রাজনীতির বিবর্তন—শাসনতান্ত্রিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক ধারণা
একাদশ শ্রেনীর ইতিহাস – দ্বিতীয় অধ্যায়
প্রাচীন গ্রিসে পলিসের উত্থানের ধারাবাহিক পর্যায়গুলি কী কী।
ডােরিয়ান বিজয়ের (আনুমানিক ১০০০ খ্রিস্টপূর্ব) পরবর্তীকালে গ্রিকরা ক্ষুদ্র ও স্বাধীন নগর রাষ্ট্রগুলি গড়ে তুলতে শুরু করেছিল। ইতিহাসবিদ ফিনলে মনে করেন যে, এই নগর- রাষ্ট্রগুলির প্রতিষ্ঠায় গ্রিকদের উদ্যোগের পশ্চাতে তাদের অনমনীয় স্বভাব কার্যকারী ছিল। গ্রিসের বিভিন্ন অঞ্চলে পলিস গঠনের ধারাবাহিক বিভিন্ন পর্যায় লক্ষ করা যায়। যেমন一
[1] শক্তিমান রাজা ও রাজ্যের অবলুপ্তি: ডােরিয়ান বিজয়ের পর থেকে গ্রিসে শক্তিমান রাজা ও বৃহৎ রাজ্যের অস্তিত্ব লুপ্ত হতে থাকে। এই সময় আগামেমনন বা ইভােমিনিয়ান্স এর মতাে বৃহৎ রাজার সন্ধান আর পাওয়া যায় না। একদা ক্লীট দ্বীপে যেখানে ইভােমিনিয়ান্স ছিলেন একমাত্র রাজা সেখানে পরবর্তীকালে পঞ্চাশটিরও বেশি স্বাধীন ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের উত্থান ঘটে। গ্রিসের আয়ােনিয়া, ইজিয়ান সাগরের বিভিন্ন দ্বীপ, পেলােপনেসাস ও মধ্য গ্রিসের বৃহদংশ, দক্ষিণ ইটালি, সিসিলি প্রভৃতি অঞ্চলগুলিতেও অসংখ্য ক্ষুদ্র, স্বাশাসিত ও স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে উঠতে থাকে।
[2] পলিসের প্রাথমিক পর্যায়: খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে সপ্তম শতকের মধ্যে গ্রিসের পলিসগুলি তাদের প্রাথমিক রূপ লাভ করতে শুরু করেছিল। স্বাধীন এই পলিসগুলিতে লােকসংখ্যা ছিল খুবই কম, মাত্র কয়েক হাজার। তখনও পরিণত পলিসের রাজনৈতিক কাঠামাে গড়ে ওঠেনি। পলিসের প্রাথমিক পর্যায়ে গ্রিসের প্রতিবেশী কোনাে কোনাে অঞ্চলে বৃহৎ রাষ্ট্রের অস্তিত্বও ছিল।
[3] পলিসের চূড়ান্ত পর্যায়: প্রিসের ইতিহাসের ধ্রুপদী যুগে (খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম থেকে চতুর্থ শতক) সেখানকার পলিস-গুলি পূর্ণরূপ লাভ করেছিল। গ্রিকরা যখন পূর্ব ও পশ্চিমে নিজেদের সম্প্রসারণের কাজ সম্পূর্ণ করতে পেরেছিল তখন গ্রিসে নগর- রাষ্ট্রের সংখ্যা দাঁড়াল প্রায় ১৫০০। এগুলির মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযােগ্য ছিল এথেন্স ও স্পার্টা।
প্রাচীন গ্রিসে ‘পলিস’ বা ‘নগর-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করাে।
গ্রিসে নগর রাষ্ট্রগুলি গড়ে-ওঠার পিছনে কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল বলে মনে করা হয়। এগুলি হল一
[1] গ্রিকদের মানসিকতা: প্রাচীন কালে গ্রিসের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগর-রাষ্ট্র বা পলিস গড়ে-ওঠার ক্ষেত্রে গ্রিকদের মানসিকতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। রাজনৈতিক কাজে নাগরিকদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সুযােগবিশিষ্ট পলিসের এই ক্ষুদ্রত্বকে গ্রিকরা তাদের রাষ্ট্রের অন্যতম গুণ বলে মনে করত। তারা, সমকালীন পারস্যের মতাে বৃহদাকার রাষ্ট্রকে একমাত্র বর্বরদের বসবাসযােগ্য বলে মনে করত।
[2] ডেরিয়ান বিজয়ের প্রভাব: ডােরিয়ান বিজয়ের পরবর্তীকালে গ্রিসের উপত্যকা ও দ্বীপের বাসিন্দাদের আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে স্থানীয় পাহাড়ের চূড়ায় একটি শক্তিশালী কেন্দ্র নির্মিত হত, যা অক্টোপলিস নামে পরিচিত ছিল। এই স্থান ক্ৰমে শাসকের বাসস্থান, জনগণের মিলনকেন্দ্র এবং ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ নগরে পরিণত হয় এবং এখান থেকে সংলগ্ন অঞ্চল শাসিত হতে থাকে।
[3] বাজার প্রতিষ্ঠা: প্রাচীন গ্রিসে উৎপাদনকারীরা একদা নিজেদের প্রয়ােজনের অতিরিক্ত সামগ্রী তারা বিক্রির জন্য উৎপাদন করতে থাকে। ফলে পণ্য কেনাবেচার কেন্দ্র হিসেবে বাজার গড়ে ওঠে। এর ফলে পলিসগুলির স্থানীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়।
[4] সামাজিক মনোভাব: প্রাচীন গ্রিকরা তাদের বাসস্থানের বাইরে সামাজিক বা রাজনৈতিক অনুষ্ঠান পছন্দ করত। তারা গ্রাম বা শহরে তাদের বাড়ি থেকে হেঁটে কর্মস্থলে যেতে চাইত এবং স্থানীয় খােলা স্থানে বা বাজারে তাদের অবসর সময় কাটাতে পছন্দ করত। ফলে পণ্য ক্রয়বিক্রয়ের বাজারগুলি ক্ৰমে বাজার-নগরে পরিণত হয় বা গ্রিকদের গােষ্ঠীজীবনের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে।
[5] অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা: বাজার নগর গুলি গড়ে উঠলেও গ্রিসের ভৌগােলিক বিচ্ছিন্নতার ফলে সেখানে পণ্য চলাচল ব্যাহত হয়েছিল। তা ছাড়া গ্রিকদের যে স্বল্প পরিমাণ পণ্যসামগ্রীর প্রয়ােজন হত তা স্থানীয় অঞ্চলেই উৎপাদিত হত। এজন্য বাজারগুলি কখনও বৃহৎ নগরীতে পরিণত হতে পারেনি। ফলে বৃহৎ এলাকায় পারস্পরিক নির্ভরতার পরিবর্তে স্থানীয় অঞ্চলেই তাদের অর্থনীতি আবর্তিত হত।
পলিসে বসবাসকারী বাসিন্দাদের নাগরিক অধিকার আলােচনা করাে।
