শিকার,জীবনানন্দ দাশ

শিকার|জীবনানন্দ দাশ|HS Bengali Question And Answers| উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রশ্নোত্তর

শিকার -জীবনানন্দ দাশ Q. জীবনানন্দ দাশের ‘শিকার’ কবিতায় যে নির্মম সত্যের প্রকাশ ঘটেছে তা নিজের ভাষায় লেখাে ? “শিকার” কবিতায় ভােরের মনােরম বর্ণনার সঙ্গে আছে নির্মম হত্যা বর্ণনা করাে।

Ans: জীবনানন্দ দাশ মহাপৃথিবী কাব্যগ্রন্থের ‘শিকার’ কবিতায় তথাকথিত সভ্যসমাজের ছবি তুলে ধরেছেন।

তথাকথিত সভ্যসমাজের প্রতিনিধি : মুখে সিগারেটের ধোঁয়া, টেরিকাটা মাথা, হাতে বন্দুক নিয়ে মানুষেরা তাদের নির্মমতার প্রকাশ ঘটায়। সারারাত চিতাবাঘিনির হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে একটি বাদামি হরিণ ভােরবেলা বেঁচে থাকার তাগিদে কচি বাতাবিলেবুর মতাে সবুজ সুগন্ধি ঘাস ছিড়ে খায়।

প্রকৃতির বুকে সভ্যসমাজের নৃশংসতা প্রয়ােগ : এরপর যখন ক্লান্ত শরীরটাকে সে নদীর জলে এলিয়ে দেয়, ঠিক তখনই একটা অদ্ভুত শব্দ হয়। নির্মল প্রকৃতির বুকে বন্দুকের গুলির এই শব্দ হয়ে ওঠে বাদামি হরিণের মৃত্যুর শব্দ। হরিণের এই ট্র্যাজিক পরিণতি ঘটে মানুষের হাতে। ধোঁয়া সেবনকারী, টেরিকাটা মানুষের দল তাদের রসনাতৃপ্তির জন্য বন্দুকের গুলিতে সৌন্দর্যের প্রতীক হরিণকে বিদ্ধ করে। জীবনসংগ্রামে হরিণটিও বাঁচতে চেয়েছিল। ভাের হলে যখন সে ভাবছিল চিতাবাঘিনির’ ভয় আর নেই, ঠিক তখনই তথাকথিত সভ্য মানুষের হাতে ঘটল তার জীবনের করুণ পরিণতি।

অন্ধ মানবসভ্যতার বিকৃত ইচ্ছা : অন্ধ মানবসভ্যতার বিকৃত ইচ্ছার বলি হতে হল হরিণটিকে। যাদের উচিত ছিল হরিণটিকে রক্ষা করা, তারাই তার মৃত্যুর কারণ হল।

ইতিকথা : ‘শিকার’ কবিতাটিতে তথাকথিত সভ্য মানুষের চেতনায় আঘাত করতে চেয়েছেন কবি। আলােচ্য কবিতায় জীবনানন্দ দাশ মানুষের চেতনাহীনতার এই নির্মম সত্যকেই তুলে ধরেছেন।

Q. ‘শিকার’ কবিতায় কবি জীবনানন্দ দাশের যে মানসিক বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটেছে তা আলােচনা করাে।

Ans: ‘শিকার’ কবিতায় কবি জীবনানন্দ দাশ মানবসভ্যতার স্বার্থপরতা, কুটিলতা এবং নৃশংসতাকে তুলে ধরেছেন।

অভিজ্ঞতার প্রতিফলক : ব্যক্তিগতভাবে তিনি বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পৃথিবীতে মানুষের নির্মমতা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবে তার কবিতায় এই অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটেছে।

প্রকৃতিপ্রেমিক : প্রকৃতিপ্রীতিকে কোনো অবস্থাতেই বিসর্জন দেননি তিনি, বরং বক্তব্যবিষয়কে তুলে ধরার জন্য প্রকৃতির নানা উপাদানের মধ্যেই তিনি উপমা প্রয়ােগ করেছেন। যেমন- “কচি বাতাবিলেবুর মক্তো সবুজ সুগন্ধি ঘাস ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছে।”

