Cold War

THE ERA OF COLD WAR| ঠান্ডা লড়াই এর যুগ|HS HISTORY QUESTIOS AND ANSWERS| উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস প্রশ্নোত্তর

তৃতীয় পর্ব (part No- 3)

Q. আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র কেন ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল? ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার পরাজয়ের কারণ সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করাে।
Ans:ভিয়েতনামে আমেরিকার হস্তক্ষেপের কারণ

[1] সাম্যবাদ রােধ: প্রথমে সােভিয়েত নেতৃত্বে ও পরে চিনের মদতে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে সাম্যবাদের প্রসার ঘটতে থাকে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র সবসময় চেয়েছে সাম্যবাদের প্রভাব রােধ করতে। তাই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র বেষ্টনী নীতি অনুসরণ করে দক্ষিণ ভিয়েতনামকে কমিউনিস্টদের প্রভাব থেকে মুক্ত করতে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কমিউনিস্ট প্রভাবকে সংযত রাখতে চেয়েছিল।

[2] পুঁজিবাদের প্রসার: পুঁজিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল ধনতন্ত্রের প্রয়ােগ ও বিকাশ ঘটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিকে নিজের অনুকূলে আনতে। তাই আন্তর্জাতিক বাজার তৈরির জন্য পুঁজিবাদের সম্প্রসারণের লক্ষ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমস্যাগুলিতে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে। এরই রেশ ধরে ভিয়েতনামের যুদ্ধে আমেরিকা অংশ নেয়।

[3] তৃতীয় বিশ্বে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে এশিয়ার দেশগুলিকে অর্থ-সাহায্যের নামে শুরু হয় মার্কিন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। ভিয়েতনাম সমস্যা আমেরিকাকে তৃতীয় বিশ্বে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোেগ এনে দেয়।

ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার পরাজয়ের কারণ:


[1] কমিউনিস্টদের বিরােধিতা: ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ভিয়েতনামের দিয়েম সরকারকে সমর্থন করে ভুল করেছিল। কারণ, এই দিয়েম সরকারের বিরােধী কমিউনিস্টরা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা ভিয়েতকং অর্থাৎ জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট (National Liberation Front)-এর সঙ্গে মিলিত হয়ে মার্কিনিদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলে।

[2] ভিয়েতনামিদের তীব্র স্বাধীনতার আকাক্ষা: ভিয়েতনামিরা নিজেদের দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে লড়াই করেছিল। তাদের এই তীব্র স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষার কাছে হার মানতে হয়েছিল বিদেশি মার্কিনিদের। স্বাভাবিকভাবেই অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ের কাছে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী ছিল। যুদ্ধ যত এগিয়েছে মানসিকভাবে মার্কিনিরা ততই পিছিয়ে পড়েছে।

[3] গেরিলা রণকৌশল: ভিয়েতনাম মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা যুদ্ধপদ্ধতিতে মার্কিনিদের থেকে এগিয়েছিল। শুধুমাত্র আকাশ থেকে বােমাবর্ষণ করে মার্কিন সেনাবাহিনী ভিয়েতনামি সেনাদের ধ্বংস করতে পারেনি।

[4] অজানা পরিবেশ: মার্কিন সেনাবাহিনী মাতৃভূমি ছেড়ে সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা পরিবেশে লড়াই করতে এসেছিল। তাই চেনাজানা পরিবেশে ভিয়েতনামি সেনারা সহজে যেভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করতে পেরেছিল মার্কিনিরা সেভাবে পারেনি।

[5] সােভিয়েত ও চিনের ভূমিকা: সােভিয়েত ও চিন সাম্যবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ ভিয়েতনামকে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র সহ সামরিক সাজসরঞ্জাম নিয়মিত জোগান দিয়েছিল। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিপুল সংখ্যক সেনা এই যুদ্ধে নিয়ােগ করলেও সফল হতে পারেনি।

[6] ভৌগােলিক দূরত্ব: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভিয়েতনামের ভৌগােলিক দূরত্ব ছিল কয়েক হাজার মাইল। এতদূর থেকে যুদ্ধকে নিয়ন্ত্রণ করে সফল হওয়া ছিল অসম্ভব। তাই শেষপর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের যুদ্ধ থেকে পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছিল।

THE ERA OF COLD WAR| ঠান্ডা লড়াই এর যুগ|HS HISTORY QUESTIOS AND ANSWERS| উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস প্রশ্নোত্তর


Q. পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযােগিতা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদক্ষেপ বর্ণনা করাে।
Ans: ভূমিকা: বিশ্ব সভ্যতার অস্তিত্ব ধরে রাখার জন্য পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযােগিতা বন্ধ হওয়া জরুরি। এই সরল সত্য অনুধাবন করে তাই অধুনা শান্তি প্রতিষ্ঠার একাধিক পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছে।

পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযােগিতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ


[1] প্রেক্ষাপট: পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযােগিতা শুরু হওয়ার অনেক আগেই নিরস্ত্রীকরণের উদ্যোগ শুরু হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরােসিমায় ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৬ আগস্ট ও নাগাসাকিতে ৯ আগস্ট আণবিক বােমার বিস্ফোরণ ঘটালে সার্বিকভাবে পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণের প্রচেষ্টা শুরু হয়।

[2] পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযােগিতা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই সােভিয়েত ও মার্কিন উভয় তরফেই পারমাণবিক বােমা ও ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এর ফলে এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে যাতে পারমাণবিক যুদ্ধে বিশ্বের ধ্বংসসাধনের সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই ধ্বংস প্রক্রিয়া MAD (Mutually Assured Destruction) তত্ত্ব নামে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে সােভিয়েত ও মার্কিন একে অপরকে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রথম আঘাত হানার ভয় দেখিয়ে নিবৃত্ত করার নীতি নেয়। এই নীতির নাম Policy of Nuclear Deterrence। পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযােগিতার অগ্রগতিকালে শক্তিসাম্য ত্রাসের সাম্য (Balance of Terror) নামে পরিচিতি লাভ করে।

[3] শান্তি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ

আণবিক শক্তি কমিশন গঠন: ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভার প্রস্তাব অনুসরণে একটি পরমাণু শক্তি কমিশন (Atomic Energy Commission) গঠন করা হয়। এই কমিশন আণবিক শক্তি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে বিস্তারিত পরিকল্পনা রচনার সিদ্ধান্ত নেয়।

