
বিশ্বায়ন|Globalization|HS Polscience Questions And Answers| উচ্চমাধ্যমিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রশ্নোত্তর| আন্তৰ্জাতিক সম্পর্ক
Content Check List: 1. বিশ্বায়ন ধারণা 2. বিশ্বায়নের উদ্ভব 3. বিশ্বায়নের রূপ 4. বিশ্বায়নের প্রকৃতি 5. বিশ্বায়নের বৈশিষ্ট্য 6. বিশ্বায়নের কারণ 7. ভারতে বিশ্বায়নের প্রভাব।
বিশ্বায়ন ধারণাটির প্রবর্তক রােল্যান্ড রবার্টসন বিশ্বের সংকুচিতকরণ ও একত্রীকরণকেই বিশ্বায়ন বলে চিহ্নিত করেছিলেন।জোসেফ স্টিগলিৎসে বলেছেন, বিশ্বায়ন হল প্রকৃতপক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জনগােষ্ঠীর মধ্যে একধরনের নিবিড় একাত্মতা বা ঘনিষ্ঠতার সংহতি। বিশ্বায়নের ফলে পরিবহণ, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক বিকাশ ঘটছে।এককথায় বিশ্বায়ন হল সমগ্র বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে একক বিশ্বের আদর্শ প্রতিষ্ঠা এবং নিবিড় সংযােগসাধনের একটি প্রক্রিয়া।
বিশ্বায়নের উদ্ভব:
১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দকে বিশ্বায়নের উৎস বর্ষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।বিশ্বায়ন নিয়ে প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে (The Globalization of World Politics”)।এরপর ১৯৯০-২০০২ এর মধ্যে বিশ্বায়ন নিয়ে অজস্র গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ৮০-র দশকে বিশ্বায়নের জাল তৃতীয় বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার সাহায্যে বিশ্বায়নের মাধ্যমে অবাধ পুঁজির বাজার ছড়িয়ে পড়তে লাগল। বিশ্বায়নের ফলে বিদেশি পুঁজি ও বহুজাতিক সংস্থাগুলি ফুলেফেঁপে উঠল। ভারতেও বহুজাতিক সংস্থার অগ্রগতি চোখে পড়তে লাগলাে।
বিশ্বায়নের রূপ :
বিশ্বায়ন একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া হলেও নিজেদের সুবিধার্থেই বিশ্বায়নের রূপকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা一
(১) অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন : সামগ্রিক বিচারে বিশ্বায়নের ধারণা মূলত অর্থনৈতিক। বিশ্বায়নের মাধ্যমে পুঁজিবাদ ব্যক্তির সম্পদকে বিনিময় মূল্যে রূপান্তর করেছে এবং অগণিত বিমূর্ত স্বাধীনতাকে একটি নির্দিষ্ট স্বাধীনতার তকমা দিয়েছে, যার নাম হল অবাধ বাণিজ্যের স্বাধীনতা। যার প্রধান লক্ষ্য ছিল সমগ্র বিশ্ব জুড়ে সমজাতীয় বিশ্ব অর্থব্যবস্থা গড়ে তােলা। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে রাষ্ট্রগুলির আইনের কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতাকে দূরে সরিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটল। একইসঙ্গে মূলধন ও প্রযুক্তির জোগান দিয়ে নতুন শিল্পজাত পণ্যের নতুন বাজার সৃষ্টি করল। ফলে আর্থিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকার পরিবর্তে পশ্চিমের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলি ও তাদের মুখ্য পৃষ্ঠপােষক সংস্থা যথা আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার (IMF), বিশ্বব্যাংক (World Bank), বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) উন্নয়নশীল দেশগুলিতে পুঁজির জোগান দেওয়ার ফলে একটি কার্যকরী ভূমিকা পালন করল। ফলে তৃতীয় বিশ্বের দুর্বল অনুন্নত রাষ্ট্রগুলি এবং উন্নয়নশীল দেশগুলি নীতি নির্ধারণে তাদের স্বার্থের বাহক হিসেবে কাজ করছে। এর ফলস্বরূপ আর্থিক বিশ্বায়নের স্বরূপ প্রকাশিত হচ্ছে।
(২) রাজনৈতিক বিশ্বায়ন : বিশ্বায়ন জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা বাতিল করে রাষ্ট্রকে বাজারকেন্দ্রিক সংস্থায় পরিণত করতে চায়। রাজনৈতিক বিশ্বায়ন হল উন্নয়নশীল দেশগুলির বাজার দখল করা। এই প্রসঙ্গে এঙ্গেলস-এর মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে, পণ্যের অনবরত প্রসারমান বাজারের প্রয়ােজনে ধনী বুর্জোয়াদের পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াতে হয়। জাতীয় রাষ্ট্রের ক্ষমতা সংকোচনের সঙ্গে সঙ্গে তারা ন্যূনতম রাষ্ট্র (Minimal State)-এর ধারণাটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। আসলে বিশ্বায়নের মূল পরিচালক হল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এর সহযােগী দোসর হল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স। এরা তাবেদারির ভূমিকা পালন করেছে। এই রাষ্ট্রগুলি জাতি-রাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রম করে উন্নয়নশীল দেশগুলির উপর বহুজাতিক কোম্পানি দ্বারা তাদের ইচ্ছা চাপিয়ে দিচ্ছে এর ফলে জাতি-রাষ্ট্রগুলির সার্বভৌমত্ব বিপন্ন বা সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। কিন্তু তারা জাতি-রাষ্ট্রের ধারণাকে পুরােপুরি অকেজো করে বিশ্বের রাষ্ট্র ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত করতে চায় না। তাদের প্রধান লক্ষ্য হল অতীতের মতাে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলির উপর নতুনভাবে ও নতুন রূপে রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা।
(৩) সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন : বিশ্বায়ন রূপকারদের প্রধান লক্ষ্য ছিল উন্নত তথ্যপ্রযুক্তি বিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির ধ্রুপদি সংস্কৃতির জগৎকে তছনছ করে দেওয়া। একইসঙ্গে বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতিকে কাজে লাগিয়ে বিজাতীয় ভােগবাদী সমাজের পণ্যকে নতুন মােড়কে হাজির করা। ফলে ভিন্ন সাংস্কৃতিক ধারা আজ রাষ্ট্রের গণ্ডি অতিক্রম করে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। আজ সারা বিশ্বে সমজাতীয় সংস্কৃতি গড়ে ওঠার রাস্তা সুগম হয়েছে। ইনটারনেট ও টিভির দৌলতে আজ সারা বিশ্বের মানুষ অল্প ব্যয়ে উন্নত সংস্কৃতির সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। একজন সমাজতত্ত্ববিদ বলেছেন যে, বিশ্বায়ন ও সংস্কৃতি পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জাতীয় সংস্কৃতির ধারণা সেকেলে করে দিচ্ছে। ছেলেমেয়েদের পরনে জিন্স, পায়ে বাহারি জুতা, হাতে কোল্ড ড্রিঙ্ক, চোখে সানগ্লাস, মুখে ফাস্টফুড, কানে স্মার্ট মোবাইল ফোন পৃথিবীর যে-কোনাে দেশের যে-কোনাে জায়গার মানুষের কাছে সহজলভ্য হয়ে যাচ্ছে। ভারতের ক্রীড়া জগৎ, সংগীত ও চিত্র জগতের নায়ক-নায়িকার মাধ্যমে বিজ্ঞাপিত সামগ্রী বা পণ্য বাজারজাত করা হচ্ছে। এইভাবে ভােগবাদী সংস্কৃতি উন্নয়নশীল দেশগুলির নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে, বিশ্বায়িত সংস্কৃতির সঙ্গে আঞ্চলিক সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটিয়ে জন্ম দিচ্ছে এক নতুন ধরনের সংস্কৃতি বা Culture.