গ্রিক পলিসপুলিতে বসবাসকারী নাগরিক, বিদেশি, ক্রীতদাস ও মহিলাদের নাগরিক অধিকারের যথেষ্ট তারতম্য ছিল।
[1] নাগরিক: পলিসের বেশিরভাগ নাগরিক ছিল স্বাধীন কৃষক, কারুশিল্পী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। নাগরিকরা বহু প্রত্যক্ষ সুযােগসুবিধা ভােগ করত। গ্রিক পলিসগুলির রাষ্ট্রীয় চরিত্রভেদে বিভিন্ন পলিসের নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকারেও তারতম্য ছিল।
[i] গণতান্ত্রিক পলিসপুলিতে মােটামুটিভাবে সকল নাগরিকের সমান রাজনৈতিক অধিকার ও রাজনৈতিক পদ লাভের সমান সুযােগ ছিল। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দুর্বল নাগরিকদের রক্ষার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হত।
[ii] অভিজাত তান্ত্রিক পলিসগুলিতে নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকারে বৈষম্য ছিল। সেখানে একমাত্র ধনীরাই অশ্বারােহী এবং ভারী অস্ত্রসজ্জিত পদাতিক বাহিনীতে যােগ দিতে পারত।
[2] বিদেশি: এথেন্স-সহ বিভিন্ন পলিসে অসংখ্য বিদেশি বসবাস করত এবং তারা সেখানে সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করেছিল। তারা মেটিক নামে পরিচিত ছিল। তবে বিদেশিরা সেখানকার নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। এই বিদেশিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কোনাে ব্যবস্থাও সেখানে ছিল না। স্পার্টায় বিদেশিদের প্রবেশাধিকারই ছিল না।
[3] ক্রীতদাস ও মহিলা: বিদেশি ছাড়াও বিভিন্ন গ্রিক পলিসে অসংখ্য ক্রীতদাস ও মহিলা বসবাস করত যারা নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত ছিল না। ক্রীতদাসরা এথেন্সে থিটিস এবং স্পার্টায় হেলট নামে পরিচিত ছিল। স্বাভাবিকভাবেই তাদেরও নাগরিক অধিকার ছিল না। ধনীরা ক্রীতদাসদের নিজেদের বিভিন্ন কাজে নিয়ােগ করতে, ভাড়া খাটাতে, বিক্রি করতে, এমনকি হত্যাও করতে পারত।
গ্রিক পলিস বা নগর-রাষ্ট্রের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করাে।
বাংলা নগর রাষ্ট্র বা ইংরেজি ‘City-state’ শব্দের গ্রিক প্রতিশব্দ হল পলিস যার অর্থ হল ‘স্বশাসিত রাষ্ট্র’। প্রাচীন কালে। গ্রিস, এশিয়া মাইনর, ইজিয়ান সাগরের দ্বীপসমূহ প্রভৃতি অঞ্চলে জনসংখ্যায় ও আয়তনে ক্ষুদ্র অসংখ্য নগর রাষ্ট্র বা পলিসের অস্তিত্ব ছিল।
[1] রাষ্ট্রের আয়তন ও জনসংখ্যা: গ্রিক পলিসগুলি আয়তনে ও লােকসংখ্যায় ক্ষুদ্র হত। ‘রিপাবলিক‘ গ্রন্থে প্লেটো বলেছেন যে, একটি আদর্শ পলিসের লােকসংখ্যা হওয়া উচিত ৫০০০। অ্যারিস্টটল বলেছেন যে, ১০ জন নাগরিক নিয়ে গঠিত পলিস যেমন স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে না, তেমনি ১ লক্ষ নাগরিক নিয়ে গঠিত পলিস সুদক্ষ শাসন পরিচালনা করতে পারবে না।
[2] রাজার অনুপস্থিতি: অধিকাংশ পলিসেই রাজতন্ত্র অনুপস্থিত ছিল। পলিসগুলি অভিজাততান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক এইরূপ বিভিন্ন ধরনের হত। অবশ্য স্পার্টায় বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র থাকলেও নির্দিষ্ট অভিজাতদের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা চলে গিয়েছিল।
[3] নাগরিক ও বিদেশিদের অবস্থান: প্রতিটি পলিসে নাগরিক ছাড়াও বহু বিদেশি বসবাস করত। তাদের নাগরিক অধিকার ছিল না, তবে সেখানে বসবাসের বিষয়ে তারা সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছিল। এথেন্সের শাসক পেরিক্লিস বলেছেন যে, “আমরা বিদেশিদের কোনো শিক্ষা বা দৃশ্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখি না।”
[4] প্রশাসনে জনগণের অংশগ্রহণ: গ্রিক পলিসগুলিতে নাগরিকরা শাসন পরিচালনায় প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিতে পারত। অ্যারিস্টটল তাঁর ‘পলিটিকস্’ গ্রন্থে বলেছেন যে, পলিসের আয়তন এমন ক্ষুদ্র হওয়া উচিত যাতে সেখানকার প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে প্রত্যক্ষ পরিচয় থাকে।
[5] স্বতন্ত্র: গ্রিসের প্রতিটি পলিস একে অপরের থেকে স্বতন্ত্র ছিল। প্রতিটি পলিসের নিজস্ব সরকার, সেনাবাহিনী, ক্যালেন্ডার থাকত। পলিসগুলির প্রতিটির পৃথক মুদ্রাব্যবস্থা এবং মানচিত্র ছিল বলেও অনুমান করা হয়। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে পলিসগুলির পূজাপদ্ধতিও পৃথক হত।
[6] নগর ও গ্রামের সমন্বয়: গ্রিক নগর রাষ্ট্র বলতে শুধু রাষ্ট্র জুড়ে নগরের অবস্থান বা নগর কর্তৃক গ্রাম শাসনকে বােঝায় না। প্রাচীন গ্রিসে যেমন এথেন্সের মতাে উন্নত নগর-রাষ্ট্র ছিল তেমনি অনেক নগর-রাষ্ট্র ছিল, যা আদৌ নগর ছিল না।
[7] অর্থনৈতিক বৈষম্য: গ্রিসের বিভিন্ন নগর-রাষ্ট্রের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল। যেমন, একদিকে করিন্থ ও মিলেটাসের মানুষ শিল্প ও বাণিজ্যের দ্বারা তাদের জীবিকা নির্বাহ করত, অন্যদিকে স্পার্টা, এলিস ও আরকাডিয়ার মানুষ কৃষি, যুদ্ধকর ও মন্দিরের আয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল।
