রাষ্ট্রের প্রকৃতি এবং এর উপাদান- একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস (তৃতীয় অধ্যায়)
কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্রে রাজার প্রধান ও অন্যান্য কর্তব্য সম্বন্ধে যে সমস্ত পরামর্শ দিয়েছেন, সেগুলি সংক্ষেপে আলােচনা করাে।
[1] প্রজাস্বার্থ রক্ষা ও প্রজাকল্যাণ: কৌটিল্য বলেছেন, রাজার কর্তব্য হল প্রজাস্বার্থ রক্ষা করা এবং প্রজাকল্যাপে নিয়ােজিত থাকা প্রজাদের মঙ্গল, সমৃদ্ধি ও সুখ প্রদানের ক্ষেত্রে রাজাকে সক্রিয় থাকতে হবে। অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে- “প্রজাসুখে সুখ্যং রাজঃ, প্রজানাঞ্চ হিতে হিতম”। অর্থাৎ প্রজাদের সুখেই রাজার সুখ, প্রজাদের হিত বা মঙ্গলেই রাজার হিত বা মঙ্গল হয়।
[2] সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষা: অর্থশাস্ত্র মতে রাষ্ট্র আসলে সমাজেরই অংশ। সমাজের মধ্যে থেকেই রাষ্ট্রের জন্ম। এই বিচারে রাজার কর্তব্য হল রাষ্ট্রকে রক্ষার মধ্যে দিয়ে সমাজকে রক্ষা করা। প্রয়ােজনে রাজা রাষ্ট্রনীতিজ্ঞ (Statesman) বা গুপ্তচর নিয়ােগ করে রাজ্যের সমস্ত খবর নেবেন।
[3] দুর্দশা থেকে মুক্ত করা: পিতা যেমন পুত্রকে রক্ষা করেন, রাজাও তেমন প্রজাদের যাবতীয় দুর্দশা থেকে মুক্ত করবেন। বন্যা, মহামারি, খরা, অগ্নিকাণ্ডের মতাে প্রাকৃতিক বা আকস্মিক বিপর্যয়ের সময়ও প্রজাদের পাশে দাঁড়ানাে রাজার কর্তব্য। দুর্ভিক্ষের সময় দুঃস্থদের সাহায্যের জন্য রাজা রাজকীয় শস্যভাণ্ডার খুলে দেবেন।
[4] দারিদ্র দূরীকরণ: কৌটিল্যের ধারণায় দরিদ্ররা সাধারণত লােভী ও বেপরােয়া হয়ে ওঠে। অভাবের তাড়নায় তারা রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করতে পারে|তাই রাজার উচিত হল দরিদ্রদের সাহায্য দান করে ধনী-দরিদ্রের মধ্যেকার ব্যবধান মােচনের চেষ্টা করা।
[5] দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন: রাজার গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করা। অপরাধীকে অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী রাজা যেমন শাস্তি দেবেন, তেমন সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও কর্তব্যনিষ্ঠ নাগরিককে রাজা পুরস্কৃত করবেন, সম্মানীয় ব্যক্তিদের সম্মান ও মর্যাদা দেবেন।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে রাজার অন্যান্য কর্তব্য
[1] সুদৃঢ় সেনাবাহিনী গঠন: কৌটিল্যের মতে, সামরিক শক্তির ওপরই রাজ্যের অস্তিত্ব বা স্থায়িত্ব অনেকাংশে নির্ভরশীল। রাজা এমন এক সেনাবাহিনী গঠন করবেন, যারা রাজ্যের সুরক্ষা দিতে সক্ষম হবেন। সেনাধ্যক্ষদের সঙ্গে পরামর্শ করেই রাজা যুদ্ধের যাবতীয় পরিকল্পনা নেবেন।
[2] ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা: রাজা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নাগরিকদের রক্ষা করবেন। ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে রাজা নিজ সন্তান বা শত্রুর মধ্যে কোনাে প্রভেদ করবেন না।রাজা চারবর্ণের প্রজাদের প্রতিই সমান ব্যবহার করবেন। আইনের চোখে এদের সকলকেই সমানভাবে দেখবেন। ন্যায়বিচার মেনেই তিনি অপরাধীকে দোষী সাব্যস্ত করবেন।
[3] যােগ্যদের নিয়ােগ: প্রশাসনের বিভিন্ন পদগুলিতে রাজা দক্ষ ও যােগ্য কর্মচারীদেরই নিয়ােগ করবেন। এমনকি সামরিক বাহিনীর প্রধান বা যুদ্ধের সেনানায়কদেরও রাজা নির্বাচন করবেন। রাজা প্রদেষ্ট’ নামে প্রধান ফৌজদারি বিচারক এবং ‘ব্যাবহারিক’ নামে প্রধান দেওয়ানি বিচারকদেরও নিয়ােগ করবেন।
[4] ব্যাবসাবাণিজ্যের উন্নয়ন: বাণিজ্য পথকে সুরক্ষিত করা এবং ব্যাবসাবাণিজ্যের উন্নতি ও সম্প্রসারণ রাজার আশু কর্তব্য। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য বজায় রাখার জন্য রাজাকে সচেষ্ট থাকতে হবে।
[5] সুসম্পর্ক স্থাপন: প্রজাসাধারণ ও প্রতিবেশী রাজ্যের সঙ্গে রাজাকে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। রাজাকে দেখতে হবে প্রজারা যেন নির্ভয়ে তার কাছে গিয়ে সহজেই তাদের অভাব-অভিযােগগুলি জানাতে পারে। রাজার ভদ্র ও পরিমার্জিত আচরণে জনগণ যেন সন্তুষ্ট থাকেন।
সীমাবদ্ধতা: প্রথমত, কৌটিল্য রাজাকে স্বাধীন বলে উল্লেখ করলেও বাস্তবে কিন্তু রাজারা স্বাধীন ছিলেন না। নৈতিক এবং আইনগত বাধ্যবাধকতার কারণে রাজার ক্ষমতা সীমিত ছিল। দ্বিতীয়ত, ‘সভা এবং ‘সমিতি রাজার কর্তব্য ও অধিকারকে অনেকাংশ নিয়ন্ত্রণ করত। তৃতীয়ত, রাজাকে অনেকসময় পূর্ব প্রচলিত প্রথা ও স্থানীয় আইনের কাছে নতিস্বীকার করতে হত। চতুর্থত, প্রজাসাধারণের অসন্তোষ বা প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি মাথায় রেখে রাজাকে যে-কোনো কাজ করতে হত।
অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্য বর্ণিত রাষ্ট্রতত্ত্ব বা ‘সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব’ আলােচনা করাে।
কৌটিল্য রচিত অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রের বর্ণনায় ‘সপ্তাঙ্গিক রাজ্যম’— শব্দ দুটির উল্লেখ রয়েছে। সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব অনুযায়ী রাজ্য বা রাষ্ট্র সর্বসমেত ৭টি অঙ্গ বা উপাঙ্গ নিয়ে গঠিত। এই সাতটি অঙ্গ হল- স্বামী, অমাত্য, জনপদ, পুর, কোশ, দণ্ড এবং মিত্র। এই সাতটি অঙ্গকে তিনি রাষ্ট্রের অপরিহার্য অঙ্গ বলে উল্লেখ করেছেন। এগুলি হল一
[1] স্বামী: কৌটিল্য স্বামী বলতে রাজা অর্থাৎ রাজ্যের প্রধানকেই বুঝিয়েছেন। এই স্বামী অর্থাৎ রাজার কর্তব্যের উল্লেখে তিনি রাজার চারটি গুণাবলির প্রয়ােজনীয়তার কথা বলেছেন, যথা一
অভিগামিক গুণ: সত্যনিষ্ঠা, ধর্মপরায়ণ, বিনয়, শিক্ষার আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতি হল অভিগামিক গুণ।
প্রজ্ঞাপন: দ্রুত কোনাে সমস্যা সঠিকভাবে বুঝে নেওয়ার ক্ষমতা, সঠিক কাজ এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হল প্রজ্ঞাপন।
উত্থান গুণ: সাহস এবং দ্রুততার সঙ্গে কাজ শেষ করার ক্ষমতা হল এই গুণের লক্ষণ।
আত্ম সম্পদ: বাগ্মিতা, ইন্দ্রিয় সংযম, স্মৃতিশক্তি, বিপদকালে অবিচলিত থাকা এই সমস্ত গুণ হল আত্মসম্পদ।
[2] অমাত্য বা মন্ত্রী: কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্রে বিভিন্ন ধরনের কর্মচারী বা অমাত্য এবং তাদের নিয়োগ পদ্ধতি, দায়িত্ব ও কর্তব্য আলােচনা করেছেন। অর্থশাস্ত্র অনুসারে এরকম কয়েকজন কর্মচারী হলেন—পুরােহিত, সমাহর্তা, সন্নিধাতা, কোশাধ্যক্ষ, রাজদূত, দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার বিচারক প্রমুখ। অমাত্যের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হল কোনাে কাজ শুরু করার আগে তার নীতি ও পদ্ধতি নির্ধারণ করা। কৌটিল্য বলেছেন—“অমাত্য অবশ্যই দেশীয় হবেন এবং স্বামী (প্রভু)র প্রতি গভীর অনুরক্ত থাকবেন।”
[3] জনপদ: জনপদ বলতে কৌটিল্য রাষ্ট্রের ভূখণ্ড ও তার অধিবাসীদের বুঝিয়েছেন। তিনি বলেছেন জনবিহীন জনপদ অর্থহীন। তিনি আদর্শ ভূখণ্ড বলতে উর্বরভূমি, প্রচুর অরণ্য সম্পদ, খনিজ সম্পদ বিশিষ্ট অঞ্চল এবং উৎকৃষ্ট মানের গােচারণভূমিকে বুঝিয়েছেন। কৌটিল্য বলেছেন, প্রতিটি গ্রামে কমপক্ষে একশত এবং সর্বাধিক পাঁচশত পরিবার বসবাস করবে।
[4] দুর্গ: কৌটিল্যের মতে দুর্গুলি সাম্রাজ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কৌটিল্য চার ধরনের দুর্গের কথা বলেছেন। এগুলি হল一
জলদুর্গ: চারিদিকে জলবেষ্টিত এলাকা নিয়ে গঠিত দুর্গ হল জলদুর্গ।
গুহা বা পার্বত্য দুর্গ: চারিদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা বা পাহাড়ের মধ্যে তৈরি হয়—এই ধরনের দুর্গ।
মরুদুর্গ: মরুপ্রান্তর সংলগ্ন দুর্গগুলির নাম ছিল মরুদুর্গ।
বনদুর্গ: বনাঞ্চলে প্রতিরক্ষার প্রয়ােজনে স্থাপিত দুর্গের নাম ছিল বনদুর্গ।
[5] কোশ : কৌটিল্যের মতে রাষ্ট্রের শক্তি নির্ভর করে কোশ বা রাজার আর্থিক ক্ষমতার ওপর। কোশ হল এমন এক অর্থভাণ্ডার যা রাজা রাজস্ব সংগ্রহের মাধ্যমে উপার্জন করেন অথবা অন্য কোনাে সৎ উপায়ে সংগ্রহ করেন। অর্থের কয়েকটি উৎস হল প্রজাদের ওপর আরােপিত ভূমিরাজস্ব, চাষিদের থেকে সংগৃহীত শস্যকর, সেচকর, ব্যাবসাদারদের থেকে আদায়িকৃত পণ্যকর প্রভৃতি।
[6] দণ্ড : কৌটিল্যের মতে দণ্ড বা বল অর্থাৎ সেনাবাহিনীর ওপর রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব নির্ভর করে। তার ধারণায় সেনারা রাজার ইচ্ছায় পরিচালিত হবে এবং রাজার নির্দেশ মতাে কাজ করবে। দণ্ড বা বল শব্দ দ্বারা মূলত হস্তী, অশ্ব, রথ এবং পদাতিক এই চতুরঙ্গ সেনাদের কথা বলা হয়েছে।
[7] মিত্র: সপ্তাঙ্গর শেষ উপাদানটি হল মিত্র বা সুহাদ (ally)। কৌটিল্যের ধারণায়, মিত্র হল সেই, যার কাছ থেকে বিপদের কোনাে সম্ভাবনা থাকে না| আর-এক দিক থেকে মিত্র বা সুহূদ শব্দটি বিজিগীষু (জয় করতে ইচ্ছুক) রাজাদের সঙ্গে মিত্রতা সূত্রে আবদ্ধকারীদের বােঝানাে হয়েছে। কৌটিল্য দু ধরনের মিত্রের কথা বলেছেন一
সহজ (Sahaja): পিতামহ ও পিতার সময়কাল থেকে যে ধরনের ব্যক্তিদের সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক রয়েছে তারা হল সহজমিত্র।