চিত্রকল্প ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত : জীবনানন্দ দাশের অন্যতম কাব্যবৈশিষ্ট্য হল চিত্ররূপময়তা। অপূর্ব সব চিত্রকল্প তিনি রচনা করেছেন ‘শিকার কবিতায়। তিনি এই কবিতায় নিরাশাবাদী নন, কারণ কবিতার সূচনাতেই ভাের শব্দটি দুবার প্রয়ােগ করে কবি আশাজনক জীবনের কথা বলেছেন। আলােচ্য কবিতায় তার উপস্থাপনাটি নাটকীয়। ভােরের দৃশ্যটি ঘটনাবিরল, উপমার পর উপমা সাজিয়ে ভােরের চিত্রটিকে স্পষ্ট করে তুলেছেন কবি। আকাশের রং ঘাসফড়িঙের দেহের মতাে কোমল নীল, পেয়ারা ও নােনার গাছ টিয়াপাখির পালকের মতাে সবুজ।

আবেগ ও উৎকণ্ঠার বহিঃপ্রকাশ : কবির প্রবল উৎকণ্ঠা এবং আবেগের সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে কবিতার বাস্তব পটভূমি, যেখানে প্রকৃতি স্বাভাবিক ও সুন্দর কিন্তু মানুষ হৃদয়হীন ও যান্ত্রিক।

শিকার|জীবনানন্দ দাশ|HS Bengali Question And Answers| উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রশ্নোত্তর

Q. ‘শিকার’ কবিতায় ‘ভাের’ শব্দটি কীভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে ?

অথবা, ‘শিকার’ কবিতায় যে দুটি ভােরের চিত্র আছে তার তাৎপর্য বিশ্লেষণ করাে।

অথবা, শিকার কবিতায় ভােরের পরিবেশ যেভাবে চিত্রিত হয়েছে, তা নিজের ভাষায় লেখাে। সেই পরিবেশ কোন্ ঘটনায় করুণ হয়ে উঠল? 

অথবা, ভাের এই শব্দটিই যেন শিকার কবিতার দুটি অংশে প্রবেশের দুটি চাবি; যা এই কবিতার শুরুতে এবং মাঝে উচ্চারিত হয়েছে।- শিকার কবিতার বিষয়বস্তু আলােচনা করে উদ্ধৃত বক্তব্যটি বিশ্লেষণ করাে। 

অথবা, শিকার কবিতায় ভােরের পরিবেশ যেভাবে চিত্রিত হয়েছে, তা নিজের ভাষায় লেখাে। সেই পরিবেশ কোন্ ঘটনায় করুণ হয়ে উঠল? 

Ans: জীবনানন্দ দাশ তাঁর মহাপৃথিবী কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া ‘শিকার কবিতায় রাত্রিশেষে ‘ভাের’ হওয়ার ঘটনাকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে ব্যবহার করেছেন।

প্রথম ভােরের বর্ণনা : কবিতার প্রথম অংশে ‘ভাের’ যেন নির্মল প্রকৃতির আত্মপ্রকাশের উপযুক্ত পটভূমি। তখন আকাশের রং ‘ঘাসফড়িঙের দেহের মতাে কোমল নীল’, চারদিকের পেয়ারা ও নােনার গাছের রং ‘টিয়ার পালকের মতাে সবুজ’। সেই ভােরেই আকাশে জেগে থাকা একমাত্র তারাটি কবির মনে বিপরীত অনুভবের ভালাে লাগা তৈরি করে। এই ভােরেই অল্পপ্রাণ শালিকের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছার মতাে স্নান হয়ে যায় হিমের রাতে দেশােয়ালিদের জ্বালানাে আগুনের শিখা। সকালের আলােয় টলমল শিশিরে ঝিলমিল করে ওঠে চারপাশের বন ও আকাশ।