পলিসগুলির পতনের বিভিন্ন কারণগুলি উল্লেখ করাে।
পলিসপুলি খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে পারস্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারলেও খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে ম্যাসিডনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। ফলে এই শতকে পলিসপুলির পতন ঘটে। পলিসগুলির পতনের বিভিন্ন কারণ ছিল—
[1] সেনাপতিদের দায়িত্ব: খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে অর্থনৈতিক দুর্বলতার ফলে এথেন্সের মতাে বৃহৎ পলিসও তার সেনাপতিদের সম্পূর্ণ আর্থিক দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছিল। তাই পেশাদার সেনাপতিরা অর্থনৈতিক প্রয়ােজনেই নিজেদের পলিসের পাশাপাশি বিদেশি শক্তিরও সেবা করতে বাধ্য হত। সেনাপতিদের এই দ্বিধাবিভক্ত দায়িত্বের ফলে আর সুযােগ্য সেনাপতি তৈরি হয়নি।
[2] নৌবছরের দুর্বলতা: অর্থনৈতিক দুর্বলতার প্রভাবে পলিসের নৌবহরের দুর্বলতাও প্রকট হয়ে পড়েছিল। এথেন্সের নৌবহরের আর্থিক দায়িত্ব যে ১২০০ ধনী পরিবার পালন করত তারা ক্রমে এই দায়িত্ব থেকে সরে যেতে চাইছিল। আর্থিক দুর্বলতার কারণে স্বেচ্ছায় নাবিকের পেশায় আশা যুবকের সংখ্যা কমে আসছিল।
[3] সামরিক ত্রুটি: গ্রিসের অধিকাংশ সৈন্য ছিল অপেশাদার ও কৃষক। তাই কৃষিকাজে যুক্ত হওয়ার জন্য তারা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চাইত না। তা ছাড়া গ্রিসের সৈনিকরা ঢাল, তরােয়াল নিয়ে যুদ্ধে দক্ষ হলেও বিপৎসংকুল পার্বত্য অঞ্চলের যুদ্ধে তারা দক্ষতা দেখাতে পারেনি। আবার স্থলযুদ্ধে স্পার্টার শ্রেষ্ঠত্বের ফলে তাদের সীমাহীন আত্মতৃপ্তি তাদের ক্ষতি করেছিল।
[4] ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী মানসিকতা: খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের গ্রিক সাহিত্য, শিল্পকলা প্রভৃতিতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের অত্যধিক প্রকাশ লক্ষ করা যায়। পলিসের আদর্শ বা সর্বজনীন বিষয়ের চেয়ে পলিসবাসী নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থকেই বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করে। ডায়ােজিনিসের “আমি একজন বিশ্বনাগরিক” উক্তি থেকে প্রমাণ হয় যে, তার কাছে ব্যক্তিই ছিল মুখ্য, সমাজ গৌণ।
[5] সংঘর্ষ: গ্রিসে বাণিজ্যের উন্নতি ঘটলে বিভিন্ন পলিসের মধ্যে বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। এর পরিণতিতে বিভিন্ন পলিসের মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে যা পলিসগুলির শক্তি ও ঐক্য ধ্বংস করে।
[6] ম্যাসিডনের সামরিক দক্ষতা: পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ম্যাসিডন সামরিক শক্তিতে যে দক্ষতা দেখিয়েছিল গ্রিক পলিসগুলি তা পারেনি। ম্যাসিডনের শাসক দ্বিতীয় ফিলিপ যে বাহিনী নিয়ে গ্রিস আক্রমণ করে তা ছিল সুদক্ষ এবং নতুন যুদ্ধকৌশলে অভিজ্ঞ। গ্রিক পলিসগুলির সামরিক দক্ষতা যুগােপযােগী না হওয়ায় তারা ম্যাসিডনের সুদক্ষ বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়।
এথেন্সে গণতন্ত্রের ভিত্তি কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়?
গ্রিসে নগর রাষ্ট্রগুলিতে কোথাও গণতন্ত্র বা কোথাও অভিজাততন্ত্র। প্রতিষ্ঠিত হয়। গণতন্ত্রের পীঠস্থান ছিল এথেন্স। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে এথেন্সে গণতন্ত্রের ভিত্তি রচিত হয়েছিল।
[1] সেলিনের সংস্কার : গণতান্ত্রিক এথেন্সে প্রথম রাষ্ট্রপতি সােলন ম্যাজিস্ট্রেট আইন বা স্থানীয় শাসন সংস্কারের দ্বারা এথেনীয় গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করেন। তিনিই প্রথম বংশকৌলিন্যের বদলে সম্পদের ভিত্তিতে এথেন্সের নাগরিকদের চারটি গােষ্ঠীতে (ট্রাইব) ভাগ করেন। এ ছাড়াও তিনি হেলাইয়া নামে এক গণ- আদালত গড়ে তােলেন। এখানে সাধারণ মানুষ আর্কনদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার অধিকারী ছিলেন।
[2] ক্লিসথিনীস সংস্কার : সােলনের পরবর্তীকালে ক্লিসথিনীস। গােষ্ঠীভিত্তিক বিভাজনের পরিবর্তে গ্রাম (ডেমি) ভিত্তিক দশটি অঞ্চল গড়ে তােলেন। এগুলি হয়ে ওঠে স্থানীয় শাসনব্যবস্থার এক একটি একক। তিনি জন্মকৌলিন্য বা সম্পদভিত্তিক গােষ্ঠীর বদলে বাসস্থানভিত্তিক সংগঠন গড়ে তােলেন।
[3] এফিয়ালটিসের সংস্কার : এফিয়ালটিস এথেন্সে গণতন্ত্রে কিছু পরিবর্তন আনেন। তিনি আইন করে এরিওপেগাস কাউন্সিলের সমস্ত ক্ষমতা কেড়ে নেন এবং তা গণ-পরিষদ, কাউন্সিল ও গণ-আদালতের মধ্যে ভাগ করে দেন। এছাড়াও তিনি আর্কানদের রায়ের বিরুদ্ধে একলসিয়াস আপিল অধিকার দেন।
[4] পেরিক্লিসের সংস্কার: পেরিক্লিস লটারির মধ্য দিয়ে সমস্ত নাগরিককে শাসনকাজে অংশগ্রহণে সুযােগ দেন। এ ছাড়াও আর্কন পদের অধিকারীকে রাষ্ট্রের বেতনভুক কমীতে পরিণত করেন। তিনি নাগরিকদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষে এথেনীয় পিতামাতার সন্তানদেরই নাগরিক হওয়ার অধিকার দান করেন।