কৃত্রিমা (Kritrima): এই ধরনের মিত্র হল অর্জিত মিত্র। এই ধরনের মিত্রতা স্বাস্থ্য, সম্পদ ও জীবনের নিরাপত্তা দেয়। কৌটিল্যের মতে—সহজমিত্ৰতা কৃত্রিমের চেয়ে উৎকৃষ্ট বা শ্রেষ্ঠ।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত মণ্ডলতত্ত্বের (প্রকৃতি-মণ্ডল বা রাজমণ্ডল), সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও। মণ্ডলতত্ত্বের গুরুত্ব লেখাে।
কৌটিল্যের বিদেশনীতি বা কূটনীতির ধারণা গড়ে উঠেছে যে তত্বকে কেন্দ্র করে তা হল মণ্ডলতত্ত্ব বা প্রকৃতি মণ্ডলতত্ত্ব বা রাজমন্ডলতত্ত্ব এই তত্ত্বে ১২ ধরনের রাজার অবস্থান দেখা যায়।
[1] সম্মুখভাগ
বিজিগীষু: রাজমণ্ডলের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত রাজ্যের রাজা হলেন বিজিগীষু৷ এই রাজা হলেন সমস্ত কর্তৃত্বের উৎস,যিনি অন্য রাজাদের ওপর আধিপত্য বিস্তারে ইচ্ছুক।
অরি: বিজিগীষু রাজার রাজ্যের সামনের ভাগের শেষপ্রান্তের রাজা হলেন অরি বা শত্ন (Enemy)। অতীত কালে অরি রাজ্যের রাজার সঙ্গে যুদ্ধ বেশি হত।
মিত্র: অরি রাজ্যের সামনের ভাগে অবস্থিত রাজ্যের রাজাই ছিলেন মিত্র। এই রাজা ছিলেন বিজিগীষু রাজার মিত্র ও অরির শত্রু।
অরি মিত্র: মিত্র রাজার রাজ্যের সামনের দিকে অবস্থিত রাজ্যটির রাজা হলেন অরি মিত্র। ইনি হলেন শত্নুর মিত্র।
মিত্র মিত্র: অরি মিত্র রাজ্যের সীমান্তবর্তী রাজা হলেন মিত্র মিত্র। ইনি মিত্ররাজার মিত্র অর্থাৎ স্বাভাবিক বন্ধু।
অরি মিত্র মিত্র: মিত্র মিত্র রাজার সীমান্তবর্তী রাজা হলেন অরি মিত্র মিত্র। ইনি অরি মিত্রের স্বাভাবিক বন্ধু। ইনি বিজিগীষু রাজা এবং মিত্র মিত্রর শত্রু বা অরি।
[2] পশ্চাৎভাগ
পার্ষিগ্রাহ: পার্ষি শব্দের অর্থ হল পশ্চাদভূমি। বিজিগীষু রাজার ঠিক পশ্চাদ্ প্রান্তের রাজ্যের রাজা হলেন পার্ষিগ্রাহ। ইনি বিজিগীষু রাজার শত্নু বা অরি।
আক্ৰন্দ: পার্ষিগ্রাহ রাজ্যের ঠিক পশ্চাদ্বর্তী রাজ্যের রাজা হলেন আক্ৰন্দ। ইনি পার্ষিগ্রাহির স্বাভাবিক শত্রু এবং বিজিগীষুর একান্ত স্বাভাবিক মিত্র।
পার্ষিগ্রাহাসার: আক্রন্দের ঠিক পশ্চাদূবর্তী রাজ্যের রাজা হলেন—পার্ষিগ্রাহাসার। ইনি আক্ৰন্দ এবং বিজিগীয়ুর স্বাভাবিক শর্টু কিন্তু পার্টিগ্রাদ্যে স্বাভাবিক মিত্র।
আক্রন্দসার: পার্ষিগ্রাহাসার-এর ঠিক পশ্চাদ্বর্তী রাজ্যের রাজা হলেন আক্রন্দসার ইনি বিজিগীষু ও আক্রন্দের মিত্র কিন্তু পার্ষিগ্রাহ ও পার্ষিগ্রাহাসারের স্বাভাবিক শত্ৰু।
[3] মধ্যম: ‘মধ্যম’ শব্দের অর্থ হল মাঝখানে অবস্থানকারী। বিজিগীষু ও অরি এই দুই রাজার নিকটবর্তী রাজ্যের রাজা হলেন মধ্যম ইনি বিজিগীষু ও অরি উভয়ের মধ্যেকার শান্তি বা যুদ্ধর ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ অবস্থান নেন।
[4] উদাসীন: বিজিগীষু, অরি ও মধ্যম রাজার রাজ্যগুলির থেকে দূরে অবস্থানকারী রাজ্যের রাজা হলেন উদাসীন। ইনি অত্যধিক বলবান রাজা। ইনি বিজিগীষু, অরি ও মধ্যম রাজাদের মধ্যেকার শান্তি বা যুদ্ধের ক্ষেত্রে সাহায্য বা প্রতিরােধে সক্ষম। এদের যৌথ বা একক আক্রমণের মােকাবিলা করতে ইনি সক্ষম।
মণ্ডলতত্ত্বের গুরুত্ব :
[1] আধুনিক বিশ্বে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ধারণে মণ্ডলতত্ত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। [2] বন্ধু ও শত্ন রাষ্ট্র নির্ধারণে কৌটিল্যের মণ্ডলতত্ত্ব স্পষ্ট ধারণা দেয়। [3] মণ্ডলতত্ত্ব থেকে ক্ষমতার ভারসাম্য তত্ত্বের (Balance of Power Theory) আভাস মেলে। [4] কোনাে একটি দেশের রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ বা বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে এই তত্ত্ব সাহায্য করতে পারে। [5] মণ্ডলতত্ত্ব জোটবদ্ধ রাজনীতির ধারণা দেয়, যার নিদর্শন আমরা দেখতে পাই আমাদের দেশ-সহ বিশ্বরাজনীতিতেও।
মন্তব্য: আধুনিক আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এই তত্ত্বের স্পষ্ট প্রতিফলন মেলে। ভাবতে অবাক লাগে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে কৌটিল্য যে তত্ত্বের উদ্ভাবন করেছিলেন, আজও তা প্রাসঙ্গিক।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রনীতি সম্বন্ধে ধারণা কী ছিল?
[1] রাজতন্ত্র
ধর্মনিরপেক্ষ-প্রশাসনিক তত্ত্ব: অর্থশাস্ত্র হল ধর্মনিরপেক্ষ, প্রশাসনিক তত্ত্ব।ধর্মনিরপেক্ষ প্রশাসন পরিচালনার শিক্ষা দেয় অর্থশাস্ত্র।
রাজার ক্ষমতা: অর্থশাস্ত্র অনুসারে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হলেন রাজা। তিনি রাষ্ট্রের প্রধান অঙ্গ এবং পার্থিব জগতে চূড়ান্ত সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী। তার কর্তৃত্বকে উপেক্ষা বা অমান্য করার ক্ষমতা কারও নেই। অবশ্য রাজার ক্ষমতার ওপর কিছু নিয়ন্ত্রণ আরােপের কথাও অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে। কেন না, রাজাই রাষ্ট্র নয়, তিনি রাষ্ট্রের অংশ মাত্র। রাষ্ট্র পরিচালনায় অনেকের সাহায্য তাঁর প্রয়ােজন। এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন রাজার মন্ত্রীমণ্ডলী। কৌটিল্য তার গ্রন্থে তিন প্রকার রাজস্বের কথা বলেছেন—সীতা, ভাগ এবং বলি। সীতা : রাজার খাসজমি সীতা থেকে রাজার ভালােই আয় হত। ভাগ: ভাগ অর্থাৎ প্রজার ব্যক্তিগত জমি থেকে উৎপন্ন ফসলের ১/৬ অংশ কর আদায় করা হত। বলি: বলি নামে একপ্রকার বাধ্যতামূলক কর আদায় করা হত। এ ছাড়া বন, খনি, শিল্প, আমদানি-রপ্তানি, পশুচারণ, পানশালা, কসাইখানা, জল, পথ প্রভৃতি থেকেও কর আদায় করা হত।
রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষতা: কৌটিল্য রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের কথা বলেছেন।
শাসনকার্যে পুরােহিতদের গুরুত্বহীনতা: আধ্যাত্মিক বিষয়ে পুরােহিতের শ্রেষ্ঠত্ব ঘােষিত হলেও রাষ্ট্রে রাজার ক্ষমতাকে পুরােহিত কোনােভাবেই প্রভাবিত করার অধিকারী নন। পুরােহিত কোনাে শাস্তিযােগ্য অপরাধ করলে কৌটিল্য নির্দ্বিধায় তার চরম শাস্তির পক্ষে সওয়াল করেছেন।
রাজার প্রতি রাজকর্মচারীদের আনুগত্য: উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীরা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের পরিবর্তে রাজার প্রতি অনুগত থাকবেন বলে কৌটিল্যের নির্দেশ ছিল।
বিচারক নিয়ােগ পদ্ধতি: বিচারক পদে নিয়ােগের পূর্বে কৌটিল্য প্রার্থীর ধর্মীয় বিচার বিবেচনা উপেক্ষা করার মানসিকতা যাচাই করে নিতেন।
[2] রাষ্ট্রনীতি
শাসকের নীতি: কৌটিল্য বলেছেন, রাজাকে কুটনীতি-পরায়ণ হতে হবে এবং রাষ্ট্রে বা শাসনব্যবস্থায় রাজাই একমাত্র সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। রাজাই রাজ্য, রাজা দুর্বল হলে রাষ্ট্র দুর্বল হতে বাধ্য।
রাজার কর্তব্য: ‘অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্য রাজাকে কঠোর পরিশ্রম করার নির্দেশ দেন। তিনি বলেছেন রাজার অবাধ ক্ষমতা থাকলেও তিনি কখনােই স্বেচ্ছাচারী হবেন না।
নৈতিকতায় গুরুত্বহীনতা: কৌটিল্য রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য যে-কোনাে পন্থা গ্রহণকেই সমর্থন করেন। তিনি বলেন যে, যুদ্ধই শান্তির একমাত্র পথ। রাষ্ট্রনীতিতে নৈতিকতার কোনাে স্থান নেই বলে তিনি মনে করেন।
মণ্ডলতত্ত্ব: তার মতে, সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী রাষ্ট্র হল স্বভাবজাত শত্রু এবং তার পরবর্তী রাষ্ট্র হল স্বভাবজাত মিত্র। এই দৃষ্টিতে রাষ্ট্রের শত্রু ও মিত্র নির্ধারণ করতে হবে। কৌটিল্যের এই তত্ত্বকে ‘মণ্ডলতত্ত্ব’ বলা হয়।
প্রজাকল্যাণ: প্রজা সাধারণের মঙ্গলসাধন করা রাজার গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য ও দায়িত্ব। কৌটিল্যের মতে, রাষ্ট্র দুটি উপায়ে প্রজাকল্যাণের দায়িত্ব পালন করতে পারে-
দুর্গতদের কল্যাণ: রাষ্ট্র প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ভিক্ষের সময় প্রজাদের ত্রাণ দেবে, কৃষকদের বীজ সরবরাহ করবে, মহামারি প্রতিরােধের উদ্যোগ নেবে, অসহায়, বৃদ্ধ ও বিধবাদের ভরণ-পােষণের দায়িত্ব নেবে ইত্যাদি।
সর্বসাধারণের কল্যাণ: সর্বসাধারণের কল্যাণের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প রূপায়িত করবে, অসাধু ব্যবসায়ীদের শাস্তি দিয়ে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করবে, সমাজ কল্যাণে মানুষকে উৎসাহিত করবে ইত্যাদি।
দুর্গ ও নগর নির্মাণ: বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরােধ ও দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রের কেন্দ্রস্থলে এবং চারিদিকে বিভিন্ন দুর্গ ও নগর নির্মাণের পরিকল্পনা করা রাষ্ট্রের লক্ষ্য হওয়া উচিত বলে কৌটিল্য উল্লেখ করেছেন।
দুর্গ: কৌটিল্য চার ধরনের দুর্গের কথা বলেছেন পার্বত্যদুর্গ, অরণ্যদুর্গ, জলদুর্গ ও মরুদুর্গ। দুর্গ পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থসম্পদ, খাদ্যশস্য, ঔষধপত্র, সৈন্যসামন্ত, অস্ত্রশস্ত্র, হাতি ঘােড়া প্রভৃতি থাকবে।
নগর: নগরগুলি বিশালাকার বাজার হিসেবে কাজ করবে এবং এখান থেকে রাষ্ট্র প্রভূত রাজস্ব অর্জন করতে পারবে।
জিয়াউদ্দিন বরনি তার ‘ফতোয়া-ই-জাহান্দারি’গ্রন্থে সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে কী মত প্রকাশ করেছেন?