দ্বিতীয় ভােরের বর্ণনা : এই ভােরের পটভূমিতেই কবিতায় আগমন ঘটে একটি ‘সুন্দর বাদামি’ হরিণের। তার কচি বাতাবিলেবুর মতাে সবুজ, সুগন্ধি ঘাস ছিড়ে খাওয়া বা নদীর জলে ঘুমহীন, ক্লান্ত শরীর ভেজানাের মধ্যে দিয়ে জীবনের স্বচ্ছন্দ বিচরণকেই প্রত্যক্ষ করা যায়। কিন্তু সুন্দরের এই সহজ প্রকাশকে ছিন্নভিন্ন করে দেয় ‘একটা অদ্ভুত শব্দ’। নদীর জল এরপর মচকাফুলের মতাে লাল হয়ে ওঠে হরিণের রক্তে। শিকারি মানুষের লােভের শিকার হয়ে হরিণটিকে চলে যেতে হয় ‘নিস্পন্দ নিরপরাধ ঘুম’-এর দেশে। তৈরি হয় ‘ভাের’ এর আর-এক ছবি।

উপসংহার : এই ভােরকে প্রকৃতি লালন করেনি; কিংবা সারারাত চিতাবাঘিনির হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে হরিণও এই ভােরের জন্য অপেক্ষা করেনি। মানুষের ক্ষুধার ও হিংস্রতার সাক্ষী হয়ে থাকে এই ভাের।

শিকার,জীবনানন্দ দাশ

Q. শিকার কবিতায় কবির রচনাভঙ্গির যে বিশিষ্টতা প্রকাশ পেয়েছে তা নিজের ভাষায় লেখাে। 

Ans: মহাপৃথিবী কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া শিকার কবিতায় অরণ্যের বুকে মানুষের হরিণশিকার বা অমানবিক আত্মপ্রকাশকে বােঝাতে গিয়ে জীবনানন্দ অসাধারণ রচনাশৈলীর আশ্রয় নিয়েছেন।

চিত্রকল্পের প্রয়ােগ : প্রথমেই লক্ষ করার মতাে বিষয় হল চিত্রকল্পের অসামান্য প্রয়ােগ। “আকাশের রং ঘাসফড়িঙের দেহের মতাে কোমল নীল কিংবা “চারি দিকে পেয়ারা ও নােনার গাছ টিয়ার পালকের মতাে সবুজ”—এ যেন কথা দিয়ে ক্যানভাসে ছবি এঁকেছেন জীবনানন্দ। কখনও চিত্রকল্পেরই বিপরীত ভাবের মিশ্রণ ঘটিয়ে কবিতায় সৌন্দর্য সৃষ্টি করা হয়। ভােরবেলা আকাশে থাকা তারার সঙ্গে কবি মিলিয়ে দেন পাড়াগাঁর বাসরঘরে থাকা ‘গােধূলিমদির মেয়েটি’-কে কিংবা ‘মিশরের মানুষী’-কে যে তার বুকের থেকে মুক্তা নিয়ে রেখেছিল কবির নীল মদের গেলাসে। একদিকে নির্জনতা এবং অন্যদিকে বৈভবের মধ্যে ভোরের একটি মাত্র তারাই যেন ব্যতিক্রমী হয়ে ওঠে।

শব্দসৃষ্টিতে ব্যঞ্জনা : চিত্রকল্পের পাশাপাশি শব্দ সৃষ্টির দ্বারা ব্যঞ্জনা তৈরিতেও জীবনানন্দ অসাধারণ। ‘একটা অদ্ভুত শব্দ’—এখানে শব্দটি যে গুলির তার সরাসরি কোনাে উল্লেখ নেই এবং সেই শব্দ ‘অদ্ভুত’ কারণ নির্মল অরণ্যে তা বেমানান। তারপরেই কবি হরিণের মৃত্যুকে স্পষ্ট করেছেন সংকেতময় ভাষা প্রয়ােগে—“নদীর জল মচকাফুলের পাপড়ির মতাে লাল।”

শেষের কথা : এইভাবে চিত্রকল্প, শব্দ এবং অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সৃষ্টির দক্ষতায় ‘শিকার কবিতাটি কবির অসাধারণ রচনাভঙ্গির পরিচায়ক হয়ে উঠেছে।

শিকার|জীবনানন্দ দাশ|HS Bengali Question And Answers| উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রশ্নোত্তর