জেনেভা নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন: রাষ্ট্রসংঘের উদ্যোগে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে জেনেভাতে এক নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন বসে। এই সম্মেলনে নিরস্ত্রীকরণের বিষয়টি তদারকির জন্য ১০টি সদস্য রাষ্ট্রকে নিয়ে এক কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি নিরস্ত্রীকরণের লক্ষ্যে সদর্থক আলােচনার প্রস্তাব রাখে।

পরবর্তী সম্মেলনসমূহ: রাষ্ট্রসংঘের উদ্যোগে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে, তারপর ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে আণবিক অস্ত্র রােধের লক্ষ্যে একাধিক পদক্ষেপ গৃহীত হয়। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে সােভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মহাকাশে ধ্বংসাত্মক অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ

বারুচ পরিকল্পনা: মার্কিন রাষ্ট্রপতি টুম্যান বিশিষ্ট শিল্পপতি তথা কূটনীতিবিদ বার্নার্ড বারুচকে পারমাণবিক শক্তি কমিশনের প্রতিনিধি মনােনীত করেন। বারুচ নিরস্ত্রীকরণ সম্পর্কিত এক পরিকল্পনা কমিশনে পেশ করেন (১৯৪৬ খ্রি., ১৫ জুন) যা ‘বারুচ পরিকল্পনা’ নামে পরিচিত। এর দ্বারা একটি আন্তর্জাতিক আণবিক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (International Atomic Development Authority বা IADA) গঠন করে পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদনের উৎস এবং পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে বেশ কিছু প্রস্তাব রাখা হয়।

আইজেনহাওয়ার পরিকল্পনা: মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ার পারমাণবিক দ্রব্যের শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহারের লক্ষ্যে রাষ্ট্রসংঘে এক পরিকল্পনা পেশ করেন। এই পরিকল্পনায় তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সামরিক ঘাঁটিগুলির আলােকচিত্র ও ব্লু প্রিন্ট বিনিময়ের উল্লেখ করেন। এ ছাড়াও তিনি রাষ্ট্রসংঘের তত্ত্বাবধানে এক আন্তর্জাতিক শক্তি কমিশন গঠনের কথা বলেন।

সােভিয়েত ইউনিয়নের উদ্যোগ: সােভিয়েত ইউনিয়নও পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুন গ্রোমিকো পরিকল্পনা নামে এক প্রস্তাব পেশ করে।

সাধারণ সভায় নিরস্ত্রীকরণে প্রস্তাব পেশ: ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে সােভিয়েত ইউনিয়ন সাধারণ সভার নিরস্ত্রীকরণ কমিশনের উপসমিতির কাছে এক প্রস্তাব পেশ করে। এই প্রস্তাবে বিভিন্ন দেশের সামরিক খাতের খরচের পরিমাণ কমানাের কথা বলা হয়।

সােভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধানের উদ্যোগ: সােভিয়েত রাষ্ট্রপতি ক্রুশ্চেভ জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের সভায় সর্বাত্মক নিরস্ত্রীকরণের প্রস্তাব তােলেন। পরবর্তী রাষ্ট্রপতি ব্রেজনেভ কৌশলগত পরমাণু অস্ত্র সীমিতকরণের লক্ষ্যে মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধান রিচার্ড নিকসনের সঙ্গে মস্কোতে সল্ট-১ চুক্তি (২৬ মে, ১৯৭২ খ্রি.) এবং পরবর্তী মার্কিন রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টারের সঙ্গে ভিয়েনায় সল্ট-২ (১৮ জুন, ১৯৭৯ খ্রি.) চুক্তি স্বাক্ষর করেন। পরবর্তীকালে সােভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান মিখাইল গরবাচভ মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশের সঙ্গে START-I (১৯৯১ খ্রি., ৩১ জুলাই) নামে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এই চুক্তিতে সােভিয়েত ও মার্কিন উভয় রাষ্ট্রের অস্ত্রসম্ভারের অস্ত্রসংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। পরবর্তী রুশ প্রজাতন্ত্রের প্রধান বরিস ইয়েলৎসিন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বুশের সঙ্গে START-II চুক্তি সম্পাদন করেন (১৯৯৩ খ্রি., জানুয়ারি)। এই চুক্তিতে উভয় দেশ নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার অর্ধেকেরও বেশি নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে সম্মত হয়।

উপসংহার: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত রাশিয়া মূলত এই দুই দেশের নেতৃত্বে পারমানবিক অস্ত্র প্রতিযােগিতা শুরু হয়। আবার এই দুই দেশের উদ্যোগেই মূলত বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন পদক্ষেপ গৃহীত হয়।

THE ERA OF COLD WAR| ঠান্ডা লড়াই এর যুগ|HS HISTORY QUESTIOS AND ANSWERS| উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস প্রশ্নোত্তর


Q. পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযােগিতা রােধের প্রাথমিক উদ্যোগ হিসেবে সার্বিক প্রচেষ্টার আলােচনা করাে।


Ans: ভূমিকা: মার্কিন নেতৃত্বাধীন প্রথম বিশ্ব, সােভিয়েত নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় বিশ্ব, জোটনিরপেক্ষ সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ে গড়ে ওঠা তৃতীয় বিশ্ব এবং রাষ্ট্রসংঘের মিলিত উদ্যোগে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযােগিতা রােধ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা শুরু হয়।

পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা রােধের উদ্যোগ:


[1] সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের উদ্যোগ


আণবিক শক্তি কমিশন গঠন: ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভার প্রস্তাব অনুসরণে একটি পরমাণু শক্তি কমিশন (Atomic Energy Commission) গঠন করা হয়। এই কমিশন আণবিক শক্তি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে বিস্তারিত পরিকল্পনা রচনার সিদ্ধান্ত নেয়। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী ও অস্থায়ী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ১১ টি সদস্য রাষ্ট্র এবং কানাডা এই কমিশনের সদস্য মনােনীত হয়।

জেনেভা নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন: রাষ্ট্রসংঘের উদ্যোগে ১৯৬০ খ্রি. জেনেভাতে এক নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন বসে। এই সম্মেলনে নিরস্ত্রীকরণের বিষয়টি তদারকির জন্য ১০টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে এক কমিটি গঠন করা হয়। দশটি রাষ্ট্র হল রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেন, কানাডা, ইটালি, বালগেরিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, রুমানিয়া ও পােল্যান্ড। এই কমিটি নিরস্ত্রীকরণের লক্ষ্যে সদর্থক আলােচনার প্রস্তাব রাখে।

