
The Era of Cold war| ঠান্ডা লড়াই এর যুগ |HS History Questions And Answers| উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস প্রশ্নোত্তর
COLD WAR |দ্বিতীয় পর্ব ( part No- 2)
Q. সুয়েজ খাল জাতীয়করণের বিরুদ্ধে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইজরায়েলের যুদ্ধ-চক্রান্ত বর্ণনা করাে
Ans : ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইজরায়েলের যুদ্ধ-চক্রান্ত :
[1] ব্রিটেনের ভূমিকা: নাসের সুয়েজ খালকে মিশরের অধীনে জাতীয়করণ করলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় প্রমাদ গােনে ব্রিটেন। কেন-না সুয়েজ খাল কোম্পানির শতকরা ৪৪ ভাগ শেয়ার ছিল ব্রিটেনের। নাসের সুয়েজ খাল জাতীয়করণের পর জানিয়েছিলেন যে, এই খালের পূর্বতন অংশীদার কোম্পানিগুলি বাজার মূল্য অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ পাবে। কিন্তু এই ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ব্রিটেনের কাছে যথেষ্ট ছিল না।
[2] ফ্রান্সের ভূমিকা: ফ্রান্সও মধ্যপ্রাচ্য থেকে অশােধিত খনিজ তেল এই পথেই জাহাজে করে নিজের দেশে নিয়ে যেত। কাজেই সুয়েজ খাল। কোম্পানির জাতীয়করণ ফ্রান্সের কাছে বিপর্যয়ের শামিল ছিল। নাসের সুয়েজ ক্যানাল কোম্পানির প্রতিটি শেয়ার-মালিককে ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত ছিলেন। তা ছাড়া সুয়েজ খাল দিয়ে রাজস্ব দানের বিনিময়ে অনুমতি সাপেক্ষে কোনাে দেশেরই জাহাজ যাতায়াতে বাধা ছিল না। আন্তর্জাতিক মানের জলপথ সুয়েজ খাল থেকে ফরাসি কোম্পানির বিশাল অঙ্কের মুনাফার উৎস বন্ধ হয়ে গেলে ফ্রান্স মিশরের সঙ্গে বিরােধিতায় লিপ্ত হয়।
[3] ইজরায়েলের ভূমিকা: ইজরায়েলও নাসেরের সুয়েজ খাল জাতীয়করণের তীব্র বিরােধিতা করে এবং ব্রিটেন ও ফ্রান্সের পাশে দাঁড়ায়। এর কারণগুলি হল—
[i] নাসের ছিলেন ইজরায়েলের শত্রু। তাই মধ্যপ্রাচ্যে নাসেরের প্রাধান্য খর্ব করে ইজরায়েল বিপন্মুক্ত হতে চেয়েছিল।
[ii] নাসের সুয়েজ খালে ইজরায়েলের জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তাই যুদ্ধে নেমে সে তার জাহাজ চলাচলকে নিশ্চিত করতে চেয়েছিল।
[iii] ইজরায়েলের ওপর আরব সন্ত্রাসবাদীদের প্রায়শই যে আক্রমণ চলছিল, তাতে মিশরের একটা ভালাে রকমের মদত রয়েছে। বলে ইজরায়েলের অভিযােগ ছিল।
এইসমস্ত কারণে মিশরকে একটা ভালােমতাে শিক্ষা দিতে ইজরায়েল ব্রিটেন ও ফ্রান্সের পক্ষ নিয়েছিল।