বিশ্বায়ন|Globalization|HS Polscience Questions And Answers| উচ্চমাধ্যমিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রশ্নোত্তর| আন্তৰ্জাতিক সম্পর্ক
Q. বিশ্বায়নের প্রকৃতি আলােচনা করাে।
Ans: ভূমিকা: ‘বিশ্বায়ন’ শব্দটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একটি অপেক্ষাকৃত নতুন ধারণা। ইংরেজি শব্দ ‘Globalization’-এর বাংলা প্রতিশব্দ হল বিশ্বায়ন বা ভুবনায়ন। বিশ্বায়নের অর্থ হল পৃথিবীর নানাদেশের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বাধাকে দূর করে ব্যাবসাবাণিজ্য-সহ সমস্ত ক্ষেত্রে একক বিশ্বের আদর্শ সুপ্রতিষ্ঠিত করা। অধ্যাপক রবার্টসন হলেন বিশ্বায়ন’ধারণার প্রথম প্রবর্তক। তিনিই প্রথম বিশ্বায়ন ধারণার আনুষ্ঠানিক রূপ দেন। ১৯৬০-এর দশকে বিশ্বায়ন-এর ধারণার উৎপত্তি হয় এবং ১৯৮০-র দশকে বিশ্বায়ন শব্দটি ব্যাপক প্রচারলাভ করে। এরপর ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের পর এই ধারণার প্রয়ােগ শুরু হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ শতকের সত্তরের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়কালটিকে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ও পুঁজিবাদের স্বর্ণযুগ বলে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু নানা কারণে পুঁজিবাদী দেশগুলি অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়লে লগ্নিপুঁজির বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যেই তার অবাধ বাণিজ্যের উপর গুরুত্ব আরােপ করে। নয়া সাম্রাজ্যবাদী লিপার শোষণমূলক চরিত্রটিকে আড়াল করার জন্য তার নতুন নাম দেওয়া হয় বিশ্বায়ন। বিশ্বায়নের প্রকৃতিকে প্রধানত নিম্নলিখিত তিনটি দিক থেকে আলােচনা করা যায়, যথা—
[1] আর্থিক দিক: বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসার, বিভিন্ন দেশের মধ্যে অর্থ ও অন্যান্য বিনিময় মাধ্যমের সঞ্চালন, এক দেশ থেকে অন্য দেশে লগ্নিপুঁজির আদানপ্রদান, বহুজাতিক অথবা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থাগুলিকে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও উৎপাদনের অবাধ স্বাধীনতা দান এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে প্রযুক্তির আদানপ্রদান এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তথ্য মাধ্যমের বিস্তার ও বিভিন্ন দেশের তথ্য মাধ্যমের উপর বৈদ্যুতিন প্রযুক্তির প্রয়ােগ প্রভৃতি। একদিকে ক্রেতার সংখ্যা ক্রমশ কমছে, অন্যদিকে মজুত মালের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে সারা বিশ্বব্যাপী দেখা দিচ্ছে আর্থিক মন্দা ও বৈষম্য। অবাধে কলকারখানা বন্ধ হওয়ায় শ্রমিক-কর্মচারী উপবৃত্ত হচ্ছে একদিকে ধনিক শ্রেণির হাতে পাহাড়প্রমাণ পুঁজি জমা হওয়ায় ধনী আরও ধনী হচ্ছে এবং অন্যদিকে কৃষক ও শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষ হয়ে পড়ছে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর। বলাবাহুল্য, বিশ্বব্যাপী জন্ম নিচ্ছে এক উদ্বাস্তু সমস্যা যা দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিচ্ছে।
[2] রাজনৈতিক দিক: রাজনৈতিক দিক থেকে বিশ্বায়ন জাতি-রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ বিরােধী। সাধারণভাবে গণতান্ত্রিক প্রকৃতি সম্পন্ন প্রতিটি জাতি-রাষ্ট্র সাধারণ মানুষের স্বার্থে পুঁজির অবাধ মুনাফা ও অবাধ লুণ্ঠনের উপর নানাপ্রকার বাধানিষেধ আরােপ করে। তবে, বিশ্বায়ন বিস্ময়করভাবে স্বায়ত্তশাসনের নানাবিধ প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখতে আগ্রহী। এর কারণ হল শক্তিশালী জাতি-রাষ্ট্র বিশ্বায়ন বৃহৎ পুঁজির সঙ্গে দর কষাকষি করতে সক্ষম, অপরদিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বায়ত্তশাসন মূলক প্রতিষ্ঠানগুলির সেই সামর্থ্য থাকে না। বৃহৎ পুঁজির নির্দেশেই তা পরিচালিত হতে বাধ্য। এইভাবে বিশ্বায়নের পাশাপাশি বিশ্বের আঞ্চলিকী করণও ঘটেছে। এই প্রসঙ্গে জোসেফ নাই এবং জন ডি জোনাহিউ তাঁদের “Governance as a Globalization World’ গ্রন্থে লিখেছেন বিশ্বায়ন এক দেশ থেকে অন্য দেশে শ্রমিকের গমনাগমন, তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি ও সরকারের ব্যবহারযােগ্য কর (Tax) ব্যবস্থা এবং মূলধনের সচলতার সাবেকি ধারণাকে পালটে দিয়েছে। এই উদ্দেশ্যসাধনের জন্য সারা বিশ্বের বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে পৃথিবীর গুটিকয়েক দেশ। তাদের রথের ঘােড়া 201-IMF, WTO, World Bank, NATO, EEC এবং বহু মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি প্রভৃতি।
[3] সাংস্কৃতিক দিক: বিশ্বায়নের লক্ষ্য হল বিশ্বব্যাপী একটি সমরূপ সংস্কৃতি গড়ে তােলা। ইনটারনেট-সহ বিভিন্ন অত্যাধুনিক গণমাধ্যমের সাহায্যে এরূপ সংস্কৃতি গড়ে তােলার কাজে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম কর্পোরেশনগুলি আত্মনিয়ােগ করে। তারা জাতি-রাষ্ট্রের গণ্ডি ছাড়িয়ে সাংস্কৃতিক প্রবাহকে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। অর্থাৎ সাংস্কৃতিক দিক থেকে বিশ্বায়ন সারাবিশ্বে Tele Electronic, Homogeneous Culture গড়ে তুলতে চায়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথিবীর একটি অংশের উৎপাদিত উদ্বৃত্ত পণ্য সামগ্রী, তথ্য প্রযুক্তি, ধ্যানধারণা, অন্য রাষ্ট্রের দ্বারা চালিত হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলি ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে যাচ্ছে। এর ফলে মানুষে মানুষে যে সাংস্কৃতিক পার্থক্য বা ভেদাভেদ আছে তা মুছে যাচ্ছে এ কাজে সাহায্য করছে উন্নত প্রযুক্তির দান ইনটারনেট, উপগ্রহভিত্তিক টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা। বিশ্বায়নের সাংস্কৃতিক দিকের ফলে আজ দুনিয়ার খবরাখবর এক মুহূর্তে সারা পৃথিবীতে ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে।
উপসংহার: ১৯৯০-এর দশক থেকেই প্রথম ইরাক যুদ্ধ, সােভিয়েত রাশিয়ার পতন, CTBT, GATT, WTO-র সক্রিয়তা মার্কিন সেনা কর্তৃক আফগানিস্তান ও ইরাকের উপর আক্রমণ, চিনের নীরবতা, উগ্রপন্থী কার্যকলাপ বৃদ্ধি সংক্রান্ত বিভিন্ন কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপক্ষে বর্তমানে যে বিশ্বায়নের সূর্য উদিত হয়েছে তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। মার্কিন শক্তি নতুন উদ্যমে বিশ্বকে শাসন করার অভিপ্রায়ে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনগুলিকে মুক্ত বাজারের মুখােশে সুকৌশলে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বায়ন এক অপরিহার্য আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া। বাজার, অর্থনীতি, উদারীকরণ ও বাণিজ্যিক বিশ্বায়ন থেকে কোনাে দেশ বাইরে বেরিয়ে আসতে পারছে না।
বিশ্বায়ন|Globalization|HS Polscience Questions And Answers| উচ্চমাধ্যমিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রশ্নোত্তর| আন্তৰ্জাতিক সম্পর্ক
Q. বিশ্বায়নের বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা করাে।