পরবর্তী সম্মেলনসমূহ: রাষ্ট্রসংঘের উদ্যোগে ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের ৫ আগস্ট মস্কোতে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার নাম আংশিক পারমাণবিক পরীক্ষা নিরােধক চুক্তি (Partial Nuclear Test Ban Treaty)। এই চুক্তির দ্বারা সমুদ্রগর্ভে, মহাকাশে বা অন্যত্র আণবিক বােমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের ওপর আংশিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। পরবর্তী সময়ে জাতিপুঞ্জের মধ্যস্থতায় সােভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আর-একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত (১৯৬৬ খ্রি.) হয়। এই চুক্তিতে বলা হয়—[i] মহাকাশে চাঁদ-সহ অন্যান্য গ্রহে ধ্বংসাত্মক কোনাে ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা যাবে না, [ii] সােভিয়েত বা মার্কিন এই দুই রাষ্ট্রের কেউই মহাকাশে একচেটিয়া কর্তৃত্বের দাবি জানাতে পারবে না। রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভার উদ্যোগে ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে ১ জুলাই পারমাণবিক অস্ত্র সম্প্রসারণ নিরােধক চুক্তি (Nuclear Non-Proliferation Treaty) স্বাক্ষরিত হয়।

[2] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ


বারুচ পরিকল্পনা: মার্কিন রাষ্ট্রপতি টুম্যান বিশিষ্ট শিল্পপতি তথা কূটনীতিবিদ বার্নার্ড বারুচকে পারমাণবিক শক্তি কমিশনের প্রতিনিধি মনােনীত করেন। বারুচ নিরস্ত্রীকরণ সম্পর্কিত এক পরিকল্পনা কমিশনে পেশ করেন (১৯৪৬ খ্রি. ১৫ জুন), যা বারুচ পরিকল্পনা নামে পরিচিত। এর দ্বারা একটি আন্তর্জাতিক আণবিক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (International Atomic Development Authority বা IADA) গঠন করে পারমাণবিক শক্তির উৎসগুলি সম্পূর্ণরূপে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে আনার কথা বলা হয়।

আইজেনহাওয়ার পরিকল্পনা: মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ার পারমাণবিক দ্রব্য ও কলাকৌশল শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহারের লক্ষ্যে রাষ্ট্রসংঘে এক পরিকল্পনা পেশ করেন। এই পরিকল্পনায় তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সামরিক ঘাঁটিগুলির আলােকচিত্র ও ব্ল প্রিন্ট বিনিময়ের উল্লেখ করেন। এ ছাড়াও তিনি রাষ্ট্রসংঘের তত্ত্বাবধানে এক আন্তর্জাতিক শক্তি কমিশন গঠনের কথা বলেন। রাষ্ট্রসংঘের অনুষ্ঠিত এক সভায় মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ার তাঁর এই শান্তি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সােভিয়েত বিরােধিতায় আইজেনহাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়।

[3] সােভিয়েত ইউনিয়নের উদ্যোগ: সােভিয়েত ইউনিয়নও পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে উদ্যোগী হয়।

সাধারণ সভায় নিরস্ত্রীকরণের প্রস্তাব পেশ: ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে সােভিয়েত ইউনিয়ন সাধারণ সভার নিরস্ত্রীকরণ কমিশনের উপসমিতির কাছে এক প্রস্তাব পেশ করে। এই প্রস্তাবে বলা হয়—

[i] বিভিন্ন দেশের সামরিক খাতে খরচের পরিমাণ এক বছরের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস করতে হবে।
[ii] শর্তহীনভাবে পারমাণবিক বােমা ও হাইড্রোজেন বােমা-সহ সমস্ত ধরনের মারণাস্ত্রের উৎপাদন, মজুতকরণ ও ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে।

কুশ্চেভের উদ্যোগ: সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী নিকিতা কুশ্চেভ ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের সভায় সর্বাত্মক নিরস্ত্রীকরণের প্রস্তাব তােলেন।

ব্রেজনেভের উদ্যোগ

সল্ট-১ চুক্তি: রাষ্ট্রপতি লিওনিদ ব্রেজনেভের নেতৃত্বে সােভিয়েত ও রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিকসনের নেতৃত্বে মার্কিন উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে সল্ট-১ বা কৌশলগত অস্ত্র সীমিতকরণ চুক্তি (Strategic Arms Limitation Treaty) স্বাক্ষরিত হয়। এই বৈঠকে ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে দুটি সমঝােতা পত্র তৈরি হয়। এই সমঝােতা পত্র অনুযায়ী দুই দেশ নিজ নিজ ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনের সংখ্যা কমিয়ে আনতে রাজি হয়। সােভিয়েত ও মার্কিন ভূমিনির্ভর ক্ষেপণাস্ত্র (ICBM অর্থাৎ Inter-Continental Ballistic Missile) এবং সমুদ্রনির্ভর ক্ষেপণাস্ত্র (SLBM অর্থাৎ Submarine-Launched Ballistic Missile) উভয়, ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা যথাক্রমে ১৭১০ ও ২৩৫০-এ কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। এই চুক্তির অন্যতম শর্তে বলা হয়—সােভিয়েত ও মার্কিন উভয় পক্ষই ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের (ABM বা Anti-Ballistic Missile) দ্বারা নিজেদের রাজধানীসহগুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলি রক্ষা করার অধিকার পাবে।

সল্ট-২ চুক্তি: সােভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান ব্রেজনেভ ও মার্কিন রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টার ভিয়েনায় এক শীর্ষ বৈঠকে যােগ দেন। এই শীর্ষ বৈঠকে স্বাক্ষরিত দশবছর মেয়াদি ভ্লাদিভস্তক চুক্তি অনুসারে উভয় দেশের ক্ষেপণাস্ত্র এবং বােমারু বিমানের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। এই চুক্তির শর্তে বলা হয় যে দুই দেশের স্থল এবং সমুদ্র ঘাঁটিতে ২৪০০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র এবং বােমারু বিমান রাখা যাবে না।