[1] ইসলামের আদর্শ থেকে বিচ্যুতি: বরনি মনে করতেন, মধ্যযুগে দিল্লির শাসকগণ ইসলামের মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছিলেন। তারা ইসলামীয় আদর্শ বা বিধি উপেক্ষা করেই সুলতানি প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। প্রথম দিককার সুলতানগণ নিজেদেরকে খলিফার প্রতিনিধি বলে প্রচার করলেও কার্যত তারা ছিলেন স্বাধীন।
[2] রাষ্ট্রনীতি ও ধর্মনীতির পৃথকীকরণ: বরনির ধারণায় দিল্লির সুলতানগণ এটা অনুভব করেছিলেন যে, শাসনকালকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য রাষ্ট্রনীতি ও ধর্মনীতি আলাদা হওয়া উচিত। সুলতানগণ এই আদর্শ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন।
[3] খলিফা ও উলেমাদের প্রতি আপাত আনুগত্য: ইলতুৎমিস-সহ প্রথমদিকের দিল্লির সুলতানগণ নিজেদের প্রয়ােজনে খলিফার প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে দিল্লির সুলতানগণ যেমন আলাউদ্দিন খলজি, তাঁর পুত্র মুবারক শাহ খলিফার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন বন্ধ করেন। বলবন, এমনকি মহম্মদ-বিন-তুঘলকও উলেমাদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে শাসন পরিচালনা করতেন।
মধ্যযুগে দিল্লির সুলতানি শাসনের প্রাতিষ্ঠানিক বা রাষ্ট্রীয় কাঠামাে বর্ণনা করাে।
দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রের শাসনকাঠামােয় দুই ধরনের স্তর লক্ষ করা যায়। একটি কেন্দ্রীয়, অপরটি হল প্রাদেশিক।
[1] কেন্দ্রীয় বিভাগ
সুলতানি: সুলতানি রাষ্ট্র পরিচালনায় কেন্দ্রীয় স্তরের শীর্ষে ছিলেন সুলতান স্বয়ং। সুলতান নিজেই ছিলেন রাষ্ট্রের সর্বশক্তির আধার এবং সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। খলিফার অধীনে থেকে সুলতান কোরানের নির্দেশ মেনে শাসন চালাতেন। সুলতান একাধারে ছিলেন শাসন, বিচার, আইন ও সমর বিভাগের প্রধান।
দপ্তরসমূহ:
দেওয়ান-ই-ওয়াজিরা: শাসন কাঠামােয় সুলতানের পরেই ছিল ওয়াজির বা প্রধানমন্ত্রীর স্থান। রাজস্ব আদায় ও প্রশাসন পরিচালনা ছাড়াও তিনি অসামরিক বিভাগেরও তত্ত্বাবধান করতেন। তাঁর দপ্তরের নাম ছিল ‘দেওয়ান ই- ওয়াজিরা।
দেওয়ান-ই-আর্জ: সামরিক বিভাগ বা দেওয়ান-ই-আর্জ’ এর প্রধান ছিলেন ‘আরিজ-ই-মামলিক। আরিজ-ই- মালিকের কাজ ছিল—সেনা ও যুদ্ধসরঞ্জাম সংগ্রহ করা, সেনাদের বেতন নির্ধারণ ও তা প্রদান করা, সেনাবাহিনীর দুর্নীতি দমন করা প্রভৃতি।
দেওয়ান-ই-রিসালত: কেন্দ্রীয় বিভাগের দেওয়ান-ই- রিসালত’ নামে বৈদেশিক দপ্তরের প্রধান ছিলেন সদর- উস-সুদূর। বিদেশি রাজদূত ও প্রতিনিধিরা এই দপ্তরের মাধ্যমে সুলতানি রাষ্ট্রের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করত।
দেওয়ান-ই-ইন্সা: এই দপ্তরের মাধ্যমে প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও বিভিন্ন সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে সুলতানের গােপন যােগাযােগ রক্ষা করা হত।
অন্যান্য দপ্তর: অন্যান্য কয়েকটি দপ্তর ছিল—গুপ্তচর দপ্তর: বারিদই-মামালিক’, এটির প্রধান ছিলেন বারিদই খাস, কৃষিদপ্তর: দেওয়ান-ই-আমির-কোহী, পূর্তদপ্তর; দেওয়ান-ই-ইমারত, পেনশন দপ্তর: দেওয়ান-ই-ইস্তাক, দাতব্য দপ্তর: দেওয়ান-ই-খয়রাত প্রভৃতি।
রাজস্ব ব্যবস্থা: সুলতানি যুগে আয়ের কয়েকটি উৎস ছিল—ভূমিরাজস্ব, জাকাৎ, জিজিয়া, খামস, খনিজ, উত্তরাধিকারহীন সম্পদ প্রভৃতি। সুলতানি রাজস্বের অপর একটি উৎস ছিল ইক্তা প্রথা। ইক্তার শাসনকর্তা ছিলেন মাকৃতি বা মুক্তি নামে কর্মচারীরা।
বিচারব্যবস্থা: বিচার ব্যবস্থার শীর্ষে থেকে সুলতান নিজে সপ্তাহে দু-দিন বিচার করতেন। প্রধান বিচারক ছিলেন কাজি-উলকাজাৎ’। মুফতি শরিয়তি আইনের যে ব্যাখ্যা দিতেন, তা অনুসরণ করেই বিচার হত।
পুলিশি ব্যবস্থা: শহরে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করত কোতােয়াল’। তাঁকে সাহায্য করত ‘মুহতাসিব। গ্রামে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করতেন গ্রাম্য চৌকিদার।
[2] প্রাদেশিক বিভাগ
নানান রূপ: সুলতানি সাম্রাজ্যে তিন ধরনের প্রদেশ লক্ষ করা যায়। যথা- (a) পূর্বতন ইক্তা, যার শাসনকর্তা ছিলেন মাতি। (b) নববিজিত রাজ্যসমূহ, যথা-বাংলা, জৌনপুর, খান্দেশ। এগুলির শাসনকর্তাকে বলা হত। ওয়ালি। (c) পরাজিত হিন্দু রাজাদের রাজ্যসমূহ।
বিভাগসমূহ: প্রদেশপুলি কয়েকটি শিক বা জেলায় বিভক্ত ছিল। শিক এর প্রধান ছিলেন শিকদার। শিকগুলি পরগনায় এবং পরগনাগুলি গ্রামে বিভক্ত ছিল।
আরও দেখুন :রাজনীতির বিবর্তন—শাসনতান্ত্রিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক ধারণা
বরনির ফতােয়া-ই-জাহান্দারিতে রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রনীতি সম্বন্ধে ধারণা কী ছিল?
[1] রাজতন্ত্র
রাজতন্ত্রের রূপ: বরনি তাঁর ফতােয়া-ই-জাহন্দারি গ্রন্থে চরম রাজতন্ত্রকে সমর্থন করেছেন। তিনি রাজতন্ত্রকে একটি বংশানুক্রমিক প্রতিষ্ঠান বলে উল্লেখ করেছেন এবং রাজাকে সবধরনের বন্ধন থেকে মুক্ত চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী বলে ঘােষণা করেছেন। তিনি ভারতের সুলতানি রাজতন্ত্রকে পারস্যের সাসানীয় রাজতন্ত্রের অনুকরণে গড়ে তােলার পরামর্শ দিয়েছেন। তার মতে, পারস্যের সম্রাট ইসলামের আদর্শ ভাবধারা রক্ষা করে চলেছে, পারস্যের রাজতন্ত্রের জাকজমক, বিলাস-বৈভব ও মর্যাদা সমগ্র ইসলামি জগতে শ্রদ্ধা লাভ করেছে।
কাউন্সিল গঠন: বরনির মতে, প্রশাসনিক কাজে সাহায্যের জন্য সুলতান এক পরিষদ (কাউন্সিল) গঠন ও তার সংস্কার করবেন। এই কাউন্সিল অর্থাৎ মজলিস-ই-খাস এমন ভাবে গঠন করতে হবে, যাতে রাজার পরিবর্তন ঘটলেও কাউন্সিল কর্তৃক গৃহীত নীতিগুলির কোনাে পরিবর্তন হবে না।
আইনের সংরক্ষণ: বরনির মতে, ইসলামিক রাজ্যগুলিতে কোরান অনুযায়ী শরিয়ত আইনই শেষ কথা। ইসলাম ধর্মমত অনুসারে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক বারাষ্ট্রীয় জীবনের একমাত্র নিয়ন্ত্রক হল—শরিয়তি আইন। রাজা যেহেতু ঈশ্বরের প্রতিনিধি এবং খলিফার হয়ে শাসন সম্পাদন করেন, তাই শরিয়তি আইন ঠিকমতাে প্রযুক্ত হচ্ছে কিনা তা দেখা রাজার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
[2] রাষ্ট্রনীতি
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা: প্লেটো ও অ্যারিস্টট্লের রাষ্ট্রনৈতিক ভাবনায় প্রভাবিত বরনি মনে করতেন রাজার প্রধান কর্তব্য হল—ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। এক্ষেত্রে তিনি ন্যায়বিচার বলতে সত্য, ন্যায়, ধর্ম ইত্যাদির প্রতিষ্ঠা করাকে বুঝিয়েছেন। বরনি বলেছেন—ইসলাম ও শরিয়তের নিয়মকানুন কঠোরভাবে রাজাকে পালন করতে হবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে আগত যাবতীয় বাধা রাজাকে অপসারিত করতে হবে। যাবতীয় অন্যায় ও অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে রাজা কঠোর ব্যবস্থা নেবেন।
ইসলামের সুপ্রতিষ্ঠা: মুসলিম রাজার এক প্রধান কর্তব্য হল ইসলামের সুরক্ষাদান ও তার প্রচার ও প্রসার ঘটানাে। রাজাদের স্মরণ রাখতে হবে যে তারা কেবলমাত্র খলিফা (ঈশ্বরের প্রতিনিধি)-দের অসমাপ্ত কাজগুলি সম্পাদন করেন। তাঁর শাসন যেহেতু ইসলাম অনুমােদিত, তাই নিষ্ঠা-সহ তিনি ইসলামি শরিয়তের বিধিবিধানগুলি অনুসরণ করবেন।
প্রজাসাধারণের কল্যাণসাধন: বরনির মতে, ইসলামিক রাষ্ট্রের প্রজাদের কল্যাণসাধনে রাজাকে ব্রতী হতে হবে। প্রজাকল্যাণে ব্যর্থ হলে রাজা প্রজাদের আনুগত্য হারাবেন। রাজা পথিকদের জন্য রাজপথ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ-সহ নানা জনকল্যাণমূলক কাজ করবেন। রাজা অমুসলিমদের নিরাপত্তা স্বাধীন ধর্মাচরণের অধিকার দেবেন।
ধর্মীয় দিক থেকে এবং রাষ্ট্রীয় দিক থেকে দিল্লি সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলােচনা করাে।
সূচনা: সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি বা চরিত্র নিয়ে আধুনিক ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ধর্মীয় দিক থেকে সুলতানি রাষ্ট্র ধর্মাশ্রয়ী না ধর্মনিরপেক্ষ ছিল শাসনতান্ত্রিক বিচারে সুলতানি রাষ্ট্র সামরিক না অভিজাততান্ত্রিক ছিল তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই।
[1] ধর্মীয় দিক থেকে
ধর্মাশ্রয়ী:
প্রবক্তাগণ: সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতিকে যে সমস্ত ঐতিহাসিক ধর্মাশ্রয়ী (Theocratic) বলে উল্লেখ করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন—ড. আর. পি. ত্রিপাঠী, ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ, ড. শ্রীবাস্তব, ড. রামশরণ শর্মা, ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ।
ধর্মাশ্রয়ী রাজাদর্শ: দিল্লির সুলতানরা ছিলেন একাধারে রাষ্ট্র ও ধর্মনেতা। ইসলামের বিধি মেনেই দিল্লির সুলতানগণ শাসনকাজ চালাতেন। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ‘দার উল-হার্ব’ (অমুসলমানের দেশ)-কে ‘দার-উল ইসলাম (মুসলমানের দেশ)-এ পরিণত করা।
খলিফার অনুমােদন: খলিফা ছিলেন সমস্ত মুসলিম দুনিয়ার প্রধান ধর্মগুরু এবং শাসক। তাই প্রথমদিকের কয়েকজন সুলতান তাদের মুদ্রায় খলিফার নাম উৎকীর্ণ করান এবং খলিফার নামে খুৎবা পাঠ করান।