Q. সােচ্চারে বলা নেই কোথাও, কিন্তু খেয়াল করলেই বােঝা যায়, কবিতাটির দুটি ভাগ আছে।- শিকার কবিতাটি অবলম্বনে এই মন্তব্যটি বিশ্লেষণ করাে। 

Ans:

জীবনানন্দ দাশের ‘শিকার’ কবিতায় শিকারির হাতে একটি হরিণের মৃত্যু কবিতাটির মূল আলােচ্য বিষয় হলেও তার উপস্থাপনে কবি সমগ্র কবিতাটিকে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন।

প্রথম ভাগ : কবিতার প্রথম অংশে রয়েছে অরণ্যের নির্মল ছবি। ভােরের বর্ণনায় ঘাসফড়িঙের দেহের মতাে কোমল নীল আকাশ, টিয়ার পালকের মতাে সবুজ পেয়ারা ও নােনার গাছের উল্লেখ রয়েছে। আকাশে তখনও একটি তারা জেগেছিল, আর মাঠে জ্বলছিল দেশােয়ালিদের জ্বালানাে শুকনাে অশ্বথপাতায় মােরগফুলের মতাে লাল আগুন। সকালের আলােয় সেই আগুনকে রােগ শালিকের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছার মতাে ম্লান লাগে। বরং সকালের আলােয়। টলমল শিশিরে চারপাশের বন আর আকাশ ‘ময়ূরের সবুজ নীল ডানার মতাে ঝিলমিল’ করে ওঠে।

দ্বিতীয় ভাগ : কবিতার দ্বিতীয় অংশে দেখা যায় অন্য এক ভাের প্রাথমিকভাবে সে ভাের বর্ণনা করে চিতাবাঘিনির হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা এক হরিণের সুন্দর প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকার কাহিনি। ভােরের আলােয় নেমে হরিণীটি কচি বাতাবিলেবুর মতাে সবুজ ও সুগন্ধি ঘাস ছিড়ে খায়, নদীর শীতল জলে গা ভেজায়। কিন্তু একটা ‘অদ্ভুত’ শব্দে নদীর জল হঠাৎ ‘মচকা ফুলের পাপড়ির মতাে লাল’ হয়ে ওঠে। প্রাণবন্ত হরিণটি পরিণত হয় নিষ্প্রাণ মাংসপিণ্ডেনাগরিক মানুষের ক্ষুধার দাবি এবং বিকৃত আনন্দ মেটাতে।

উপসংহার : এইভাবে একই ভােরের দুই বিপরীত দৃশ্য—একদিকে সুন্দরের জেগে ওঠা, অন্যদিকে মানুষের নিষ্ঠুরতায় ‘হিম—নিস্পন্দ নিরপরাধ ঘুম’ এর ছবিকে তুলে ধরেছেন কবি জীবনানন্দ দাশ।

আরও দেখুন : আমার বাংলা (সুভাষ মুখোপাধ্যায়)

Q. শিকার কবিতায় কবি ভােরের প্রকৃতি ও জীবনের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা নিজের ভাষায় লেখাে। 

অথবা, শিকার কবিতায় ভােরের প্রথম পর্যায়ের যে ছবি ফুটে উঠেছে, তা নিজের ভাষায় লেখাে। 

সূচনা : জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘শিকার কবিতায় একটি বাদামি হরিণের হত্যার পটভূমিতে ভােরের এক বিপরীত রূপ তুলে ধরেছেন।

ভোরের আকাশ : ভােরের আকাশের রং ঘাসফড়িঙের দেহের মতাে কোমল নীল। চারদিকের পেয়ারা আর নােনার গাছ টিয়ার পালকের মতাে সবুজ। একটি তারা তখনও আকাশে ছিল। হিমের রাতে শরীর গরম করার জন্য দেশােয়ালিরা রাতে মাঠে যে আগুন জ্বেলেছিল, শুকনাে অশ্বখপাতায় তা তখনও জ্বলছিল।

ভােরের সূর্য : ভােরের সূর্যের আলােয় আগুনের শিখাও তার আগের জ্যোতি হারিয়ে ম্লান হয়ে গিয়েছিল। সকালের আলােয় শিশিরভেজা বন ও আকাশ যেন ময়ূরের সবুজ-নীল ডানার মতাে ঝিলমিল করছিল। সূর্যের প্রথম আলােয় উদ্ভাসিত প্রকৃতির ছবি জীবনানন্দ তুলে ধরেছেন তার কবিতায়।