গরবাচভের উদ্যোগ: পরবর্তীকালে সােভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান মিখাইল গরবাচভ তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি রােনাল্ড রেগনের সঙ্গে জেনেভাতে এক শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়ে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণকে সফল করার আহবান জানান (১৯৮৫ খ্রি., ১৯ নভেম্বর)। গরবাচভ পরবর্তীকালে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশের সঙ্গে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হন (১৯৯১ খ্রি., ৩১ জুলাই)। এই চুক্তির নাম START-I চুক্তি। এই চুক্তি অনুসারে দুই দেশ ১৬০০ টি Strategic Nuclear Delivery Vehicles এবং ৬ হাজার যুদ্ধ বােমা রাখবার অনুমতি লাভ করে।

ইয়েলৎসিনের উদ্যোগ: পরবর্তী রুশ প্রজাতন্ত্রের প্রধান বরিস ইয়েলৎসিন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বুশের সঙ্গে START-II চুক্তি সম্পাদন করেন (১৯৯৩ খ্রি., জানুয়ারি)। এই চুক্তিতে উভয় দেশ নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র-ভাণ্ডার অর্ধেকেরও বেশি নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে সম্মত হয়।

THE ERA OF COLD WAR| ঠান্ডা লড়াই এর যুগ|HS HISTORY QUESTIOS AND ANSWERS| উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস প্রশ্নোত্তর

Q. পরমাণু অস্ত্র নিমার্ণে ব্যর্থতার কারণ ও ফলাফল লেখাে।
Ans: পরমাণু অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণ:


[1] ঠান্ডা লড়াই: কোনাে কোনাে দেশ মুখে নিরস্ত্রীকরণের কথা বললেও বাস্তব ক্ষেত্রে সে ভয়ানক আগ্রাসন চালায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে আমেরিকা ও রাশিয়া উভয় শক্তি নিরস্ত্রীকরণের কথা বললেও এবিষয়ে তাদের আন্তরিকতা ছিল না। কেননা, নিজেদের মধ্যে ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের পক্ষে অস্ত্র হ্রাস করা সম্ভব ছিল না।

[2] পারস্পরিক বিশ্বাসের অভাব: রাশিয়া ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে গােপনে আণবিক বােমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটালে আমেরিকার বিশ্বাস ভঙ্গ হয়। আবার ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে (মে মাসে) আমেরিকা তার U-2 পর্যবেক্ষণ বিমান থেকে রাশিয়ার ওপর গুপ্তচর বৃত্তি চালালে রাশিয়ার অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়। এই ধরনের অবিশ্বাসের ঘটনা নিরস্ত্রীকরণের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করে।

[3] অস্ত্রের ধরন নিয়ে সমস্যা: কোন্ দেশের কোন্ অস্ত্র ‘আক্রমণাত্মক’ এবং কোন অস্ত্র ‘রক্ষণাত্মক’ তা নিয়ে বিভিন্ন দেশের মধ্যে মতবিরােধ থাকে। এক দেশ যে অস্ত্রকে ‘আক্রমণাত্মক বলে বিবেচনা করে অন্য দেশ তাকেই ‘রক্ষণাত্মক’ বলে মনে করতে পারে। এ বিতর্কের ফলে কোনাে মীমাংসায় পৌঁছানাে সম্ভব হয়নি এবং নিরস্ত্রীকরণের বাস্তবায়নও অধরা থেকে যায়।

[4] গুণগত নিরস্ত্রীকরণের সমস্যা: নিরস্ত্রীকরণ বলতে সাধারণত অস্ত্রের পরিমাণ হ্রাস বা অস্ত্রের বিলুপ্তি বােঝানাে হয়। কিন্তু বিভিন্ন দেশের মধ্যে আলােচনার মাধ্যমে পরিমাণগত নিরস্ত্রীকরণ সম্ভব হলেও গুণগত নিরস্ত্রীকরণ সম্ভব নয়। এর কারণ হিসেবে ড.কিসিঞ্জার বলেছেন যে, প্রকৃত অস্ত্র প্রতিযােগিতা চলে গবেষণাগারে। তাই কোনাে দেশের সৈন্য সংখ্যা যতই হ্রাস করা হােক না কেন, এর দ্বারা প্রকৃত নিরস্ত্রীকরণ সম্ভব নয়।

[5] চুক্তি লঙ্ঘন: নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করার পরও বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন সময় চুক্তি লঙ্ঘন করার ফলে এবিষয়ে যথেষ্ট সমস্যার সৃষ্টি হয়। অনেক ক্ষেত্রেই চুক্তিকে বুড়াে আঙুল দেখিয়ে তারা গােপনে অস্ত্র উৎপাদন ও মজুতের কাজ চালিয়ে যায়।

পরমাণু অস্ত্র প্রতিযােগিতার ফলাফল


[1] সভ্যতার বিলুপ্তির আশঙ্কা: পরমাণু অস্ত্র প্রতিযােগিতা পৃথিবীর মানব-সভ্যতার অস্তিত্বকে প্রশ্ন চিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি ছাড়াও বর্তমানে মাঝারি শক্তিসম্পন্ন বহু দেশের হাতে বিপুল পরিমাণ পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে যা সমগ্র পৃথিবী ধ্বংস করেও শেষ হবে না।

[2] দূষণ: পরমাণু অস্ত্র প্রতিযােগিতা পৃথিবীর পরিবেশদূষণের মাত্রাকে বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে যেখানেই পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা চালানাে হােক না কেন পরমাণুর বর্জ্যপদার্থ প্রকৃতিতে মিশে গিয়ে সীমাহীন দূষণ ছড়াচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, সম্প্রতি জাপানের পরমাণু কেন্দ্র সুনামির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরমাণু বর্জ্য প্রকৃতিতে মিশে জমির ধান, নদীর মাছ সব কিছু প্রবেশ করেছে। মানুষ তার পরােক্ষ প্রভাবে ক্যান্সারসহ নানা রােগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুপথযাত্রী হচ্ছে বা হবে।

[3] অর্থনৈতিক ক্ষতি: অস্ত্র প্রতিযােগিতায় অংশগ্রহণকারী দেশগুলি তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি রূপায়ণ করতে গিয়ে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে সেসব দেশের বিরাট অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে এবং প্রকৃত উন্নয়ন কর্মসূচি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