উলেমাদের ওপর নির্ভরশীলতা: সুলতানি আমলে উলেমারা ছিলেন কোরান ও শরিয়তের ব্যাখ্যাকার। তাঁরা প্রয়ােজনে সুলতানকে ধর্মীয় ব্যাপারে পরামর্শ দিতেন। আলাউদ্দিন খলজি ছাড়া অন্যসব সুলতানের আমলেই উলেমাদের যথেষ্ট প্রভাব ও প্রতিপত্তি বজায় ছিল।
অমুসলমানদের অধিকারহীনতা: সুলতানি রাষ্ট্রে অমুসলমান শ্রেণির তেমন কোনাে অধিকার ছিল না। জিজিয়া কর প্রদানের বিনিময়ে সুলতানি রাষ্ট্রে বসবাস করা ছাড়া তারা আর কোনাে বিশেষ সুযােগসুবিধা ভােগের অধিকারী ছিলেন না।
ধর্মনিরপেক্ষ:
প্রবক্তাগণ: একদল আধুনিক ঐতিহাসিক মনে করেন সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। এই মতের কয়েকজন প্রবক্তা হলেন—ড, হাবিবউল্লাহ, ড. মুজিব, ড. মহম্মদ হাবিব, ড. ইফতিকার আলম খান, ড. নিজামি, ড. সতীশ চন্দ্র প্রমুখ।
ধর্মনিরপেক্ষ রাজাদর্শ: ড. হাবিবউল্লাহ মনে করেন সুলতানি রাষ্ট্র ধর্মাশ্রয়ী ছিল না। ধর্মনিরপেক্ষতাই ছিল এর মূলভিত্তি। তার মতে দিল্লির সুলতানগণ রাষ্ট্রকে ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘােষণা করেননি। সুলতানগণ অমুসলমানদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করার জন্যেও কোনাে রাষ্ট্রীয় নীতি গ্রহণ করেননি৷
শরিয়ত থেকে বিচ্যুতি: দিল্লির সুলতানগণ শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে সর্বদা শরিয়ত নির্দেশিত বিধি মেনে চলেননি। ইসলামের বিধান অনুযায়ী মুসলিমদের প্রাণদণ্ড নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ফিরােজ তুঘলক ছাড়া অন্য কোনাে সুলতানের আমলে তা মানা হয়নি। শরিয়ত বিধি অনুসারে ইসলামীয় রাষ্ট্রে পৌত্তলিকদের কোনাে জায়গা নেই। কিন্তু সুলতানি শাসনে ভারতে হিন্দু পৌত্তলিকদের অস্তিত্ব ছিল।
খলিফার কর্তৃত্ব অস্বীকার: দিল্লির সুলতানগণ বাস্তবে খলিফার নির্দেশ মেনে শাসন পরিচালনা করতেন না। চেঙ্গিজ খাঁর পৌত্র হলাগু-র হাতে আব্বাসীয় খলিফা আল-মুস্তাসিন বিল্লাহ নিহত হলে দিল্লির সুলতানদের কাছে খলিফার অনুমােদন লাভ ঐচ্ছিক হয়ে পড়ে।
উলেমাদের ক্ষমতা হ্রাস: সুলতানি রাষ্ট্রে মুসলিম ধর্মবিশারদ উলেমারা রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় ব্যাপারে সুলতানদের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু সুলতানরা উলেমাদের কথামতাে দেশশাসন বা ধর্মনীতি প্রণয়ন করতেন না।
[2] রাষ্ট্রীয় দিক থেকে
সামরিক: সুলতানি রাষ্ট্র সামরিক শক্তির ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছিল। এর স্থায়িত্বও সামরিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল ছিল। কেউ কেউ মনে করেন সুলতানি রাষ্ট্র ছিল প্রকৃত অর্থে একটি পুলিশ-রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য ছিল—দেশরক্ষা, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং রাজস্ব আদায় করা।
অভিজাততান্ত্রিক: কারাে কারাে মতে সুলতানি শাসন ছিল একটি কেন্দ্রীভূত রাজতন্ত্র। এই রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় অভিজাতদের বিশেষ স্থান ছিল। সুলতান ইলতুৎমিস ‘বন্দেগান ই-চাহেলগানি নামক অভিজাত তুর্কিগােষ্ঠীর হাতে প্রভূত ক্ষমতা দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে অতুর্কিরাও অভিজাততন্ত্রে স্থান পেয়েছিল।
মূল্যায়ন: সার্বিক বিচারে সুলতানি রাষ্ট্রকে ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র বলা চলে না। কেননা সমন্বয়বাদী সুলতানি শাসনব্যবস্থায় একদিকে যেমন খলিফাতন্ত্র উপেক্ষিত হয়েছিল অপরদিকে উলেমাদের প্রভাব নগণ্য হয়ে পড়েছিল। ড., সতীশ চন্দ্র বলেছেন, “প্রকৃতপক্ষে সুলতানি রাষ্ট্র ছিল সামরিক ও অভিজাততান্ত্রিক।”
রােমান পণ্ডিত মার্ক তুল্লি সিসেরাের রাষ্ট্রচিন্তা ও রাষ্ট্রাদর্শ আলােচনা করাে।
সূচনা: রােমান রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের মধ্যে এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হলেন মার্ক তুল্লি সিসেরাে (১০৬-৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। তিনি পূর্বপ্রচলিত রোমান রাষ্ট্রব্যবস্থার যাবতীয় প্রথারীতি নীতিকে সংশােধনের উদ্যোগ নেন এবং রোমান আইনতত্বকে বিশ্বজনীনতার আদর্শে উত্তরণ ঘটান।
[1] উৎস: প্লেটো, অ্যারিস্টটল, পলিবিয়াস এবং স্টইকদের মতবাদ সিসেরাের রাষ্ট্রচিন্তাকে সব থেকে বেশি প্রভাবিত করে। পাশাপাশি সমকালীন রােমের সমাজজীবন এবং রাজনীতির গতিপ্রকৃতি তার রাষ্ট্রচিন্তার মূল উৎস ছিল।
[2] সরকার: সিসেরাে রাজতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র এবং গণতন্ত্র এই তিন ধরনের সরকারের উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন— একজনের শাসন হল রাজতন্ত্র, কয়েকজনের শাসন হল প্রজাতন্ত্র, বহুজনের বা সমাজের সকলের শাসন হল গণতন্ত্র। এই তিন ধরনের সরকারের গুণাবলির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা মিশ্র সরকার হল সর্বোৎকৃষ্ট।
[3] আইনগত ধারণা
মূল বক্তব্যসমূহ: (a) সিসেরাের মতে, আইন মানবিক চিন্তার ফসল নয়, তা হল শাশ্বত, সনাতন। (b) বাস্তব নীতির ওপর গড়ে ওঠে আইন, যা সমগ্র বিশ্বকে চালনা করে। (c) আইন হল ঈশ্বরের প্রাথমিক ও চূড়ান্ত ইচ্ছা, যা যুক্তি দিয়ে বাধা ও বাধ্যতার দ্বারা সমস্ত কিছুকে পরিচালিত করে। (d) সিসেরাের ধারণায় পশুজগৎ আইনের তাৎপর্য বােঝে না, কিন্তু তারাও সহজাত প্রকৃতি গুণে আইন মেনে চলে। (e) পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব মানুষই কেবলমাত্র তার চিন্তা শক্তির দ্বারা আইনের প্রয়োজনীয়তা বা তাৎপর্য বুঝতে পারে।
প্রাকৃত আইন: সিসেরাের ধারণায় প্রাকৃত আইন ভগবানের তৈরি, তাই একে লঙ্ঘন করা যায় না। বিশ্বের সর্বত্র এই প্রাকৃত আইনের অস্তিত্ব রয়েছে।
[4] ন্যায়বিচার: সিসেরাের ধারণায় প্রাকৃত আইনের যথার্থ প্রয়ােগ ঘটলে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হতে পারে। সিসেরাের ধারপায় রাষ্ট্রের সমস্ত আইন ও সমাজের সমস্ত প্রথা যখন যুক্তিবাদী আইন দ্বারা পরিচালিত হবে, তখন সমাজে ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা ঘটবে।
[5] প্রাকৃতিক সাম্য: সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতি জুড়ে প্রাকৃতিক সাম্যের অস্তিত্ব বিদ্যমান। সমতার নীতি মেনেই ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রজীবন পরিচালিত হয়। সিসেরাে প্রাকৃত সাম্যনীতির সাহায্যে ক্রীতদাস-সহ সমাজের সমস্ত শ্রেণির মানুষকে সমান সুযােগসুবিধাদানের পক্ষপাতী ছিলেন।
সমালােচনা: সিসেরাের রাষ্ট্রচিন্তা পরবর্তীকালে বিভিন্ন দার্শনিকের কাছে সমালােচিত হয়েছে। গেটেল বলেছেন— সিসেরাের রাষ্ট্রতত্বে তেমন কোনাে মৌলিকতা ছিল না। সমালােচকদের মতে—সিসেরাে উদ্ভাবনশীল চিন্তাবিদ ছিলেন না। সিসেরাের আইনি ভাবনাও মৌলিক ছিল না, তা ছিল গ্রিক ও নির্বিকারবাদী ধারণার অনুসারী।
সিসেরাের রাষ্ট্রাদর্শ
[1] বিশ্বসমাজ গঠন: সিসেরাের রাষ্ট্রাদর্শের ধারণা মেলে তার দুই রাজনৈতিক গ্রন্থ ‘দ্য রিপাবলিক’ (The Republic) এবং ‘দ্য লজ’ (The Laws) থেকে। সিসেরাে এই বিশ্বের সমস্ত রাষ্ট্রকে নিয়ে একটি আদর্শ রাষ্ট্রসমবায় বা কমনওয়েলথ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
[2] উৎপত্তির কারণ: সিসেরাের ধারণায় ব্যক্তির স্বাভাবিক সামাজিক প্রবণতা এবং তাদের সম্মিলিত ইচ্ছার কারণেই রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। সিসেরাে মনে করতেন কোনাে আবেগ বা স্বার্থ নয়, সাধারণ যুক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়েই বিবর্তনের পথ ধরে রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে।
[3] রাষ্ট্রত্ত্বের মূলকথা: সিসেরাের রাষ্ট্রত্বের মূল কথা হল—[i] রাষ্ট্র এমন এক নৈতিক সংস্থা যা কিছু ব্যক্তির সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে গড়ে উঠেছে। [ii] রাষ্ট্র হল আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি সামাজিক সংগঠন যা বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণে নিয়ােজিত। [iii] রাষ্ট্র একদিকে আইনি সংস্থা অপরদিকে ন্যায়ের প্রতীক। তাই শাসক ও শাসিত উভয়ই রাষ্ট্রকে মেনে চলতে বাধ্য। [iv] রাষ্ট্র একটি যৌথ সংস্থা। প্রতিটি নাগরিকই এর সদস্য।
মূল্যায়ন: পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার প্রাচীন ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে প্লেটো ও অ্যারিস্টটুলের পরেই সিসেরাের স্থান। বিশ্বজনীন আদর্শের প্রেক্ষাপটে বিশ্বসমাজ (Commonwealth) বা রাষ্ট্র সমবায় (Confederation) গঠনের তত্ত্ব রাষ্ট্রচিন্তার জগতে এক নবদিগন্তের উন্মােচন ঘটায়।
রােমান রাষ্ট্রচিন্তার বিভিন্ন দিকগুলি আলােচনা করাে। রােমান রাষ্ট্রচিন্তার প্রকৃতি ও গুরুত্ব লেখাে
সূচনা: প্রাচীন রোমান রাষ্ট্রচিন্তা মৌলিক ছিল না, তাদের রাষ্ট্রভাবনায় প্রাচীন গ্রিসের যথেষ্টই প্রভাব ছিল। রােমের রাষ্ট্রদর্শন আসলে তাত্ত্বিক দর্শন নয়, তা হল ব্যাবহারিক জীবনদর্শন।
[1] উৎস: রােমের ইতিহাস, ভৌগােলিক পরিবেশ, আর্থ- সামাজিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এই সমস্ত কিছুই রােমান রাষ্ট্রচিন্তাকে প্রভাবিত করেছিল। পাশাপাশি অখণ্ড সাম্রাজ্য গঠনের পরিকল্পনাও রােমান রাষ্ট্রচিন্তার উৎস হিসেবে কাজ করেছিল।