Ans: ভূমিকা: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হল বিশ্বায়ন। বিগত শতাব্দীর ১৯৮০-র দশকে যে মুক্ত বাজার অর্থনীতির সূচনা হয়, তারই ফলশ্রুতি হল বিশ্বায়ন।
বিশ্বায়নের বৈশিষ্ট্য:
বিশ্বায়নের বৈশিষ্ট্য আলােচনার পূর্বে বিশ্বায়নের বেড়াজালে বিশ্ব’ এই ছক বা চিত্রের সাহায্যে বিশ্বায়ন, বিশ্ববাজার এবং বিশ্বায়ন পৃথিবীর প্রকৃত অর্থকে পরিস্ফুট করে তােলা যেতে পারে।
(১) বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে যােগসূত্র স্থাপন: বিশ্বায়ন বিভেদ ও বৈষম্যকে প্রাধান্য না দিয়ে আন্তর্জাতিক সংহতি তৈরির কথা বলে। বিশ্বায়ন এই সত্যকে তুলে ধরে রাষ্ট্রগুলির মধ্যে একটি অভিন্ন যােগসূত্র গড়ে তুলতে চায়।
(২) বিশ্বায়ন হল একটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া: বিশ্বায়নের সঙ্গে অর্থনীতি গভীরভাবে যুক্ত। বলা যায়, বিশ্বায়ন হল পুঁজির প্রকারান্তরে অর্থনীতির বিশ্বায়ন। বিশ্বব্যাপী পুঁজির গমনাগমন বা আর্থিক লেনদেনই হল বিশ্বায়ন। অন্যভাবে বলা যায়, বিশ্ববাজারের চাহিদা অনুযায়ী অর্থনীতির উন্মুক্তকরণ, যেখানে পণ্য উৎপাদন এবং বণ্টনে, বিপণনে অর্থনীতি দুনিয়া জুড়ে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে, সেটাই হল আর্থিক বিশ্বায়ন।
(৩) আর্থিক দিক থেকে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা: বিশ্বায়ন পৃথিবীর প্রতিটি দেশের আর্থিক দিক থেকে পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল করে তুলেছে। এই নির্ভরশীলতা বিভিন্ন দেশের বিবদমান স্বার্থ, মতাদর্শ এবং ব্যাবসাবাণিজ্যের বাধাকে মুছে দিতে সক্ষম হয়েছে।
(৪) মুক্ত বাজার অর্থনীতি: মুক্ত বাজার অর্থনীতির প্রভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিনিয়ােগকারীরা বিদেশের মাটিতে অবাধ বিনিয়োগ করবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অনুমােদন লাগবে না। অর্থাৎ বিশ্বায়ন সমগ্র বাজারকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে চায়।
(৫) উদারীকরণের সঙ্গে বিশ্বায়নের গভীর সম্পর্ক: বিশ্বায়নের উদারীকরণ ও বেসরকারিকরণের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। উদারনীতিবাদ আসলে পুঁজিবাদের ভিন্নতর রূপ (মূর্তি এক, খােলস বা বহিরাবরণ শুধু আলাদা)। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে তার পরিমার্জন হলেও শােষণ করার চরিত্র পালটায়নি। একমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বের যুদ্ধে কয়েকটি পশ্চিমি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র শক্তি আর্থিক উদারীকরণ তত্ত্বকে ব্যবহার করে বিশ্বায়নের জামা পরিয়ে শােষণের কৌশলকে পরিপূর্ণতা দিয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলি বিশ্বায়ন এবং উদারীকরণের ঢাকায় নিজ দেশে আর্থিক সংস্কারে বাধ্য হচ্ছে, তাই উদারীকরণ ও বেসরকারিকরণ হল বিশ্বায়নের অন্যতম হাতিয়ার বা তাত্ত্বিক শক্তির ভিত্তি।
(৬) অতিরিক্ত মুনাফার লােভে অনুন্নত দেশে পুঁজি বিনিয়োগ: বিশ্বায়নের অন্যতম লক্ষ্য হল অপেক্ষাকৃত গরিব দেশগুলিতে পুঁজি বিনিয়োগ। এর কারণ দরিদ্র দেশগুলির অর্থনীতি চাঙ্গা নয়, যেসব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করলে গরিব দেশগুলি বেশি উপকৃত হবে সেইসব ক্ষেত্রে বিদেশি পুঁজি (FDI) বিনিয়োগ করা হয় না। কেবলমাত্র যেসব ক্ষেত্রে বেশি মুনাফা অর্জন সম্ভব হবে শুধুমাত্র সেইসব ক্ষেত্রেই বিদেশি কোম্পানিগুলি তাদের পুঁজি বিনিয়োগ করে। যেমন—মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ভারতে তাদের কারখানা গড়ে তুলেছে, কারণ ভারতে কাঁচামাল ও শ্রমিক কম খরচে পাওয়া যায় এবং উৎপাদিত পণ্য চড়া দামে বিক্রি করে মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলা যায়। স্বাভাবিকভাবে এদেশের মাটি ও শ্রমিক ব্যবহার করে গড়ে ওঠা শিল্প ও বাণিজ্য সংস্থার লাভের অঙ্ক ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
(৭) তথ্য প্রযুক্তির উল্লেখযােগ্য উন্নতি: তথ্য প্রযুক্তির সবিশেষ উন্নতির উপর ভর করে বিশ্বায়ন আজ সফল হয়েছে। বিশেষত এইসময় যে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটে গেছে, তা বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে। উল্লেখ্য যে, ইনটারনেট ব্যবস্থা দূরকে করেছে নিকট। ইনটারনেট-সহ সকল তথ্য প্রযুক্তির বিকাশ গােটা বিশ্বকে এক ছাতার তলায় আনতে সক্ষম হয়েছে। ফলে আমরা নয়া বিশ্বব্যবস্থার সন্ধান পেয়েছি।
(৮) ভূখণ্ডকেন্দ্রিক রাষ্ট্রীয় সনাতনী সার্বভৌম ধারণার পরিবর্তন: বিশ্বায়নের যুগে কোনাে রাষ্ট্রই যেমন নিজস্ব ভূখণ্ডের মধ্যে অবাধ ক্ষমতা ভােগ করতে পারে না, তেমনই বাহ্যিক ক্ষেত্রেও তার চরম ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারে না। আধুনিক বিশ্বে প্রতিটি দেশই পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। ফলে সাবেকি সার্বভৌম ক্ষমতার ধারণা বিশ্বায়নের যুগে সার্বিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। বিশ্বের প্রতিটি দেশই বিশ্বব্যাংক ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতি ও নির্দেশ মেনে চলে। ফলে বর্তমান সময়ে চিরাচরিত সার্বভৌম ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে।
(৯) বিশ্বায়ন হল নয়া উপনিবেশবাদ: বিশ্বায়ন হল ছদ্মবেশী নয়া উপনিবেশবাদ। একে অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন ও বলা যায়।
আরও দেখুন : মোবাইল এর মাধ্যমে অর্থ উপার্জন (youtube Shorts)
বিশ্বায়ন|Globalization|HS Polscience Questions And Answers| উচ্চমাধ্যমিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রশ্নোত্তর| আন্তৰ্জাতিক সম্পর্ক
Q. বিশ্বায়নের কারণ বর্ণনা করাে।
Ans: প্রথমত: গত শতকের আটের দশকে বা তার আগে কিংবা পরে বিশ্বায়ন নতুন উদ্যমে যাত্রা শুরু করে। এর কারণ হল বিগত তিন-চার দশকে বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা ও কারিগরি কলাকৌশলের ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব বিপ্লব এসেছে, তার ফলে বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সঙ্গে অতি সহজে যােগাযােগ স্থাপিত হয়েছে। মূলধন ও প্রযুক্তিগত কলাকৌশলের আদানপ্রদান আজ বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি আজ নিজেদের বিকাশের প্রয়ােজনে শিল্পসমৃদ্ধ দেশ গুলো থেকে পুঁজি ও কারিগরি কলাকৌশল আমদানির দিকে নজর দিচ্ছে। অপরদিকে, লাভজনক বিনিয়োগের আশায় উন্নত দেশগুলি এসব রপ্তানি করতে বিশেষ আগ্রহী। উভয়ই যেখানে সহযােগিতার হাত সম্প্রসারিত করেছে সেখানে প্রয়ােজনীয় পুঁজি ও দ্রব্যসামগ্রীর অবাধ আদানপ্রদানে প্রতিবন্ধকতা থাকা একেবারেই কাম্য নয়। মূলধন এবং কলাকৌশলের অবাধ গতি বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্বায়ন তার জয়যাত্রাকে গতিসম্পন্ন করে তুলেছে।
