
ঠান্ডা লড়াই এর যুগ | The Era of the Cold War|HS History Questions And Answers
প্রথম পর্ব ( Part No-1)
Question. পটসডাম সম্মেলনের বর্ণনা দাও ।
পটভূমি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে যেসব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল পটসডাম সম্মেলন। জার্মানির রাজধানী বার্লিনের পাশে পটসডাম শহরে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুলাই থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত ১৫ দিনব্যাপী চলা এই সম্মেলনে মিলিত হন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হ্যারি এস. ট্রুমান, সােভিয়েত রাষ্ট্রনায়ক ই. স্টালিন এবং প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল।
আলােচ্য বিষয় :
1.জার্মানির কাছ থেকে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ আদায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে জার্মানির সমাজব্যবস্থার পুনর্গঠন।
2.ইয়াল্টা সম্মেলনের ঘােষণাপত্রগুলির মূল্যায়ন।
পােল্যান্ডের পশ্চিম সীমান্ত নির্ধারণ।
পটসডাম সম্মেলন গৃহীত সিদ্ধান্ত :
1.ব্রিটেন, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে একটি কাউন্সিল গঠন করা হবে। এই কাউন্সিল জার্মানি, ইতালি, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি ও ফিনল্যান্ডের সঙ্গে শান্তি চুক্তির খসড়া তৈরি করবে।
2.জার্মানিকে আশ্বাস দিয়ে বলা হয় যে, জার্মান জাতির স্বাধীনতা রক্ষা করা হবে। এর পাশাপাশি জার্মানিতে গণতান্ত্রিক মূল্যবােধ রক্ষা, রাজনৈতিক দলগুলির অস্তিত্ব রক্ষা, নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষা করা হবে।
3.জার্মানির সমরবাদ ও নাৎসিবাদের সম্পূর্ণরূপে অবসান ঘটানাে হবে এবং সামরিক শিক্ষাকেন্দ্র ও নাৎসি প্রতিষ্ঠানগুলির অস্তিত্ব বিলােপ করা হবে।
4.জার্মানিতে যুদ্ধাস্ত্র তৈরি হয় এমন কারখানাগুলি মিত্রপক্ষ নিজেদের অধিকারে নিয়ে আসবে।
5.আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে জার্মানির যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে।
6.পূর্ব প্রাশিয়াকে ভেঙে এর পশ্চিমাঞ্চল পােল্যান্ডকে দেওয়া হবে। আর অবশিষ্ট অংশ সােভিয়েত রাশিয়া পাবে।
7.জার্মানির নৌবহরগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সােভিয়েত রাশিয়া ও ব্রিটেন নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে।
8.জার্মানির কাছ থেকে যুদ্ধের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আদায় করবে মিত্রপক্ষ নিযুক্ত কমিশন।
Era of the Cold War | উচ্চ মাধ্যমিক ইতিহাস|HS History Questions And Answers
Question: ইয়াল্টা সম্মেলনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।
পটভূমি: ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ৪ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কৃয়সাগরের পাশে ক্রিমিয়ার ইয়াল্টা প্রদেশে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ইয়াল্টা নামে পরিচিত ওই সম্মেলনে যােগ দিয়েছিলেন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল আর সােভিয়েত রাষ্ট্রনায়ক স্টালিন।
আলােচ্য বিষয়:
1.জার্মানির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা।
2. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ইউরােপের রাজনৈতিক মানচিত্রের পুনর্গঠন করা।
বিশ্বে আন্তর্জাতিক শান্তিপ্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য এক আন্তর্জাতিক সংগঠন তৈরি করা।
3. রাশিয়ার দাবিমতাে নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রয়ােগের ক্ষমতা নিয়ে আলােচনা করা।
দূরপ্রাচ্যের যুদ্ধে রাশিয়ার যােগদানের গুরুত্ব পর্যালােচনা করা।
4. পােল্যান্ডের সীমানা ও ভবিষ্যৎ সরকার গঠনের প্রশ্নের সমাধান করা।
জার্মানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ:
1.স্থির হয় নাৎসিবাদের কবল থেকে জার্মান- বাসীকে মুক্ত করা হবে এবং যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হবে।
2. জার্মানির রাজধানী বার্লিনকেও চার ভাগ করে পশ্চিমাংশ আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণে এবং পূর্বাল রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলা হয়। ইংল্যান্ড ও আমেরিকার ভাগ থেকে ফ্রান্সকে কিছুটা অংশ দেওয়া হবে বলেও ঠিক হয়।
3. স্থির হয় নবগঠিত জার্মানির শাসনতান্ত্রিক আইনকানুন আন্তর্জাতিক আইনের অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
4.সিদ্ধান্ত হয় জার্মানির অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে মিত্রপক্ষ।
5.যুদ্ধে জার্মানি মিত্রপক্ষের যে ক্ষয়ক্ষতি করেছিল তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে জার্মানির কাছ থেকে আপাতত ২০ মিলিয়ন ডলার আদায় করা হবে বলেও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
রাষ্ট্রসংঘ [United Nations] প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি :
1.রাষ্ট্রসংঘের সংবিধান রচনার জন্য আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো শহরে মিত্রপক্ষের সকল দেশ এপ্রিল মাসে মিলিত হবে।
2.রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশগুলি ভেটো প্রয়ােগের ক্ষমতা পাবে।
3.নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য দেশ অছি পরিষদের রাষ্ট্রগুলির ব্যাপারে আলােচনা করতে পারবে।
পােল্যান্ড নীতি :
1. সিদ্ধান্ত হয় দু-টুকরাে পােল্যান্ডকে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
2.পােল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় সীমানা অক্ষুন্ন রাখার জন্য জার্মানির উত্তর পশ্চিম দিকের ভূখণ্ড পাবে পােল্যান্ড।
রাশিয়ার প্রাপ্তি :
1.দক্ষিণ মাঞ্চুরিয়া রেলপথ ব্যবহারের অধিকার।
2.কিউরাইল দ্বীপপুঞ্জ, শাখালিনের দক্ষিণাংশ এবং তার নিকটবর্তী উপদ্বীপ।
3.দাইরেনের বন্দরকে আন্তর্জাতিক বন্দর হিসেবে ঘােষণা করা হয়, সেখানে রাশিয়াকে বিশেষ সুযােগসুবিধা ও অধিকার প্রদান করা হয়।