[2] আইনতত্ত্ব: প্রকৃত অর্থে রােমান সাম্রাজ্যেই সর্বপ্রথম সঠিক আইনের ধারণা গড়ে ওঠে, যা পরবর্তীকালে বিশ্বের অন্যান্য দেশের আইনব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। রােমানরাই সর্বপ্রথম আইনকে লিখিত আকারে নথিভুক্ত করার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন। ধর্মের সংকীর্ণ গণ্ডি ছাড়িয়ে তারা আইনকে প্রকৃতি জগতের বাস্তব প্রকাশ হিসেবে তুলে ধরেন। বিশ্বসভ্যতায় রােমান আইনের তিনটি দান হল—[i] পৌর আইন, [ii] সর্বজনীন আইন, [iii] প্রাকৃতিক আইন।
[3] রােমান নাগরিকতার তত্ত্ব: রােমান রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ নাগরিকত্বের ধারণাকে সর্বজনীন আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন। রােমান নাগরিকতা তত্ত্বের মূল দুটি নীতি হল- [i] ‘জন্মসূত্রে মানুষ স্বাধীন’, [ii] ‘মানুষে মানুষে সমতার অধিকার হল প্রাকৃতিক অধিকার। রােমান রাষ্ট্রচিন্তাবিদ সিসেরাে বলেছেন, “সমগ্র বিশ্ব হল এমন একটি কমনওয়েলথ, যেখানে সমস্ত মানুষ সমান।” স্টয়িক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রােমান রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ বিশ্বমানবতা তথা সকলের সমতার ধারণা প্রচার করেন।
সমালােচনা: কিছু অসংগতির কারণে রােমান আইনতত্ত্ব সামঞ্জস্যহীন বলে সমালােচিত হয়েছে। রােমান রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ যে বিশ্বজনীন আইনের উল্লেখ করেছেন তার সঙ্গে বাস্তবের খুব একটা মিল নেই। তা ছাড়া মিশ্র শাসনব্যবস্থাও ভ্রান্তিকর, কেন না রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও গণতন্ত্রের মধ্যে মিশ্রণ সম্ভব নয়।
রােমান রাষ্ট্রচিন্তার প্রকৃতি ও গুরুত্ব
[1] প্রকৃতি: রােমান রাষ্ট্রচিন্তায় আইনতত্ত্বের ধারণা মেলে। পাশাপাশি এই রাষ্ট্রচিন্তা মিশ্র শাসনব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক সার্বভৌমিকতারও স্বরূপ উন্মােচন করে। রোমান রাষ্ট্র ধারণায় চুক্তির মাধ্যমে শাসক-শাসিতের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। রােমান রাষ্ট্রচিন্তা অনুসারে রাজতন্ত্রের যুগে রাজা, প্রজাতন্ত্রের যুগে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, সাম্রাজ্যবাদের যুগে সম্রাট তাদের কাজের জন্য জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন।
[2] গুরুত্ব: রাষ্ট্রত্ত্বকে আইনের ধারায় প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল তাদের বড়াে অবদান। আইন, সংবিধান, সরকার এবং শাসননীতি, রাষ্ট্রসমবায়, বিশ্বনাগরিকত্ব, শৃঙ্খলাবাদ, সমাজজীবন সম্পর্কে তারা যে ধারণা দিয়ে গেছেন ব্যাবহারিক রাজনীতির বিকাশে তার গুরত্ব অসীম।
আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ হিসেবে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির ভূমিকা বিশ্লেষণ করাে। তার রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্য ও ত্রূটি-বিচ্যুতি গুলি লেখাে।
সূচনা: ইটালির একজন বিখ্যাত রাষ্ট্রচিন্তাবিদ ছিলেন নিকোলো ডি বার্নাডাে ম্যাকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭ খ্রি.)। আধুনিক রাষ্ট্রতত্ত্বের ভিত নির্মাণের কারণে তাকে ‘আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক’, ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নিউটন’ প্রভৃতি আখ্যা দেওয়া হয়।
ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তা :
[1] রচিত রাষ্ট্রগ্রন্থসমূহ: ম্যাকিয়াভেলি রচিত কয়েকটি গ্রন্থ হল—‘দ্য প্রিন্স’, ‘দ্য ডিসকোর্সেস অন দ্য ফাস্ট ডিকেড অব লিভি’, ‘মান্ট্রোগােলা’, ‘আট অব ওয়ার প্রভৃতি। তবে তার সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাবনার প্রতিফলন মেলে ‘দ্য প্রিন্স’ গ্রন্থে। এই গ্রন্থে ম্যাকিয়াভেলি রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিচালনার বিধিনিষেধগুলি আলােচনা করেছেন।
[2] রাষ্ট্রের শ্রেণিবিভাগ: ম্যাকিয়াভেলি রাষ্ট্র ও সরকারকে রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র এবং নিয়মতান্ত্রিকগণতন্ত্র—এই তিনভাগে ভাগ করেছেন। তিনি ‘দ্য প্রিন্স’ গ্রন্থে রাজতন্ত্র এবং ‘দ্য ডিসকোর্সেস অন দ্য ফাস্ট ডিকেড অব লিভি’ গ্রন্থে প্রজাতন্ত্রের স্বরূপ তুলে ধরেছেন।
[3] রাষ্ট্রচিন্তার গুরুত্ব: আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশে ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রভাবনা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রথমত, তিনিই হলেন প্রথম ইউরােপীয় রাষ্ট্রচিন্তাবিদ, যিনি রাষ্ট্রভাবনাকে ধর্ম ও নীতিশাস্ত্রের কবল থেকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন। দ্বিতীয়ত, তিনিই প্রথম রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার উপাদানগুলিকে বাস্তব তথ্যের কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেওয়ার কথা বলেছেন। তৃতীয়ত, তিনিই প্রথম ক্ষমতা রাজনীতির প্রবক্তা, যা আজও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিভিন্ন রাষ্ট্র অনুসরণ করে চলেছে।
ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্য ও ত্রূটিবিচ্যুতি
[1] বৈশিষ্ট্য: সাধারণভাবে ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তার কিছু বৈশিষ্ট্য হল一
ধ্রুপদি চিন্তায় গুরুত্ব: ম্যাকিয়াভেলি বিশ্বাস করতেন গ্রিস এবং রােমের ধুপদি বা সনাতন ঐতিহ্য ইউরােপে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পারলে মধ্যযুগীয় অসাড় ও স্থবির রাষ্ট্রচিন্তা থেকে ইউরােপ মুক্ত হবে।
আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা প্রবর্তন: তিনিই সর্বপ্রথম রাষ্ট্রচিন্তাক্ষেত্রে আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা পেশ করেন। তিনি বলেন জাতীয় রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সার্বভৌমত্ব।
ধর্ম ও নীতিবােধের মধ্যে পৃথকীকরণ: ম্যাকিয়াভেলি বলেন যে, ব্যক্তিগত নীতিবােধ রাজার ক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয়। রাজাকে ব্যক্তিধর্ম ও নীতিবােধের উর্ধ্বে উঠে কঠোরভাবে শাসন চালাতে হবে।
রাজনৈতিক সমস্যা নির্ধারণ পদ্ধতি: রাজনৈতিক সমস্যাপুলি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ম্যাকিয়াভেলি অভিনব পদ্ধতির উল্লেখ করেছেন一
সদর্থক (Positive): সমকালীন সমাজের ঘটনাবলি থেকে অভিজ্ঞতা অর্জনের উপর গুরুত্ব দেওয়ার কথাবলা হয়েছে।
নঞর্থক (Negative): এটি মূলত ঈশ্বরের অস্তিত্ব, চার্চের একচেটিয়া কর্তৃত্ব এবং প্রাকৃতিক আইনের একাধিপত্য অস্বীকার করাকে বােঝায়।
[2] ত্রূটিবিচ্যুতি: সমালােচকদের দৃষ্টিতে ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তার কিছু ত্রূটিবিচ্যুতি ধরা পড়ে। যেমন- [i] ম্যাকিয়াভেলি সার্বভৌমত্ব, রাজনৈতিক ক্ষমতাতত্ত্ব এবং যুদ্ধনীতি ছাড়া আর অন্য কিছুর ওপর তেমন স্পষ্টভাবে আলােকপাত করেননি। [ii] ম্যাকিয়াভেলির ধারণায় আগে রাষ্ট্রীয় পরে সামাজিক কাঠামাে গঠিত হয়েছে। কিন্তু তার এই ধারণা ভুল, কেন না আগে সমাজ তৈরি হয়েছে, পরে রাষ্ট্রীয় কাঠামাে। [iii] রাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষার জন্য সমস্ত ক্ষমতা রাজার হাতে থাকা উচিত—তার এই ধারণাও ত্রূটিপূর্ণ, কেন-না এক্ষেত্রে প্রজার স্বার্থ লঙ্ঘিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। [iv] সর্বোপরি অভিজ্ঞতার আলােকে তিনি যেভাবে মানবচরিত্রকে শ্রেণিভুক্ত করেছেন, তাও ভ্রান্ত ছিল। তাই অধ্যাপক আ্যালেন বলেছেন “ম্যাকিয়াভেলির মানবপ্রকৃতি সম্পর্কিত ধারণা ছিল ত্রূটিপূর্ণ।”
জাঁ বোঁদা (Jean Bodin)র রাষ্ট্রতত্ত্ব পর্যালােচনা করাে। বোঁদার রাষ্ট্রতত্ত্বের সীমাবদ্ধতা ও গুরুত্ব লেখাে।
সূচনা: ফরাসি রাষ্ট্রচিন্তাবিদ জাঁ বোঁদা (১৫৩০-১৫৯৬ খ্রি.) ছিলেন রাষ্ট্রচিন্তার আকাশে এক জ্বল জ্যোতিষ্ক। ঐতিহাসিক অ্যালেন বলেছেন—“বোঁদা ষােড়শ শতকের ফ্রান্স, তথা সমকালীন বিশ্বের রাজনৈতিক চিন্তাবিদদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন।”
[1] রাষ্ট্রগ্রন্থসমূহ: জঁ বোঁদার রাষ্ট্রচিন্তার ধারণা মেলে যে দুটি গ্রন্থ থেকে সেগুলি হল- [i] মেথড ফর দ্য ইজি কম্প্রিহেনশন অব হিস্ট্রি এবং [ii] ‘সিক্স বুকস্ অব দ্য কমনওয়েলথ। প্রথম বইটিতে রয়েছে মূলত ইতিহাসের ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য আর দ্বিতীয় গ্রন্থটিতেও রয়েছে মূলত রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিষয়ক প্রবন্ধ।
[2] রাষ্ট্রচিন্তার ধারা
রাষ্ট্রের সংজ্ঞা: রাষ্ট্রের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বোদা বলেছেন— কয়েকটি পরিবার ও তাদের যৌথ সম্পত্তির সমন্বয়ে যখন কোনাে আইনসত সরকার সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে, তখন তাকে রাষ্ট্র বলে।
রাষ্ট্রের লক্ষ্য: বোঁদার ধারায় একটি রাষ্ট্র শুধুমাত্র মানুষের বস্তুগত লক্ষই চরিতার্থ করবে না, তার আধ্যাত্মিক প্রয়ােজনও মেটাবে। রাষ্ট্রের দেহ ও আত্মা দুই ই আছে। দেহের প্রয়ােজন জরুরি হলেও আত্মার স্থান তার উর্ধের্ব।