[5] লটারির মাধ্যমে নির্বাচন: এথেন্সে লটারির মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে থেকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শাসন কর্তাদের নির্বাচিত করা হত। এর ফলে সাধারণ শ্রেণির প্রতিনিধিদের অনেকেই রাষ্ট্র পরিচালনার সুযােগ পেত। এভাবেই দরিদ্ররাও পরিষদে এবং জুরি আদালতে বসার অধিকার পেয়েছিল।
[6] গণবিতর্ক: এথেন্সে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছিল গণবিতর্ক ব্যবস্থা। রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে একলেসিয়ার অধিবেশনে বিতর্ক হত। কোনাে একটি প্রস্তাব উঠলে তার পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্কের পর তা নির্বাচিত হত পরে উপস্থিত নাগরিকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটের দ্বারা।
[7] জনগণের শাসন: গ্রিক শব্দ ডেমস’ ও ‘ক্রাটাসে’ থেকেই ইংরেজি ডেমােক্রেসি’ শব্দটি এসেছে। ‘ডেমস’ হল কোনাে একটি পলিসের সমস্ত নাগরিক সংখ্যা আর ‘ক্রাটাস’ হল শাসক। এই বিচারে এথেনীয় গণতন্ত্র ছিল জনগণের শাসক। শুধুমাত্র আক্ষরিক অর্থে নয় প্রকৃত অর্থেই এথেন্সে শাসনব্যবস্থা ছিল গণতান্ত্রিক। এই শাসনব্যবস্থায় দরিদ্র জনগণের একটা বড়াে অংশ যুক্ত হওয়ার ফলে গণতন্ত্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বলা চলে।
আরও দেখুন : আদিম মানিব থেকে প্রারম্ভিক সভ্যতা সমূহ
গ্রিক পলিসের রাজনৈতিক গঠন সম্পর্কে আলােচনা করাে।
গ্রিক পলিসগুলির রাজনৈতিক সংগঠন বা শাসন কাঠামাের প্রধান তিনটি অংশ ছিল। যথা- [1] সমিতি, [2] পরিষদ এবং [3] ম্যাজিস্ট্রেট। এথেন্স গণতান্ত্রিক এবং স্পার্টা অভিজাততান্ত্রিক শাসন কাঠামাের আদর্শ পলিস ছিল। এথেন্সের শাসনকাঠামােতে সমিতি, পরিষদ এবং ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়াও হেলাইয়া বা জুরি আদালতের অস্তিত্ব ছিল, যা অন্যান্য পলিসে ছিল না।
[1] সমিতি বা একলেজিয়া : এথেন্সের সমিতির নাম ছিল একলেজিয়া এবং স্পারটায় অ্যাপেলা। প্রথম পর্বে একলেজিয়ার অস্তিত্ব ও ক্ষমতা খুব বেশি ছিল না। পরবর্তীকালে নানান বিবর্তনের মধ্য দিয়ে একলেজিয়া শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। সেই সময় এথেন্সের থিটিস (এথেন্সের ক্রীতদাস)-রা ছাড়া অন্য সকলেই একলেজিয়ার সদস্য হতে পারত।
[2] ভােটাধিকার : প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে গঠিত সমিতির সিদ্ধান্ত অনুসারে পলিসের রাজনৈতিক চরিত্র নির্ধারিত হত। [i] গণতন্ত্রে প্রাপ্তবয়স্ক সকল স্বাধীন নাগরিক ভােটাধিকার প্রয়ােগ করতে পারত। এথেন্সে অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভােট না দিলেও সকল নাগরিকের সেই অধিকার ছিল এবং কখনাে কখনাে তারা তা প্রয়ােগ করত। [ii] অভিজাততন্ত্রে সকলের ভােটাধিকার ছিল না। নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পত্তির মালিকরা সেখানে ভােটদানের অধিকার ভােগ করত।
[3] পরিষদ: সােলনের শাসনের পূর্ব পর্যন্ত এথেন্সে একটিমাত্র পরিষদ ছিল যার নাম ছিল এ্যারিওপাগাসের কাউন্সিল। সােলন এই কাউন্সিলের ক্ষমতা কমিয়ে চারশো জনের পরিষদ এবং পরে ক্লেইসথেনেস পাঁচশাে জনের পরিষদ গঠন করেন। অভিজাততন্ত্রে পরিষদের আয়তন হত ক্ষুদ্র। এখানে সদস্যরা নির্বাচনের পরিবর্তে মনােনীত হতেন। সাধারণভাবে অভিজাততন্ত্রে সমিতির তুলনায় পরিষদের গুরুত্ব বেশি থাকলেও স্পার্টা ছিল এর ব্যতিক্রম। স্পার্টার পরিষদের নাম ছিল গেরুসিয়া। এটি বিচারালয় হিসেবেও কাজ করত।
[4] ম্যাজিস্ট্রেট: পলিসে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ বা রাজার ক্ষমতা লুপ্ত হওয়ার পর ম্যাজিস্ট্রেট পদের সৃষ্টি হয়। এথেন্সের শাসনব্যবস্থায় উচ্চবিত্ত ম্যাজিস্ট্রেটরা নিযুক্ত হত। তাদের বলা হত আরকন। স্পার্টার ম্যাজিস্ট্রেটরা ইফর নামে পরিচিত ছিল। তবে ইফরগণ রাজার বিকল্প নয়, রাজার পাশাপাশি কার্য পরিচালনা করত। তারা পরিষদের সভায় যােগ দিতে পারত এবং সমিতির (অ্যাপেলা) সভা পরিচালনা করত।
গ্রিক পলিসের ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে আলােচনা করাে।
ধর্মীয় ক্ষেত্রেও গ্রিক পলিসগুলি এক একটি পৃথক একক হিসেবে গড়ে উঠেছিল। পলিসের ধারণার সঙ্গে ধর্ম-ভাবনা যে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিল তার উল্লেখ সক্রেটিস, প্লেটো ও অ্যারিস্টোফানেসের রচনা থেকে জানা যায়।
[1] বিভিন্ন দেবদেবী : প্রিক পলিসে বহু দেবতার আরাধনার প্রচলন ছিল। বিভিন্ন পলিসের দেবদেবীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জিউস, পসিডন, হ্যাডেস, অ্যাপােলাে, আরটিসিস, এথেনা, হারমিস, ডিমিটার, হেরা প্রমুখ। বিভিন্ন দেবতা বিভিন্ন ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণ করতেন| যেমন— জিউস ছিলেন আকাশের দেবতা, পসিডন ছিলেন সাগর ও ভূমিকম্পের দেবতা, হ্যাডেস ছিলেন পরলােকের দেবতা। জিউস ছিলেন দেবতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।