4.পোর্ট আর্থারকে নৌ-ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারের জন্য রাশিয়াকে ৯১ বছরের লিজের অধিকার প্রদান করা হয়।
Era of the Cold War
Question: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে পৃথিবীতে ঠান্ডা লড়াইয়ের উদ্ভবের কারণগুলি উল্লেখ করাে।
Ans : ভূমিকা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে একদিকে থাকে সােভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট, অপরদিকে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিম ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রজোট। বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক ও সামরিক আধিপত্য গড়ে তােলার জন্য এই দুই রষ্ট্রজোটের মধ্যে যে গােপন লড়াই শুরু হয় তা ঠান্ডা লড়াই নামে পরিচিত।
ঠান্ডা লড়াইয়ের পটভূমি|ঠান্ডা লড়াই উদ্ভবের পরিস্থিতি :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী পর্যায়: ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের বলশেভিক বিপ্লবকে দমন করার জন্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগোেষ্ঠী (আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপান) জারতন্ত্রের সমর্থনে রাশিয়ায় সেনা পাঠায়। সমাজতন্ত্রকে সুচনাকালেই শেষ করে দেওয়া ছিল তাদের উদ্দেশ্য। কাজেই রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের জন্মলগ্ন থেকেই বিশ্বে “দ্বিমেরুকরণ রাজনীতির জন্ম হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন পর্যায়
দ্বিতীয় রণাঙ্গনের ভূমিকা: যুদ্ধ চলাকালে জার্মানির প্রবল আক্রমণে দিশাহারা সােভিয়েত রাশিয়া পশ্চিম জোটের কাছে জার্মানির বিরুদ্ধে পশ্চিম ইউরােপে দ্বিতীয় রণাঙ্গন খােলার অনুরােধ রাখে। কিন্তু এই অনুরােধকে নিয়ে চার্চিলের দুমুখাে নীতি স্টালিনকে কুদ্ধ করে তােলে।
পটসডাম সম্মেলন: জার্মানির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ নিয়ে সােভিয়েত ও মার্কিন মতবিরােধ প্রকট হয়ে ওঠে। পটসডাম সম্মেলন থেকেই ঠান্ডা লড়াই প্রকাশ্যে আসে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়
চার্চিলের ফালটন বক্তৃতা: ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল আমেরিকার মিসৌরি প্রদেশের অন্তর্গত ফালটনে ওয়েস্টমিনস্টার কলেজে এক ভাষণে (১৯৪৬ খ্রি., ৫ মার্চ) বলেন, উত্তর বালটিক সাগরের তীরবর্তী স্টেটিন থেকে দক্ষিণ অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের ট্রিয়েস্ট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল লৌহ যবনিকার (সােভিয়েত) আড়ালে ঢাকা। ফালটন বক্তিতায় চার্চিল রুশ আগ্রাসন থেকে ইউরােপীয় সভ্যতাকে রক্ষা করার দায়িত্ব যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অর্পণ করেন।
ট্রুম্যান নীতি: আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান মার্কিন কংগ্রেসে এক বক্তৃতায় (১৯৪৭ খ্রি., ১২ মার্চ) তুরস্ক ও গ্রিস-সহ বিশ্বের যে-কোনাে দেশকে সােভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সামরিক ও আর্থিক সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতি দেন, যা টুম্যান নীতি নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক আইজ্যাক ডয়েস্টার ট্রুম্যান নীতিকে ঠান্ডা লড়াইয়ের আনুষ্ঠানিক ঘােষণা বলে অভিহিত করেছেন।
মার্শাল পরিকল্পনা: ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৫ জুন আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতায় আমেরিকার বিদেশমন্ত্রী জর্জ মার্শাল যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরােপে আর্থিক পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে এক পরিকল্পনা পেশ করেন, যা মার্শাল পরিকল্পনা নামে পরিচিত। ইউরােপে অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন পরিকল্পনা নিয়ে টুম্যান নীতির পরিপূরক হিসেবে উপস্থাপিত হয় এই মার্শাল পরিকল্পনা। ফলে আরও ঘনীভূত হয়ে ওঠে ঠান্ডা লড়াই।
কেন্নানের বেষ্টনী তত্ত্ব : রাশিয়ায় কর্মরত প্রাক্তন সহকারী মার্কিন রাষ্ট্রদূত জর্জ এফ. কেন্নান, মি. এক্স ছদ্মনামে আমেকিার ফরেন অ্যাফেয়ার্স নামে পত্রিকায় এক প্রবন্ধে সােভিয়েতের আক্রমণাত্মক নীতি প্রতিহত করার জন্য এবং সােভিয়েত প্রভাবকে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য ‘বেষ্টনী তত্ত্ব’ (১৯৪৭ খ্রি., ৪ জুলাই) প্রকাশ করেন, যা মার্কিন প্রশাসন মেনে নেয়।
সােভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে আর্থিক সহায়তা পরিষদ গঠন: সােভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে গঠন করে কমিকন (Council for Mutual Economic Assistance) নামে একটি আর্থিক সহায়তা পরিষদ। মার্শাল পরিকল্পনার প্রত্যুত্তর হিসেবে কমিকন গঠিত হয়েছিল।
আমেরিকার নেতৃত্বে শক্তিজোট গঠন: সােভিয়েত আগ্রাসন প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে গড়ে তােলে উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা (NATO)। তারপর একে একে গড়ে তােলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা (SEATO); মধ্যপ্রাচ্য প্রতিরক্ষা সংস্থা (MEDO) [পরবর্তীকালে এটির নাম হয় মধ্য এশিয়া চুক্তি সংস্থা (CENTO)]; ‘অ্যানজাস (ANZUS) ইত্যাদি শক্তিজোট।
রাশিয়ার নেতৃত্বে শক্তিজোট গঠন: আমেরিকার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা পশ্চিম সামরিক শক্তিজোট ন্যাটোর জবাবে রাশিয়ার নেতৃত্বে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব ইউরােপীয় দেশগুলিকে (পােল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেকোশ্লোভাকিয়া, রুমানিয়া, বালগেরিয়া, আলবানিয়া ও পূর্ব জার্মানি) নিয়ে গঠিত হয় ওয়ারশ চুক্তি সংস্থা (Warsaw Pact Organisation, WPO), যা ছিল একটি যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
Era of the Cold War
Question: ঠান্ডা লড়াই-এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি কী ছিল? তৃতীয় বিশ্বের ওপর ঠান্ডা লড়াইয়ের কতটা প্রভাব পড়েছিল?