Q. সুয়েজ সংকট সমাধানে ভারতের ভূমিকা কী ছিল?
Ans : সুয়েজ সংকট সৃষ্টির পর থেকেই ভারত এই সংকট সমাধানের উদ্যোগ নেয়। ভারত সুয়েজ খাল ব্যবহারকারী দেশ ছিল বলে, সুয়েজ সমস্যা সমাধানে ভারতের স্বার্থ জড়িত ছিল।
[1] প্রাথমিক প্রচেষ্টা হিসেবে: সুয়েজ খাল ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে নিজস্বার্থেই ভারত সুয়েজ সমস্যা (১৯৫৬ খ্রি.) সমাধানে এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ভারত মনে করত ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দের ‘কনস্ট্যান্টিনােপল কনভেনশন’ অনুসারে সুয়েজ খাল মিশরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তবে সেই সঙ্গে সে এ-ও মনে করত যে, খাল ব্যবহারকারীদের একটি উপদেষ্টামূলক ভূমিকা থাকা দরকার।
[2] বিদেশমন্ত্রীর মাধ্যমে: ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে সুয়েজ সমস্যার সমাধানে লন্ডন সম্মেলনে মিশরের কোনাে প্রতিনিধি যােগদান না করায় ভারতের প্রতিনিধি বিদেশমন্ত্রী কৃয় মেনন দু-পক্ষের মধ্যে যােগসূত্রের ভূমিকা পালন করেছিলেন। সুয়েজ সংকট সমাধানের লক্ষ্যে কৃষ মেনন পাঁচ দফা পরিকল্পনা পেশ করেন। তিনি সুয়েজ খাল ব্যবহারকারী দেশগুলির মধ্যে এক কমিটি গঠন করে সমস্যা সমাধানের প্রস্তাব দেন। তিনি মিশরের ওপরও খাল রক্ষার দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলেন।
[3] প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে: ব্রিটেন ও ফ্রান্সের প্ররােচনায় মিশরের ওপর ইজরায়েলের আক্রমণকে ভারত সরকার কঠোরভাবে নিন্দা করে। প্রধানমন্ত্রী নেহরু এটিকে এক নগ্ন আক্রমণ বলে নিন্দা করেন।
[4] জাতিপুঞ্জে যােগদান: জাতিপুঞ্জের শান্তিরক্ষা বাহিনী হিসেবে ভারত মিশরে সেনা পাঠায়। যুদ্ধবিরতি কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে এবং বিদেশি সৈন্য অপসারণের বিষয়ে জাতিপুঞ্জে আলােচনা কালে ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ঠান্ডা লড়াই এর যুগ|Era of Cold War
Q. কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও ।
Ans: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ক্যারিবিয়ান সাগরে অবস্থিত পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে সর্ববৃহৎ দ্বীপ কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি নির্মাণকে কেন্দ্র করে সােভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এক স্বল্পকালীন দ্বন্দ্ব শুরু হয় যার নাম কিউবার ক্ষেপনাস্ত্র সংকট।
[1] পটভূমি: কিউবা ১৮৯৮ খ্রি. স্পেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার পর উন্নতির লক্ষ্যে মার্কিন মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে। এই সুযােগ নিয়ে মার্কিন পুঁজিপতিরা কিউবার অর্থনীতির মূলভিত্তি আখের খেতের ৪০ ভাগ দখল করে নেয়। কিউবার ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমেরিকা তার অনুগামী ফ্যালজেনিকো বাতিস্তাকে ১৯৫৪ খ্রি. রাষ্ট্রপতি পদে বসায়। কিন্তু তিনি মার্কিন পুঁজিবাদের তাঁবেদারে পরিণত হওয়ায় কিউবাবাসী বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়।
[2] ফিদেল কাস্ত্রোর ভূমিকা: বাতিস্তা সরকারের জনবিরােধী কাজকর্মের প্রতিবাদে কিউবার তৎকালীন ছাত্রনেতা ফিদেল কাস্ত্রো তীব্র সরকারবিরােধী আন্দোলন গড়ে তােলেন। ক্রমশ জনসমর্থন আদায় করে এক বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের দ্বারা বাতিস্তা সরকারের পতন ঘটিয়ে। কাস্ত্রো কিউবার ক্ষমতা দখল করেন (১৯৫৯ খ্রি., ১ জানুয়ারি)। কিউবার রাষ্ট্রপতি কাস্ত্রো এরপর পুঁজিবাদী আমেরিকার দিক থেকে সরে এসে রাশিয়া, চিন ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তােলার উদ্যোগ নেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি কিউবায় মার্কিন পুঁজিপতিদের চিনি কলগুলি জাতীয়করণ করেন। তার পাশাপাশি মার্কিন পুঁজিপতি গােষ্ঠীর পরিচালনাধীন ব্যাংক ও অন্যান্য শিল্পকেন্দ্রগুলিও জাতীয়করণ করেন।
[3] কাস্ত্রো অপসারণে আমেরিকার ভূমিকা: আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র কাস্ত্রোর এরকম কার্যকলাপে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে নানাভাবে কাস্ত্রো সরকারের পতনের পরিকল্পনা নেয়। মার্কিন গােয়েন্দা বিভাগের (CIA) গােপন সহায়তায় ১,৪০০ ভাড়াটে সৈন্য মার্কিন জাহাজে করে কিউবার ফ্লোরিডা উপকূলের কাছে পিগ উপসাগরে পৌছােয়। বিদ্রোহীদের সহায়তার জন্য মার্কিন বি-২৬ বিমান প্রস্তুত ছিল। কিন্তু কিউবার সেনাদল তাদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করলে মার্কিন চক্রান্ত ব্যর্থ হয়।
