
রূপনারানের কূলে| উচ্চমাধ্যমিক বাংলা|Hs Bengali Questions and Answers
Q. ‘রূপনারানের কূলে’ কবিতায় কবি রবীন্দ্রনাথ জীবনসায়াহ্নে উপনীত হয়ে যা উপলদ্ধি করেছেন, তা নিজের ভাষায় লেখাে।
Ans: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থের ১১ সংখ্যক কবিতা ‘রূপনারানের কূলে’- তে কবি তাঁর পরিণত বয়সের জীবনদর্শনের এক অসামান্য প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
প্রকৃতস্বরূপ : কবিতাটিতে দেখা যায়, স্বপ্নের জগৎ থেকে কবি ফিরে এসেছেন মাটি ও মানুষের টানে। আঘাতে-সংঘাতে-বেদনায় তিনি উপলদ্ধি করেছেন নিজের প্রকৃত স্বরূপ, যা প্রকৃতপক্ষে মানবচেতনার যথাযথ রূপ। মানবজীবন কল্পনাবিলাসের কোমল মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা কোনাে অসম্ভব বা অবাস্তবের প্রকাশ এ নয়। কঠোর সত্যের মুখােমুখি দাঁড়ানাের মধ্য দিয়েই মানবজীবন সার্থকতা লাভ করে।
দুঃখের তপস্যা : এই সত্যের স্বরূপ এটাই যে, তাতে জীবনের গতিশীলতা প্রকাশ পায়। কবির কথায় আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা হল এই জীবন। তাকে অস্বীকার করে রঙিন স্বপ্ন কল্পনার জগতে আশ্রয় নেওয়ার মধ্যে জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ইতি কথা : রানি চন্দকে রবীন্দ্রনাথ এই কবিতা প্রসঙ্গে বলেছিলেন—“সত্য কঠিন—অনেক দুঃখ, দাবি নিয়ে আসে। স্বপ্নে তা তাে থাকে নাচ কিন্তু তবুও আমরা সেই কঠিনকেই ভালােবাসি। ভালােবাসি সেই কঠিনের জন্য সবকিছু দুঃসহ কাজ করতে।” এভাবেই আলােচ্য কবিতাটিতেও এই জীবনের প্রকৃত স্বরূপটি চিনে নেওয়ার কথা বলেছেন কবি। ‘রূপনারানের কূলে’ এভাবেই তিনি সত্য ও জীবনের সন্ধান করেছেন।
Q. “রূপ নারানের কূলে/জেগে উঠিলাম”- কবির এই জেগে ওঠার তাৎপর্য আলােচনা করাে।
Ans: কথামুখ : রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থের ১১ সংখ্যক কবিতা ‘রূপনারানের কূলে’-তে জীবনের মধ্য থেকেই জীবনকে উপলখির কথা বলেছেন। রূপনারান’ শব্দটি এখানে কোনাে বিশেষ নদীকে বােঝাতে নয়, এই প্রবহমান জীবনকালকে বােঝাতেই তা ব্যবহৃত হয়েছে। কবির অনুভব : জীবন-সায়াহ্নে উপনীত হয়ে কবি অনুভব করেছেন, এই জগৎ শুধুই স্বপ্ন নয়, বরং আঘাত ও বেদনার মধ্য দিয়ে জীবনের বিকাশই প্রকৃত সত্য। আঘাতে-বেদনায়, রক্তের অক্ষরে অর্থাৎ অজস্র সামাজিক ও রাজনৈতিক সংঘাতের মধ্য দিয়ে এই সত্যকে উপলব্ধি করেছেন কবি। সে সত্য কঠিন, দ্বন্দ্বমুখর, কিন্তু সেই কঠিনকেই কবি ভালােবাসতে চেয়েছেন। কারণ কবির কথায়, “সেইখানেই প্রাণের গতি।” অন্য একটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-
“সপ্ত সিন্ধু দশ দিগন্ত
নাচাও যে ঝংকারে,
আরাম হতে ছিন্ন করে
সেই গভীরে লও গাে মােরে
অশান্তির অন্তরে যেথায়
শান্তি সুমহান।”
সত্যের মূল্য : জীবন মানে কবির কাছে আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা। এই দুঃখের তপস্যার উদ্দেশ্য আসলে সত্যের মূল্য দিয়ে জীবনের সমস্ত দেনা শােধ করে দেওয়া। তারপরেই মৃত্যুতে নিজেকে নিশ্চিন্তে সমর্পণ করে দেওয়া সম্ভব। এইভাবেই রবীন্দ্রনাথ অলীক কল্পনা বা ভাবের জগৎ থেকে দুঃখ-আঘাত-সংঘাত মুখর বাস্তব পৃথিবীতেই মানবের মুক্তি প্রত্যক্ষ করেছেন। শেষের কথা: জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছে কবি মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও মানবসংসারের তীরেই নিজের আশ্রয় খুঁজেছেন। ‘রূপনারানের কূলে’ জেগে ওঠা আসলে সেই সন্ধানেরই কাহিনি।