Ans: ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে বিশ্বে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে ঠান্ডা লড়াই। ঠান্ডা লড়াইয়ের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল一
[1] কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দ্বন্দ্ব: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে মহাশক্তিধর (Super-Power) রাষ্ট্ররূপে আবির্ভাব ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত ইউনিয়নের। তাই ঠান্ডা লড়াই বলতে বােঝায় মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সারা বিশ্বে নিজ নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে।
[2] বিভিন্ন দেশের সমর্থন লাভের দ্বন্দ্ব: উভয় রাষ্ট্রই বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের ওপর নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে ও তাদের সাহায্য ও সহযােগিতা লাভ করতে তৎপর ছিল। বিভিন্ন দেশের সমর্থন লাভের দ্বন্দ্বকে ঘিরে উদ্ভব ঘটে দ্বিমেরু রাজনীতি (Bipolar Politics)-র।
[3] রাজনৈতিক মতাদর্শগত বিভেদ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে এবং সােভিয়েত ইউনিয়ন সাম্রাজ্যবাদের বিরােধিতা ও সাম্যবাদের পক্ষে পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। এর পরিণতি হিসেবে ঠান্ডা লড়াই নামে রাজনৈতিক মতবাদের লড়াই শুরু হয়।
[4] সামরিক বলবৃদ্ধি: কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইকে কেন্দ্র করে দুই শক্তিজোট ভিতরে ভিতরে জোর সামরিক প্রস্তুতি শুরু করে। প্রবল থেকে প্রবলতর শক্তিসম্পন্ন মারণাস্ত্র তৈরি ও সেগুলির পরীক্ষার নামে যুদ্ধ মহড়া শুরু হয় দুই শিবিরে। এইভাবে উভয়পক্ষই প্রবল সামরিক বলে বলীয়ান হয়ে ওঠে। বিশ্বে আতঙ্কজনক বাতাবরণ গড়ে ওঠে, যা ঠান্ডা লড়াই নামে অভিহিত হয়।
[5] আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতা: দুপক্ষেরই অনুগত কোনাে রাষ্ট্র কোনাে অঞ্চলে যুদ্ধরত হলে ওই যুদ্ধকে ওই অঞলেই সীমাবদ্ধ রাখতে উভয়েই তৎপর হয়ে ওঠে।
[6] ছায়া যুদ্ধ: আমেরিকা ও রাশিয়া উভয় পক্ষের সামরিক শক্তি যথেষ্ট বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও কোনাে পক্ষই একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে অংশ নেয়নি। কেবল যুদ্ধের আবহ বজায় রেখেছিল।
তৃতীয় বিশ্বে ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রভাব :
[1] ঠান্ডা লড়াইয়ের আবর্তে জড়িয়ে পড়া: দুই বৃহৎ শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলেই ঠান্ডা লড়াই পরিবেশের উৎপত্তি। কিন্তু ওই দুই শক্তি কখনােই নিজেদের মধ্যে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েনি। অথচ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির পক্ষে ঠান্ডা লড়াইয়ের আবর্ত থেকে দূরে সরে থাকা কিন্তু সম্ভব হয়নি।
[2] আমেরিকা ও রাশিয়ার আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে জাপান, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের আধিপত্য বিলুপ্ত হয়েছিল। এর ফলে এশিয়া মহাদেশের এক বিশাল অংশে যে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা পূরণের লক্ষ্যে এগিয়েছিল ধনতান্ত্রিক আমেরিকা বা সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া উভয় দেশই। ফলে ঠান্ডা লড়াইয়ের যে সূত্রপাত ইউরােপে হয়েছিল, তা ওই দুই মহাশক্তির হস্তক্ষেপে এবার এশিয়া মহাদেশেও। ছড়িয়ে পড়ল। তৃতীয় বিশ্বও তা থেকে রক্ষা পেল না। দুই কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ, সুয়েজ সংকট, আরব-ইজরায়েল বিরােধ, ভিয়েতনাম সংকট, ইরাক ইরান যুদ্ধ, ইরাক-কুয়েত লড়াই, পাক-ভারত যুদ্ধ ইত্যাদি হল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
[3] শক্তিজোট গুলির প্রভাব: নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে বৃহৎ শক্তিবর্গের গড়ে তােলা একাধিক শক্তিজোট তৃতীয় বিশ্বের ওপর ঠান্ডা লড়াইকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদতে কমিউনিস্ট চিনকে প্রতিরােধ ও ভিয়েতনামে কমিউনিস্ট আগ্রাসন রােধ করার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা (SEATO)। এ ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে গড়ে তােলা হয় মধ্যপ্রাচ্য প্রতিরক্ষা সংস্থা (MEDO) (১৯৫৫ খ্রি.)। পরবর্তীকালে এই সংস্থারই নাম হয় বাগদাদ চুক্তি বা সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশন (CENTO)। মধ্যপ্রাচ্যে রুশ আধিপত্য রােধ ও সেখানকার খনিজ তেল সম্পদের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব স্থাপনই ছিল এটি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য।
Era of the Cold War
Question: ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সামরিক মৈত্রী চুক্তির পর্যালােচনা করাে।
Ans: মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটসমূহ
[1] ন্যাটো