[4] কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি গঠন: কাস্ত্রো সরকার ৫০ লক্ষ কিউবাবাসীকে রক্ষার জন্য রাশিয়ার সাহায্যে কিউবাতে একটি ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে কিউবার রাষ্ট্রপতি ফিদেল কাস্ত্রো রাশিয়া থেকে মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র (IRBM অর্থাৎ Intermediate Range Ballistic Missiles) গােপনে আমদানি করে কিউবাতে প্রতিস্থাপন করেছিলেন।
ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের গুরুত্ব
[1] যুদ্ধােদ্যোগ হ্রাসে: এই সংকটের ফলেই শেষপর্যন্ত মস্কো ও ওয়াশিংটনের তরফে যুদ্ধাদ্যোগ হ্রাস পেতে থাকে।
[2] মানবতার জয়ে: কিউবা সংকটকে কেন্দ্র করেই রুশ-মার্কিন উভয় পক্ষই আণবিক যুদ্ধের ভয়াবহতা উপলদ্ধি করতে সক্ষম হয়। ফলে হিংসার বিরুদ্ধে সংযম, শুভবুদ্ধি ও মানবতাবাদ শেষপর্যন্ত জয়যুক্ত হয়। ধ্বংসের হাত থেকে পৃথিবী রক্ষা পায়।
[3] পারস্পরিক আলােচনায়: উভয়শক্তিই এরপর থেকে পারস্পরিক আলােচনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানের পথ গ্রহণ করে। উভয়ের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করে।
[4] পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা নিরােধ চুক্তিতে: এই সংকটের এক গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি হল পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা নিরােধ চুক্তি স্বাক্ষর। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে সােভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা ও ফ্রান্সের মধ্যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়।
[5] হটলাইন স্থাপনে: এই সংকটের পরবর্তী সময় থেকে যে কোনাে সংকটের সরাসরি সমাধানের জন্য হােয়াইট হাউস ও ক্রেমলিনের মধ্যে হটলাইন-এর মাধ্যমে টেলিযােগাযােগ স্থাপিত হয়।
[6] কিউবায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়: ভৌগােলিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এত কাছাকাছি একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য, কিউবাই হল পশ্চিম গােলার্ধের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
অবশেষে (২০ নভেম্বর, ১৯৬২ খ্রি.) সােভিয়েত রাশিয়া কিউবা থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি সরিয়ে নিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও কিউবার বিরুদ্ধে নৌ অবরােধ তুলে নেয়। এইভাবে দুই মহাশক্তিশালী রাষ্ট্রের শুভবুদ্ধির প্রভাবে বিশ্ব একটি সর্বনাশা মহাযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা পায়।
ঠান্ডা লড়াই এর যুগ|Era of Cold War
আরও দেখুন : ঠান্ডা লড়াই এর যুগ (প্রথম পর্ব)
Q. কোরিয়া সংকট বা কোরিয়া যুদ্ধের বর্ণনা দাও।
Ans: সূচনা: ১৯৪৫ সালে কোরিয়াবাসীর অনুমতি ছাড়াই কোরিয়াকে উত্তর ও দক্ষিণ ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। এর ফলে সৃষ্টি হয় কোরিয়া সংকট বা কোরিয়া যুদ্ধ।
[1] সংকটের সূত্রপাত: কোরিয়া ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা পর্যন্ত জাপানের কর্তৃত্বাধীন ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে মার্কিন সেনা ও সােভিয়েত লালফৌজ জাপানের হাত থেকে কোরিয়াকে মুক্ত করে। অবশেষে জাপান সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হলে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে ৩৮° অক্ষরেখা বরাবর কোরিয়ার উত্তরাংশে রাশিয়ার ও দক্ষিণাংশে আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।
[2] সমস্যা সমাধানে কমিশন গঠন: ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে মস্কোয় রাশিয়া-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিলিত হয়ে এক যুগ্ম কমিশন’ গঠন করে। এই কমিশন কোরিয়ার অস্থায়ী স্বাধীন সরকার গঠন করবে বলে ঘােষণা করা হয়। কিন্তু আদর্শগত মতানৈক্যের কারণে যুক্তরাষ্ট্র তখন বিষয়টি রাষ্ট্রসংঘে উত্থাপন করলে সমস্যা সমাধানের জন্য সাধারণ সভা ৯ টি সদস্যরাষ্ট্র নিয়ে একটি অস্থায়ী কমিশন (United Nations Temporary Commission on Korea বা UNTCOK) গঠন করে (সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭ খ্রি.)। এই কমিশনের ওপর কোরিয়া থেকে বিদেশি সেনা অপসারণ এবং শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব অর্পিত হয়। ভারতীয় কূটনীতিবিদ কে. পি. এস. মেনন এই কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।