দ্বিতীয়ত: বিশ্বায়নের আবির্ভাবের অন্য একটি কারণ হল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন। সাম্যবাদের পতনের পর দ্বিমেরুতার স্থান দখল করল একমেরুতা এবং বিশ্বব্যাপী একটিমাত্র মতাদর্শ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, সেটি হল পুঁজিবাদ বা পুঁজিবাদী দুনিয়ার মদতে গড়ে ওঠা নয়া উদারনীতিবাদ। বিশ্ববাসী আজ উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, পুঁজিবাদী দুনিয়ার নেতৃত্বে পরিচালিত বিশ্বায়নের প্রভাব থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে রাখা যাবে না। এই বােধােদয় বিশ্বায়ন সৃষ্টির একটি বড় কারণ।
তৃতীয়ত: উপনিবেশবাদ পরবর্তী যুগে বিশ্বের সকল উন্নয়নশীল দেশের অন্যতম লক্ষ্য হল দ্রুত বিকাশের ব্যবস্থা করা। তারা বাস্তববাদী হয়ে উন্নত রাষ্ট্রগুলি থেকে বিকাশের উপাদান সংগ্রহে সচেষ্ট হয়। এই মানসিকতা থেকেই জন্ম নেয় বিশ্বায়ন।
চতুর্থত: বিশ্বায়নের আবির্ভাবের আর-একটি কারণ হল রাষ্ট্রনেতা, রাজনীতিবিদ, প্রশাসক প্রভৃতিদের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারার বদল। এরা মনে করেন যে, উন্নয়নে রাষ্ট্রের ভূমিকা ক্রমাগত ক্ষীণ হয়ে আসছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির বহুজাতিক সংস্থা এবং বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল এবং উন্নয়ন ও পুনর্গঠনের নিমিত্ত আন্তর্জাতিক ব্যাংক প্রভৃতি বিশ্বের অর্থব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন ও পুনর্গঠনের জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। এই সংস্থাগুলি নিজেদের প্রয়ােজনে তৃতীয় বিশ্বের অর্থনীতিতে উপস্থিত হয়। অপরদিকে, তৃতীয় বিশ্বের দেশ সমূহ যাবতীয় ছুতমার্গকে বিসর্জন দিয়ে উন্নয়নের যজ্ঞে শামিল হয়। তৃতীয় বিশ্বের মানসিকতার এই পরিবর্তন বিশ্বায়নের আবির্ভাবকে ত্বরান্বিত করে।
উপসংহার: সবশেষে বলা যায় যে, বিশ্বব্যাপী মানসিকতার পরিবর্তন বিশ্বায়নের পক্ষে গিয়েছিল। শুল্ক শিথিলতার ফলে বিশ্ব বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়। বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যম ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ঘটে এবং ব্যাংক ব্যবস্থাকে বিশ্বপ্রকৃতিসম্পন্ন করে গড়ে তােলে ও সহজতর আদানপ্রদান ব্যবস্থা বা ইন্টারনেটের অপরিহার্যতা বিশ্বায়নের গতির সঞ্চার করে।
বিশ্বায়ন|Globalization|HS Polscience Questions And Answers| উচ্চমাধ্যমিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রশ্নোত্তর| আন্তৰ্জাতিক সম্পর্ক
Q. বর্তমান যুগে ভারতে বিশ্বায়নের প্রভাব বা ফলাফল পর্যালোচনা করো।
Ans: বহুচর্চিত ও আলােচিত বিশ্বায়ন ভারতে যে প্রভাব বিস্তার করেছে, তা নিম্নে সূত্রাকারে আলােচনা করা হল一
(১) ভারতের কৃষিতে সবুজ বিপ্লব হলেও সামগ্রিক উন্নতি হয়নি: স্বাধীনতা লাভের পর বিদেশের সঙ্গে ভারতের যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নতি, ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে ব্যাংক জাতীয়করণ, অল্প সুদে কৃষি ও শিল্পের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণের ব্যবস্থা, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকে সামনে রেখে (১৯৫৬-৬৪ খ্রি.) দ্রুত শিল্পায়ন। ১৯৬০-এর দশকে ভারতের কৃষিতে সবুজ বিপ্লব ঘটে কিন্তু সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকায় সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পায়নি, বিশ্বের অগ্রগতির সঙ্গে সমানতালে ভারতের প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতি হয়নি, যার ফলে ভারতের কোনাে একটি রাজ্যে সবুজ বিপ্লব ঘটলেও সারা দেশের সামগ্রিক উন্নতি হয়নি।
(২) বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতিপূরণে বিদেশি ঋণ গ্রহণ: বিশ্বায়নের যুগে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধির আমলে পরিস্থিতি উদারীকরণের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ভারতের বিশ্বায়নের দরজা-জানালা খুলে দেন, তখন বিশ্বায়নের সমর্থকরা সমন্বয়ে দাবি জানান যে, ভারতীয় অর্থনীতিকে বিশ্ব অর্থনীতির দোসর করে তুলতে হলে ভারতের বিশ্বায়নকে বরণ করে নিতে হবে যাকে তখন বলা হয় TINA অর্থাৎ There Is No Alternative I এক সময় থেকেই ভারতে বিশ্বায়ন তার প্রকৃত ব্যাঘ্র-থাবা বসাতে থাকে এবং তার প্রভাব ভারতের বাজারেও পড়তে থাকে। বিলগ্নিকরণ, বেসরকারিকরণ, উদারীকরণ ও বিশ্বায়নের চাপ ভারত সরকারকে বেসামাল করে দেয়। বিশ্বায়নের মুখ্য প্রবক্তা হিসেবে পরিচিত আমেরিকা, ইংল্যান্ড মহাজনি পুঁজির ব্যাবসা সম্প্রসারণের মাধ্যমে IMF, World Bank, MNC-এর মতাে বহুজাতিক কোম্পানিগুলিকে ঋণের ফাদে ফেলে দেয় এবং এই পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারত নতুনভাবে শােষণের মুখে পড়ে।
(৩) টাকার অবমূল্যায়ন ও বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি: ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে নতুন জনতা সরকার ভারতে ক্ষমতায় এসে ভারতীয় অর্থনীতির তেমন কোনাে উল্লেখযােগ্য পরিবর্তনসাধন করতে না পারায় টাকার অবমূল্যায়ন ঘটে ও জাতীয় কোশাগারে বিদেশি মুদ্রার টান পড়ে। একসময় কয়েক হাজার টন সােনা বিদেশের ব্যাঙ্কে বন্ধক রাখতে হত। অধ্যাপক অমিয় কুমার বাগচী লিখেছেন, সম্ভাব্য অবমূল্যায়নের সুবিধা নেওয়ার জন্য এদেশের পুঁজিপতিদের একটি অংশ এবং বুর্জোয়া শ্রেণির কিছু প্রতিনিধি কোটি কোটি কালাে টাকা, কালাধন বিদেশে পাচার করে দিয়েছিল, ফলে কোশাগারে বিদেশি মুদ্রায় টান পড়ে।
(৪) প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের আমল: পি ভি নরসিমহা রাও IMF, World Bank-এর প্রস্তাবিতা ভারতীয় বাজারের কাঠামােগত সংস্কার শর্তে বিদেশি ঋণ গ্রহণ করেন এবং এদেশের বাজার বিশ্বায়নের কারবারিদের কাছে উন্মুক্ত করে দেন। এ ছাড়াও বহুজাতিক পুঁজির গমনাগমনের পথ-সহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ বন্ধ করেন, আমদানি শুল্ক হ্রাস করেন, বাণিজ্যগােষ্ঠীর অবাধ বিনিয়ােগের সুযােগ ও স্বাধীনতা প্রদান করেন। এর ফলে ভারতবর্ষ হয়ে ওঠে বিশ্বায়নের সবচেয়ে বড়াে মৃগয়াক্ষেত্র।
(৫) অসতর্কতার কুফল: ভারতবাসীর কাছে বিশ্বায়নের ফল ভালাে হয়নি বলে অনেকে মনে করেন। মুক্ত বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে ভারতে যে বিদেশি পুঁজি আসছে তা উৎপাদন প্রযুক্তি ও পরিকাঠামো-সহ দীর্ঘমেয়াদি কোনাে প্রকল্পে বেশি বিনিয়োগ হচ্ছে না, বেশি বিনিয়োগ হচ্ছে শেয়ার কেনাবেচায়। অসতর্ক বিশ্বায়ন নীতির কুপ্রভাব দেখা গেছে ব্যাংক স্ক্যাম ক্ষেত্রে। একসময় ভারতীয় বাজার থেকে লক্ষ লক্ষ মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্তের সঞ্চিত অর্থ কপূরের মতাে উবে যায়, এখনও এই ধারা বহমান।
(৬) হায়ার এবং ফায়ার নীতি: বিশ্বায়নের প্রভাবে ভারতের কাঠামােগত সংস্কার প্রক্রিয়া বহু শ্রমজীবী মানুষের রুটিরুজির উপর করুণ প্রভাব ফেলেছে। বিশ্বায়ন ভারতের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের কাছে কোনাে সুফল পৌছে দিতে পারেনি। বিদেশি সংস্থার কলকারখানার সঙ্গে দেশীয় কলকারখানা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ফলে বহু কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, ফলে কাজ হারিয়েছে হাজার হাজার দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিক। IMF, World Bank-এর সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়িত করতে গিয়ে Hire and Fire নীতি প্রয়ােগ করা হয়। এর অর্থ হল কাজ থাকলে ডেকে নেওয়া, কাজ না থাকলে তাড়িয়ে দেওয়া─ এই নীতি প্রয়ােগের ফলে বহু শ্রমিকের জীবনে নেমে এসেছে দুঃখের করাল ছায়া।