গঠন: বিশ্বে সােভিয়েত আগ্রাসন প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে আর্থার ভ্যান্ডেনবার্গ আমেরিকার সেনেটে ‘ভ্যান্ডেনবার্গ রেজোলিউশন’ পেশ করলে (১৯৪৮ খ্রি., ১১ জুন) তা অনুমােদিত হয়। স্থির হয় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজ স্বার্থরক্ষার জন্য আমেরিকার বাইরে অবস্থিত রাষ্ট্রগুলির (নন-আমেরিকান পাওয়ার) সঙ্গে যৌথ সামরিক চুক্তি সম্পাদন করতে পারবে। এরই ফলশ্রুতি হিসেবে ৪ এপ্রিল, ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে জন্ম নেয় ন্যাটো অর্থাৎ উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা (North Atlantic Treaty Organisation)।
সদস্য: ন্যাটোর প্রাথমিক সদস্য ছিল ১২টি (বর্তমানে ২৮ টি) দেশ। প্রথমে বেলজিয়াম, কানাডা, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, লুক্সেমবুর্গ, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, পাের্তুগাল, ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর সদস্য হয়। পরে আরও কয়েকটি দেশ এতে যােগ দেয়।
উদ্দেশ্য: [a]আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করা ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। [b]সােভিয়েত সাম্যবাদের প্রসার রােধ ও সােভিয়েত আগ্রাসনের হাত থেকে রক্ষার লক্ষ্যে এটি গঠিত হয়। [c] ন্যাটো গঠনের অপর একটি উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিম ইউরােপে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।
[2] অ্যানজাস
গঠন: কমনওয়েলথের সদস্যভুক্ত কয়েকটি দেশ একজোট হয়ে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের, ১ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষর করে পারস্পরিক নিরাপত্তা চুক্তি বা অ্যানজাস। এর সদর দপ্তর অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরাতে অবস্থিত।
সদস্য: অ্যানজাস নামে নিরাপত্তা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও নিউজিল্যান্ড। এক সপ্তাহের মধ্যে জাপান, আরও ৪৮টি দেশ এই চুক্তিতে আবদ্ধ হয়।
উদ্দেশ্য: প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিরাপত্তা রক্ষার উদ্দেশ্যে গঠিত হয় অ্যানজাস (Australia, New Zealand, United States Security Treaty, সংক্ষেপে ANZUS)।
[3] সিয়াটো
গঠন: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে কেন্দ্র করেও একটি সংস্থা গড়ে ওঠে (১৯৫৪ খ্রি., ৮ সেপ্টেম্বর)। এটির নাম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা বা সিয়াটো (South-East Asia Treaty Organ isation সংক্ষেপে SEATO)।
সদস্য: এই সংগঠনটির সদস্য ছিল ৮টি দেশ, যথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ফিলিপিনস। এর প্রধান কার্যালয় ব্যাংককে অবস্থিত।
উদ্দেশ্য: মূলত কমিউনিস্ট চিনের বিরুদ্ধাচরণ এবং ভিয়েতনামে কমিউনিস্টদের অগ্রগতি রােধের লক্ষ্যেই মার্কিন নেতৃত্বাধীন এই জোট গঠিত হয়েছিল।
[4] সেন্টো
গঠন: ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে মধ্যপ্রাচ্যকে কেন্দ্র করে গঠিত হয় মধ্যপ্রাচ্য প্রতিরক্ষা সংস্থা বা মেডাে (Middle East Defence Organisation, সংক্ষেপে MEDO)। চুক্তিটি বাগদাদে স্বাক্ষরিত হওয়ায় এটি বাগদাদ চুক্তি নামেও পরিচিত। পরবর্তীকালে এই সংস্থার নাম হয় সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা সেন্টো (CENTO)।
সদস্য: গঠনের সময় এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিল গ্রেট ব্রিটেন, পাকিস্তান, ইরাক ও ইরান। এই সংস্থাটির সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পর্যবেক্ষক হিসেবে যুক্ত হয়।
উদ্দেশ্য: এই সংস্থাটি সােভিয়েত বিরােধিতার এবং মার্কিন পুঁজিবাদী আদর্শ প্রচারের উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠে।
সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট
1. ওয়ারশ চুক্তি সংস্থা: আমেরিকার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা পশ্চিমি সামরিক শক্তিজোট ন্যাটোর পালটা হিসেবে গড়ে ওঠে রাশিয়ার নেতৃত্বে সামরিক জোট ওয়ারশ চুক্তি সংস্থা [Warsaw Pact Organisation (WPO) or Warsaw Treaty Organisation (WTO)] এই চুক্তির মাধ্যমে রাশিয়া চেয়েছিল তার নিজের এবং তার সহযােগী দেশগুলির নিরাপত্তা সমস্যার সমাধান করতে।
চুক্তিস্বাক্ষরকারী দেশসমূহ: ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মে ওয়ারশ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। মধ্য ও পূর্ব ইউরােপের কমিউনিস্ট দেশগুলির মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এই চুক্তিতে অংশ নিয়েছিল রাশিয়া, বালগেরিয়া, হাঙ্গেরি, পােল্যান্ড, পূর্ব জার্মানি, আলবানিয়া, রুমানিয়া এবং চেকোশ্লোভাকিয়া।
উদ্দেশ্য: i) এই সমস্ত দেশ নিজেদের মধ্যে জোটবদ্ধ হয়েছিল যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য। ii) পারস্পরিক অর্থসাহায্যের কর্মসূচি গ্রহণ ও তা রূপায়ণের লক্ষ্যে রাশিয়ার নেতৃত্বে ভবিষ্যতে এক আর্থিক সহায়তা পরিষদ গঠনের লক্ষ্য নির্ধারিত হয়।
2. কমিকন: রাশিয়ার নেতৃত্বে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে গঠিত হয় পারস্পরিক অর্থনৈতিক সহযােগিতা সংস্থা বা (Council for Mutual Economic Assistance a COMECON)। এটি সামরিক সংস্থা না হলেও সামরিক জোটের সহায়ক হিসেবে কাজ করত।
Era of the Cold War

Question: বার্লিন সংকট পর্যালােচনা করো। ঠান্ডা লড়াই-এ বার্লিন অবরােধের গুরুত্ব কী? ছিল ?