[3] দক্ষিণ কোরিয়ায় সরকার গঠন: রাষ্ট্রসংঘের অস্থায়ী কমিশনের সদস্যদের রাশিয়া উত্তর কোরিয়ায় প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। রাষ্ট্রসংঘ তখন নিজ তত্ত্বাবধানে দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি নির্বাচনের আয়ােজন করে (১০ মে, ১৯৪৮ খ্রি.)। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছর ১৫ আগস্ট প্রজাতান্ত্রিক কোরিয়া (Republic of Korea) নামে সেখানে মার্কিন-প্রভাবিত একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সিওল হয় এর রাজধানী। এই সরকারকেই রাষ্ট্রসংঘ সমগ্র কোরিয়ার একমাত্র বৈধ সরকার বলে স্বীকৃতি জানায় (১২ ডিসেম্বর, ১৯৪৮ খ্রি.)। পরের বছর ১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রও প্রজাতান্ত্রিক কোরিয়া তথা দক্ষিণ কোরিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দান করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র সবদিক থেকেই কোরিয়াকে সাহায্য করতে থাকে। মার্কিন মদতপুষ্ট সিংম্যান রি ছিলেন এই সরকারের প্রধান।
[4] উত্তর কোরিয়ার আগ্রাসন: দক্ষিণ কোরিয়াকে কেন্দ্র করে সুদূরপ্রাচ্যে যখন একটি মার্কিন ঘাঁটি তৈরি হচ্ছে, তখন কোরিয়া সমস্যাকে আরও জটিল করে তােলেন উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট নেতা কিম ইল সুঙ। সােভিয়েত মদতে তিনি সেখানে গণতান্ত্রিক কোরিয়া (Peoples’ Democratic Republic of Korea) নামে একটি সরকার গঠন করেন। পিয়ং ইয়ং হয় এর রাজধানী। এই সরকারের সেনাবাহিনী কোনাে পূর্বাভাস ছাড়াই হঠাৎ ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জুন ৩৮°অক্ষরেখা অতিক্রম করে দক্ষিণে প্রবেশ করলে দু-পক্ষের মধ্যে শুরু হয় প্রত্যক্ষ লড়াই।
[5] আন্তর্জাতিক সেনা প্রেরণ: নিরাপত্তা পরিষদ উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণকারী বলে চিহ্নিত করে এবং কোরিয়ায় রাষ্ট্রসংঘের সেনাবাহিনী পাঠানাের সিদ্ধান্ত নেয়।
[6] চিনের অংশগ্রহণ: রাষ্ট্রসংঘ প্রেরিত বাহিনীর প্রধান জে. ম্যাক আর্থার দক্ষিণ কোরিয়া থেকে শত্রুসেনা বিতাড়িত করার পর ৩৮° অক্ষরেখা অতিক্রম করে উত্তর কোরিয়ায় ইয়ালু নদীর তীর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে সেখানে বােমাবর্ষণ করলে চিন তার তীব্র প্রতিবাদ জানায়। এরপরই চিন কোরিয়া যুদ্ধে যােগদান করে এবং অতি দ্রুত দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিওল দখল করে নেয় (৪ জানুয়ারি, ১৯৫১ খ্রি.)।
[7] যুদ্ধের অবসান: শেষপর্যন্ত ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জুলাই উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ং ইয়ং-এ উভয়পক্ষের যুদ্ধবিরতি ঘটে। পূর্বের মতাে ৩৮° অক্ষরেখা ধরেই দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রসীমা নির্ধারিত হয়।
[8] কোরিয়া যুদ্ধের ফলাফল
বিভাজন স্বীকার: বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে দুই কোরিয়ার সংযুক্তি তাে দূরের কথা, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিভাজনকেই মেনে নিতে হয়।
মানবিক ও আর্থিক ক্ষতি: যুদ্ধেদুই কোরিয়ারই প্রচণ্ড ক্ষতি হয়। মার্কিনি, কোরীয়, চিনা সব মিলিয়ে ২৫ লক্ষেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
আমেরিকার সামরিক শক্তিবৃদ্ধির প্রস্তুতি: যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধের পর তার সামরিক বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তােলার প্রস্তুতি নেয়।
ঠান্ডা লড়াইয়ের বিস্তার: এই যুদ্ধের ফলে ঠান্ডা লড়াই সমগ্র প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে।
উপসংহার: কোরিয়ার যুদ্ধ প্রকৃত অর্থে ছিল অনাবশ্যক ও নিষ্ফল, কেননা দীর্ঘস্থায়ী এই যুদ্ধের ফল ছিল শূন্য।
ঠান্ডা লড়াই এর যুগ|Era of Cold War
Q. কোরিয়া যুদ্ধের কারণ গুলি কী ছিল ।