[2] পলিসের সঙ্গে সংযোগ: গ্রিসের দেবদেবীরা পলিসের উন্নতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল বলে গ্রিকরা বিশ্বাস করত। দেবদেবীগণ পলিসের নিয়মশৃঙ্খলার ধারক ও বাহক বলে পরিচিত ছিলেন। পলিসপগুলিতে সারাবছর ধরে দেবতাদের উদ্দেশ্যে নানা ধরনের উৎসব, অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করা হত।
[3] দেবতার আরাধনা : গ্রিসের বিভিন্ন পলিসে যেমন পৃথক পৃথক দেবদেবীর পূজার প্রচলন ছিল, তেমনি একই দেবতা বা দেবী একাধিক পলিসেও পূজিত হতেন। যেমন, দেবী এথেনা এথেন্স এবং স্পার্টা উভয় পলিসেই পূজিতা হতেন। কিন্তু উভয় পলিসে তার গুরুত্বে পার্থক্য ছিল। এথেন্সে দেবী এথেনার অত্যধিক গুরুত্ব ছিল এবং সেখানে এথেনাকে নগরের অভিভাবিকা হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু স্পার্টায় এথেনার এই গুরুত্ব ছিল না। ভিন্ন ভিন্ন পলিসে ভিন্ন ভিন্ন পূজাপদ্ধতি ও পৃথক ধর্মীয় অনুষ্ঠানেরও প্রচলন ছিল।
[4] দ্বৈত সত্তা: প্রাচীন গ্রিসের দেবদেবীদের দ্বৈত সত্তার অস্তিত্ব ছিল। দেবদেবীগণ একদিকে যেমন নির্দিষ্ট কোনাে পলিসের দেবতা ছিলেন অন্যদিকে তারা আবার সমগ্র গ্রিক জাতিরও দেবতা ছিলেন।
[5] পরলােকচিন্তা: গ্রিকরা বিশ্বাস করত যে, মানুষের মৃত্যুর পর আত্মা ইহলােকে ঘুরে বেড়ায়। যথাযথ ধর্মীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর সেই আত্মা ইহলােক থেকে পরলােকে পৌঁছােয়। প্রাচীন গ্রিক মতে, পরলােক নিয়ন্ত্রিত হয় দেবতা হ্যাডেসের দ্বারা।
[6] ধর্মীয় সৌধ ও গ্রন্থ : গ্রিকরা স্থানীয়ভাবে পলিসের বিভিন্ন স্থানে পূণ্যভূমি ও স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করত। এই ধর্মীয় সৌধগুলি বিভিন্ন দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হত। হেসিয়ডের ‘থিওগনী’ এবং ওয়ার্কস এন্ড ডেজ’, হােমারের ‘ইলিয়াড’ এবং ‘ওডিসি’, পিন্ডারের ‘ওডেস’ ছিল গ্রিকদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ।
ষােড়শ মহাজনপদের বিভিন্ন রাজ্যগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
বৌদ্ধগ্রন্থ ‘অঙ্গুত্তরনিকায়’, জৈনগ্রন্থ ‘ভগবতীসূত্র’, হিন্দু পুরাণ প্রভৃতি থেকে জানা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে উত্তর ভারতে কোনাে ঐক্যবদ্ধ কেন্দ্রীয় শক্তির অস্তিত্ব ছিল না। উক্ত সাহিত্যিক উপাদানগুলি থেকে এই সময় উত্তর ভারতে ষােলােটি ছােটো ছােটো রাজ্যের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। এই ষােলােটি ক্ষুদ্র রাজ্যকে একত্রে ষােড়শ মহাজনপদ বলা হয়। ষােড়শ মহাজনপদের মধ্যে উত্তর ভারতে পনেরোটি এবং দক্ষিণ ভারতে একটি রাজ্যের উত্থান ঘটেছিল।
ষােড়শ মহাজনপদের বিভিন্ন রাজ্য
ষােড়শ মহাজনপদের রাজ্যগুলির অবস্থান ছিল আফগানিস্তানের কাবুল থেকে দক্ষিণ ভারতে গােদাবরী নদীর উপকূলের মধ্যবর্তী অঞ্চলে। রাজ্যগুলি হল一
[1] কাশী: এর অবস্থান ছিল বর্তমান উত্তরপ্রদেশের পূর্বদিক।
[2] কোশল: এর অবস্থান ছিল বর্তমান অযােধ্যা বা শ্রাবস্তী।
[3] অঙ্গ: এর অবস্থান ছিল বর্তমান পূর্ব বিহার। এই রাজ্যের রাজধানী ছিল চম্পা।
[4] মগধ: মগধের অবস্থান ছিল বর্তমান বিহারের গয়া ও পাটনা জেলা। এর প্রথম রাজধানী ছিল গিরিব্রজ বা রাজগৃহ। পরে পাটলিপুত্রে রাজধানী স্থানান্তরিত হয়।
[5] অবন্তী: এর অবস্থান ছিল বর্তমান মালব ও মধ্যপ্রদেশের কিছু অংশে। এর উত্তরাংশের রাজধানী ছিল উজ্জয়িনী ও দক্ষিণাংশের রাজধানী ছিল মাহিস্মতি।
[6] বৎস: এর অবস্থান ছিল বর্তমান এলাহাবাদের নিকটবর্তী গঙ্গার দক্ষিণ তীরে। এর রাজধানী ছিল কৌশাম্বী।
[7] বৃজি: এর অবস্থান ছিল বর্তমান উত্তর বিহারে। এর রাজধানী ছিল বৈশালী।
[8] মল্ল: এর অবস্থান ছিল বর্তমান উত্তরপ্রদেশের গােরক্ষপুর জেলা। এর রাজধানী ছিল কুশীনগর বা পাবা।
[9] কুরু: এর অবস্থান ছিল বর্তমান দিল্লি ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল। এর রাজধানী ছিল ইন্দ্রপ্রস্থ।
[10] পাঞ্চাল: এর অবস্থান ছিল বর্তমান রােহিলখণ্ড। উত্তর পালের রাজধানী ছিল অহিচ্ছত্র এবং দক্ষিণ পাঞ্চালের রাজধানী ছিল কাম্পিল্য।
[11] চেদি: এর অবস্থান ছিল বর্তমান বুন্দেলখন্ড ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল। এর রাজধানী ছিল শুকতিমতী।
[12] মৎস্য: এর অবস্থান ছিল বর্তমান রাজপুতানার জয়পুর। এর রাজধানী ছিল বিরাটনগর।
[13] শূরসেন: এর অবস্থান ছিল যমুনা নদীর তীরে মথুরা অঞ্চল। এর রাজধানী ছিল মথুরা।
[14] অম্মক: এর অবস্থান ছিল বর্তমান গােদাবরীর উপত্যকা অঞ্চল বা পাটলি। এর রাজধানী ছিল পােটালি বা পােটান।
[15] গান্ধার: এর অবস্থান ছিল বর্তমান রাওয়ালপিন্ডি ও কাশ্মীর উপত্যকা। এর রাজধানী ছিল তক্ষশিলা৷
[16] কম্বোজ: এর অবস্থান ছিল বর্তমান দক্ষিণ-পশ্চিম কাশ্মীর। এর রাজধানী ছিল রাজপুর।
মগধের উত্থানের প্রধান কারণগুলি কী ছিল?