ভােরের বুকে নৃশংসতা : কিন্তু পরে শিকারির বন্দুকের গুলিতে সুন্দর বাদামি হরিণের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে নৃশংস দৃশ্য তৈরি হয়, তার পটভূমিতে প্রকৃতির এই নির্মল ছবি যেন সেই নৃশংসতাকে আরও নির্মম করে তােলে। এই ঘটনা প্রকৃতির বুকে মানুষের হৃদয়হীনতার স্বরূপকেই প্রকাশ করে। প্রাণবন্ত হরিণের ‘উষ্ম লাল’ মাংসে রূপান্তর, নাগরিক সভ্যতার হাতে প্রকৃতির ধ্বংসের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।

শিকার,জীবনানন্দ দাশ

Q. “একটি তারা এখন আকাশে রয়েছে;”—’এখন’ বলতে কোন সময়ের কথা বােঝানাে হয়েছে? আকাশের তারাকে কেন্দ্র করে কবির ভাবনার যে বিশিষ্টতা প্রকাশিত হয়েছে তা নিজের ভাষায় আলােচনা করাে।

Ans:

রাত্রিশেষে ভােরের আকাশ যখন ঘাস ফড়িংয়ের শরীরের মতাে কোমল নীল হয়ে ওঠে, এখন বলতে কবি সেই সময়টির কথা বলতে চেয়েছেন।

কবিভাবনার বিশিষ্টতা

কথামুখ : জীবনানন্দ দাশের মহাপৃথিবী কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘শিকার’ কবিতাটি রচিত হয়েছে একটি ভাের-এর পটভূমিতে।

আকাশে তারার উপস্থিতি : অন্ধকারের জরায়ু থেকে জন্ম নেওয়া ভােরে যখন আকাশের রং পালটে যায়, পেয়ারা এবং নােনার গাছের সবুজ ফুটে ওঠে—তখনই আকাশে দেখা যায় একটি তারাকে। যেন রাতের বিদায়ী অস্তিত্বকে সে ধারণ করে রাখে। ভােরের এই তারাকে কবি তুলনা করেন ‘পাড়াগাঁর বাসরঘরে সব চেয়ে গােধূলিমদির’ মেয়েটির সঙ্গে। অর্থাৎ, তারাটির উপস্থিতির সঙ্গে কবি গ্রামবাংলার বাসরঘরের মেয়েটির মতাে লজ্জা আর কুণ্ঠাকে তুলনা করেছেন। ‘বাসরঘরে’ আর ‘মদির’ শব্দের ব্যবহারে কবি সেই সলজ্জ স্বভাবকে আরও গভীর করে তােলেন।

তারাটির উপস্থিতির সঙ্গে তুলনা : এরপরেই তারাটির উপস্থিতিকে কবি তুলনা করেন ‘মিশরের মানুষী’ র সঙ্গে, যে হাজার হাজার বছর আগে এক রাতে তার বুকের থেকে মুক্তা নিয়ে রেখেছিল কবির নীল মদের গেলাসে। একটু আগে গ্রাম্য মেয়ের সঙ্গে তুলনায় যে সহজতা ছিল তা ভেঙে যায় ঐতিহাসিক আড়ম্বরে। নীল আকাশের ক্যানভাসে রাত-জাগা তারা আর নীল মদের পাত্রে রাখা মুক্তা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ‘মিশরের মানুষী’ আর ‘হাজার হাজার বছর’ মিলে ছবিটি দেশকালের সীমা অতিক্রম করে চিরকালীন বিস্তৃতি পায়।

ইতিকথা : ভােরের আকাশের তারা কবির চেতনায় অসামান্য শিল্পরূপ লাভ করে। প্রকৃতির যে স্নিগ্ধ, অমলিন পটভূমি তৈরি করা এখানে কবির লক্ষ্য ছিল, ভােরের তারা তাতে যেন এক নতুন মাত্রা যােগ করে।