রূপনারানের কূলে – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
Q. “রক্তের অক্ষরে দেখিলাম/আপনার রূপ,”- এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে কবি কী বােঝাতে চেয়েছেন?
Ans: ভূমিকা : শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থের ১১ সংখ্যক কবিতা ‘রূপনারানের কূলে’ কবিতায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের শেষ বেলায় পৌছে জীবন তথা নিজের প্রকৃত স্বরূপটি উপলব্ধি করতে চেয়েছেন। এই কবিতাটি রচনার কিছুদিন আগে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন সভ্যতার সংকট প্রবন্ধটি। এই প্রবন্ধেরই উপসংহারে তিনি লেখেন一
“নরলােকে বাজে জয়ডঙ্ক,
এল মহাজন্মের লগ্ন।
আজি অমারাত্রির দুর্গতােরণ যত
ধূলি তলে হয়ে গেল ভগ্ন।”
জীবনের যথার্থ স্বরূপ উপলদ্ধি : ‘রূপনারানের কূলে’ অর্থাৎ জীবনকালের শেষপ্রান্তে যখন উপনীত হন কবি, তখন তিনি স্বপ্নের মায়া থেকে সরে আসেন—আর তখনই জীবন ও জগতের যথার্থ স্বরূপ তার চোখে ধরা পড়ে। মূল সত্য : এ জীবন আঘাত-সংঘাতে পূর্ণ। দ্বন্দ্বময় বাস্তবজগতে অজস্র সামাজিক ও রাজনৈতিক সংঘাতের মধ্য দিয়েই জীবনের যে বিকাশ—সেটাই সত্য। মায়া, ছলনা বা প্রবঞ্চনার ফাদ অতিক্রম করেই মানুষ উপলদ্ধি করতে পারে জীবনের যথার্থ স্বরূপ, এই রূপময় বিশ্বের প্রকৃত পরিচয়। জীবনের যে স্বাভাবিক গতি বা বিকাশ, তাকে কল্পনা বা স্বপ্নবিলাসের দ্বারা উপলখি করা যায় না। প্রকৃত সত্য কঠিন হলেও কবি তাকেই গ্রহণ করেছেন, কারণ সেখানে বঞ্চিত হওয়ার কোনাে সম্ভাবনা থাকে না। মানবচেতনার স্বরূপ : ‘রক্তের অক্ষরে’ অর্থাৎ যন্ত্রণার পথ ধরে এই গতিশীল অথচ কঠিন জীবনকেই কবি দেখতে চান। ‘আপনার রূপ’ বলতে কবি আসলে মানবাত্মার বা মানবচেতনা যথার্থ স্বরূপকেই বােঝাতে চেয়েছেন।
Q. “জানিলাম এ জগৎ/ স্বপ্ন নয়।” কবির এই মন্তব্যের তাৎপর্য লেখাে।
Ans: শুরুর কথন: শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থের ১১ সংখ্যক কবিতা ‘রূপনারানের কূলে’-তে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছে জীবনকে নতুনভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছেন। জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন一
“আমি পৃথিবীর কবি, যেথা তার যত ওঠে ধ্বনি
আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি।”
জীবনের যথার্থতা: আলােচ্য কবিতাটিতেও কবির এই মাটির পৃথিবীতে থাকার ইচ্ছাই প্রকাশিত হয়েছে। স্বপ্ন ও কল্পনার মায়া-আবরণকে দূরে সরিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে জগৎকে দেখেছেন তা আঘাত-সংঘাতমুখর, বেদনায় কাতর। সেখানে প্রতিদিনের ব্যক্তিগত জীবনের হতাশা, যন্ত্রণা, নানা সামাজিক এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ইত্যাদির মধ্য দিয়েই জীবনের যথার্থ পরিচয় পাওয়া যায়।