প্রথমদিকে ষােড়শ মহাজনপদের রাজ্যগুলির মধ্যে অবন্তী, বৎস, কোশল এবং মগধ-এই চারটি রাজ্য প্রাধান্য লাভ করেছিল। অবশেষে হর্ষঙ্ক, শৈশুনাগ, নন্দ ও মৌর্য—এই চারটি রাজবংশের আমলে মগধকে কেন্দ্র করে উত্তর ভারতে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।
[1] সুযোগ্য নেতৃত্ব : হর্ষঙ্ক বংশের বিম্বিসার, অজাতশত্রু, শৈশুনাগ বংশের শিশুনাগ, নন্দ বংশের মহাপদ্মনন্দ, মৌর্য বংশের চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, অশােক প্রমুখ রাজন্যবর্গের দক্ষ নেতৃত্বে মগধের সাম্রাজ্যবাদ সফলভাবে পরিচালিত হয়েছিল। মগধের বাসসাকর, কৌটিল্য, রাধাগুপ্ত প্রমুখ মন্ত্রীবর্গের সুযােগ্য পরামর্শও এবিষয়ে যথেষ্ট সহায়তা করেছিল।
[2] বিদেশি আক্রমণ থেকে রক্ষা : মগধের অবস্থান ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের উপদ্রুত অঞ্চল থেকে অনেক দূরে হওয়ায় বিদেশি আক্রমণকারীদের পক্ষে ভারতের অভ্যন্তরে এত দূরে আক্রমণ করা সহজ ছিল না।
[3] ভৌগােলিক অবস্থান : মগধ রাজ্য ও রাজধানী নদী ও পাহাড়ের দ্বারা বেষ্টিত ছিল। মগধের প্রথম রাজধানী রাজগৃহ ছিল পাহাড়বেষ্টিত। পরবর্তী রাজধানী পাটলিপুত্র গঙ্গা, শােন ও গণ্ডক নদীবেষ্টিত হয়ে যেন এক জলদুর্গে পরিণত হয়েছিল। এরূপ ভৌগােলিক নিরাপত্তা ভেদ করে শত্রুদের পক্ষে মগধ আক্রমণ করা সহজ কাজ ছিল না।
[4] উর্বর কৃষিজমি: গঙ্গা ও অন্যান্য নদীবিধৌত মগধের কৃষিজমি ছিল খুবই উর্বর। কৃষিতে প্রচুর উৎপাদনের ফলে প্রভূত পরিমাণ রাজস্ব আদায় সম্ভব হত। ফলে মগধে সৈন্যদের ভরণ-পােষণে সুবিধা ও রাজকোশের আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটেছিল।
[5] বৈদেশিক বাণিজ্য: বিভিন্ন দূর দেশের সঙ্গে মগধের রপ্তানি বাণিজ্য চলত। মগধের সমৃদ্ধ বৈদেশিক বাণিজ্যের ফলে সেখানকার অর্থনীতি মজবুত হয়েছিল। এই আর্থিক শক্তি মগধের সামরিক শক্তির ভিতও শক্ত করেছিল।
[6] অরণ্য সম্পদ: মগধের ঘন অরণ্য ছিল হিংস্র জীবজন্তু ও অসংখ্য বৃক্ষে পরিপূর্ণ। এইসব বৃক্ষের কাঠ যুগ্ধকরণে কাজে লাগত। এ ছাড়া এই অরণ্য থেকেই মগধের সৈন্যের যুদ্ধের জন্য প্রয়ােজনীয় রণহস্তী সংগ্রহ করা হত।
[7] খনিজ সম্পদ: মগধের তামা ও লােহার খনিগুলি সামরিক অস্ত্রশস্ত্র ও কৃষির জন্য প্রয়ােজনীয় বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরিতে ব্যবহৃত হত। ফলে মগধের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষিরও উন্নতি হয়েছিল।
[8] মিশ্র সংস্কৃতি : মগধের সীমানার একদিকে আর্য ও অন্যদিকে অনার্য সংস্কৃতির অবস্থান থাকায় এখানে এক মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, যা মগধের অগ্রগতিকে সহজ করেছিল।
সাম্রাজ্যের উত্থান থেকে পতন পর্যন্ত মৌর্য ও ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক অগ্রগতির তুলনামূলক আলােচনা করাে।
মৌর্য ও ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্য ছিল প্রাচীন বিশ্বের দুটি সুবৃহৎ ও শক্তিশালী সাম্রাজ্য। নীচে মৌর্য ও ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক অগ্রগতির তুলনামূলক আলােচনা করা হল一
Hiমৌর্য সাম্রাজ্য
1. প্রাচীন ভারতে ষােড়শ মহাজনপদের মধ্যে অন্যতম মহাজনপদ মগধকে কেন্দ্র করে ৩২৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মৌর্য সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে।
2. চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (৩২৪-৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) নন্দ বংশের উচ্ছেদ ঘটিয়ে মগধে মৌর্য শাসনের প্রতিষ্ঠা করেন।
3. মৌর্য সাম্রাজ্যের উল্লেখযােগ্য কীর্তিমান শাসক ছিলেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (৩২৪-৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ও সম্রাট অশােক (২৭৩-২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)।
4. চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য মগধের সিংহাসনে বসার পর সিন্ধু ও পাঞ্জাব অঞ্চল থেকে গ্রিকদের বিতাড়িত করেন। তিনি উত্তর-পশ্চিমে কাবুল থেকে দক্ষিণে কর্ণাটকের তিনেভেলি পর্যন্ত এবং পশ্চিমে আরব সাগর থেকে পূর্বে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটান। পরবর্তীকালে অশােক কলিঙ্গ রাজ্যটি দখল করেন।
5. মৌর্য সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন সম্রাট অশােক। সাম্রাজ্য প্রসারের তুলনায় সাম্রাজ্য রক্ষা, মানবিক উদ্দেশ্যে ধর্মপ্রচার, জনকল্যাণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে তিনি অনেক বেশি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।