শিকার -জীবনানন্দ দাশ

Q. “হয়ে গেছে রােগা শালিকের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছার মতাে।”- মন্তব্যটির প্রেক্ষাপট শিকার কবিতাটি অবলম্বনে আলােচনা করাে।

Ans: জীবনানন্দ দাশের মহাপৃথিবীকাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া শিকার কবিতার প্রথম অংশে কবি ভােরের আগমনে প্রকৃতির যে রূপান্তর ঘটে তার বর্ণনা দিয়েছেন।

প্রকৃতি দৃশ্যের পরিবর্তন : সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে আকাশের রং যেমন পালটে যায়, প্রকৃতি হয়ে ওঠে সবুজ—ঠিক সেভাবেই হিমের রাতে দেশােয়ালি মানুষরা তাদের শরীর গরম রাখার জন্য সারারাত মাঠে যে আগুন জেলেছিল- “মােরগযফুলের মতাে লাল আগুন”- সে আগুনও নিভে আসে।

আগুনের রূপের পরিবর্তন : শুকনাে অশ্বখপাতায় সে আগুনের অবশেষ জ্বলতে থাকে, কিন্তু তার তেজ আর রং আগের মতাে থাকে না। কবির কথায়, সূর্যের আলােয় সেই আগুনের রং আর কুকুমের মতাে থাকে না, হয়ে যায় “রােগা শালিকের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছার মতাে।” একটি অসাধারণ উপমানের ব্যবহার করেছেন কবি এখানে, যার সম্পূর্ণটাই আসলে এক অসামান্য চিত্রকল্প।

আগুন ও প্রকৃতির অনুষঙ্গ : রাতের অবসানে আগুন নিভে আসে, সূর্যের আলােয় তা ম্লান হয়ে যায়, আর তাকে কবি মিলিয়ে দেন অল্পপ্রাণ এক শালিকের হৃদয়ের ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া ইচ্ছার সঙ্গে। সামান্য একটি স্পর্শযােগ্য বিষয় এখানে অনুভূতির বিষয় হয়ে ওঠে। আর তার থেকে অনেক দীপ্তিমান হয়ে ওঠে চারদিকের বন ও আকাশ, যা সকালের আলােয় টলমল শিশিরে ময়ূরের সবুজ-নীল ডানার মতাে ঝিলমিল করে।

Q. ‘আগুন জ্বলল আবার’—’শিকার’ কবিতায় উল্লিখিত দু-ধরনের আগুনের পারস্পরিক তুলনা করাে।

Ans: জীবনানন্দ দাশের ‘শিকার’ কবিতায় দুটি উপলক্ষ্যে দুবার আগুন জ্বালানাের কথা বলা হয়েছে।

প্রথমবার আগুন জ্বালানাের বর্ণনা : প্রথম যে আগুনের পরিচয় আমরা পাই, তা হল-
“হিমের রাতে শরীর উম রাখবার জন্য দেশােয়ালিরা
সারারাত মাঠে আগুন জ্বেলেছে-”

সুতরাং, এই আগুনের উদ্দেশ্য হল শীতের কাতরতায় উষ্মতা পাওয়া। এ আগুন তাই ধ্বংসের প্রতীক নয়, প্রাণরক্ষার প্রচেষ্টাই এখানে প্রাধান্য পেয়েছে।

বনভূমির স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে অক্ষুন্ন রেখে এ আগুন জীবনরক্ষার উষ্ম অনুভবে পূর্ণ। মােরগফুলের মতাে লাল টক্টকে সেই আগুনে সারারাত নিজেদের বাঁচিয়েছে ‘দেশেয়ালি’ মানুষগুলাে।

দ্বিতীয়বার আগুন জ্বালানাের বর্ণনা : কিন্তু কবিতার শেষপ্রান্তে এসে কবি যখন বলেন, ‘আগুন জ্বলল আবার’, তখন সেই আগুন কিন্তু অন্য এক দ্যোতনা নিয়ে প্রকাশিত হয়। এই দ্বিতীয় আগুনটি সম্বন্ধে কতািয় বলা হয়েছে-
“সূর্যের আলােয় তার রং কুকুমের মতাে নেই আর;
হয়ে গেছে রােগা শালিকের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছার মতাে।”