Ans: সূচনা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে পটল্ডাম সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জার্মানিকে রাশিয়া, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড এই চারটি দেশের কর্তৃত্বাধীনে চারটি পৃথক অঞ্চলে ভাগ করা হয়। এখানে প্রতিটি রাষ্ট্র নিজেদের আলাদা আলাদা উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চেয়েছিল। রাশিয়া চেয়েছিল তার অধিকার করা পূর্ব জার্মানিতে এক তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠিত হােক। কিন্তু মিত্রশক্তি চেয়েছিল তাদের অধিকার করা অঞ্চলগুলি নিয়ে পশ্চিম জার্মানি গঠন করতে। এর ফলে জার্মানি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় বার্লিন সংকট।
বার্লিন অবরােধ বা বার্লিন সংকট :
1. প্রেক্ষাপট: জার্মানিকে চার ভাগে ভাগ করা হবে-
রাশিয়ার অঞ্চল: ওডার-নিস নদীর তীর বরাবর এ পর্যন্ত অঞ্চলের অধিকার পাবে রাশিয়া।
মার্কিন অঞ্চল: জার্মানির দক্ষিণ অঞ্চলের অধিকার পাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ব্রিটিশ অঞ্চল: জার্মানির উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের অধিকার পাবে ব্রিটেন।
ফ্রান্সের অঞ্চল: জার্মানির দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অধিকার পাবে ফ্রান্সে।
চারভাগে বিভক্ত হলেও সমগ্র জার্মানিতে অর্থনৈতিক নীতি থাকবে একটিই। জার্মানির চারটি ভাগে একই অর্থনীতি চালু রাখার জন্য বার্লিনে গঠিত হবে ACC (Allied Control Council)। জার্মানির রাজধানী বার্লিনকেও চার ভাগে ভাগ করা হবে বলে ঘােষণা করা হয়।
2. সােভিয়েত কর্তৃক বার্লিন অবরােধ: বার্লিন ছিল পূর্ব জার্মানির অংশ আর তাই তা ছিল রাশিয়ার কর্তৃত্বাধীন।আবার পশ্চিম জার্মানিতে মার্কিনিরা যে আর্থিক উন্নয়নের উদ্যোগ নেয় তাতে রাশিয়া ক্ষুধ হয়েছিল। এর ফলে রাশিয়া পশ্চিমি রাষ্ট্রজোটের পূর্ব বা পশ্চিম বার্লিনে প্রবেশের সড়কপথ (যা ছিল রাশিয়ার অধীনস্থ) অবরােধ করে (১৯৪৮ খ্রি., ২৪ জুন)। এই ঘটনা বার্লিন অবরােধ (Berlin Blockade) নামে পরিচিত।
3. সংকটের অবসান: রাশিয়ার বার্লিন অবরোধের ফলে পশ্চিম জার্মানিতে চরম খাদ্যসংকট দেখা দেয়। ব্রিটেন ও আমেরিকা রাশিয়ার অবরােধের কাছে। নতিস্বীকার না করে দীর্ঘ ১১ মাস ধরে ১৪০০ বিমানের সাহায্যে আকাশপথে অবরুদ্ধ বার্লিন অঞ্চলকে প্রতিদিন ৮ হাজার টন খাদ্যসামগ্রী, ওষুধ, তেল, কয়লা-সহ অন্যান্য প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের জোগান দেয়। এই ঘটনা ‘Berlin Airlift‘ নামে খ্যাত। স্টালিন এই আকাশপথে সরবরাহ ব্যবস্থার বিরােধিতা করার সাহস দেখাতে পারেননি। অবশেষে বাধ্য হয়ে রাশিয়া ২৯৩ দিন পর অবরােধ তুলে নেয় (১৯৪৯ খ্রি., ১২ মে)।
4. বার্লিন সংকটের ফলাফল: বার্লিন সংকটের ফলাফল ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী।
জটিলতা বৃদ্ধি: বার্লিন সংকট আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলেছিল। আমেরিকা সাম্যবাদের প্রসার রােধ করতে চাইলে রাশিয়াও পুঁজিবাদের প্রসার রােধে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে বিশ্বরাজনীতি জটিল রূপ ধারণ করে।
জার্মানিতে আলাদা সরকার: মার্কিন জোটের মদতে পশ্চিম জার্মানি, জার্মান যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র (Federal Republic of Germany, FRG) হিসেবে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২১ মে আত্মপ্রকাশ করে। পশ্চিম জার্মানির প্রধান হন খ্রিস্টান ডেমােক্রেটিক দলের কনরাড আদানুর। আর রুশ জোটের মদতে পূর্ব জার্মানি জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র (German Democratic Republic, GDR) হিসেবে পরিচিতি পায়। এই সরকারের কর্ণধার হন আটো গ্রোটোহল। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৩ আগস্ট পূর্ব জার্মান সেনাবাহিনী পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিনের মধ্যে কংক্রিটের ও কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে প্রাচীর গড়ে তােলে।
সামরিক শক্তিবৃদ্ধি: এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়ে বৃহৎ শক্তিভুক্ত দেশগুলি নিজেদের সামরিক শক্তিকে আরও মজবুত করার দিকে নজর দেয়।
উপসংহার: বার্লিন সংকটের পরিণতি হিসেবে পরবর্তীকালে ঠান্ডা লড়াই রাজনীতি আরও পরিপুষ্ট হয়।
Question: রুমানিয়াতে কীভাবে সােভিয়েত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়?