And: [1] রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়। ফলে জাপান অধিকৃত কোরিয়ার উত্তরাংশ রাশিয়ার কাছে এবং দক্ষিণাংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এসময় থেকে কোরিয়ার ৩৮° উত্তর অক্ষরেখার উত্তরাংশে রাশিয়া এবং ৩৮° উত্তর অক্ষরেখার দক্ষিণাংশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।
[2] অস্থায়ী কমিশনের ব্যর্থতা: কোরিয়ার সমস্যা নিয়ে মস্কোতে সােভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় (১৯৪৫ খ্রি., ডিসেম্বর)। এই বৈঠকে উভয় রাষ্ট্র এক যুগ্ম কমিশন গঠনের কথা বলে। এই কমিশনের নেতৃত্বে কোরিয়ার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে এক অস্থায়ী স্বাধীন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু এই উদ্যোগ শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়।
[3] কোরিয়ায় দুই সরকার প্রতিষ্ঠা: অস্থায়ী কমিশনের উদ্যোগ ব্যর্থ হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোরিয়ার সমস্যাকে জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভায় উত্থাপন করে। সাধারণ সভা তার ৯টি সদস্যরাষ্ট্র নিয়ে একটি অস্থায়ী কমিশন (United Nations Temporary Commission on Korea বা UNTCOK) গঠন করে। এই কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্তি হন বিশিষ্ট ভারতীয় কূটনীতিবিদ কে. পি. এস. মেনন। এই কমিশনের ওপর কোরিয়ায় জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু রাশিয়া জাতিপুঞ্জের সদস্যদের উত্তর কোরিয়ায় প্রবেশ করতে দেয়নি। তাই জাতিপুঞ্জের তত্ত্বাবধানে দক্ষিণ কোরিয়ায় নির্বাচনের (১০ মে, ১৯৪৮ খ্রি.) মাধ্যমে এক গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। মার্কিন প্রভাবিত এই সরকারের প্রধান হন সিংম্যান রি (১৯৪৮ খ্রি., ১৫ আগস্ট)। ঠিক একই সময়ে উত্তর কোরিয়াতেও কমিউনিস্ট নেতা কিম-ইল-সুঙের নেতৃত্বে সােভিয়েত প্রভাবিত একটি সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
[4] দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর উত্তর কোরিয়ার আক্রমণ: জাতিপুঞ্জের অস্থায়ী কমিশন এবং নিরাপত্তা পরিষদ উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণকারী বলে চিহ্নিত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিপুঞ্জ দক্ষিণ কোরিয়ার পাশে দাঁড়ালে রাশিয়া ও চিন উত্তর কোরিয়ার পক্ষ নেয়। ফলে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ বাধে।
ঠান্ডা লড়াই এর যুগ|Era of Cold War
Q. কোরিয়া সংকট সৃষ্টিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী ছিল ?
Ans: [1] সংকটে অংশগ্রহণ: উত্তর কোরিয়া ছিল রাশিয়ার দখলে। রাশিয়া এখানে তাদের অনুগত একটি কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। অপরদিকে দক্ষিণ কোরিয়া ছিল মার্কিন অধীনস্থ। উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করলে আমেরিকা দক্ষিণ কোরিয়াকে সব ধরনের সাহায্য দেওয়া শুরু করে। জাতিপুঞ্জ উত্তর কোরিয়াকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং মার্কিন সেনাপতি ডগলাস ম্যাকআর্থারকে জাতিপুঞ্জ বাহিনীর সেনাপতি করে আমেরিকা কোরিয়া যুদ্ধে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।
[2] সংকট সৃষ্টিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব
রাষ্ট্রপুঞ্জকে প্রত্যক্ষ মদত দান: আমেরিকার প্রত্যক্ষ যােগদানের জন্যই কোরিয়া যুদ্ধ বা কোরিয়া সংকট ধনতন্ত্র ও সাম্যবাদের ঠান্ডা লড়াইয়ের আবর্তে রূপান্তরিত হয়। আমেরিকার প্রচ্ছন্ন মদতেই জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণকারী দেশরূপে চিহ্নিত করেছিল।
সেনা প্রেরণে: মার্কিন রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান দক্ষিণ কোরিয়াকে সব ধরনের সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতি দেন (১৯৫০ খ্রি., ২৫ জুন)। এই উদ্দেশ্যে তিনি মার্কিন সেনানায়ক জেনারেল ম্যাক আর্থারকে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দেন। জাতিপুঞ্জের সমর্থন থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কোনাে অসুবিধে হয়নি।
যুদ্ধবিরতিতে: দীর্ঘ আলাপ-আলােচনার পর অবশেষে ১৯৫৩ খ্রি. ২৭ জুলাই উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পানমুনজমে উভয়পক্ষের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
সীমারেখা স্থিরীকরণে: এই শান্তিচুক্তির দ্বারা ৩৮° অক্ষরেখাকে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার সীমারেখা বলে ঘােষণা করা হয়।