প্রকৃত সত্য: এই জীবন স্বপ্নের রঙে রঙিন নয়, রক্তের অক্ষরেই এর যথার্থ পরিচয়। তাই কবি উপলব্ধি করেছেন এ জীবনে ‘দুঃখের তপস্যা’ই সত্য, কিন্তু তার মধ্য দিয়েই ঘটবে জীবনের বিকাশ। এই সত্য হল জীবনের যথাযথ তাৎপর্য বুঝতে শেখা। মানুষের ধর্ম প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—তাই বিরাটকে বলি রুদ্র, তিনি মুক্তির দিকে আকর্ষণ করেন দুঃখের পথে।” জীবন দুঃখময়, কিন্তু তার মধ্য দিয়েই মানুষের চেতনার বিকাশ ঘটে। তখনই মানুষ জীবনের প্রকৃত ধর্মকে অনুভব করতে পারে।
ইতিকথা: তাই স্বপ্নবিলাসিতায় নয়, দুঃখের তরঙ্গমুখরতার মাঝেই জীবনের ‘সত্য’-কে খুঁজে পাওয়া যায়।
রূপনারানের কূলে – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
Q. “চিনিলাম আপনারে”—কে, কখন, কীভাবে নিজেকে চিনেছেন? এর ফলে তার মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা নিজের ভাষায় লেখাে।
Ans: আপন স্বরূপকে চেনা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘রূপনারানের কূলে’ কবিতায় প্রশ্নোদ্ধৃত মন্তব্যটি করেছেন। ‘রূপনারানের কূলে’ অর্থাৎ জীবনকালের শেষপ্রান্তে জেগে উঠে কবি তাঁর কল্পনার জগতের সঙ্গে বাস্তব পৃথিবীর কোনাে সাদৃশ্যই খুঁজে পাননি। “জানিলাম এ জগৎ/স্বপ্ন নয়”- বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে এটাই কবির উপলদ্ধি। আঘাত-সংঘাতের মধ্য দিয়েই যে জীবনের বিকাশ, তা কবি স্পষ্ট উপলদ্ধি করেছেন। সামাজিক ও রাজনৈতিক নানান সংঘাতের মধ্য দিয়েই যে সভ্যতার বিকাশ, জীবনের প্রতিক্ষেত্রের যে টানাপােড়েন ও রক্তক্ষরণ, কবি তাকে ‘সত্য’ বলে উপলদ্ধি করেছেন এবং এভাবেই তিনি নিজের স্বরূপ চিনতে পেরেছেন।
কবির প্রতিক্রিয়া : ‘রক্তের অক্ষরে’ কবি নিজেকে চিনতে পেরেছিলেন আঘাতে-বেদনায়। আর তখনই কবির উপলদ্ধি হয়েছিল যে সত্যের প্রকৃত রূপ অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু তাসত্ত্বেও তিনি সেই কঠিন সত্যকেই ভালােবেসেছেন এই বিশ্বাসে যে, প্রকৃত সত্য কখনও ছলনা করে না, তাই তার দ্বারা বঞ্চিতও হতে হয় না। তাই সত্য ও জীবনের যথার্থ রূপের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করার অঙ্গীকারই এখানে কবির মূল লক্ষ্য হয়ে উঠেছে।
Q. “সত্য যে কঠিন”—এই উপলব্ধিতে কবি কীভাবে উপনীত হলেন তা ‘রূপনারানের কূলে’ কবিতা অবলম্বনে লেখাে | ‘রূপনারানের কূলে’ অবলম্বনে কবির উপলব্ধি নিজের ভাষায় লেখাে।
Ans: কথামুখ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবন-সায়াহ্নে এসে এক অনন্য জীবনদর্শনের মুখােমুখি হয়েছেন। আর সেই জীবনদর্শনের কথাই আলােচ্য ‘রূপনারানের কূলে’ কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে।
সত্যের প্রকৃত মূল্য: স্বপ্নময় কাব্যের জগতের কবি এসে পৌঁছেছেন রুক্ষ গদ্যময় জীবনের পটভূমিতে। আলােচ্য কবিতায় কবি সত্যের মূল্যকে নতুনভাবে উপলব্ধি করেছেন। কবিরা যে কল্পনার দাসত্ব করেন, সেই স্বপ্ন কল্পনার জগৎ সত্য নয়। সত্যের যথার্থ স্বরূপকে খুঁজে নিতে হয় আঘাত-সংঘাতমুখর জনসমাজের মধ্য থেকেই। সেখানে ‘রক্তের অক্ষরে’ অর্থাৎ সংঘর্ষ আর রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে নিজের ব্যক্তিসত্তার নির্মাণ কবি লক্ষ করেন।