(৭) ভারতের কৃষি-অর্থনীতির উপর ক্ষতিকর প্রভাব: ভারতের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির উপর বিশ্বায়নের ক্ষতিকর প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়।বিশ্বায়ন পুরোপুরি পণ্য নির্ভর ও শিল্প মুখি হওয়ায় কৃষি উৎপাদনের বৃদ্ধির হার কমেছে বহুগুণ, তা ছাড়া রপ্তানিযােগ্য কৃষি পণ্যের উপর জোর দেওয়ার ফলে কোথাও কোথাও খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে।
(৮) শিল্পায়ন, নগরায়ণ এবং সেচ বাঁধ নির্মাণের কারণে কৃষিজমি নষ্ট: বিশ্বায়নের দাপটে আজ ভারতের কৃষক কুলের বিপন্ন। নগরায়ণ ও শিল্পায়নের তাগিদে উর্বর কৃষিজমি নষ্ট করা হয়েছে। চাষযােগ্য জমিতে গড়ে তােলা হয়েছে SEZ (Special Economic Zone)। দেশি-বিদেশি শিল্পপতি, পুঁজিপতি ও বহুজাতিক কোম্পানির রাক্ষুসে থাবায় বহু কৃষক পরিবার তাদের একমাত্র আবাদযােগ্য জমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে। গুজরাটে উকাই-এর বাঁধ ও সেচ প্রকল্পের ধাক্কায় ৭০ হাজার উপজাতি পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়ে নতুন করে ছিন্নমূল উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে।
(৯) পশ্চিমি ভােগবাদী সংস্কৃতির প্রভাব: বিশ্বায়নের ফলে ভারতের নিজস্ব সংস্কৃতি বিপন্ন হয়ে ধ্বংসের মুখে পতিত হয়েছে। পশ্চিমি ভােগবাদী সংস্কৃতি ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নষ্ট করে দিচ্ছে। ভােগবাদী সংস্কৃতির প্রচারের ফলে আঞ্চলিক ও জাতীয় সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য ক্ষুন্ন হতে চলেছে। বিশ্বায়ন মূলত প্রাচ্য সংস্কৃতি, সৃষ্টিশীলতাকে ধ্বংস করে দিতে চাইছে।
(১০) পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে: বিশ্বায়নের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানব সমাজের পরিবেশ। পরিবেশ আজ সংকটে বিপন্ন। বিশ্বায়নের ফলে ভারতে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানা ভয়াবহ দূষণ ছড়াচ্ছে আকাশে-বাতাসে। যা Eco Friendly নয় বা পরিবেশ বান্ধব নয়।
উপসংহার: বিশ্বায়নের প্রভাব আজ সমাজের সর্বস্তরে দেখা যাচ্ছে। বাজার অর্থনীতি, উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ, প্রযুক্তিবিদ্যার যথেষ্ট ব্যবহারের দ্বারা বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে ডেকে আনা হচ্ছে। উন্নত বিশ্বের বিজ্ঞানের ভালাে দিকগুলি গ্রহণ করতে হবে, মন্দ দিকগুলিকে আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলে দিতে হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি এবং দেশীয় সংস্কৃতি চর্চাই পারবে বিশ্বায়নের কুপ্রভাবমুক্ত বাঁচার রাস্তা খুঁজে দিতে।
বিশ্বায়ন|Globalization|HS Polscience Questions And Answers| উচ্চমাধ্যমিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রশ্নোত্তর| আন্তৰ্জাতিক সম্পর্ক
Q. ভারতে বিশ্বায়নের সুবিধা ও অসুবিধা
Ans:
ভারত রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে দেশীয় বাজারের মুক্তি ও আমদানি-রপ্তানি ও বিদেশি বিনিয়োগের বেড়াজাল উন্মুক্ত করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক পর্বে মনে করা হয়েছিল যে, ভারতের চিরাচরিত আর্থিক ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে। এই ধারণা অমূলক প্রমাণিত হয়েছে, ভারতীয়রা বিশ্বায়নের সুফলকে অনুভব করতে পেরেছে।
✹ উদারীকরণ নীতি অনুসরণ করার ফলে ভারতের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। মুক্ত অর্থব্যবস্থা বিনিময় হারকে সরলীকরণ করেছে। এর ফলস্বরূপ রপ্তানি বাণিজ্যের হার বৃদ্ধি পেয়েছে।
✹ বিগত শতাব্দীর আশির দশকে ভারতের বেহাল অর্থনীতির কারণে দেশের সােনা বিদেশে বন্ধক দিতে হয়েছিল, সেই বন্ধকের হাত থেকে ভারত আজ মুক্ত। ভারতে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলের পরিমাণ বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।
✹ ভারতবর্ষে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদিত চাল, আলু, গম, তুলা প্রভৃতি শস্য গুলির আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দাম বেশি থাকায় তা রপ্তানি করা হচ্ছে। ফলে কৃষকরা অতিরিক্ত দাম পাচ্ছে।
✹ভারতীয় টাকাকে পুরােপুরি লেনদেন বা বিনিময়যােগ্য করা হয়েছে। ফলে ডলারের অনুপাতে টাকার বিনিময় হারে ওঠানামা লক্ষ করা যায়। বর্তমানে ভারতীয় টাকার বিনিময় হারে স্থায়িত্ব পরিলক্ষিত হচ্ছে । ✹বিশ্বায়নের ফলে ভারতের অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বনির্ভরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমদানির পাশাপাশি রপ্তানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি আমদানি ব্যয়ের প্রায় সমস্তটাই রপ্তানিকৃত অর্থের সাহায্যে মেটানাে সম্ভব হচ্ছে।
✹প্রযুক্তিবিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে ভারতীয় প্রযুক্তিবিদরা বিদেশে যথেষ্ট সংখ্যায় কর্মসংস্থানের সুযােগ পাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে ভারতবর্ষ আজ অগ্রণী দেশে পরিণত হয়েছে।
✹ভারতীয় উদ্যোগপতি ও শিল্পপতিরা বিশ্বায়নের সুযােগকে সদ্ব্যবহার করে বিদেশের মাটিতে গাড়ি শিল্প, ইস্পাত শিল্প প্রভৃতি অধিগ্রহণ করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছে।
✹মহাকাশ গবেষণায় আজ ভারত বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলির মধ্যে অন্যতম। ভারতের প্রতিষ্ঠান ইস্রাে প্রচুর বৈদেশিক কৃত্রিম উপগ্রহকে মহাকাশে রকেটের সাহায্যে পাঠিয়ে বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। ফলে তারা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহে দেশকে সাহায্য করেছে।
✹ বিশ্বায়নের ফলে ভারতে যােগাযােগ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটে গেছে। ইনটারনেট, সেলফোন আজ প্রতিটি ভারতবাসীর ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। ভারত সরকার স্বপ্ন দেখে তারা ভারতবর্ষকে ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় পরিণত করবে।
উদারীকরণ নীতি প্রয়ােগের ফলস্বরূপ ভারতের সাধারণ মূল্যস্তরে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
ভারতে বিশ্বায়নের অসুবিধাসমূহ:
বিশ্বায়নের সুফল ভোগের পাশাপাশি আজ তার কুফলগুলিও ভারতের অর্থনীতির ক্ষেত্রে নিদারুণভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। সেগুলি আলােচনা করা প্রয়ােজন।
✹ বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার ফলে বিশ্বের বহুজাতিক বৃহৎ কোম্পানিগুলি এদেশে অবাধে কাজ করার ফলে দেশীয় কোম্পানিগুলি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে, যার ফলস্বরূপ ভারতীয় অর্থনীতির মূল স্তম্ভসমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