[4] তৃতীয় বিশ্বের দুর্দশা: বৃহৎ শক্তিগুলি পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে সেই ব্যয় আদায় করার জন্য তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দরিদ্র দেশে নানাভাবে শােষণ চালাচ্ছে। ফলে, এসব দেশের মানুষ দিনদিন দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে। এসব দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান নিম্নমুখী হতে বাধ্য হচ্ছে।

[5] শক্তির অপব্যবহার: পরমাণু শক্তির মাত্রা খুবই ব্যাপক। এই শক্তিকে মানবকল্যাণে বহু কাজে ব্যবহার করা সম্ভব। বিদ্যুৎ উৎপাদন, চিকিৎসাবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে পরমাণু শক্তির গুরুত্ব সীমাহীন। কিন্তু পরমাণু অস্ত্র প্রতিযােগিতার নেমে বহু দেশ পরমাণু শক্তির শুভ দিকটিকে কাজে না লাগিয়ে এই শক্তির অপব্যবহার করছে।



Q. দাঁতাত কী? বিশ্ব রাজনৈতিক দাঁতাতের উদ্ভবের কারণ ও গুরুত্ব আলােচনা করাে।

Ans: দাঁতাত:


দাঁতাত (Detente) একটি ফরাসি শব্দ। এর অর্থ হল উত্তেজনা প্রশমন (relaxation of tension)। ১৯৭০-এর দশকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঠান্ডা লড়াই ক্রমশ স্তিমিত হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক ইতিহাসে এই পর্বটি দাঁতাত নামে পরিচিত। অর্থাৎ পারস্পরিক বােঝাপড়ার মাধ্যমে স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সুপরিকল্পিত নীতি হল দাঁতাত’। হেনরি কিসিংগারের মতে, দাঁতাত হল প্রত্যক্ষ সামরিক সংঘাত এবং সর্বোপরি পারমাণবিক যুদ্ধ এড়ানাের লক্ষ্যে চিরাচরিত প্রতিদ্বন্দ্বিতার বদলে পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সমঝােতায় গুরুত্ব আরােপ।

দাঁতাতের উদ্ভবের কারণসমূহ:


[1] অস্ত্র হ্রাস সম্পর্কিত সম্মেলন: পারমাণবিক যুদ্ধ ভীতি রাশিয়া এবং আমেরিকা দুই দেশকে পরস্পরের কাছাকাছিআনে।ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসানে যে শীর্ষ সম্মেলনগুলির ভূমিকা ছিল সেগুলি হল-রুশ-মার্কিন জেনেভাশীর্ষ বৈঠক (১৯৮৫ খ্রি. ১৯নভেম্বর), ওয়াশিংটন শীর্ষ সম্মেলন (১৯৮৭ খ্রি. ডিসেম্বর), মস্কো শীর্ষ বৈঠক (১৯৮৮ খ্রি., ২৯মে), মাল্টা শীর্ষ বৈঠক (১৯৯০ খ্রি. ৯ সেপ্টেম্বর), প্যারিস শিখর সম্মেলন (১৯৯০ খ্রি. ১৯ নভেম্বর), মস্কো শীর্ষ বৈঠক (১৯৯১ খ্রি. ৩০ জুলাই) ইত্যাদি। তবে প্যারিস শিখর সম্মেলনেই কার্যত ঠান্ডা যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটেছিল বলা চলে। কারণ, মার্কিন রাষ্ট্রপতি বুশ নিজেই এই সম্মেলনকে ঠান্ডা লড়াই-এর সমাপ্তি বলে অভিহিত করেছিলেন।

[2] রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ: ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে সােভিয়েত রাশিয়ার ঐকান্তিক চেষ্টা সত্ত্বেও সাম্যবাদী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বিভেদ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি জোটনিরপেক্ষতা নীতি অবলম্বন করে এবং ন্যাটো ভুক্ত দেশগুলি, বিশেষত ফ্রান্স ও ব্রিটেন নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আরও মজবুত করার জন্য তাদের রাজনীতিকে বিশ্বজনীন করার প্রয়াস গ্রহণ করে। এর ফলে ঠান্ডা লড়াই রাজনীতির তীব্রতা হ্রাস পেতে থাকে।

[3] গর্বাচেভের ভূমিকা: সােভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধানরূপে গর্বাচেভ গ্লাসনস্ত (মুক্তচিন্তা) ও পেরেস্ত্ৰৈকা (পুনর্গঠন)-এই দুই নীতির ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিম ইউরােপের দেশগুলির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইলে বিশ্বে ঠান্ডা লড়াই রাজনীতির উত্তেজনা প্রশমিত হতে শুরু করে।

[4] শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতি: সােভিয়েত রাশিয়ার দিক থেকে প্রথমে ক্রুশ্চেভ, পরে ব্রেজনেভের আমলে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতি স্থাপন রুশ বিদেশনীতির মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। অপর দিকে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলে ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসান প্রক্রিয়া শুরু হয়।

[5] বহুমেরু রাজনীতির উত্থান: ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দ্বিমেরুতার পরিবর্তে বহুমেরুতার উত্থান ঘটতে শুরু করে। তৃতীয় বিশ্ব থেকে চিনের উত্থান এবং ব্রিটেন, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি সহ বিভিন্ন রাষ্ট্র কর্তৃক স্বাধীন বিদেশনীতি গ্রহণ বহুমেরু রাজনীতির উত্থানকে ত্বরান্বিত করে। এতে শঙ্কিত হয়ে সােভিয়েত ও মার্কিন উভয় রাষ্ট্রই আরও সহনশীল হতে বাধ্য হয়। ফলে ঠান্ডা লড়াই রাজনীতির অবসান ঘটতে থাকে।

[6] জোটনিরপেক্ষ নীতি: ভারতের নেতৃত্বে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি একে একে জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করতে শুরু করলে এবং বহু ইউরােপীয় দেশ তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পুঁজি বিনিয়ােগে আগ্রহী হয়ে উঠলে সােভিয়েত এবং মার্কিন, দুই জোটের মধ্যেকার ঠান্ডা লড়াইয়ের তীব্রতা হ্রাস পেতে থাকে দাঁতাতের উদ্ভব ঘটে।

দাঁতাতের গুরুত্ব:


[1] স্নায়ুযুদ্ধের অবসান: সােভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী জোট এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী জোট যেভাবে বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করেছিল তা থেকে বিশ্বকে মুক্ত করেছিল দাঁতাত। লৌহযবনিকা তুলে নেওয়া হয়েছিল। ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রতীক বার্লিন প্রাচীর ধূলায় মিশিয়ে দেওয়া কৃতিত্ব দাঁতাতের। দুই জোটের নেতৃত্বাধীন দেশগুলাে বুঝেছিল অস্ত্র নয়, নিরস্ত্রীকরণই আসল পথ।