জীবনের আসল রূপ: জীবনের গতি কখনও সরলরেখায় চলে না। দুঃখ, বেদনাবােধ আর অপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে জীবন এগিয়ে চলে। সেখানে ‘আঘাতে আঘাতে/বেদনায় বেদনায়’ নিজেকে চেনা যায়। কল্পনার মায়ালােক ক্ষণিকের, তা সাময়িকভাবে আনন্দ দিতে পারে; কিন্তু এই মােহের আবরণ ছিড়ে গেলে বােঝা যায় জীবন আসলে কল্পনানির্ভর নয়।
বিশ্বসংসারের প্রকৃত রূপ: যখনই মানুষ কল্পনা বা স্বপ্নময়তাকে অতিক্রম করতে পারে, তখনই রূপময় বিশ্বের প্রকৃত রূপ তার কাছে স্পষ্ট হয়। সেখানে দ্বন্দ্ব সংঘাত, বেদনা-রক্তাক্ততা যতই থাকুক, সেটাই জীবনের যথার্থ রূপ এবং এটাই সত্যেরও স্বরূপ। সত্য তাই কবির কাছে কঠিন বলেই উপলব্ধ হয়।
রূপনারানের কূলে – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

Q. “সত্য যে কঠিন, / কঠিনেরে ভালোবাসিলাম,”—কবির কাছে ‘সত্য’র যে ধারণা প্রকাশিত হয়েছে তা নিজের ভাষায় প্রকাশ করাে।
Ans: শুরুর কথা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পরে প্রকাশিত শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থের ১১ সংখ্যক কবিতায় দেখা যায়, ‘রূপনারানের কূলে’ অর্থাৎ রূপময়, প্রবহমান জীবনের শেষপ্রান্তে এসে কবি জেগে উঠেছে। সেই জগতের মধ্যে কোনাে মায়াস্বপ্ন বা কল্পনাকে তিনি খুঁজে পাননি। পরিবর্তে তিনি এসে দাঁড়িয়েছেন আঘাত─সংঘাতমুখর বাস্তব জনজীবনে।
সত্য অভিজ্ঞতা: জীবনের অজস্র বেদনা এবং রক্তপাতকে কবি এখানে প্রত্যক্ষ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতাকেই কবি সত্য বলে মনে করেছেন। আত্মপরিচয়’-এ রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন─ “সত্যের লক্ষণই এই যে, সমস্তই তার মধ্যে এসে মেলে।…তাই সত্যের প্রতি শ্রদ্ধা করে পৃথিবীটি বস্তুত যেমন, অর্থাৎ নানা অসমান অংশে বিভক্ত, তাকে তেমনি করেই জানবার সাহস থাকা চাই।”
সত্যের প্রতি ভালােবাসা: আলােচ্য কবিতাটিতেও সত্যের এই কঠিন স্বরূপকে প্রত্যক্ষ করে রবীন্দ্রনাথ তাকেই ভালােবেসেছেন। কারণ তার ভাবনায় সত্য কখনও বঞ্চনা বা ছলনা করে না। কবির কাছে জীবন আসলে দুঃখের তপস্যা। কিন্তু তা এই সত্যের মূল্য শােধ করার জন্যই।
সত্যই জীবনের যথার্থতা: কল্পনা বা স্বপ্নবিলাসের দ্বারা জীবনের এই সত্যকে এড়িয়ে যাওয়ার অর্থ জীবনের স্বাভাবিক গতিকে ও তার যথার্থ স্বরূপকে অস্বীকার করা। অন্যদিকে, কঠিন সত্য জীবনের যথার্থ স্বরূপকে চিনিয়ে দেয়।
আরও দেখুন : শিকার – জীবনানন্দ দাশ
Q. “আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন,”—কেন কবি এই জীবনকে দুঃখের তপস্যা বলেছেন? এখানে কবির মনােভাবে বিবর্তনের যে ছবি পাওয়া যায় তা নিজের ভাষায় লেখাে।
Ans: জীবনকে দুঃখের তপস্যা বলার কারণ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘রূপনারানের কূলে’ কবিতায় জীবনকে ‘আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা’ বলেছেন। কবির কাছে জীবন হল আঘাত সংঘাত, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে সত্যকে উপলদ্ধি করা। সত্যের স্বরূপ অত্যন্ত কঠিন। সুখ এবং আনন্দকে অতিক্রম করে দুঃখের নির্মমতায় তার বিস্তার। সত্যকে পাওয়ার জন্য মানুষের যে সাধনা, তা অত্যন্ত কঠিন। তাকে উপলব্ধি করার জন্য কল্পনার সৌধ থেকে নেমে আসতে হয় বাস্তবের অমসৃণ জমিতে। ‘রক্তের অক্ষরে’ নিজের রূপ দেখতে পাওয়া যায়, নিজেকে চিনতে পারা যায় আঘাতে-বেদনায়। জীবনের সায়াহ্নে পৌঁছে কবি সত্যের যে কঠিন স্বরূপ, তা চিনতে পারেন এবং সেই কঠিনকেই তিনি ভালােবাসেন। কারণ, সত্য কখনও বঞ্চনা করে না। সত্যের প্রতি এই আকর্ষণ এবং তার স্বরূপের যথার্থ উপলব্ধি থেকেই কবির মনে হয় জীবন হল ‘আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা’।