✹ প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের জন্য বা FDI (Foreign Direct Investment)-এর জন্য বিদেশি বিনিয়ােগপতিদের কাছে খুলে দেওয়া হল ভারতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্পসংস্থাগুলিকে। যে-সমস্ত ক্ষুদ্র শিল্প দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে রাখত তারা আজ মৃতপ্রায়। বহুসংখ্যক শ্রমিক কাজ হারিয়ে বেকারে পরিণত হয়েছে।
✹ কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার অবাধ হওয়ার ফলে খাদ্যশস্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ কৃষকরা ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। বিদেশি সস্তা চাল এদেশে আসছে। ফলে কৃষকরা চাষ করে লাভজনক দাম পাচ্ছে না। ফলে কৃষিতে তার প্রভাব পড়ছে।
✹ বিশ্বায়নের পরিণামে ভারতে বেকারসমস্যা প্রকট হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিদেশি বহুজাতিক সংস্থাসমূহের মূলধন উৎপাদন পদ্ধতির কারণে বৃদ্ধি পাওয়ায় চাকরির সুযােগ হ্রাস পাচ্ছে।
✹ বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া ভারতীয় অর্থনীতিতে শিল্পোৎপাদনের উর্ধ্বমুখী ধারা সৃষ্টি করতে পারেনি।
✹ প্রভিডেন্ট ফান্ড ও পেনশন প্রভৃতি রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত আর্থিক সুবিধাগুলি আজ বাজার নির্ভর হয়ে গেছে। সরকার এখন পেনশন ও প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা শেয়ার বাজারে লগ্নি করছে। ফলে নাগরিকদের ভবিষ্যৎ জীবনে অন্ধকার নেমে আসছে।
✹ সমালােচকরা বলে থাকেন, ভারতের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারে স্ফীতি হয়েছে, যে তথ্য বিশ্বায়নের সমর্থকরা দিয়ে থাকেন তা বিভ্রান্তিমূলক। আসলে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের জন্য এই স্ফীতি দেখায়। প্রকৃতপক্ষে ভারতের নাগরিকরা বিশ্বব্যাংকের মতাে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দেনায় ডুবে আছে।
✹সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের দৌলতে আজ বিদেশি টেলিভিশন, ইনটারনেট এবং বলিউড সিনেমার প্রভাবে নিজস্ব সংস্কৃতি ও সভ্যতা সংকটের মুখে পড়েছে। সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ এর দৌলতে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
✹ বহুজাতিক সংস্থা গুলোর অবস্থান এর ফলে ভারতের কৃষিজ ও বনজ সম্পদও রক্ষা পাচ্ছে না। পেটেন্ট আইনের জন্য ভারতের সুপ্রাচীন বনজ ও কৃষিজ সম্পদ বিদেশি কোম্পানির হাতে চলে যাচ্ছে।
✹ সব কিছুতেই ঠিকা শ্রমিক, চুক্তিমূলক চাকরি, স্বেচ্ছা ও বাধ্যতামূলক অবসর, বেসরকারিকরণ ও জনগণের জন্য সরকারি পরিসেবা হ্রাস করা হচ্ছে। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলি বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা বা উন্নত কলাকৌশলের পরিবর্তে দিচ্ছে শুধু বিলাসসামগ্রী। উন্নত পুঁজিবাদী দেশের কোম্পানিগুলির মূল উদ্দেশ্য প্রায় ১২৫ কোটি মানুষের বাজার দখল করা। যার ফলে ওষুধপথ্য-সহ নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে পড়েছে।
উপসংহার: বিশ্ব অর্থনীতি থেকে ভারতীয় অর্থনীতিকে বিচ্ছিন্ন রাখা সম্ভব নয়, উচিতও নয়; সংযুক্তিকরণ আবশ্যক। তবে ভারতের স্বার্থের অনুকূলে বিদেশি বিনিয়োগ ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাঞ্ছনীয়। মূলধনের বিশ্ব বাজারের সঙ্গে ভারতীয় অর্থনীতির সংযােগের ফলে যে পরিবর্তিত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার সঙ্গে সম্যকভাবে সংগতিসাধনের সামর্থ্য ভারতীয় অর্থনীতিকে অর্জন করতে হবে। বিশ্বায়নের অশুভ ফল দূর করতে হলে ভারতকে তার নিজস্ব সমাজ সংস্কারের কাজে মন দিতে হবে এবং বিদেশিদের উপর নির্ভর না করে স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে।
বিশ্বায়ন|Globalization|HS Polscience Questions And Answers| উচ্চমাধ্যমিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রশ্নোত্তর| আন্তৰ্জাতিক সম্পর্ক
Q. রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার উপর বিশ্বায়নের প্রভাব
Ans: বিশ্বায়নের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিশ্বায়নের প্রভাবে জাতি-রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা বিপন্ন বা সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে বলে কেউ কেউ মত ব্যক্ত করেছেন। বিশ্বায়নের প্রভাবে বর্তমান বিশ্বের রাষ্ট্র গুলো সত্যিই সার্বভৌম ক্ষমতা হারাচ্ছে কি না সে প্রশ্নটি বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করেছে। বর্তমান একমেরুকেন্দ্রিকতার যুগে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার বিশেষ কোনাে প্রাসঙ্গিকতা নেই। কারণ পারস্পরিক নির্ভরশীলতার যুগে কোনাে রাষ্ট্রই এককভাবে তার অবাধ ক্ষমতার বাস্তব রূপায়ণ ঘটাতে পারে না।
[1] সাবেকি রাষ্ট্রের ধারণার পরিবর্তন: জাতি-রাষ্ট্রগুলির সনাতন সার্বভৌমিকতা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ধারণায় ব্যাপকভাবে অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনাটি বিশ্বায়নের প্রভাবেই ঘটেছে। কিনা আজকের দুনিয়ায় কোনাে রাষ্ট্রের পক্ষেই এককভাবে তার চূড়ান্ত ও চরম ক্ষমতার বাস্তব প্রকাশ ঘটানাে সম্ভব নয়। যদি কোনাে রাষ্ট্র তার চূড়ান্ত ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়, তবে তা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রহসনের পাত্রে পরিণত হবে। কেননা পারস্পরিক নির্ভরতার দ্বারাই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। এই প্রবণতা বর্তমানে রাষ্ট্রসমূহের ভূমিকাকে কিছুটা ক্ষুন্ন করেছে। ফলে রাষ্ট্র সমূহের চরম ক্ষমতার সম্মুখীন হয়ে সনাতনী ধারণাকে পরিত্যাগ করে রাষ্ট্রকে একটি বাজারভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। বলাবাহুল্য, বিশ্বায়নের প্রভাবে সমগ্র বিশ্ব একটি বাজারে রূপান্তরিত হয়েছে আর দেশীয় বাজারগুলি বিশ্ব বাজারের অংশে পরিণত হয়েছে।
[2] রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির বিপর্যয়: অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের ফলে রাষ্ট্র একটি বিশ্ব ব্যবস্থার অধীনে পরিণত হয়েছে। বিস্তৃত রাষ্ট্র নিজেই বিশ্বায়নের একটি বিশেষ মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। এই নীতি অনুসরণ করার জন্য সার্বভৌম রাষ্ট্র গুলির স্বাধীনভাবে অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বিশ্বায়নের কারণে রাষ্ট্রসমূহের অর্থনৈতিক নীতি পরস্পরের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ফলে এই প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দেশসমূহের ভূমিকা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। দেশগুলির পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার (IMF), বিশ্বব্যাংক (World Bank) এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO), এ ছাড়া বহুজাতিক সংস্থা ও আন্তঃমহাদেশীয় বাণিজ্য সংস্থা গড়ে উঠেছে, যেগুলি আর্থিক বিশ্বায়নের রূপায়ণে কলকাঠি নাড়াচ্ছে। সেখানে জাতীয় রাষ্ট্রসমূহের পরিচালকরা অসহায় ভূমিকা পালন করছে। বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের নেতৃবৃন্দ তাদের আর্থিক নীতি ও নির্দেশের উপর নির্ভরশীল হওয়ার ফলে স্বাধীন দেশসমূহের স্বাধীন আর্থিক নীতি বিপর্যয়গ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