এই আগুন কাম-ক্রোধ-লােভ-মােহমদ-মাৎসর্যরূপ ষড়রিপু উদ্রেককারী এবং সেই কারণেই প্রকৃতির স্বাভাবিক সৌন্দর্যময়তার বিপরীত দিকে তার অবস্থান। এই আগুনে তাই দগ্ধ হয় নিরীহ এক হরিণের শরীর, তৈরি হয় ‘উষ্ম লাল হরিণের মাংস’।

আগুনের প্রতীকী অর্থ : সুতরাং, ‘শিকার’ কবিতায় সারারাত ধরে জ্বলা প্রথম আগুন হল প্রকৃতিময়তার প্রতীক, প্রাণময়তার প্রতীক, আর ভােরবেলা জ্বালানাে দ্বিতীয়বারের আগুন হল প্রকৃতি বিরুদ্ধতার প্রতীক, প্রাণহননের প্রতীক।

Q. “সুন্দর বাদামি হরিণ এই ভােরের জন্য অপেক্ষা করছিল”— হরিণের ভােরের জন্য অপেক্ষার কারণ এবং সেই ভােরকে উপভােগের বর্ণনা দাও।

Ans: হরিণের ভােরের জন্য অপেক্ষার কারণ : মহাপৃথিবী কাব্যগ্রস্থ থেকে নেওয়া জীবনানন্দ দাশের ‘শিকার’ কবিতায় ভােরের মনােরম বনভূমিতে সুন্দর বাদামি রঙের হরিণটির আবির্ভাব হয়। “নক্ষত্রহীন, মেহগনির মতাে অন্ধকারে” সারারাত চিতাবাঘিনির গ্রাস থেকে নিজেকে বাঁচাতে সুন্দরীর বন থেকে অর্জুনের বনে ঘুরে বেড়িয়েছিল হরিণটি। দিনের আলােয় নিজেকে রক্ষার তাগিদেই সে অপেক্ষা করেছিল ভােরের জন্য।

ভােরকে উপভােগের বর্ণনা:
ভােরের আলােয় নেমে আসা : ভােরের আলােয় হরিণটি বনের বাইরে বেরিয়ে আসে এবং কচি বাতাবিলেবুর মতাে সবুজ, সুগন্ধি ঘাস ছিড়ে খায়। তারপরে নেমে যায় নদীর শীতল জলে—তার ঘুমহীন ক্লান্ত শরীরকে সতেজ করার জন্য, বিহ্বল শরীরটাকে স্রোতের মতাে একটা শীতল আবেশ দেওয়ার জন্য।

জীবনের উল্লাস খোঁজার প্রয়াস : অন্ধকারের জরায়ু থেকে জন্ম নেওয়া ভােরের রােদের মতােই জীবনের উল্লাস খুঁজে নিতে চেয়েছিল হরিণটি। চেয়েছিল নীল আকাশের নীচে ‘সুর্যের সােনার বর্শার মতাে’ জেগে উঠতে। কবির অনুভবে, সেই হরিণের লক্ষ্য ছিল ‘সাহসে সাধে সৌন্দর্যে’ অন্যান্য হরিণীকে চমকে দেওয়া।

মেলে ধরার সুযােগ : এইভাবে মনােরম অরণ্যপ্রকৃতিতে হরিণটি যেন নিজেকে মেলে ধরার সুযােগ পেয়ে যায়। প্রাণবন্ত, চঞ্চল হরিণটি প্রকৃতিকে নিজের স্বচ্ছন্দ বিচরণের ক্ষেত্র মনে করে। সম্ভবত হরিণটির নির্মম পরিণতির কথা চিন্তা করেই জীবনের এই উদযাপন কবি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন।

শিকার|জীবনানন্দ দাশ|HS Bengali Question And Answers| উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রশ্নোত্তর

শিকার জীবনানন্দ দাশ

Q. “উষ্ম লাল হরিণের মাংস তৈরি হয়ে এল।” —মাংসলােভী মানুষের যে হিংস্রতার পরিচয় ‘শিকার কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে, তা নিজের ভাষায় বর্ণনা করাে।