মৌর্য সাম্রাজ্যের ব্যাপ্তি প্রধানত ভারতেই সীমাবদ্ধ ছিল। ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের আয়তনের তুলনায় মৌর্য সাম্রাজ্যের আয়তন ছিল অনেক কম।
6. সামরিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে মৌর্য সাম্রাজ্য ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের তুলনায় অনেক কম দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল।
7. মৌর্য প্রশাসনের সর্বময় কর্তা ছিলেন সম্রাট। সমগ্র সাম্রাজ্য বিভিন্ন প্রদেশে, প্রদেশগুলি বিভিন্ন বিষয় বা আহর বা জেলায়, জেলাগুলি বিভিন্ন গ্রামে বিভক্ত ছিল।
8. মৌর্য সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ১৩৮ বা ১৪০ বছর [৩২৪ – ১৮৭ (মতান্তরে ১৮৫) খ্রিস্টপূর্বাব্দ]।
9. মৌর্য সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ ১৮৭ (মতান্তরে ১৮৫) খ্রিস্টপূর্বাব্দে সর্বশেষ মৌর্য সম্রাট বৃহদ্রথকে হত্যা করে মগধের সিংহাসনে বসলে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্য
1. দক্ষিণ বলকান অঞ্চলকে কেন্দ্র করে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতক থেকে খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের মধ্যে ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়।
2. ক্যারানাস (৮০৮-৭৭৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) নামে জনৈক ব্যক্তি ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।
3. ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের উল্লেখযােগ্য কীর্তিমান শাসক ছিলেন সম্রাট দ্বিতীয় ফিলিপ (৩৫৯-৩৩৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ও সম্রাট তৃতীয় আলেকজান্ডার (৩৩৬ -৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)।
4. ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের প্রকৃত সম্প্রসারণ শুরু হয় সম্রাট দ্বিতীয় ফিলিপের রাজত্বকাল থেকে। তিনি ইলিরিয়া, সে ও অন্যান্য গ্রিকরাজ্য দখল করেন। পরবর্তীকালে তাঁর পুত্র তৃতীয় আলেকজান্ডার পারস্য জয় করেন এবং ইউরােপ, আফ্রিকা ও ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশ পর্যন্ত সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটান।
5. ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন সম্রাট তৃতীয় আলেকজান্ডার। তিনি প্রধানত সামরিক দক্ষতা এবং সাম্রাজ্যবিজেতা হিসেবে কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন।
6. ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্য গ্রিক ভূখণ্ডের সীমানা অতিক্রম করে বহুদূর বিস্তৃত হয়েছিল। মৌর্য সাম্রাজ্যের তুলনায়। ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের আয়তন ছিল অনেক বেশি।
7. সামরিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্য মৌর্য সাম্রাজ্যের তুলনায় অনেক বেশি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল।
8. ম্যাসিডনীয়ার প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরে ছিলেন সম্রাট। সমগ্র সাম্রাজ্য বিভিন্ন জেলায় বিভক্ত ছিল। প্রশাসনের সর্বনিম্ন স্তরে ছিল বিভিন্ন শহর ও গ্রাম।
9. ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব ছিল অন্তত ৬৬২ বছর (৮০৮-১৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। অর্থাৎ মৌর্য সাম্রাজ্যের তুলনায় ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব অনেক বেশি ছিল।
১৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ম্যাসিডন রােমান সাম্রাজ্যের দখলে চলে গেলে এই সাম্রাজ্যের সম্পূর্ণ পতন ঘটে।
রােমান ও গুপ্ত শিল্পকলার বিষয়ে একটি তুলনামূলক আলােচনা করাে।
প্রাচীন রােমান এবং গুপ্ত উভয় সাম্রাজ্যেই শিল্পকলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল। স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে উভয় সাম্রাজ্যে এই অগ্রগতি লক্ষ করা গিয়েছিল। নীচে উভয় সাম্রাজ্যের শিল্পকলার মধ্যে একটি তুলনামূলক আলােচনা করা হল一
রােমান শিল্পকলা
✸প্রাচীন ইট্রাঙ্ক্যান শিল্পের (৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ধারা থেকে রােমান শিল্পের উদ্ভব ঘটেছে বলে মনে করা হয়। এ ছাড়া রােমানরা দীর্ঘদিন গ্রিস, মিশর, আফ্রিকা প্রভৃতি দেশ শাসন করেছিল। তাই রােমান শিল্পকলায় সেইসব দেশের শিল্পরীতির যথেষ্ট প্রভাব পড়েছিল।
✸আনুমানিক ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে শুরু করে পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্যের পতনের কাল (৪৭৬ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত সময়ের মধ্যে রােমান শিল্পের চরম অগ্রগতি লক্ষ করা যায়।