রাষ্ট্রের শ্রেণিবিভাগ: বোদা বলেছেন—সরকার হবে তিন ধরনের যথা রাজতান্ত্রিক, অভিজাততান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক। জাঁ বোঁদার ধারণায় মিশ্র রাষ্ট্র কাম্য নয়, কেন না তা হল নৈরাজ্যেরই নামান্তর। তাঁর মতে প্রশাসন মিশ্র হলেও রাষ্ট্র মিশ্র হতে পারে না।
রাষ্ট্রের কাজ: বোঁদা মনে করেন রাষ্ট্রকে সবার আগে সাধারণের স্বার্থ সুরক্ষিত করতে হবে। মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দান, সম্পত্তি রক্ষপাবেক্ষপ, প্রশাসনের সুষ্ঠু পরিচালনা, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করা ইত্যাদি হল রাষ্ট্রের কাজ।
সার্বভৌমত্ব: বোঁদা বলেছেন রাষ্ট্র চরম সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন- “সার্বভৌমত্ব হল রাষ্ট্রের আদেশ প্রদানকারীর এক চরম ক্ষমতা যা নাগরিক তথা প্রজাদের ওপর ব্যবহার করা হয় এবং আইন দ্বারা যা অনিয়ন্ত্রিত থাকে।”
বিপ্লবতত্ত্ব: জা বোঁদা স্বৈরতন্ত্র যখন রাজতন্ত্রে এবং রাজতন্ত্র যখন অভিজাততন্ত্রে পরিণত হয় সেই আমূল পরিবর্তনই হল বিপ্লব। বিপ্লব দু ধরনের যথা (a) পরিবর্তনমুখা (Alteratio) বিপ্লব, (b) বিরুদ্ধ বা বিপরীতধর্মী (Conversio) বিপ্লব। তিনি বিপ্লবের কারণগুলিকে তিনভাগে ভাগ করেছেন যথা—ঐশ্বরিক, প্রাকৃতিক, মানবিক।
বোঁদার রাষ্ট্রতত্ত্বের সীমাবদ্ধতা ও গুরুত্ব
[1] সীমাবদ্ধতা: বোঁদার রাষ্ট্রচিন্তার কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। প্রথমত, বোদা সমকালীন বুর্জোয়াদের সমর্থনে নিজের রাষ্ট্রচিন্তার ভিত্তি নির্মাণ করেন। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞা দিলেও তিনি তার বিশ্লেষণ করে যাননি। তাঁর সার্বভৌমত্ব তত্ত্ব ঐশ্বরিক এবং স্বাভাবিক আইন দ্বারা সংযত। তৃতীয়ত, রাষ্ট্রের আদর্শ এবং লক্ষ্য সম্পর্কে বোদা সুস্পষ্ট কোনো মতাদর্শ দিয়ে যেতে পারেননি। চতুর্থত, রাষ্ট্রকে শুধুমাত্র পরিবারগুলির সমষ্টি বলে বর্ণনা করে বোঁদা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন।
[2] গুরুত্ব: বোদার রাষ্ট্রতত্ত্বের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও তা একেবারে গুরুত্বহীন নয়৷ রাষ্ট্রের সঙ্গে পরিবারের সম্পর্ক, রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য, রাষ্ট্রের শ্রেণিবিভাগ, নাগরিকতা, সার্বভৌমত্ব, বিপ্লবতত্ত্ব বিষয়ক বোদার চিন্তাধারা আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় নতুন দিশা দেখিয়েছে। তাই অধ্যাপক গেটেল লিখেছেন—“বোঁদার চিন্তাধারা ফ্রান্সের ও ইংল্যান্ডের সমকালীন চিন্তাদর্শনের ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল।”
টমাস হবসের রাষ্ট্রদর্শন আলােচনা করাে। হবসের রাষ্ট্রদর্শনের সীমাবদ্ধতা ও গুরুত্ব লেখাে।
সূচনা: ইংরেজ দার্শনিক টমাস হবস (১৫৮৮-১৬৭৯ খ্রি.) আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। সামাজিক চুক্তি মতবাদের অন্যতম সার্থক প্রবক্তা ছিলেন তিনি। তিনি বলেন”রাষ্ট্র হল যন্ত্র এবং রাষ্ট্রে বসবাসকারীরা নিয়মশৃঙ্খলায় আবদ্ধ।” যন্ত্রের গতি নিয়ে রাষ্ট্র চলমান আর তার সঙ্গে সঙ্গে চলমান মানুষ এবং তার কর্মকাণ্ড।
[1] রচিত রাষ্ট্রগ্রন্থসমূহ: হবসের লেখা সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থটি হল লেভিয়াথান (Leviathan), যা তিনি ফ্রান্সে নির্বাসনে থাকাকালীন রচনা করেছিলেন। এছাড়াও তার উল্লেখযোগ্য আরও দুটিগ্রন্থ ছিল- ডিকরপােরে (De corpore) এবং ডি হােমাইন (De Homine)। লেভিয়াথান গ্রল্থে হবসের রাষ্ট্রচিন্তার বিশদ বিবরণ রয়েছে।
[2] রাষ্ট্রচিন্তার ধারা
সামাজিক চুক্তি মতবাদ
মূল বক্তব্য: হবসের ধারণায় সামাজিক চুক্তির মধ্যে দিয়েই রাষ্ট্র নামে যন্ত্রের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন সমাজ গড়ে ওঠার আগে মানুষ প্রকৃতির কোলে জীবন কাটাত। কিন্তু প্রকৃতির রাজ্যের অনিশ্চয়তা এবং দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় মানুষ চুক্তির দ্বারা সমাজ গঠন করল। যাবতীয় প্রাকৃতিক অধিকার সার্বভৌম শাসকের হাতে অর্পণ করল।
প্রকৃতির রাজ্য: হবসের সামাজিক চুক্তি মতবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল প্রকৃতির রাজ্য (State nature)। হবসের ধারণায় সমাজ গঠনের আগে মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে বসবাস করত। প্রকৃতির এই রাজ্য ছিল ভয়াবহ এবং অসহনীয়। এই প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত থাকত। বলবান দুর্বলদের পরাজিত করত।
প্রাকৃতিক আইন: হবসের ধারণায় এই প্রকৃতির রাজ্যে সংঘাতপূর্ণ জীবনের জন্য প্রাকৃতিক আইনের প্রয়ােজন। হবসের মতে, প্রাকৃতিক আইন হল পারস্পরিক বিবেচনাপ্রসূত স্বাভাবিক কিছু পরামর্শ। অসহনীয় জীবনযাপন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে পারস্পরিক বিবেচনার মাধ্যমে মানুষ কিছু আইন তৈরি করে।
সার্বভৌমিক তত্ত্ব: হবসের ধারণায় সার্বভৌম ক্ষমতা হল, মানুষের এমন এক চূড়ান্ত ক্ষমতা, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষরাষ্ট্রের এবং জনসাধারণের নিরাপত্তারক্ষা করেন। সার্বভৌমত্বের প্রধান উদ্দেশ্য হল—জনস্বার্থ রক্ষা করা।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ: হবসের চিন্তায় ব্যক্তি তার নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সদা সচেষ্ট। রাষ্ট্র ব্যক্তির জন্য সৃষ্টি হয়েছে। ব্যক্তি রাষ্ট্রের জন্য নয়|ব্যক্তির নিরাপত্তা ও মঙ্গল সাধনই রাষ্ট্রের অন্যতম উদ্দেশ্য।
হবসের রাষ্ট্রদর্শনের সীমাবদ্ধতা ও গুরুত্ব
[1] সীমাবদ্ধতা: পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তাবিদ ভন, মারে, গেটেল প্রমুখ হবসকে রক্ষণশীল, যান্ত্রিক, গণতন্ত্র বিরােধী তত্ত্বের রূপকার বলেছেন। হবসের রাষ্ট্রতত্ত্বের সামাজিক চুক্তি ভ্রান্ত এবং তার প্রকৃতির রাজ্যতত্ত্ব কাল্পনিক। কেননা হবসের চুক্তিতত্ত্বে চুক্তি সম্পাদনকারী শুধুমাত্র একটি পক্ষ আছে, তা হল সাধারণ মানুষ বা জনসাধারণ। এতে শাসক বা অন্য কোনাে পক্ষ নেই। কিন্তু বাস্তবে চুক্তি হয় দুই বা ততােধিক পক্ষের মধ্যে। তাই হবসের এই চুক্তিতত্ত্ব অবাস্তব।
[2] গুরুত্ব: টমাস হবস ঐশ্বরিক তত্ত্বকে অস্বীকার করে রাষ্ট্রকে মানবিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়ে গেছেন হবস। তাই লিও স্ট্রস হর্সকে “The originator of modern political philosophy” বলে উল্লেখ করেছেন।
জন লকের রাষ্ট্রচিন্তার পরিচয় দাও এবং রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে লকের অবদান লেখাে।
সূচনা: আধুনিক বস্তুনিষ্ঠ ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রতত্ব পূর্ণতা পায় ব্রিটিশ রাষ্ট্রচিন্তাবিদ জন লকের রচনাগুলির মধ্যে। তিনি ছিলেন উদারনীতিবাদের জন্মদাতা তথা সার্থক প্রবত্তা।
[1] রাষ্ট্রদর্শ: সমকালীন ইংল্যান্ডের সমাজজীবনের প্রেক্ষিতেই গড়ে উঠেছিল লকের রাষ্ট্রদর্শন। লকের রাষ্ট্রাদর্শের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিষয় ছিল—অভিজ্ঞতাবাদ, প্রকৃতির রাজ্য, প্রাকৃতিক আইন ও প্রাকৃতিক অধিকার, সামাজিক চুক্তি, সম্পত্তি তত্ত্ব প্রভৃতি৷
[2] রচনাসমূহ: ‘টু ট্রিটিজেস্ অফ গভর্নমেন্ট (1690 খ্রি.)। প্রন্থে লক রাষ্ট্র ভাবনার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর লেখা অন্যান্য কয়েকটি গ্রন্থ হল—‘কনসার্নিং হিউম্যান আন্ডারস্ট্যান্ডিং, ‘হিস লেটারস্ অন টলারেন্স প্রভৃতি।
[3] গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বের ব্যাখ্যা
সামাজিক চুক্তি: জন লক বলেছেন প্রকৃতির রাজ্যে প্রতিটি ব্যক্তি প্রত্যেকের সঙ্গে চুক্তি করে এই রাষ্ট্রসমাজ গড়ে তুলেছে। এই চুক্তির উদ্দেশ্য হল জীবন, স্বাধীনতা এবং সম্পত্তির অধিকারকে রক্ষা করা।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ: জন লক ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। ক্ষমতার ভিত্তিতে তিনি সরকারকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন যথা—আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ এবং ফেডারেটিভ (Federative) বিভাগ। তিনি মনে করতেন সরকারের এই তিনটি বিভাগকে আলাদা করে দিলে স্বেচ্ছাচারিতার সুযােগ থাকবে না।
প্রকৃতির রাজ্য: প্রকৃতির রাজ্য প্রাকৃতিক আইন দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় প্রত্যেকে সমান অধিকার ও স্বাধীনতা ভােগ করে। লক প্রকৃতির রাজ্যকে এক শান্তির রাজ্য হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যেখানে মানুষ পারস্পরিক সহযােগিতার মধ্যে দিয়ে বাস করত।
অভিজ্ঞতাবাদ: লক বলেন যে জগৎ সংসারে সমস্ত কিছুকেই অভিজ্ঞতার আলােকে বিচার করা উচিত। লকের ধারণায় জন্মানাের পর প্রথমে মানুষের মন থাকে সাদা কাগজের মতাে, যাতে কোনাে দাগ থাকে না। কিন্তু যতদিন যায় মানুষ অভিজ্ঞতা লাভ করে, যা তার চিন্তা ও জ্ঞানের জগতের প্রসার ঘটায়।
প্রাকৃতিক আইন ও অধিকার: লক বলেছেন প্রকৃতির রাজ্য পরিচালনা করত প্রাকৃতিক আইন। এই প্রাকৃতিক আইন ছিল বলেই কেউ কারও জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারত না। লকের ধারণায় এই প্রাকৃতিক আইন ছিল সর্বজনীন।
সম্পত্তি তত্ত্ব: লকের ধারণায় সম্পত্তির অধিকারের মধ্যেই রয়েছে মানুষের জীবন ও স্বাধীনতার অধিকার। লক বলেছেন সমস্ত মানুষ প্রকৃতিগতভাবে সমান প্রাকৃতিক সম্পদ ভােগ করার অধিকারী।