ঠান্ডা লড়াই এর যুগ|Era of Cold War
Q. কোরিয়া সংকটের সমাধানে ভারতের ভূমিকা কী ছিল?
Ans: সূচনা: কোরিয়া যুদ্ধে ভারত এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জওহরলাল নেহরুর প্রধানমন্ত্রিত্বে ভারত সরকার কোরিয়া সমস্যায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বিশ্বের দরবারে প্রশংসিত হয়।
কোরিয়া সংকটের সমাধানে ভারতের ভূমিকা
[1] যুদ্ধবিরতি ঘােষণায়: দুই কোরিয়ার মধ্যে সমস্যার সূচনা লগ্নেই তা সমাধানের উদ্দেশ্যে জাতিপুঞ্জ ৯ জন সদস্যের একটি অস্থায়ী কমিশন (United Nations Temporary Com mission on Korea বা UNTCOK) গঠন করে। যার সভাপতি ছিলেন, বিশিষ্ট ভারতীয় কূটনীতিবিদ কে.পি.এস. মেনন। প্রতিবেদনে মেনন বৃহৎ শক্তিবর্গকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই সমস্যা মিটিয়ে নেবার আহবান জানান এবং তা না হলে এক ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে সাবধান করে দেন। এই কমিশনের দায়িত্ব ছিল শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে কোরিয়ায় একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা। অবশেষে ভারতের অদম্য প্রচেষ্টায় ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জুলাই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছিল।
[2] যুদ্ধবন্দি সমস্যায়: যুদ্ধ শেষে যুদ্ধবন্দি সমস্যার সমাধানের জন্য ভারতের জেনারেল থিমাইয়ার সভাপতিত্বে গঠিত হয় ‘নিরপেক্ষ রাষ্ট্রসমূহের প্রত্যাবাসন কমিশন (Neutral Nations Repatriation Commission)। নিরপেক্ষ রাষ্ট্রজোটের এই কমিশন ঘােষণা করে যেㅡ
[a] স্বদেশে ফিরতে না চাওয়া যুদ্ধবন্দিরা নিরপেক্ষ দেশে বাস করতে পারবেন।
[b] স্বদেশে ফিরতে অনিচ্ছুক যুদ্ধবন্দিরা বেসামরিক ব্যক্তিরূপে চিহ্নিত হবেন। অনিচ্ছুক ও বেসামরিক ১৫ হাজার যুদ্ধবন্দি ফরমােজা (তাইওয়ান) এবং ৭ হাজার উত্তর কোরিয়ান যুদ্ধবন্দি দক্ষিণ কোরিয়ায় বসবাস করতে পারবেন।
[c] যুদ্ধবন্দিদের ৬০ দিনের মধ্যে নিজ নিজ দেশে ফেরৎ পাঠাতে হবে। কমিশনের এই ঘােষণায় যুদ্ধবন্দি সমস্যার সন্তোষজনক মীমাংসা হয়।
[3] শান্তির প্রতি দায়বদ্ধতায়: দুই কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে নিরাপত্তা পরিষদের সঙ্গে ভারতও উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণকারী বলে চিহ্নিত করে। তবে কোরিয়া সমস্যার সমাধানে তৃতীয় কোনাে পক্ষের হস্তক্ষেপের প্রস্তাবে ভারত প্রতিবাদ জানায়। ভারত জানায়, এতে কোরিয়া সমস্যা আরও জটিল হবে। ভারতের লক্ষ্য ছিল যুদ্ধের কর্মসূচি থেকে উভয়পক্ষকে সরিয়ে শান্তির পথে নিয়ে আসা। এই প্রতিবাদে শান্তির প্রতি ভারতের দায়বদ্ধতা সুস্পষ্ট হয়।
[4] মার্কিন আগ্রাসনের বিরােধিতায়: তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক রাষ্ট্রসংঘকে তাঁবেদার সংগঠনে পরিণত করার প্রচেষ্টাকে সমালােচনা করেন। তিনি এ ব্যাপারে স্পষ্ট ভাষায় ভারতের উদ্দেশ্য বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন ভারত স্থায়ীভাবে নিরপেক্ষ নয়; জোটবদ্ধ তাে নয়ই। উত্তর কোরিয়ার বিরােধিতা করার অর্থ পশ্চিমি দেশগুলিকে তােষণ করা নয়।
[5] চিন-কোরিয়া যুদ্ধবিরতিতে: জাতিপুঞ্জের শান্তিরক্ষা বাহিনী উত্তর কোরিয়া দখলের পর চিন সীমান্তে ইয়ালু নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে বােমাবর্ষণ শুরু করলে সােভিয়েত মদতপুষ্ট চিনের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী জাতিপুঞ্জের বাহিনীর ওপর পালটা আক্রমণ করে। চিনা বাহিনী দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিওল দখল করে নিলে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি টুম্যান সেনাপতি জেনারেল ম্যাক আর্থারকে বরখাস্ত করে চিনের সঙ্গে সমঝােতা চায়। অবশেষে সােভিয়েতের মধ্যস্থতায় উভয়ের মধ্যে যে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব আসে ভারত তাতে সমর্থন জানায়। ভারতের সভাপতিত্বে একটি নিরপেক্ষ কমিশনের ওপর দুই দেশের বন্দি বিনিময় দায়িত্ব দেওয়া হয়। ইতিপূর্বে জাতিপুঞ্জে চিনকে আক্রমণকারী বলে অভিহিত করে একটি প্রস্তাব পাস হলে ভারত তার বিরােধিতা করে।