[3] রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কর ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ: বিশ্বায়ন মুক্ত অর্থনীতির সমর্থক। সুতরাং, বিশ্বায়নের স্বার্থে রাষ্ট্রসমূহ অভ্যন্তরীণ কর ও শুল্ক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছে। দেশীয় শিল্প ও বাণিজ্য স্বার্থরক্ষার পরিবর্তে বিদেশি মূলধনের বিনিয়োগের স্বার্থে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা দূর করে বাজারের সচলতা দান করা দেশীয় সরকারের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (FDI Foreign Direct Investment)-এর জন্য সরকারগুলি তাদের দেশীয় বিনিয়োগের ক্ষেত্রসমূহ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এর ফলস্বরূপ জাতীয় সরকার তার সনাতন কর আরােপ ও বিলােপ করার ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বায়নের এজেন্ট হিসেবে ভূমিকা পালন করছে।
[4] মুক্ত বাণিজ্য নীতি: লগ্নিপুঁজির অবাধ বিচরণ ও তার লুণ্ঠনকে নিয়ন্ত্রণের অক্ষমতা জাতি-রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব অনেকখানি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। প্রতিটি রাষ্ট্র কোনােরূপ শর্ত আরােপ না করেই অবাধ বাণিজ্য নীতিটিকে কার্যকর করার জন্য এগিয়ে আসে। স্বাধীন আর্থিক নীতি গ্রহণের পরিবর্তে রাষ্ট্রগুলি আর্থিক ক্ষেত্রে কাঠামােগত সংস্কার, সরকারি ক্ষেত্রগুলির বেসরকারিকরণ, ভরতুকি প্রত্যাহার, কর্মীসংকোচন প্রভৃতি জনবিরােধী নীতিসমূহ গ্রহণে বাধ্য হচ্ছে।
[5] দেশীয় সংস্কৃতির সংকট: বিশ্বায়ন সর্বত্র অভিন্ন সংস্কৃতি গড়ে তুলতে অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে গেছে। এর জন্য বহুজাতিক সংস্থাগুলি তাদের প্রচারমাধ্যমকে দেশীয় বাজারে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করছে। এর ফলস্বরূপ বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রভাবে আজ রাষ্ট্রসমূহের নিজ সংস্কৃতি গভীর সংকটের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। পশ্চিমি ভােগবাদী সংস্কৃতি প্রচারকারী এইসকল প্রচারমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সরকারের থাকে না। কোন সরকার ওইসব প্রচার বন্ধে উদ্যোগী হলে ওই সরকারের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে এবং প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার অভিযােগ এনে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গৃহীত হবে।
[6] সার্বভৌমিকতার ধারণা অবসানের সম্ভাবনা: বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার বিরূপ প্রভাব রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার ধারণার উপর ব্যাপক প্রতিকূলতা সৃষ্টি করেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির ফলে বিশ্বের দূরতম প্রান্তে যােগাযােগ সুগম হয়েছে। এর ফলে বিভিন্ন দেশ সমূহের মধ্যে ভৌগােলিক দূরত্ব কমে গেছে। এই পরিবর্তনের ফলে চিরাচরিত সার্বভৌমিকতার অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক রূপ ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাই বিশ্বায়নের সমর্থকরা মনে করেছেন যে, বর্তমান সময়ে কোনাে দেশের অভ্যন্তরীণ নীতি আজ আর পররাষ্ট্রনীতি থেকে পৃথক নয়। এই দুটি দিকই পরস্পরের পরিপূরক। এর প্রভাবে রাষ্ট্রের প্রধান চরিত্র সার্বভৌমিকতার ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বায়নের প্রভাবে বর্তমান সময়ে কোনাে রাষ্ট্রের পক্ষেই আর চরম সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়ােগ করা সম্ভব নয়। এর ফলস্বরূপ সাবেকি সার্বভৌমিকতার ধারণার অবসানের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
[7] বহুজাতিক সংস্থার প্রভাব: বিশ্বায়নের ফলে বহুজাতিক সংস্থাগুলির অস্বাভাবিকভাবে সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলির নীতি নির্ধারণকারীরা অনেকসময় বাধ্য হয়েই এইসকল সংস্থার নির্দেশে তাদের জাতীয় ও পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করেন। নয়া সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি বহুজাতিক সংস্থার মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলির রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সচেষ্ট হয়। অধ্যাপক বার্নেট ও স্যার বলেছেন যে, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো উন্নত সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি সাম্রাজ্য লিসাকে চরিতার্থ করার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে।
[8] স্বাধীন নীতি গ্রহণে ব্যর্থ: বিশ্বায়নের যুগে একমেরুকেন্দ্রিকত প্রাধান্য লাভ করার ফলে মার্কিন প্রশাসনের নির্দেশ মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রকে কাঠামােগত পুনর্বিন্যাস সাধন করতে বাধ্য করা হয়েছে। পুনর্গঠনের মাধ্যমে ওইসব রাষ্ট্র শ্রমিকদের মজুরি হ্রাস, পেনশন না দেওয়া, সরকারি ব্যয় হ্রাস ও ভরতুকি প্রদান বন্ধ প্রভৃতি চরম জনবিরােধী নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। এই অবস্থায় জাতি-রাষ্ট্রসমূহের অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমিকতা বিপন্ন হয়ে পড়ে।
[9] সন্ত্রাস বিরোধী চুক্তির মাধ্যমে সার্বভৌমিকতার হস্তক্ষেপ: বর্তমানে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলি সন্ত্রাসবাদ প্রতিরােধের জন্য বিভিন্ন চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। সন্ত্রাসবাদের বিশ্বব্যাপী কার্যকলাপ প্রতিরােধের জন্য গৃহীত চুক্তির শর্তগুলি সকল রাষ্ট্র সার্বভৌমিকতা কে সংকুচিত করে।
উপসংহার: প্রকৃতপক্ষে বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে চরম ও অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন সার্বভৌম রাষ্ট্রের ধারণা আজ আর গ্রহণযােগ্য নয় বলে কেউ কেউ দাবি করেন। অধ্যাপক ডেভিড হেন্ডের মতে, রাষ্ট্রীয় আইন অব্যাহত আছে। তবে জটিল আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার ফলে রাষ্ট্রের নিজস্ব অধিকার বর্তমানে সীমিত হয়ে পড়েছে। পরিশেষে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, বিশ্বায়নের প্রভাবে রাষ্ট্রসমূহের সার্বভৌমিকতা বিপদের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে এ কথাটা কিছুটা সত্য হলেও আন্তর্জাতিক তার প্রয়ােজনে সার্বভৌমিকতা তার চরম রূপটি পরিত্যাগ করে সময়ের প্রয়োজনে গুরুত্ব দিয়েছে।
বিশ্বায়ন|Globalization|HS Polscience Questions And Answers| উচ্চমাধ্যমিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রশ্নোত্তর| আন্তৰ্জাতিক সম্পর্ক