সমালােচনা: লকের রাষ্ট্রচিন্তা সমালােচনার উর্বে ছিল না। প্রথমত, লকের বেশ কয়েকটি তত্ত্বে স্ববিরোধিতা লক্ষ করা যায়। লক একদিকে আইনসভা অপরদিকে রাষ্ট্রসমাজকে চরম ক্ষমতার আধার বলে উল্লেখ করছেন। আবার কখনও বা রাজাকে ক্ষমতার বিশেষ অধিকারী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। দ্বিতীয়ত, লক শ্রমজীবীদের ওপর মালিকপক্ষের শােষণগত ভুমিকাকে তিনি এড়িয়ে গেছেন। তৃতীয়ত, লক তার রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে যুক্তিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের মধ্যে মিলন ঘটাতে চেয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব নয়।
জন লকের অবদান
[1] প্রাকৃত অধিকার তত্ত্ব: তিনিই প্রথম স্পষ্টভাষায় বলেন জীবন, স্বাধীনতা এবং সম্পত্তির অধিকার হল মানুষের স্বাভাবিক বা প্রাকৃত অধিকার।
[2] ক্ষমতা-পৃথকীকরণ তত্ত্ব: লকই প্রথম স্পষ্টভাবে ক্ষমতা বিভাজন নীতির ব্যাখা দেন।
[3] ঐশ্বরিক অধিকার তত্ত্বের বিরোধিতা: ঐশ্বরিক তত্ত্বের বিরােধিতা করে লক বলেন—রাষ্ট্র হল মানবীয় প্রতিষ্ঠান, কোনাে ঐশ্বরিক প্রতিষ্ঠান নয়।
[4] বিপ্লবের তত্ত্ব: বিপ্লবের তত্ত্বে লক স্বৈরাচারিতার অবসানের ক্ষমতা জনগণের হাতে দেন। তার এই তত্ত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রে অনুসৃত হয়।
রুশাের রাষ্ট্রদর্শনের সংক্ষিপ্ত ধারণা দাও।
সূচনা: রাষ্ট্রচিন্তার জগতে এক অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব হলেন ফরাসি চিন্তাবিদ জঁ-জাক রুসো রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে রুশাের স্থান নির্ণয় করতে গিয়ে অধ্যাপক হানশ বলেছেন- “রাজনৈতিক আদর্শবাদীদের মধ্যে রুশাে উচ্চ স্থানের অধিকারী”
[1] রাষ্ট্রদর্শ: রুশাের রাষ্ট্রাদর্শের মূল তিনটি বিষয় হল প্রকৃতির রাজ্য (State of Nature), সামাজিক চুক্তি (The Social Contract), সাধারণ ইচ্ছা (General Will)। রুশাের রাষ্ট্রদর্শে গণতন্ত্র ও সাম্যের প্রতিফলন মেলে।
[2] রচনাসমূহ: রুশো রচিত উল্লেখযােগ্য তিনটি গ্রস্থ হল- আ ডিসকোর্স অন দ্য মরাল এফেক্টস অব আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সস’, ‘আ ডিসকোর্স অন দি অরিজিন অব ইন ইকুয়ালিটি’, ‘দ্য সােশ্যাল কন্ট্রাক্ট।
[3] গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বের ব্যাখ্যা
প্রকৃতির রাজ্য: বুলশাের ধারণায় প্রকৃতির রাজ্য ছিল ভূস্বর্গ (Earthly Heaven) সম, যেখানে মানুষের মধ্যে মধুর ও আন্তরিক সম্পর্ক, সুখ-শান্তি বজায় ছিল। রুশাে বলেছেন— “মানুষের মধ্যে চিন্তা ও বিচারশক্তির উন্মেষ ঘটলে পারস্পরিক ভেদাভেদ গড়ে ওঠে ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব ঘটে। ফলে প্রকৃতির রাজ্যের যাবতীয় সুখশান্তির অবসান হয়।”
সামাজিক চুক্তি মতবাদ: প্রকৃতির রাজ্যে ঘনিয়ে ওঠা অশান্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে মানুষ এক চুক্তি সম্পাদন করে। এই চুক্তির মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠে রাজনৈতিক বা পৌরসমাজারুশাের ধারণায় এই চুক্তিই হল সামাজিক চুক্তি। ‘সামাজিক চুক্তি (The Social Contract) গ্রন্থের প্রথম খন্ডে রুশাে লিখেছেন”মানুষ স্বাধীনভাবে জন্মায়, কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলাবদ্ধ”।
সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব: রুশাের সামাজিক চুক্তি মতবাদের প্রধান অঙ্গ হল—সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব। সামাজিক চুক্তির মধ্যে দিয়ে যে মিলিত শক্তি গড়ে ওঠে তা হল সাধারণ ইচ্ছা। ব্লুশাের ধারপায় ব্যক্তি মানুষের ইচ্ছা দু-ধরনের একটি হল প্রকৃত ইচ্ছা, অপরটি হল বাস্তব ইচ্ছা। রুশোর মতে, সাধারণ ইচ্ছা হল প্রকৃত ইচ্ছাগুলির গুণফল।
মন্তেস্কুর রাষ্ট্রদর্শন
ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম মানবতাবাদী রাষ্ট্রচিন্তাবিদ হলেন চার্লস লুই দ্য মন্তেষ্কু (১৬৮৯-১৭৫৫ খ্রি.)। তিনিই প্রথম রাষ্ট্রচিন্তাবিদ যিনি সমাজবিজ্ঞানী হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেছেন।
[1] রাষ্ট্রদর্শ: মন্তেঙ্কুর রাষ্ট্রাদর্শের মূল কয়েকটি বিষয় ছিল রাষ্ট্রতত্ত্ব, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি, আইনের ধারণা, স্বাধীনতার তত্ত্ব প্রভৃতি।
[2] রচনাসমূহ: মন্তেস্কু রচিত উল্লেখযােগ্য কয়েকটি গ্রন্থ হল—‘দ্য পারসিয়ান লেটারস’, ‘গ্রেটনেস অ্যান্ড ডেকলাইন অফ দ্য রােমানস’, ‘স্পিরিট অফ দ্য লজ’ প্রভৃতি।
[3] রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণা: মন্তেস্কুর ধারণায় রাষ্ট্র একটি আইনসম্মত সংগঠন। তার চিন্তায় রাষ্ট্রের কাজ হল ব্যক্তির নৈতিক জীবনের চলার পথের বাধাগুলিকে দূর করে তাদের মঙ্গলসাধনে ব্রতী হওয়া। মন্তেন্ধু তিন ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থার উল্লেখ করেছেন, যথা—
প্রজাতন্ত্র: প্রজাসাধারণের হাতে যেখানে সমস্ত ক্ষমতা থাকে, তা হল প্রজাতন্ত্র।
রাজতন্ত্র: নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত আিন মেনে রাজা তার অধীনস্থ কর্মচারীদের নিয়ে যে শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করেন, তা হল রাজতন্ত্র।
স্বৈরতন্ত্র: আইনের তােয়াক্কা না করে, কোনাে একজন ব্যক্তি নিজের খেয়ালখুশিমতাে যে শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন, তা হল স্বৈরতন্ত্র।
[4] মন্তেস্কুর রাষ্ট্রতত্ত্ব:
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি: মন্তেস্কুর ধারণায় আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ (প্রশাসন) এবং বিচার বিভাগকে আলাদা করে দেওয়া উচিত। তিনি মনে করতেন এই তিনটি বিভাগের ক্ষমতা কোনাে একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে কেন্দ্রীভূত হলে সাম্য ও স্বাধীনতা বিঘ্নিত হবে। মন্তেষ্কু বলেন- “পৃথিবীতে যত অশান্তি ও নিপীড়ন বা শােষণের ঘটনা রয়েছে তার মূলে আছে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন।”
আইনের ধারণা: মন্তেস্কু মনে করতেন সমস্ত বস্তুরই নিজ নিজ আইন রয়েছে। দেবতাকুল, মনুষ্য জগৎ এমনকি পশুদেরও নিজস্ব আইন রয়েছে। তার ধারণায় যেখানেই সম্পর্ক রয়েছে সেখানেই আইন রয়েছে। সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইনের প্রয়ােজন।
স্বাধীনতার তত্ত্ব: মন্তেন্ধুর স্বাধীনতা সম্পর্কিত ধারণা রয়েছে ‘দ্য স্পিরিট অফ লজ’ গ্রন্থে। মন্তেষ্কুর ধারণায় চরম বা অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা স্বাধীনতার পরিপন্থী। মন্তেষ্কু মূলত স্বাধীনতা বলতে রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে বােঝাতে চেয়েছেন।
পারসিক শাসনব্যবস্থার অঙ্গ হিসেবে স্যাট্রাপদের পরিচয় দাও এবং স্যাট্রাপির গঠনকাঠামাে উল্লেখ করাে।
সূচনা: পারস্যের আকিমেনীয় সাম্রাজ্য বৃহৎ ও ক্ষুদ্র কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল যেগুলির নাম ছিল স্যাট্রাপি। স্যাট্রাপিল্লুলির শাসনকতা ছিলেন স্যাট্রাপ, যারা রাজার কাছে প্রত্যক্ষভাবে দায়বদ্ধ ছিলেন।
[1] অর্থ: প্রাচীন পারসিক অর্থে স্যাট্রাপ বলতে সাম্রাজ্যের রক্ষাকর্তাকে বােঝাত। এক কথায়, আকিমেনীয় সাম্রাজ্যের একটি প্রশাসনিক বিভাগ ছিল স্যাট্রাপি আর এই বিভাগের প্রধান ছিলেন স্যাট্রাপ।
[2] উৎস: ‘Satrap’ শব্দটির উদ্ভব ঘটেছে গ্রিক শব্দ ‘Satrapeia’ থেকে। Satrapy শব্দটির আভিধানিক অর্থ হল প্রাচীন পারস্যের প্রদেশ। আর Satrap শব্দের আভিধানিক অর্থ হল প্রাচীন পারস্যের প্রাদেশিক শাসনকর্তা।
[3] আত্মপ্রকাশ: বিভিন্ন জাতিগােষ্ঠী অধ্যুষিত আকিমেনীয় সাম্রাজ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করার প্রয়ােজনীয়তা থেকেই পারসিক সম্রাট কাইরাস আনুমানিক ৫৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্যের আকিমেনীয় সাম্রাজ্যে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালু করেন। ফলে প্রদেশ বা সাট্র্যাপিগুলিতে স্যাট্রাপদের নিয়ােগ করা শুরু হয়।
[4] কার্যাবলি: স্যাট্রাপির প্রধান শাসনকর্তা হিসেবে স্যাট্রাপদের বেশকিছু কাজ করতে হত। যেমন一
কর আদায় ও জমা: ট্যাক্স আদায় করা ও তা সরকারি কোশাগারে জমা দেওয়া।
সেনা নিয়ােগ: যুদ্ধে পারদর্শী ব্যক্তিকে সেনাবাহিনীতে নিয়ােগ করা।
আমলা নিয়ােগ: আঞ্চলিক প্রশাসনিক স্তরে আমলাদের নিয়ােগ করা।
বিদ্রোহ দমন: অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহগুলির অবসান ঘটানাে।
সমস্যার মােকাবিলা: প্রদেশগ্লুলির বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বা নানাবিধ সমস্যার মােকাবিলা করা।
বৈদেশিক আক্রমণ রোধ: বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরােধ করা।
সমরবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ: সামরিক শক্তির রক্ষণাবেক্ষণ করা।
বিচারকাজ: স্যাট্রাপ ছিলেন প্রদেশের বিচার বিভাগের প্রধান। পৌর এবং ফৌজদারি অপরাধের তিনি বিচার করতেন।
বাৎসরিক খতিয়ান পেশ: সঠিক সময়ে খতিয়ান পেশ-এ ব্যর্থ হলে স্যাট্রাপদের মহান রাজা প্রথমে সতর্ক করতেন এবং পরে তার পদ কেড়ে নিতেন।
[5] স্যাট্রাপের সঙ্গে সম্রাটের সম্পর্ক