Ans : সূচনা: পূর্ব ইউরােপের রুশ সম্প্রসারণের গতিধারায় রুমানিয়া ছিল উল্লেখযােগ্য একটি দেশ। বহুদিন থেকেই রুমানিয়ার কমিউনিস্ট আন্দোলনে স্বতন্ত্রতা বজায় ছিল। রুমানিয়াই প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যে জার্মান ফেডারেল রিপাবলিকের (পশ্চিম জার্মানি) সঙ্গে। কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। সমাজতান্ত্রিক দেশ হয়েও রুমানিয়া তার বিদেশনীতিতে পুঁজিবাদী দেশগুলির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। তাই বােধ হয় সমাজতান্ত্রিক দেশ হয়েও রাশিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক ততটা বন্ধুত্বপূর্ণ হয়নি।
রুমানিয়ায় সােভিয়েত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা :
1. বিবাদের কারণ: সােভিয়েত রুমানিয়া বিবাদের কারণগুলি হল—
অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি, তেল সরবরাহের জন্য পাইপলাইন প্রতিষ্ঠা, বিদেশনীতিতে পুঁজিবাদের আহ্বান ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে।
রুমানিয়া ওয়ারশ চুক্তি জোটের ও কমিকন-এর সদস্যরাষ্ট্র ছিল; তবুও সে ফ্রান্স, ইটালি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখায় সােভিয়েত রাশিয়া ক্ষুদ্ধ হয়।
2. রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা: রুমানিয়া নাৎসিশাসনমুক্ত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে। তবে সেখানে তখনই কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। রাজা মাইকেল-এর নেতৃত্বে সেখানে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
3. স্টালিনের হস্তক্ষেপ: ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে স্টালিন রুমানিয়ায় রুশ সেনা মােতায়েন করেন। সেইসঙ্গে তিনি রাজা মাইকেলকে কমিউনিস্টদের নিয়ে একটি জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের নির্দেশ দেন। এই সময় স্টালিন ইচ্ছা করলেই রুমানিয়ায় একটি কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। কিন্তু তখনও যুদ্ধ চলছিল এবং পশ্চিমি দেশগুলির সাহায্য ও সহযােগিতা তখনও রাশিয়ার প্রয়ােজন ছিল। তাই বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন স্টালিন ওই মুহূর্তে সেখানে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠা করা থেকে বিরত থাকেন।
4. কমিউনিস্ট শক্তিবৃদ্ধি: ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে রুমানিয়ায় কমিউনিস্ট-সমর্থিত ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট’ বিপুল ভােটে জয়লাভ করে। তবে সে সময় সংসদে কমিউনিস্ট সদস্যসংখ্যা ছিল মাত্র এক ষষ্ঠাংশ। এই নতুন সরকার অকমিউনিস্টদের ওপর অকথ্য অত্যাচার শুরু করে। জনপ্রিয় কৃষকনেতা আইওন মিহালেক (Ion Mihalache) ও তার সহযােগীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগ আনা হয়। বলা হয়, তারা মার্কিন ও ব্রিটিশ মদত নিয়ে রাষ্ট্রবিরােধী চক্রান্তে লিপ্ত। বিচারে তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয় ও তাদের পেজেন্টস পার্টি ভেঙে দেওয়া হয়। রাজা মাইকেল পদত্যাগ করেন (ডিসেম্বর, ১৯৪৭ খ্রি.)। রাজা মাইকেলের পদত্যাগের কিছুদিনের মধ্যেই সমস্ত বিরােধীদের দমন করে, একমাত্র কমিউনিস্ট-অনুগামীদের নিয়েই সেখানে গঠিত হয় ‘রুমানিয়ান ওয়ার্কার্স পার্টি’ নামে কমিউনিস্ট দল। আসন্ন নির্বাচনে (১৯৪৮ খ্রি., ফেব্রুয়ারি) সােশ্যাল ডেমােক্র্যাট পার্টি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে মিশে যায়। নির্বাচনে কমিউনিস্ট দল ৪১৪টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ৪০৫টিতে জিতে সরকার গঠন করে।
উপসংহার: সােভিয়েত নিয়ন্ত্রণাধীনে নবগঠিত এই সরকার কাজ শুরু করলে, রুমানিয়ার ওপর রুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
Era of the Cold War
Question : চেকোশ্লোভাকিয়া ও হাঙ্গেরিতে সােভিয়েত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিবরণ দাও।
Ans : চেকোশ্লোভাকিয়ায় সোভিয়েত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা :
সরকার গঠনের মাধ্যমে: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে আলেকজান্ডার ডুবচেক-এর নেতৃত্বে রাজনৈতিক ব্যবস্থার গণতন্ত্রীকরণের উদ্যোগ শুরু হলে চেকোশ্লোভাকিয়ার সমাজতান্ত্রিক অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পর চেকোশ্লোভাকিয়া জার্মানির বন্ধন থেকে মুক্ত হয়। কমিউনিস্ট নেতা ক্লিমেন্ট গােটওয়াল্ড প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে আয়ােজিত সাধারণ নির্বাচনে কমিউনিস্ট দল সর্বোচ্চ ভােট পায়। এদিকে প্রবাসী চেক রাষ্ট্রপতি এডওয়ার্ড বেনেস লন্ডন থেকে স্বদেশে ফিরে পুনরায় চেক প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ করেন। রাশিয়ার চাপে বেনেস চেকোশ্লোভাকিয়ার রুথেনিয়া প্রদেশটি সােভিয়েতকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। কমিউনিস্ট নেতা ভ্যাকলাভ নােসেক ছিলেন এই সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