কবিমনের বিবর্তনের ছবি : সত্যের যে উপলদ্ধিতে কবি পৌঁছেছেন তা আসলে কবিমনের এক স্পষ্ট বিবর্তনের ইঙ্গিত-কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবের বুক্ষ জমিতে নেমে আসা। কবিতার সূচনাতেই তাই কবি লিখেছেন “রপনারানের কুলে/জেগে উঠিলাম,/জানিলাম এ জগৎ/স্বপ্ন নয়।” ‘রূপনারানের কুলে’ অর্থাৎ রুপময়, প্রবহমান জীবনকালের প্রান্তে উপনীত হয়ে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীর রূপ দেখে অশীতিপর কবি তাই নিরাবরণ, প্রত্যক্ষীভূত ও অনিবার্য সত্যকে ভালােবেসে গ্রহণ করেছেন। ত্যাগ করেছেন স্বপ্নচারিতাকে। কল্পনা থেকে সত্যের পথে কবিচেতনার বিবর্তন এভাবেই ফুটে উঠেছে।
রূপনারানের কূলে – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
Q. “মৃত্যুতে সকল দেনা শােধ করে দিতে।”- কোন দেনা শােধের কথা বলা হয়েছে কবিতাটি অবলম্বনে আলােচনা করাে।
Ans: প্রাক্কথন: শেষ লেখা কাব্যগ্রন্থের ১১ সংখ্যক কবিতা ‘রূপনারানের কূলে’-তে রবীন্দ্রনাথের আত্মােপলদ্ধির প্রকাশ ঘটেছে। ‘রূপনারানের কূলে’ প্রকৃত জীবনবােধে জেগে ওঠায় কবির পরিণত উপলব্ধি এই যে, জগৎ স্বপ্ন নয়, রক্তের অক্ষরে অর্থাৎ বাস্তবজগতের অজস্র সংঘাত বেদনার মধ্য দিয়েই জীবনের প্রকৃত স্বরূপকে চেনা যায়।
জীবনের দেনা শােধ: জীবনের সঙ্গে মানুষের এই পরিচয়ই ‘সত্য’ পরিচয়, এই পথই জীবনের ‘সত্যকে উপলদ্ধি এবং আবিষ্কার করার একমাত্র উপায়। রানি চন্দকে এই কবিতা লেখার প্রেক্ষাপট বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—“সত্য কঠিন—অনেক দুঃখ, দাবি নিয়ে আসে। স্বপ্নে তা তাে থাকে নাচ কিন্তু তবুও আমরা সেই কঠিনকেই ভালােবাসি।” কবির কথায় কঠিনের জন্যই সবসময় দুঃসহ কাজ করতে আমরা তৈরি থাকি- “এমনি করে জীবনের দেনা শােধ করে চলি আমরা।”
কবির বিশ্বাস: কবি বিশ্বাস করেন, প্রকৃতি ও মানবসমাজের কাছে প্রতিটি ব্যক্তিমানুষের যে ঋণ, তা এই জীবনেই শােধ করতে হয়। আঘাত ও বেদনাকে সহ্য করেও সত্যের দিকে এগিয়ে চলাই হল জীবনের যথার্থ ধর্ম। সত্যকে পাওয়ার জন্য মানুষের দুঃখের তপস্যায় বা কঠিন সাধনা আসলে সত্যের দারুণ মূল্যকে শােধ করে দেওয়ার জন্য। এই সত্যকে যেহেতু সবসময়ই উপলব্ধি করতে হয়, তাই মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্ত পর্যন্ত চলে মানুষের এই কঠোর সাধনা, জীবনের যথার্থ স্বরূপকে চিনতে পারার কঠিনতম প্রয়াস।
ইতিকথা: মৃত্যুতে সকল দেনা শােধ করে দেওয়ার অর্থ জীবনের কাছে সত্যের যে দাবি, তা সম্পূর্ণ করা। এভাবেই কল্পনা ও স্বপ্নের জগৎ ত্যাগ করে দ্বন্দ্বমুখর জীবনের প্রতিই কবি নিজের পক্ষপাত প্রকাশ করেছেন।
You must be logged in to post a comment.