[2] সামরিক জোটের প্রয়ােজনীয়তা হ্রাস: দাঁতাতের পর্বে সামরিক জোটগুলির প্রয়ােজনীয়তা হ্রাস পায়। SEATO, CENTO-র মতাে সামরিক জোটগুলি ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে যায়। NATO-এর ওয়ারশ চুক্তিগুলিরও আবশ্যকতা কমে আসে। পূর্ব ইউরােপে কমিউনিস্টদের পতন শুরু হলে ওয়ারশ চুক্তিও বিলুপ্ত হয়।

[3] বিভিন্ন দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি: দাঁতাতের প্রভাবে বিভিন্ন দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। সােভিয়েত-মার্কিন সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে আসার ফলে পূর্ব-পশ্চিম ইউরােপ, সােভিয়েত পশ্চিম ইউরােপ, আমেরিকা-পূর্ব ইউরােপ, চিন-সােভিয়েত ও জাপান সােভিয়েত সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। এই সমস্ত দেশগুলির মধ্যে দাঁতাতের পূর্বেকার তিক্ততার সম্পর্কের অবসান ঘটে। অর্থাৎ দাঁতাত এই দেশগুলির পারস্পরিক সম্পর্কের শীতলতাকে উয়তায় বদলে দেয়।

[4] নির্জোট আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা হ্রাস: নির্জোট দেশগুলি ইতিপূর্বে ঠান্ডা লড়াইকালে নিজেদের নিরাপত্তার স্থায়িত্ব এবং আর্থিক অগ্রগতির লক্ষ্যে সাম্যবাদী বা পুঁজিবাদী কোনাে জোটেই যােগ দেয়নি। কারণ, তারা কোনাে একটি জোটে যােগ দিয়ে অন্য জোটের বিরাগভাজন হতে চায়নি। এই লক্ষ্যে তারা নির্জোট আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। দাঁতাত রাজনীতি সেই নির্জোট আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা হ্রাস করে।

[5] ইউরােপের ঐক্য ও সংহতির সুদৃঢ়করণ: দাঁতাত রাজনীতি পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির পুনর্মিলন ঘটায়। পাশাপাশি প্যারিস শীর্ষ বৈঠকের মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিম ইউরােপের বিভাজন কমিয়ে আনা হয়। ইউরােপের আঞ্চলিক বিরােধগুলির শান্তিপূর্ণ মীমাংসার রাস্তা তৈরি হয়। সার্বিক রূপে ইউরােপীয় ঐক্য ও সংহতির ক্ষেত্র আগের তুলনায় অনেকটাই মজবুত হয়।

[6] অন্যান্য ক্ষেত্রে: সােভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র—এই দুই মহান শক্তিশালী দেশ দাঁতাতের জন্যই সামরিক খাতে বাড়তি খরচ থেকে সরে আসে। সেই অর্থ তারা জনকল্যাণমুখী কাজে খরচ করে। মুক্ত বাজার, অবাধ বাণিজ্য উদারীকরণ নীতি—এই সবকিছু আসলে দাঁতাতের ফলশ্রুতি। দাঁতাতের সুদূরপ্রসারী ফলাফল হিসেবেই সন্ত্রাসবাদ বিরােধিতা এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে সহযােগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল।

Q. জোটনিরপেক্ষ নীতি কী? ভারতের জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের কারণ ও গুরুত্ব লেখাে।
Ans: জোটনিরপেক্ষ নীতি:


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী জোট ও সােভিয়েত নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী জোটের কোনাে একটি জোটে যােগ না দিয়ে নিরপেক্ষ থাকার নীতিই হল জোটনিরপেক্ষ বা নিজোর্ট নীতি। এই জোটনিরপেক্ষ দেশগুলি নিজেদের স্বার্থে যে আন্দোলন গড়ে তােলে তার নাম নির্জোট আন্দোলন। এই নীতির প্রবক্তা হলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং যুগােশ্লাভিয়ার প্রধানমন্ত্রী মার্শাল টিটো।

জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের কারণ বা উদ্দেশ্য:


[1] জাতীয় ঐতিহ্য রক্ষা: সুপ্রাচীন কাল থেকেই অহিংসা, শান্তি, সহমর্মিতা ও সহনশীলতার আদর্শে ভারত বিশ্বাসী। হিংসা- জর্জরিত পৃথিবীতে বুদ্ধ ও অশােকের শান্তির বাণী ভারতবর্ষের সীমানা ছাড়িয়ে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। ক্ষমতার শীর্ষে উঠেও আকবর ও শিবাজি সহনশীলতার কথা প্রচার করেন। এই সুমহান আদর্শ ও জাতীয় ঐতিহ্য বহন করার উদ্যোগ থেকেই ভারত সরকার জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণে অগ্রসর হয়।

[2] রাজনৈতিক স্বতন্ত্রতা: রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারত পুঁজিবাদ বা সাম্যবাদকোনােটিকেই সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করেনি। কারণ ভারত গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু নিজেই ঔপনিবেশিকতাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরােধী ছিলেন। নেহরু বলেছিলেন—বিশ্বের পক্ষে ও আমাদের পক্ষে যা ক্ষতিকর তা আমরা নির্দ্বিধায় নিন্দা করব।

[3] আর্থসামাজিক উন্নতি: স্বাধীনতা লাভের ঠিক পরের মুহূর্ত থেকেই ভারত এক গভীরতর আর্থসামাজিক সংকটের মুখে পড়ে। দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, বেকারত্ব, খাদ্যাভাব, কালােবাজারি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা—এসব সমস্যার ফলে ভারতীয় অর্থনীতি একেবারে ভেঙে পড়লে নেহরু স্বতন্ত্র আর্থিক পরিকল্পনা গ্রহণের দ্বারা আর্থসামাজিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে সচেষ্ট হন।