অ-কমিউনিস্ট উৎখাতের সুবাদে: ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে বেনেসের চেক সরকার আমেরিকার মার্শাল পরিকল্পনার শর্তাবলি মেনে নিলে রাশিয়া শঙ্কিত হয়ে পড়ে। সে আশঙ্কা করে এর ফলে চেকোশ্লোভাকিয়ায় সাম্যবাদ-বিরােধী সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। তখন সারা পূর্ব ইউরােপে সােভিয়েত কর্তৃত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। তাই স্টালিনের নির্দেশে সেখানে শুরু হয় অ-কমিউনিস্টদের উৎখাত ও নিধন।
অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সূত্রে: স্টালিনের পরামর্শ মেনে প্রধানমন্ত্রী গােটওয়াল্ড বিরােধী দলগুলিকেও নিশ্চিহ্ন করার কাজ শুরু করেন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভ্যাকলাভ নােসেক প্রাগের আটজন পুলিশ অফিসারকে বরখাস্ত করে তাদের জায়গায় আটজন সাম্যবাদী মনােভাবাপন্ন ব্যক্তিকে নিয়ােগ করেন। সরকারের অধিকাংশ মন্ত্রী এর তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং ওইসমস্ত অফিসারকে পুনর্নিয়ােগের দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী গােটওয়াল্ড কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেই সমর্থন করেন। ফলে যুক্তফ্রন্ট সরকার থেকে অ-কমিউনিস্ট অনেক মন্ত্রী পদত্যাগ পত্র পেশ করেন। এর ফলে সে দেশে কমিউনিস্ট ও অকমিউনিস্টদের মধ্যে প্রবল দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
বেনেসের পদত্যাগের সূত্র: প্রেসিডেন্ট বেনেস অকমিউনিস্ট মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র গ্রহণে বাধ্য হলে চেকোশ্লোভাকিয়ায় কমিউনিস্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ এক মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ উদারপন্থী গণতান্ত্রিক নেতা এবং সরকারের বিদেশমন্ত্রী জ্যা মাসারিক- এর সন্দেহজনকভাবে নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হলে প্রেসিডেন্ট বেনেস পদত্যাগ করতে বাধ্য হন (জুন, ১৯৪৮ খ্রি.)। প্রধানমন্ত্রী গােটওয়াল্ড চেকোশ্লোভাকিয়ার নতুন প্রসিডেন্ট হন (১৯৪৮ খ্রি.)। চেকোশ্লোভাকিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় সােভিয়েত কর্তৃত্ব।
রুশ ধাঁচে হাঙ্গেরিতে প্রজাতন্ত্র গঠন প্রক্রিয়া:
1. সরকারি ক্ষমতালাভের মধ্যে দিয়ে: ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে হাঙ্গেরিতে এক সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে স্মল ল্যান্ড হােল্ডার্স দল এবং সমাজতন্ত্রী দল মিলিতভাবে ৫৬ শতাংশ ভােট পেয়ে ক্ষমতায় আসে। বিশ্বযুদ্ধোত্তর হাঙ্গেরিতে এই প্রথম সাধারণ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে ও যুক্তফ্রন্টের শাসন শুরু হয়। কমিউনিস্ট দলের স্টালিনপন্থী রাকোসি সহকারী প্রধানমন্ত্রী পদ, আর স্টালিন বিরােধী ইমরে নেগি লাভ করেন স্বরাষ্ট্র দফতরের কার্যভার।
2. বিরােধীদের দমনের মাধ্যমে: কমিউনিস্ট পার্টি স্বরাষ্ট্র দফতরের অপব্যবহারের দ্বারা বিরােধীদের নিশ্চিহ্ন করে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে থাকে। দেশবিরােধী অন্তর্ঘাতমূলক কাজের অভিযােগ এনে। বিরােধী দলকে কালিমালিপ্ত করা হয়। সমগ্র দেশজুড়ে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়।
3. নতুন সরকার গঠনের মাধ্যমে: ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটে। নতুন সরকার গঠনের জন্য পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জালিয়াতি ভরা এই নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে ‘ন্যাশনাল ইনডিপেন্ডেন্ট ফ্রন্ট’। সমাজবাদী গণতন্ত্রী নেতা আপাড সাকাসিটস-এর নেতৃত্বে গঠিত হয় নবনির্বাচিত সরকার।
4. সােভিয়েতীকরণের মাধ্যমে: স্টালিনের প্রত্যক্ষ মদতে নবগঠিত এই সরকারের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন স্টালিনপন্থী রাকোসি। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ আগস্ট হাঙ্গেরিতে সােভিয়েতের অনুকরণে বামপন্থী গণপ্রজাতন্ত্র গঠন করা হয়। ক্রেমলিন নেতৃবৃন্দ হাঙ্গেরির কমিউনিস্ট নেতাদের এটা বােঝাতে সক্ষম হন যে, পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণের হাত থেকে রক্ষার জন্য হাঙ্গেরিকে সােভিয়েত অনুকরণে পরিচালনা করা দরকার। এই সূত্র ধরেই হাঙ্গেরির রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সােভিয়েত মডেলকে অনুসরণের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কৃষি, শিল্প এমনকি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও সােভিয়েত নীতি অনুসৃত হয়।