Q. বিশ্বায়নের প্রভাবে ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কারসমূহ আলােচনা করাে।
Ans: ভূমিকা: ভারতে আধুনিক বিশ্বায়নের প্রভাব প্রথম পরিলক্ষিত হয় প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর আমলে। বিশ্বায়নের আরম্ভ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের আমলে। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে নরসিমহা রাওয়ের প্রধানমন্ত্রীত্বেই ভারতে তথাকথিত আর্থিক সংস্কার শুরু হয়। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে সরকার নতুন শিল্পনীতি ঘােষণা করার ফলে বিলগ্নিকরণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তার সঙ্গেই বিদেশি পুঁজির জন্য দরজা খুলে দেওয়া ও সরকারি সংস্থার বেসরকারিকরণ ও আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল জোর কদমে। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে বৈদেশিক আর্থিক সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী আর্থিক সংস্কারের ঐতিহাসিক বাজেট পেশ করা হয়। এই বাজেটে ১৯৯৮-১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রায় সব রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে সরকারি শেয়ার ২৬ শতাংশে কমিয়ে আনার ঘােষণা করা হয়। এই কারণেই ভারতে নব্বই-এর দশককে আর্থিক সংস্কারের দশক বলে অভিহিত করা হয়।
নেহরু মডেল: ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতে শুধু রাজনৈতিক জগৎ নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করে চলতেন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে নেহরু সরকার মিশ্র অর্থনীতির নীতি গ্রহণ করলেন। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত পঞ্চ-বার্ষিকী পরিকল্পনার সূচনা, ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ঘোষণা এইসব এককথায় নেহরু মডেল নামে পরিচিত।
নেহরুর মৃত্যুর পর ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে নেহরু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির আমলে একটু অন্যরকম ভাবনা শুরু হয়। তিনি নতুন শিল্পনীতি ঘােষণা করেন, কারণ তখন ভারতের আর্থিক চিত্র ছিল অত্যন্ত খারাপ। মুদ্রাস্ফীতি প্রায় রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও উৎপাদন ক্ষমতা মাত্র ৪ শতাংশ ছিল। ইন্দিরা গান্ধির পুত্র রাজীব গান্ধি নিজ উদ্যোগে কিছু সংস্কার কর্মসূচি বা উদারীকরণ শুরু করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ধনী ব্যক্তিদের কর হ্রাস, আমদানি নীতি সহজ করা, বিদেশি লগ্নিকারকদের সুবিধা দান, বেসরকারিকরণ প্রভৃতি। রাজীব গান্ধি সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থনৈতিক বিকাশের মতােই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাওয়ের আমলে বিশ্বায়ন বা উদারীকরণ বা আর্থিক সংস্কারের প্রকৃত সূচনা ঘটে। ন পআর্থিক সংস্কারের সূচনা: ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জুলাই ভারতে আর্থিক সংস্কারের ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরণীয় দিন বলে চিহ্নিত। ওই দিন চার দশকের নেহরু নীতি বর্জন করে নরসিমহা রাও সরকার তার বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অর্থমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং-কে দিয়ে নতুন শিল্পনীতি ঘােষণা করলেন এবং এই নতুন শিল্পনীতিতে অবাধ বাজার অর্থনীতি, সরকারি সংস্থার বেসরকারিকরণ এবং বিদেশি পুঁজির স্বেচ্ছাচারের সূচনা ঘটল। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে নরসিমহা রাও সরকারের আর্থিক সংস্কারের অন্যতম প্রধান একটি বিষয় ছিল কাঠামােগত সমঝােতার নীতি (Structural Adjustment Policy), যা পশ্চিমী অর্থনীতির মূল কথা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
আর্থিক সংস্কারের মূল নীতি: নরসিমহা রাও সরকার কতকগুলি বিশেষ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন-(১) ১৮টি বিশেষ শিল্প ছাড়া শিল্প সংক্রান্ত লাইসেন্স প্রথার অবলুপ্তি, (২) মেট্রোপলিটন এবং নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা আইনের অধীন প্রয়ােজনীয় বিধিনিষেধের অবসান, (৩) বিদেশি ব্যবসায়ীদের শেয়ার কেনার সীমা বৃদ্ধি করা, (৪) রাজনীতিবিদ ও আমলাদের প্রভাব ও চাপ মুক্ত করা।
২০০৩ খ্রিস্টাব্দে বিজেপি পরিচালিত পূর্বতন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর জোট সরকার পর্যন্ত এই আর্থিক সংস্কার নীতি অনুসরণ করে। বিজেপি ও জাতীয় মাের্চা মুখে স্বদেশিয়ানার কথা বললেও রাওয়ের থেকে জোর কদমে উপরোক্ত কর্মসূচি কার্যকরী করেছে এবং নতুন নতুন নীতি গ্রহণ করেছে। তবে বর্তমান সরকারের কাছে আর্থিক সংস্কার বলতে মূলত বিলগ্নিকরণকেই বােঝানাে হয়। এর ফলে সরকারি সংস্থাগুলি দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিদের কাছে সবকিছু বিক্রি করে দিচ্ছে। এর দরুন ভারত ভবিষ্যতে শিল্প-বাণিজ্যে স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারবে।
আর্থিক বিশ্বায়নের উন্মেষ: ভারতের নতুন আর্থিক সংস্কারের ফলে ভারতে আর্থিক বিশ্বায়ন ঘটে চলেছে। এ কারণে ভারত বর্তমানে নতুন বিশ্ব অর্থব্যবস্থার অন্যতম শরিক। সেই হিসেবে ভারত বিশ্ব পরিবার বা বিশ্ব গ্রামের সদস্য হিসেবে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করে। আর্থিক সংস্কার সূচির পরিকল্পনা অনুসারে ভারত GATT চুক্তির মতাে বিভিন্ন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। বর্তমান মোদি সরকারের Demonetization, GST, সুদের পরিমাণ হ্রাস, ব্যাংক বিল প্রভৃতি রাষ্ট্রীয় বৈষয়িক উদারীকরণ বা সংস্কারের আরও কয়েকটি সাম্প্রতিক নিদর্শন হল মাত্র ছয়টি শিল্পক্ষেত্র ছাড়া সব শিল্পে নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া। এই ছয়টি ক্ষেত্র হল মদ, তামাক, প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি, শিল্পে ব্যবহৃত বিস্ফোরক, বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক, ওষুধ ও মদের উপকরণ প্রভৃতি।
এ ছাড়া মাত্র চারটি ক্ষেত্রকে রাষ্ট্রের মধ্যে রেখে সব উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এগুলি হল অস্ত্র, গােলা-বারুদ, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, প্রতিরক্ষা বিমান, যুদ্ধজাহাজ, পারমাণবিক শক্তি, ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মার্চ ভারত সরকারের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী বিষয়গুলি এবং রেলপথ পরিবহণ।
নতুন শিল্পনীতি বা আর্থিক সংস্কারের ফলাফল: ভারত হল জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র। এই কারণে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ এবং রাষ্ট্রীয় পরিসেবা ভারতের শুধু সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি নয়, ভারতের সমাজ ও রাজনীতির সঙ্গেও ওতপ্রােতভাবে জড়িত। বেসরকারিকরণ এই উদ্যোগ অতি উৎসাহী পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে।
You must be logged in to post a comment.