[4] জাতীয় স্বার্থের সংরক্ষণ: জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করে কোনাে দেশেরই পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারিত হয় না। তবে এই স্বার্থ সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হতে পারে, কিন্তু কখনােই উপেক্ষিত হতে পারে না। সাম্যবাদী বা ধনতন্ত্রবাদী কোনাে জোটের মধ্যে না গিয়ে নেহরু মিশ্র অর্থনীতি ও স্বাধীন বিদেশনীতি গ্রহণের দ্বারা জাতীয় স্বার্থের সংরক্ষণ চেয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে নেহরু বলেছেন- “স্বাভাবিকভাবেই আমি ভারতের স্বার্থের দিকে লক্ষ রেখেছি, কারণ এটিই আমার প্রধান কর্তব্য”।

[5] নিরপেক্ষতা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্যবাদী ও ধনতন্ত্রবাদী— এই দুই পরস্পরবিরােধী শক্তিজোটে বিভক্ত বিশ্ব যখন ঠান্ডা লড়াইয়ে মত্ত, তখন ভারত কোনাে জোটেই অংশগ্রহণ না করে নিরপেক্ষনীতি গ্রহণ করে।

[6] তৃতীয় শক্তিজোটের নেতৃত্ব: যে সমস্ত দেশ ঠান্ডা লড়াইয়ের বাইরে থাকতে চাইছিল, কী আয়তন, কী জনসংখ্যা উভয় ব্যাপারেই ভারতের কাছে তারা ছিল নিতান্তই নগণ্য। সুতরাং নিজের নেতৃত্বে বিশ্বে একটা জোটনিরপেক্ষ গােষ্ঠী বা তৃতীয় শক্তিজোট গড়ে তােলার লক্ষ্যেও ভারত জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করে।

জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের গুরুত্ব


[1] নবলব্ধ স্বাধীনতা রক্ষা: জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন এশিয়া আফ্রিকার নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগােষ্ঠীর নবলব্ধ স্বাধীনতাকে রক্ষা করে তাদের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের প্রয়াসকে অব্যাহত রাখতে সাহায্য করে।

[2] ভারসাম্য রক্ষা: দ্বিমেরুকরণ রাজনীতির মাঝে তৃতীয় বিশ্বের আবির্ভাব ঘটিয়ে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন বিশ্ব রাজনীতিতে ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

[3] শান্তিপ্রতিষ্ঠা: বর্ণবৈষম্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও আণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে এই আন্দোলন বিশ্বে শান্তিপ্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

[4] জঙ্গি আগ্রাসন রােধ: এই আন্দোলন বিশ্বে সােভিয়েত-মার্কিন জঙ্গি আগ্রাসনকে যে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল তাতে সন্দেহ নেই। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের এ এক ব্যতিক্রমী সাফল্য।

[5] তৃতীয় বিশ্বের আত্মর্যাদা প্রতিষ্ঠা: এই আন্দোলন শক্তিশালী হওয়ার আগে পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্রগুলিই বিশ্বরাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করত। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের বক্তব্যই ছিল শেষ কথা। কিন্তু এই আন্দোলন তৃতীয় বিশ্বের সদ্য স্বাধীন, দরিদ্র ও অনুন্নত দেশ ও জাতিগুলিকে আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছে।

THE ERA OF COLD WAR| ঠান্ডা লড়াই এর যুগ|HS HISTORY QUESTIOS AND ANSWERS| উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস প্রশ্নোত্তর

COLD WAR


Q. জোটনিরপেক্ষ নীতি সম্পর্কে আলোচনা করো। ভারতের জোটনিরপেক্ষ নীতির সাফল্য ও ব্যর্থতা আলােচনা করাে।

Ans: জোটনিরপেক্ষ নীতি:


[1] পটভূমি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রজোট ও সােভিয়েত নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী রাষ্ট্রজোটের দ্বন্দ্বের ফলে বিশ্বে এক উত্তেজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যা ঠান্ডা লড়াই নামে পরিচিত। এমতাবস্থায়, সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ এই রাজনৈতিক দ্বিমেরুকরণ থেকে নিজেদের দূরে রাখতে চায় এবং এই দুই পরস্পরবিরােধী রাষ্ট্রগােষ্ঠীর কোনােটিতেই যােগনা দিয়ে নিজেদের স্বতন্ত্রতা বজায় রাখতে চায়। জাতীয় স্বার্থ ও নবলব্ধ স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য ভারত জোটনিরপেক্ষ বিদেশনীতি গ্রহণ করে। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী উল্লেখযােগ্য কিছু দেশ হল ভারত, মিশর, যুগােশ্লাভিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ঘানা, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি। এই আন্দোলনের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য নেতা ছিলেন ভারতের জওহরলাল নেহরু, মিশরের গামাল আবদেল নাসের, যুগােশ্লাভিয়ার মার্শাল টিটো,ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, ঘানার নকুমা প্রমুখ। এই নীতি অনুসরণের ফলে ভারত এই দুই রাষ্ট্রের জোট এবং সেগুলির তাত্ত্বিক প্রভাব থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল।

[2] বান্দুং সম্মেলন: ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে এশিয়ার ১৪টি দেশ নিজেদের মধ্যে ঐক্য সুদৃঢ়করণে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। এর ফলে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং শহরে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের ২৯টি দেশের প্রতিনিধিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে মিলিত হন যা বান্দুং সম্মেলন নামে পরিচিত। এই সম্মেলনের মূল উদ্যোগকারী দেশগুলি ছিল ইন্দোনেশিয়া, বার্মা, পাকিস্তান, সিংহল ও ভারত এবং এই সম্মেলনের মধ্যমণি ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান জওহরলাল নেহরু। বান্দুং সম্মেলনে জওহরলাল নেহরু ঘােষিত দশশীল নীতি জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিল বলে মনে করা হয়।

আনুষ্ঠানিকভাবে জোটনিরপেক্ষ নীতির শর্তাবলি আলােচনা করার জন্য বেলগ্রেড-এ প্রথম জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে আয়ােজিত হয়। ৫ থেকে ১২ জুন মিশরের রাজধানী কায়রােতে একটি Preparatory Conference অনুষ্ঠিত হয়। এখানে ২২টি দেশের বিদেশমন্ত্রী এক বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্য রাষ্ট্রগুলির জন্য নির্ধারিত নিয়মাবলি ও যােগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারিত করা হয়। এগুলি হল —

[i] জোটনিরপেক্ষ সদস্যপদপ্রার্থী দেশকে স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র নীতি মেনে চলতে হবে।