Era of the Cold War
Question : সুয়েজ সংকটের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
Ans : মিশর দেশের উত্তর-পূর্ব দিকে ইংরেজ ও ফরাসিদের তত্ত্বাবধানে খনন করা একটি খাল হল সুয়েজ খাল। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ওই খাল খনন শুরু হলেও ১৮৬৯ থেকে এতে বাণিজ্যিকভাবে জাহাজ চলাচল শুরু হয়। ইউনিভার্সাল সুয়েজ ক্যানাল কোম্পানি নামে এক সংস্থাকে একটি চুক্তির ভিত্তিতে ৯৯ বছরের মেয়াদে খালটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই মিশরের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি গামাল আবদেল নাসের এক ঘােষণার মাধ্যমে সুয়েজ খাল ও সুয়েজ ক্যানাল কোম্পানি—দুটিকেই জাতীয়করণ করে নেন। ফলে সুয়েজ খালকে কেন্দ্র করে এক সমস্যা তৈরি হয়। বিশ্বজুড়ে এই সমস্যাকেই সুয়েজ সংকট বােঝায়।
সুয়েজ সংকটের কারণ :
1. ব্রিটেন ও ফ্রান্সের দায়িত্ব: আরব-ইজরায়েল দ্বন্দ্ব চলাকালে ব্রিটেন ও ফ্রান্স ইজরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিলে আরব দেশগুলি ক্ষুদ্ধ হয় এবং নাসেরের সঙ্গেও পাশ্চাত্য দেশগুলির মনােমালিন্য শুরু হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্রিটেন ও ফ্রান্সই সুয়েজ খালের ওপর সবথেকে বেশি নির্ভরশীল ছিল। মার্কিন বিদেশমন্ত্রী ডালেস যখন সুয়েজ খাল ব্যবহারকারী দেশগুলিকে নিয়ে এক সংস্থা গঠনের প্রস্তাব দেন তখনও ব্রিটেন ও ফ্রান্স সে প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। এর ফলে সুয়েজ সংকট তৈরি হয়। পরে জাতিপুঞ্জে মিশর এই প্রস্তাব তুলে ধরলে ব্রিটেন ও ফ্রান্স সুয়েজ খালের ওপর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়, যা নাসেরের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না।
2. আসওয়ান বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প: নাসের চেয়েছিলেন মিশরের আর্থিক উন্নয়নের জন্য নীলনদের ওপর আসওয়ান বাঁধ নির্মাণ করতে। কেননা, এই বাঁধের সাহায্যে ৮ লক্ষ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে জলসেচ করে সেগুলি আবাদি জমিতে পরিণত করা যাবে। আবার এই বাঁধের জলাধার থেকে যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে তা শিল্পোন্নয়নে সাহায্য করবে। এই নির্মাণ প্রকল্পের মােট খরচ ধরা হয়েছিল ১৪০০ মিলিয়ন ডলার। ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও বিশ্বব্যাংক মিলিতভাবে এই প্রকল্পের জন্য ৭০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে রাজিও হয়। কিন্তু এক বছর আলােচনা চলার পর আমেরিকা ও ব্রিটেনের প্ররােচনায় বিশ্বব্যাংক ঋণ প্রস্তাব বাতিল করে দিলে নাসের প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন।
3. সুয়েজ খাল জাতীয়করণ: ক্ষুব্ধ নাসের সুয়েজ খাল এবং সুয়েজ ক্যানাল কোম্পানির জাতীয়করণ করেন (২৬ জুলাই, ১৯৫৬ খ্রি.) এবং ঘােষণা করেন –
[i] এই সুয়েজ খাল থেকে আদায় করা অর্থ আসওয়ান বাঁধ নির্মাণে খরচ করা হবে।
[ii] কোম্পানির বিদেশি অংশীদারদের প্রচলিত বাজারদর অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
[iii] আন্তর্জাতিক যােগসূত্র হিসেবে সব দেশের জাহাজ এই জলপথ ব্যবহার করতে পারবে। এর ঠিক তিনমাস পরে (২৯ অক্টোবর, ১৯৫৬ খ্রি.) ব্রিটেন ও ফ্রান্সের গােপন প্ররােচনায় ইজরায়েল মিশর আক্রমণ করে।
সুয়েজ সংকটের গুরুত্ব বা ফলাফল
1. আরব দুনিয়ার পশ্চিমি বিদ্বেষ: প্রথম আরব ইজরায়েল যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমেত পশ্চিমি শক্তিগুলি নিজেদের স্বার্থে নানাভাবে ইজরায়েলকে সাহায্য করেছিল। এমতাবস্থায় সুয়েজ সংকটকে কেন্দ্র করে মিশরের ওপর ইঙ্গ-ফরাসি আক্রমণ শুরু হলে মিশর-সহ গােটা আরব দুনিয়ায় পশ্চিম-বিরােধী মনােভাবের সৃষ্টি হয়।
2. সুদৃঢ় আরব ঐক্য: পশ্চিম-বিরােধী মনােভাব আরবদের আরও সংহত করে তােলে। তাদের ঐক্য আরও দৃঢ় হয়। মিশর ও সিরিয়া ঐক্যবদ্ধ হয়ে গঠিত হয় ‘সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র’। নাসের হন তার প্রথম রাষ্ট্রপতি।
3. শত্রূতা বৃদ্ধি: সুয়েজ সংকট মিশর ও ইজরায়েলের মধ্যে শত্রূতাকে চরমে নিয়ে যায়। ইজরায়েলকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।
4. মিশরের কর্তৃত্ব: মিশর কর্তৃক সুয়েজ খাল জাতীয়করণকে আন্তর্জাতিক দুনিয়া স্বীকৃতি দিলে সুয়েজ খালের ওপর মিশরের কর্তৃত্ব দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
5. ইজরায়েলের মার্কিন নির্ভরতা বৃদ্ধি: সুয়েজ সংকটের জেরে সংঘটিত দ্বিতীয় আরব-ইজরায়েল যুদ্ধে ইজরায়েল আর্থিক ও সামরিক দিক থেকে প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ক্ষতিপূরণের জন্য ইজরায়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়।
You must be logged in to post a comment.