[6] জোটনিরপেক্ষতার সুদৃঢ়করণে: ভারত যে জোটনিরপেক্ষ নীতির প্রতি আন্তরিকভাবে বিশ্বাসী তা কোরিয়ার যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা থেকে পরিস্ফুট হয়। ভারতের জোটনিরপেক্ষতার মধ্যে যে কোনাে খাদ নেই, তা বােঝা যায় যখন নেহরু সরকার প্রথমে উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণকারী দেশ হিসেবে ঘােষণা করে এবং পরে মার্কিন নীতির সমালােচনা করে।
[7] পরস্পরবিরােধী সমালােচনা:
[i] কোরিয়া যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ মীমাংসার লক্ষ্যে ভারতের ভূমিকাকে চিন ও রাশিয়া পশ্চিমি তােষণ বলে সমালােচনা করে। আবার,
[ii] আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশ কোরিয়ার সমস্যায় ভারতের ভূমিকাকে কমিউনিস্ট তােষণ বলে সমালােচনা করে।
উপসংহার: কোরিয়ার সংকট বা কোরিয়া যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ মীমাংসা ভারত মনেপ্রাণেই চেয়েছিল। ভারতের এই আন্তরিক, সৎ ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পরােক্ষভাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে উৎসাহিত করেছিল।
ঠান্ডা লড়াই এর যুগ|Era of Cold War

Q. হাে-চি-মিনের নেতৃত্বে ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
Ans: সূচনা: হাে-চি-মিনের নেতৃত্বে, ভিয়েতনামবাসী (১৯৪৫-৭৫ খ্রি.) যে সংগ্রাম চালিয়েছিল, তা ইতিহাসে ভিয়েতনাম যুদ্ধ নামে পরিচিত। ভিয়েতনাম যুদ্ধে ভিয়েতনামিরা প্রথমে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদ ও পরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে ধ্বংস করে স্বাধীনতা অর্জন করে।
[1] প্রথম পর্ব (১৯৪৫-৫৪ খ্রি.)
ফরাসি নীতি: ফ্রান্স প্রথমে দক্ষিণ ইন্দোচিনে আধিপত্য কায়েম করেছিল। কিন্তু ফ্রান্স শুধুমাত্র তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে রাজি ছিল না। সে চেয়েছিল গােটা ইন্দোচিনে ফরাসি আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে। অপরদিকে হাে-চি-মিন চেয়েছিলেন ভিয়েতনামের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধের সূচনা ঘটে।
ভিয়েতমিন-ফ্রান্স চুক্তি: ভিয়েতনাম সংঘর্ষের প্রথম দিকে ভিয়েতমিন ও ফ্রান্সের মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় (১৯৪৬ খ্রি., ১ মার্চ), যাতে ফ্রান্স ভিয়েতনামকে ইন্দোচিন ফেডারেশন ও ফরাসি ইউনিয়নের অংশরূপে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে ফ্রান্স হাইফং অঞ্চলে বােমা নিক্ষেপ করে ৬ হাজার নিরীহ অসামরিক ভিয়েতনামিকে হত্যা করলে সংঘর্ষ শুরু হয়।
ইন্দোচিনে স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা: ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর থেকে টানা তিন বছর সংঘর্ষের পর বাওদাইয়ের নেতৃত্বে ইন্দোচিনে এক স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
নেভারে প্ল্যান-দিয়েন-বিয়েন-ফু ঘটনা: ফরাসি বাহিনী ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের শেষদিক থেকে একের পর এক রণক্ষেত্রে হারতে থাকে। এই অবস্থায় ফরাসি সেনাপতি নেভারে ভিয়েতমিনদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করার উদ্দেশ্য এক নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, যা নেভারে প্ল্যান নামে পরিচিত। এই পরিকল্পনা অনুসারে ফ্রান্স উত্তর ভিয়েতনামের টংকিং-এর দিয়েন-বিয়েন-ফু নামে একটি স্থানে অস্ত্রশস্ত্র সমেত একটি দুর্ভেদ্য ঘাঁটি নির্মাণ করে। কিন্তু সেনাপতি জেনারেল নগুয়েন গিয়াপের নেতৃত্বে ভিয়েতমিন সেনারা ফরাসি সেনাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করে।