Ans: জীবনানন্দ দাশের শিকার কবিতার পটভূমিতে আছে এক নির্মল ‘ভাের’।

প্রকৃতির রূপ : সেখানে ‘আকাশের রং’ ঘাসফড়িঙের দেহের মতাে কোমল নীল। টিয়ার পালকের মতাে সবুজ পেয়ারা ও নােনার গাছ। সকালের আলােয় টলমলে শিশিরে চারদিকের বন ও আকাশ ঝিলমিল করছে। এই অসামান্য ভােরেই বেঁচে থাকার পরিসর খুঁজেছিল সুন্দর বাদামি হরিণ।

হরিণের বেঁচে থাকার উল্লাস : সারারাত এক বন থেকে অন্য বনে পালিয়ে চিতাবাঘিনির হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে এই ভােরের আলােয় হরিণটি বেঁচে থাকার উল্লাস উপভােগ করতে চেয়েছিল। সে ভােরের আলােয় ছিড়ে খেয়েছিল কচি বাতাবিলেবুর মতাে সবুজ সুগন্ধি ঘাস আর ‘নদীর তীক্ষ্ণ শীতল ঢেউয়ে’ নেমেছিল রাতজাগার ক্লান্তি মেটাতে।

নাগরিক মানুষের লালসা : ভােরের আলােয় হরিণটি যখন জীবনের উল্লাস খুঁজে নিচ্ছিল, ঠিক তখনই ভেসে আসে বন্দুকের গুলির শব্দ আর নদীর জল হরিণের রক্তে হয়ে ওঠে ‘মচকাফুলের পাপড়ির মতাে লাল’। নাগরিক মানুষের লালসা মেটাতে নিষ্পাপ হরিণটি ‘উষ্ম লাল’ মাংসে পরিণত হয়।

উপসংহার : নক্ষত্রের নীচে ঘাসের বিছানায় বসে অনেক পুরােনাে শিশিরভেজা গল্প আর সিগারেটের ধোঁয়ায় সভ্যতার যে চিহ্ন দেখা যায় তাতে স্পষ্ট হয় সভ্যসমাজের নৃশংসতায় চিরকালের ঘুমের দেশে নিম্পাপ জীবনের হারিয়ে যাওয়ার কাহিনিই।

Q. ‘শিকার’ কবিতায় কবি হরিণটিকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন তা নিজের ভাষায় আলােচনা করাে।

Ans: জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘শিকার’ কবিতায় ভােরের সূর্যের প্রথম আলােয় উদ্ভাসিত প্রকৃতির বুকে একটি ‘সুন্দর বাদামি হরিণ’-এর নৃশংস হত্যার ছবি এঁকেছেন।

হরিণের বন্যজীবন : কবিতার শুরুতে হরিণটির বন্যজীবনের বর্ণনা দিয়েছেন কবি। সারারাত হরিণটি রাতের গভীর অন্ধকারে সুন্দরীর বন থেকে অর্জুনের বনে ঘুরে ঘুরে নিজেকে চিতাবাঘিনির হাত থেকে রক্ষা করেছিল আর অপেক্ষা করেছিল ভাের হওয়ার জন্য।

হরিণের উল্লাস ও আবেশময়তা : সূর্য উঠলে হরিণটি ভােরের আলােয় বেরিয়ে আসে। খিদে মেটাতে কচি বাতাবিলেবুর মতাে সবুজ সুগন্ধি ঘাস ছিড়ে ছিড়ে খায়। তারপরে হরিণটি গা ভাসায় নদীর শীতল জলে তার শরীরের ক্লান্তি দূর করার জন্য কিংবা নীল আকাশের নীচে জেগে উঠে ‘সাহসে সাধে সৌন্দর্যে’ হরিণীদের চমকে দেওয়ার জন্য।

পরিণতি : এইসব আকাক্ষার অবসান হয়ে যায় শিকারির গুলিতে বিদ্ধ হলে। হরিণের রক্ত নদীর জল আচমকা মচকাফুলের পাপড়ির মতাে লাল হয়ে যায়। তৈরি হয় ‘উষ্ম লাল হরিণের মাংস’। মানুষের পাশবিক ক্ষুধার কাছে বলি হতে হয় প্রকৃতির নিরপরাধ হরিণটিকে।