[ii] জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের আদর্শকে সম্মান জানিয়ে বিভিন্ন দেশের উপনিবেশবিরােধী জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে সমর্থন জানাতে হবে।

[iii] পরস্পরবিরােধী রাষ্ট্রজোটগুলির অন্তর্বর্তী সংঘাত বা প্রভাবকে এড়িয়ে চলতে হবে এবং ঠান্ডা যুদ্ধের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে এমন কোনাে পারস্পরিক সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া যাবে না।

[iv] রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থানগত ভিন্নতা সত্ত্বেও জোটনিরপেক্ষ দেশগুলিকে পারস্পরিক সহাবস্থান নীতি মেনে চলতে হবে।

[v] কোনাে সদস্য দেশ আঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষার জন্য কোনাে বৃহৎ শক্তিশালী দেশের সাথে যদি সামরিক সমঝােতা করে, তবে সেটিকে ঠান্ডা যুদ্ধের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে।

[vi] জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণকারী কোনাে দেশ তার ভূখণ্ডকে বিদেশি শক্তির সামরিক স্বার্থে প্রদান করলেও সেই ভূখণ্ডকে ঠান্ডা যুদ্ধের স্বার্থে ব্যবহার করা যাবে না।

জোটনিরপেক্ষ নীতির সাফল্য:


[1] দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়


কোরিয়া সমস্যা: ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ সংক্রান্ত জটিল সমস্যা সমাধানে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে ভারত এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সােভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। প্রথমে কোনাে পক্ষই ভারতকে আমল না দিলেও পরে যুদ্ধবিরতির উদ্যোগকে উভয় শক্তিই স্বাগত জানায়। যুদ্ধবিরতির পর বন্দি বিনিময় নিয়ে সমস্যা দেখা দিলে ভারতের মধ্যস্থতায় জেনারেল থিমাইয়ার নেতৃত্বে এই সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান হয়।

ভিয়েতনাম সমস্যা: ইন্দোচিনে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম ও পরে ভিয়েতনাম সমস্যা সমাধানেও ভারতের ভূমিকা ছিল খুবই উল্লেখযােগ্য। ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এই অঞ্চলের জনসাধারণের মুক্তিসংগ্রামকে ভারত খােলা মনে সমর্থন করে। এ ব্যাপারে সম্মেলনের যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করার জন্য তিনটি কমিশন নিযুক্ত হয়। সেগুলির সভাপতি নিযুক্ত হন জে.এম. দেশাই, জে.এন. খালা এবং জে.পার্থসারথী।

চিনকে জাতিপুঞ্জের সদস্য মনােনয়ন: ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে চিনে সাম্যবাদী প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হলে মার্কিনজোট প্রজাতন্ত্রী চিনকে জাতিপুঞ্জে স্বীকৃতি দেয়নি। বিবাদ থাকা সত্ত্বেও চিনকে জাতিপুঞ্জের সদস্য করার পক্ষে সমর্থন জানিয়ে ভারত জোরালাে বক্তব্য রাখে। অবশেষে কমিউনিস্ট চিনকে জাতিপুঞ্জ বাবা রাষ্ট্রসংঘের সদস্যরূপে গ্রহণ করা হয়।

[2] পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকায়


মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক জোট স্থাপন: ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক জোট স্থাপনের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটো ও বাগদাদ চুক্তি ভারত অগ্রাহ্য করে।

পশ্চিম এশিয়ার মুক্তি আন্দোলন: পশ্চিম এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী সংগ্রাম ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে ভারত অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়।

সুয়েজ সংকটের সমাধান: ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে সুয়েজ সংকট এবং মিশরের ওপর ইঙ্গ-ফরাসি ও ইজরায়েলি আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারত তীব্র প্রতিবাদ জানায়। নেহরু মিশরকে সাহায্য করতে ভারতীয় সেনা পাঠানাের হুমকি দেন। জাতিপুঞ্জের হস্তক্ষেপে আক্রমণকারীরা মিশর ত্যাগ করে।

কঙ্গোতে শান্তি স্থাপন: কঙ্গােকে ঐক্যবদ্ধ রেখে সেখানে শান্তি স্থাপনের জন্য রাষ্ট্রসংঘ বাহিনীকে সাহায্য করতে ভারত সেনাদল পাঠায়।

[3] তৃতীয় বিশ্বের নেতৃত্বদানে: ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ভারত ও চিনের মধ্যে পঞ্চশীল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। শান্তিস্থাপনে বিশ্ব এক নতুন পথনির্দেশ পায়। পরের বছরই ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং শহরে এশিয়া-আফ্রিকার ২৯টি রাষ্ট্রের এক সম্মেলনে ভারতের নেতৃত্বে বিশ্বে নির্জোট আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। পরে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে যুগােশ্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রথম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও ভারত ছিল মধ্যমণি। এইভাবে ভারত ঠান্ডা লড়াইয়ের বাইরে নির্জোট তৃতীয় বিশ্ব গঠনের পথে এগিয়ে যায়।

[4] হাঙ্গেরি সমস্যায়: ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দ হাঙ্গেরিতে সােভিয়েত আক্রমণ এবং ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে সােভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক কয়েকজন হাঙ্গেরীয় নেতার মৃত্যুদণ্ডের ঘটনায় ভারত প্রতিবাদ জানায়।

জোটনিরপেক্ষ নীতির ব্যর্থতা:


[1] ভারত-চিন বিরােধে: ভারতের নির্জোট নীতি কিন্তু চিন ও ভারতের মধ্যে বিরােধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে তিব্বতীয় ধর্মগুরু দলাই লামাকে ভারতে আশ্রয়দান এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চিনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাকে কেন্দ্র করে ভারত-চিন বিরােধ সৃষ্টি হয়।

[2] পাক-ভারত বিরােধে: কাশ্মীর প্রশ্ন, পাক-ভারত আন্তর্জাতিক সীমানা-বিরােধ ইত্যাদি পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ককে তিক্ত করে তােলে। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে নেহরু নুন চুক্তি (Nehru-Noon Treaty) দ্বারা ভারত বেরুবাড়ি অঞ্চলের একটা অংশ পাকিস্তানের হাতে তুলে দিলেও সীমানা বিরােধ থামেনি। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান কচ্ছ সীমান্তের কিছু অঞ্চল অধিকার করলে পাক-ভারত যুদ্ধ বাঁধে।