[2] জেনেভা সম্মেলন (১৯৫৪ খ্রি.): জেনেভা সম্মেলনে ২০ জুলাই যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পাদিত হয়। নির্ধারিত হয়-
[i] ১৭°অক্ষরেখা বরাবর ভিয়েতনামকে দু-ভাগে ভাগ করা হবে।
[ii] ওই অক্ষরেখার উত্তরাঞ্চলে ভিয়েতমিনদের এবং দক্ষিণাঞ্চলে ফরাসি নিয়ন্ত্রণাধীন ন-দিন-দিয়েমের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।
[iii] উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের কোথাও কোনাে বিদেশি সেনা থাকবে না।
[iv] ভিয়েতনামের ওই বিভাজন হবে সম্পূর্ণ অস্থায়ী।
[v] শান্তিপূর্ণ উপায়ে দুই ভিয়েতনামের মিলনের জন্য রাষ্ট্রসংঘগঠিত একটি তদারকি কমিশনের নেতৃত্বে নির্বাচন আহ্বান করা হবে (১৯৫৬ খ্রি., জুলাই)।
[3] দ্বিতীয় পর্ব (১৯৫৬-৭৫ খ্রি.)
জেনেভা সম্মেলনের ব্যর্থতা: জেনেভা সম্মেলনের (১৯৫৪ খ্রি.) দ্বারা ভিয়েতনাম সমস্যার সমাধান হয়নি। জেনেভা সম্মেলন ভিয়েতনাম যুদ্ধের একটা অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটালেও আর একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।
যুদ্ধে আমেরিকার অংশগ্রহণ: ইন্দোচিনে হাে-চি-মিন এর প্রভাব-প্রতিপত্তিকে আটকানাের জন্য ফরাসি নিয়ন্ত্রণাধীন ন-দিন- দিয়েম-কে দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপতি পদে বসানাে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ভিয়েতনামে ব্যাপক আর্থিক ও সামরিক সাহায্য পাঠাতে শুরু করে।
ভিয়েতকংদের সঙ্গে সংঘর্ষ: উত্তর ভিয়েতনামে মার্কিন অপচেষ্টাকে রুখে দিয়ে হাে-চি-মিন বিভিন্ন জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি রূপায়ণের দ্বারা নিজের সরকারের জনপ্রিয়তা অক্ষুন্ন রাখেন। অপরদিকে দক্ষিণ ভিয়েতনামে দিয়েম সরকার নির্বাচনের বিরােধিতা করলে, সমগ্র ইন্দোচিন জুড়ে প্রবল বিক্ষোভ দেখা দেয়। দক্ষিণ ভিয়েতনামে নবগঠিত জাতীয় মুক্তি ফ্রন্টের যােদ্ধ ভিয়েতকংদের সঙ্গে দিয়েম সরকারের সংঘর্ষ বাঁধে।
স্বৈরাচারী দিয়ে সরকারের পতন: ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ভিয়েতকংদের বিরুদ্ধে মার্কিন ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম বাহিনী একজোট হয়ে আক্রমণ করে। ভিয়েতনামে মার্কিন হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে গােটা বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়। এদিকে গণ- অভ্যুত্থানে দিয়েম সরকারের পতন ঘটে (১৯৬৩ খ্রি., নভেম্বর)।
স্বাধীন ভিয়েতনামের আত্মপ্রকাশ: ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জানুয়ারি উত্তর ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ে আমেরিকার সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভিয়েতনাম থেকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাস নাগাদ দক্ষিণ ভিয়েতনামের জেনারেল ভ্যান-মিন সায়্যানে ভিয়েতকংদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম ঐক্যবদ্ধ হয়। আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন ঐক্যবদ্ধ সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনাম প্রজাতন্ত্রের (Socialist Republic of Vietnam)
উপসংহার: হাে-চি-মিনের নেতৃত্বে ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মুক্তিযুদ্ধগুলােতে অনুপ্রেরণা জোগায়।
You must be logged in to post a comment.