✸রােমানরা খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে কংক্রিটের স্থাপত্যকৌশল উদ্ভাবন করলে স্থাপত্যকর্মের প্রভূত উন্নতি ঘটে। রােমানরাই প্রথম স্থাপত্য পাথরের ব্যবহার শুরু করেছিল।
✸রােমান স্থাপত্যশিল্পের অন্যতম নিদর্শনগুলি হল বিভিন্ন অট্টালিকা ও প্রাসাদ। রােমের বৃহদায়তন প্রাসাদগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল প্যান্থিয়ন। এ ছাড়া ৮০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয় চার তলাবিশিষ্ট বিশালায়তন অ্যাফিথিয়েটার বা কলােসিয়াম। এখানে ৫০,००० দর্শক একত্রে বসে রথের দৌড়, গ্ল্যাডিয়েটরদের যুদ্ধ প্রভৃতি দেখতে পারত। রােমান স্থাপত্যের অপর উল্লেখযােগ্য নিদর্শন ছিল ফোরাম।
✸রােমান শিল্পে ব্যক্তির প্রতিকৃতি ছিল বিশেষ জনপ্রিয়। রােমান শিল্পে বিভিন্ন মূর্তি ও প্রতিকৃতি নির্মিত হত। পূর্ণাবয়ব মূর্তি ছাড়াও সম্রাটদের আবক্ষ মূর্তি নির্মিত হত। বিখ্যাত ব্যক্তির ক্ষমতার প্রকাশ ঘটাতে শিল্প- স্থাপত্যকে ব্যবহার করা হত। তা ছাড়া বিভিন্ন স্থাপত্যের দেয়ালে নানান কারুকার্যময় অলংকরণ করা হত।
✸আর্কিসিলােয়াস, বােথােস, স্টেটফানােস, জিনােড্রাউস প্রমুখ ছিলেন রােমান যুগের সুবিখ্যাত ভাস্কর। তাঁরা বিভিন্ন সম্রাট ও দেবদেবীর মূর্তি নির্মাণ করেন।
✸নারী-পুরষ, শিশু ও নিসর্গের দৃশ্য অঙ্কনে রােমান চিত্রকররা দক্ষ ছিলেন। কাঠ ও অন্যান্য সামগ্রী থেকে আঁকার তুলি তৈরি হত। রং তৈরি করা হত বিভিন্ন পাথুরে শিলা ও গাছপালা থেকে লাল, হলুদ, সাদা, কালাে প্রভৃতি রঙের বহুল ব্যবহার ছিল। আলেকজান্দ্রিয়ার ডেমিট্রিয়াস এবং টিমােম্যাচোস ছিলেন বিখ্যাত রােমান চিত্রকর।
✸রােমান শিল্পের উপরােক্ত ধারাগুলি ছাড়াও ধাতু শিল্প, খােদাই শিল্প, হাতির দাঁতের শিল্প, মৃৎশিল্প প্রভৃতিরও বিকাশ ঘটেছিল।
আজ প্রায় দু’হাজার বছর পর রােমান সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব না থাকলেও সেই রােম নগরী আজও আছে। সেই সঙ্গে সেযুগের বিভিন্ন নির্মাণকার্য এবং শিল্পকলার নিদর্শনও এখনও টিকে আছে।
গুপ্ত শিল্পকলা
✸সম্পূর্ণ ভারতীয় শিল্পরীতিতে এ যুগের শিল্পের বিকাশ ঘটে। আর. ডি. ব্যানার্জীর মতে, গুপ্তযুগে ভারতীয় শিল্পকলা দীর্ঘকালের পরাধীনতা মুক্ত হয়ে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে আত্মপ্রকাশ করেছিল। মন্দিরনির্মাণ শিল্পে দ্রাবিড় ও নাগর শিল্পরীতির প্রভাব পড়েছিল।
✸আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ গুপ্ত শিল্পকলার পথ চলা শুরু হয়। তবে খ্রিস্টীয় চতুর্থ ও পঞ্চম শতকে এই শিল্পকলার চূড়ান্ত অগ্রগতি লক্ষ করা যায়।
✸গুপ্তযুগে ইট, কাঠ, পাথর প্রভৃতি দিয়ে স্থায়ী মন্দির নির্মাণের প্রচলন ঘটে। এসময় পাথর কেটে বিভিন্ন বৌদ্ধ, জৈন ও হিন্দু মন্দির নির্মাণ শুরু হয়। মন্দিরের মাঝখানে গর্ভগৃহ এবং চারপাশে প্রাঙ্গণ থাকত।
✸এই যুগের উল্লেখযােগ্য কয়েকটি স্থাপত্য-নিদর্শন হল মণিনাগের মন্দির, কোটেশ্বর মন্দির, তিগােয়ার বিষ্নমন্দির, ভূমারের শিবমন্দির, কুবীরের পার্বতীমন্দির, দেওগড়ের দশাবতার মন্দির, কানপুরের ভিতরগাঁওয়ের মন্দির, অজন্তা ও ইলােরা এবং ভূপালের নিকটবর্তী উদয়গিরির গুহামন্দির, সাঁচী ও বুদ্ধগয়ার স্তুপ ইত্যাদি।
✸ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে বৈদেশিক শিল্পের বা গান্ধার শিল্পের প্রভাবমুক্ত হয়ে গুপ্তযুগে নতুন শিল্পরীতি গড়ে ওঠে। এ যুগে ভাস্কর্যের বিষয়বস্তু ছিল পৌরাণিক দেবদেবী যেমন রাম, কৃয়, বিয়ু প্রভৃতি। ভাস্কর্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হল সারনাথের বুদ্ধমূর্তিগুলি। অমরাবতী ও মথুরার ভাস্কর্যের সৌন্দর্য এ যুগে পরিণত রূপ লাভ করেছিল।
✸সারনাথের অবলােকিতেশ্বর মূর্তি, সাঁচির বােধিসত্ত্ব, মথুরার ব্রোঞ্জের দণ্ডায়মান বুদ্ধমূর্তি, দেওঘরের দশাবতার মন্দিরে অনন্তশয্যায় শায়িত বিষুর মূর্তি প্রভৃতি গুপ্তযুগের ভাস্কর্যের উল্লেখযােগ্য নিদর্শন।
✸গুপ্ত যুগে অজন্তা ও ইলােরার গুহার দেওয়ালে অঙ্কিত চিত্রকলাগুলি এযুগের দর্শকদেরও বিস্মিত করে। রাজকীয় জীবন থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, নগর, অরণ্য, ঋষি, ভূতপ্রেত সবই এখানকার চিত্রের বিষয়বস্তু। এ ছাড়া বাঘ গুহাচিত্রের নিদর্শনগুলিও অপূর্ব। “মাতা ও পুত্র’, ‘বােধিসত্ব চক্লপাণি’, ‘হরিপ চতুষ্টয়’ প্রভৃতি চিত্রগুলিতে বাস্তব জীবনের কাহিনি ফুটে উঠেছে।
✸গুপ্তযুগে ধাতুশিল্প, অলংকার শিল্প, কাঠের শিল্প, মৃৎশিল্প প্রভৃতির অগ্রগতি ঘটেছিল। এযুগে ধাতুশিল্পের অগ্রগতি ছিল এককথায় বিস্ময়কর।
✸গুপ্তযুগের শিল্পকলা রােমান শিল্পকলার প্রায় সমসাময়িক হলেও গুপ্তযুগের অধিকাংশ শিল্প-নিদর্শন কালের স্রোতে বিলীন হয়ে গেছে। এ