পরিশ্রমের শ্রান্ত ক্লান্ত সন্ন্যাসী চিরবিশ্রাম লাভ করলেন ১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুলাই। বিবেকানন্দ নেই কিন্তু তার জ্যোতির্ময় জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, তীক্ষ্ণ ধীশক্তি ও মননের পরিচয় রয়েছে তার অজস্র
বক্তৃতা এবং রচনার মধ্যে। ‘রাজযােগ’ ‘ভক্তিযােগ’ ‘প্রাচ্য পাশ্চাত্য, বর্তমান ভারত’ প্রভৃতি তার অবিস্মরণীয় গ্রন্থ।

বর্তমান সময়ে বিবেকানন্দের বাণীর প্রাসঙ্গিকতা :

হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীকে বিবেকানন্দ শুনিয়েছিলেন শান্তির বাণী, হীন পতিত মানুষের বুকে সঞ্চারিত করেছিলেন অমৃতময়ী আশা আর স্বদেশবাসীকে ডেকে বলেছিলেন
— হে ভারত ভুলিও না— নীচ জাতি, মূর্খ , দরিদ্র, অজ্ঞ,
       মুচি, মেথর, তােমার রক্ত, তােমার ভাই।
প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মিলন সম্বন্ধে আমাদের আশা একদিন
সত্যেন্দ্রনাথের কবিতায় রূপ পেয়েছিল—
      “বীর সন্ন্যাসী বিবেকের বাণী ছুটেছে জগৎময়’
        বাঙালির ছেলে ব্যাঘ্রে বৃষভে ঘটাবে সমন্বয়। “


মূল্যায়ণ :  চিকাগাে মহাসভার একশত বৎসরের উপান্তে দাঁড়িয়ে আমরা কি আর একবার সে আশা করতে পারি না? আজকের যুযুধান বিশ্বকে দেবার মত ভারতের কি কিছুই অবশিষ্ট নেই? স্বামীজী-ই তাে বলেছিলেন “The Voice of India has been the voice of religion.” ভারতবর্ষের এই ধর্মবাণী তার বেদান্তের বাণী মানবতার বাণী; এই বাণীই ভারত বিশ্বকে দিতে পারে। এই বাণীর মূর্ত বিগ্রহ স্বামী বিবেকানন্দ। মনীষী রােমাঁ রােলাঁকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন— ” If you want to know India, you read Vivekananda “ মনে হয় আজ আমাদের প্রতিটি শান্তিকামী মানুষের উচিত এই মহাপুরুষের জীবনচরিত পাঠ করা, তার কর্মধারাকে জানা, তাঁর প্রদর্শিত পথে চলা। তাহলে মানুষের মুক্তি সম্ভব হতে পারে।