দায়বদ্ধতার: পারস্যের বিভিন্ন প্রদেশে নিয়ােজিত। স্যাট্রাপগণ ছিলেন মূলত সম্রাটের প্রতিনিধি। তারা নিজেদের কাজের জন্য সম্রাটের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন।
কর্তব্যগত: স্যাট্রাপদের প্রদেশগুলিতে বিভিন্ন কর্তব্য পালন করতে হত। যেমন কর আদায় ও জমা, বিদ্রোহ দমন, বাৎসরিক খতিয়ান পেশ প্রভৃতি।
প্রতিনিধিত্বগত: সামরিক শক্তি প্রদর্শন এবং রাজকীয় কর্তৃত্ব পালনের মধ্যে দিয়েই তারা নিজেদেরকে সম্রাটের সফল প্রতিনিধি হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন।
নিয়ােগ ও পদচ্যুতিগত: নিয়ােগ থেকে শুরু করে পদচ্যুতি পর্যন্ত স্যাট্রাপদের ভাগ্য নির্ভরশীল ছিল সম্রাটের ওপর। দায়িত্বে অবহেলা দেখালে তারা সম্রাট কর্তৃক স্যাট্রাপগপ পদচ্যুত হতেন।
[6] স্যাট্রাপগুলির বিদ্রোহ: পরবর্তী সময়ে পারস্যের কেন্দ্রীয় শাসন দুর্বল হয়ে পড়লে সেই সুযােগে বিভিন্ন পারসিক স্যাট্রাপির শাসক স্যাট্রাপগণ স্বাধীনতাকামী হয়ে ওঠেন। পারসিক সম্রাট দ্বিতীয় ফিলিপ ও তৃতীয় আলেকজান্ডারের শাসনকালে এশিয়া মাইনর ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে স্যাট্রাপগণ বিদ্রোহ ঘােষণা করেন।
স্যাট্রাপির গঠনকাঠামাে
সমগ্র আকিমেনীয় সাম্রাজ্যটি বেশ কয়েকটি বৃহৎ স্যাট্রাপিতে বিভক্ত ছিল। এই বৃহৎ স্যাট্রাপিগুলি আবার কয়েকটি মুখ্যকেন্দ্রীয় এবং ক্ষুদ্র স্যাট্রাপিতে বিভক্ত ছিল।
[1] বৃহৎ স্যাট্রাপি: কয়েকটি বৃহৎ স্যাট্রাপি ছিল [i] পারসা/পারসিস, [ii] মাডা/মিডিয়া, [iii] পার্ডা/লিডিয়া, [iv] ব্যাবিরাস/ব্যাবিলনিয়া, [v] মুদ্রায়া/ইজিপ্ট, [vi] আরাকোসিয়া, [vii] ব্যাক্টিস/ব্যাকট্রিয়া ইত্যাদি।
[2] কেন্দ্রীয় ক্ষুদ্র স্যাট্রাপি: কয়েকটি কেন্দ্রীয় ক্ষুদ্র স্যাট্রাপি ছিলপার্থিয়া, আরমেনিয়া, কাপাডােসিয়া, লিভিয়া, আসিরিয়া, নিম্ন ইজিপ্ট, হারভাসিয়া, স্যাট্রাজিডিয়া ইত্যাদি।
[3] ক্ষুদ্র স্যাট্রাপি: কয়েকটি ক্ষুদ্র স্যাট্রাপি ছিলপ্যারাট্যাসিন, হিরকানিয়া, কোলচিস, সিরিয়া, সিটামিন, আরবেলিটিস, কারিয়া, ফ্রিজিয়া, ওরিটা, অ্যারিয়াসপে ইত্যাদি।
চিনের ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার পরিচয় দাও। চিনের ম্যান্ডারিনদের কার্যাবলি ও গুরুত্ব উল্লেখ করাে।
সূচনা: ম্যান্ডারিনরা ছিলেন সাম্রাজ্যবাদী চিনের আমলা। চিনা শাসনতন্ত্রে এদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে তারা সম্রাটের সহযােগী ছিলেন।
[1] ম্যান্ডারিনদের যোগ্যতা: চিনা উচ্চপদস্থ আমলা অর্থাৎ ম্যান্ডারিনদের বেশ কিছু যােগ্যতার অধিকারী হতে হত।
প্রশাসনিক দক্ষতা: ম্যান্ডারিন পদপ্রার্থীকে প্রশাসনের কাজ চালানাের মতাে দক্ষতা দেখাতে হত।
শিক্ষাদীক্ষা: নিয়ােগের আগে ম্যান্ডারিন পদপ্রার্থীর শিক্ষাদীক্ষা বিচার করা হত।
রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা: প্রার্থী ইতিপূর্বে স্থানীয় বা প্রাদেশিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কার্যাবলির সঙ্গে যুক্ত থেকে কোনাে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন কি না তাও দেখা হত।
ধ্রুপদি চিনের ঐতিহ্যের ধারণা: ম্যান্ডারিন পদপ্রার্থীর ধ্রুপদি চিনের ঐতিহ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার ছিল।
অন্যান্য যােগ্যতা: জেলখাটা আসামি, শ্রমিক, অভিনেতা, গায়ক, পাহারাদার, ক্রীতদাস, ভিক্ষুক প্রমুখ ম্যান্ডারিন পদপ্রার্থী হতে পারতেন না।
[2] নিয়ােগ ও পদচ্যুতি: ম্যান্ডারিন পদপ্রার্থীদের নিয়ােগ করার আগে যােগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষা নেওয়া হত। এই পরীক্ষায় কনফুসীও আদর্শ, তাওবাদ, সাহিত্য, কাব্য, সাধারণজ্ঞান, রাজনীতি এবং ধ্রুপদি চিনের ঐতিহ্য সম্পর্কে প্রশ্ন রাখা হত। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের প্রথমে স্থানীয়, প্রাদেশিক বা কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী হিসেবে নিয়ােগ করা হত। সাধারণত ম্যান্ডারিনদের একই জায়গায় দীর্ঘদিন না রেখে বিভিন্ন জায়গায় বদলি করে দেওয়া হত। ম্যান্ডারিনরা তাদের কাজে অবহেলা দেখালে বা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লে বা সাম্রাজ্য বিরােধী কাজে লিপ্ত হলে প্রমাণ সাপেক্ষে তারা সম্রাট কর্তৃক পদচ্যুত হতেন।
[3] মর্যাদা ও বেশভূষা: চিনের সমাজে উচ্চস্তরের ম্যান্ডারিনগণ যথেষ্ট সম্মানের অধিকারী ছিলেন। বিশেষত চিনের কিং বংশের রাজাদের আমলে চিনের সমাজে রাজপরিবার ও প্রধানমন্ত্রীর পরেই মর্যাদা ভােগ করতেন। উচ্চস্তরের ম্যান্ডারিনগণ উচ্চস্তরের ম্যান্ডারিনগণ মূল্যবান ধাতুর অলংকারযুক্ত ও রত্নখচিত পােশাক পরতেন। তারা দামি পদ্মরাগমণিযুক্ত টুপি মাথায় দিতেন। মধ্য ও নিম্ন স্তরের ম্যান্ডারিনগণও যথেষ্ট ব্যয়বহুল জীবন যাপন করতেন। তারাও জমকালাে পােশাক পরতেন এবং প্রবাল, লাপিস- লাজুলি, সােনা, রুপা প্রভৃতি রত্নখচিত টুপি মাথায় দিতেন।
[4] অবসান: উনিশ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষাধারার অনুপ্রবেশ ঘটলে চিনে ম্যান্ডারিনদের নিয়ােগ পরীক্ষা পদ্ধতি তুলে দেওয়া হয় (১৯০৫ খ্রি.)। চিনে কিং রাজবংশের পতন ঘটার (১৯১১ খ্রি.) পর সামগ্রিকভাবে ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার অবলুপ্তি ঘটে।
ম্যান্ডারিনদের কার্যাবলি ও গুরুত্ব
[1] কার্যাবলি: চিনের কেন্দ্রীয় সরকারের মুখ্যসচিবালয়ের অধীনে ম্যান্ডারিনদের একাধিক কাজ করতে হত। যেমন-
প্রশাসন পরিচালনায় সাহায্য: চিনের ম্যান্ডারিনরা প্রশাসনের উধর্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মেনে যাবতীয় কাজ পরিচালনা করতেন।
রাজকার্যে সাহায্য: সর্বোচ্চ স্তরের ম্যান্ডারিনগণ যেহেতু চিনা সম্রাটের প্রধানমন্ত্রীর সমগােত্রীয় ছিলেন, তাই তারা প্রত্যক্ষভাবে রাজাকে সহায়তা করার সুযােগ পেতেন।
সাম্রাজ্যে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা: মধ্যে ও নিম্ন স্তরের ম্যান্ডারিনগণ প্রদেশ বা স্থানীয় অঞ্চলগুলিতে শান্তিগৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রয়ােজনীয় উদ্যোগ নিতেন।
অন্যান্য কাজ: ম্যান্ডারিনরা ব্যাবসা বানিজ্যে তদারকি করা, আর্থিক ক্ষেত্রে সচলতা রক্ষা করা, সাহিত্য-সংস্কৃতির দিকটি দেখাশােনা করা প্রভৃতি কাজও করতেন।
[2] গুরুত্ব
প্রশাসনিক: চিনের প্রশাসনিক সাফল্য ম্যান্ডারিন ব্যবস্থার ওপরে অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিল।
সাম্রাজ্যের যুগের স্থায়িত্ব বৃদ্ধিতে: চিনের সাম্রাজ্যের যুগের স্থায়িত্ব বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন ম্যান্ডারিনগণ। খ্রিস্টপূর্ব একবিংশ শতক থেকে সিয়া রাজবংশের মাধ্যমে চিনে যে রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু হয়েছিল তাকে দীর্ঘস্থায়ী করার ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে ম্যান্ডারিন ব্যবস্থা বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল।
জেন্ট্রি সম্প্রদায়ের উত্থানে: চিনের সমাজে ম্যান্ডারিনগণ বিশেষ সুবিধাভােগী এবং বিশিষ্ট সম্প্রদায় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এই ম্যান্ডারিনদের থেকেই পরবর্তীকালে চিনে জেন্ট্রি সম্প্রদায়ের উত্থান ঘটেছিল।
দিল্লির সুলতানি আমলে ইকাদারদের পরিচালনাধীন ইক্তা প্রথার বিবরণ দাও। ইক্তা প্রথার বিবর্তন ও ফলাফল উল্লেখ করাে।
সূচনা: দিল্লির সুলতানি শাসনকালে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল ইত্তাদারদের দ্বারা পরিচালিত ইক্তা প্রথা। ইক্তা গ্রহণকারীরা মাকৃতি বা ইত্তাদার নামে পরিচিত ছিল।
[1] অর্থ: ‘ইক্তা’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল একটি অংশ বা এলাকা। রাজস্ব ব্যবস্থার বিচারে ইক্তা শব্দের সহজ অর্থ হল ভূমি থেকে উৎপাদিত শস্যের ওপর বিশেষ কোনাে ব্যক্তিবর্গকে সরকার কর্তৃক অধিকারদান।
[2] প্রবর্তন: কে. এম. আশরফের ধারণায় সম্ভবত খলিফা মুক্তাদি ইত্তা ব্যবস্থার উদ্ভাবন ঘটান। একাদশ শতকে নিজাম-উল-তুসি নামে এক সেলজুক তুর্কি ঐতিহাসিক তাঁর সিয়াসৎ নামা’ গ্রন্থে ইক্তা প্রথার প্রচলনের কথা উল্লেখ করেন। ভারতে ত্রয়ােদশ শতকের সূচনা পর্বে দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিস ইকা প্রথার প্রবর্তন করেন।
[3] উদ্দেশ্য: ইক্তা ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে দিল্লির সুলতানরা কয়েকটি উদ্দেশ্য পূরণ করতে চেয়েছিলেন। যেমন—[i] সুলতানগণ ইত্তা প্রদানের মধ্যে দিয়ে আসলে আমির-ওমরাহদেরই সন্তুষ্ট করতে চেয়েছিলেন। [ii] সুলতানি সাম্রাজ্যসীমা উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় দূরবর্তী অঞ্চল গুলির ওপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ এবং যােগাযােগে অসুবিধা দেখা দেয়। ইক্তাদারদের নিয়ােগের মধ্যে দিয়ে এই অসুবিধা দূর করার চেষ্টা শুরু হয়। [iii] নতুন নতুন বিজিত অঞ্চলগুলি থেকে রাজস্ব আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এই অনিশ্চয়তা দূরীকরণের লক্ষ্যে ইক্তাদারদের নিয়োগ করা হয়। [iv] দিল্লি সুলতানিকে সুরক্ষিত ও দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য সামন্ততন্ত্রের ধ্বংসসাধন প্রয়ােজন ছিল।
[4] বৈশিষ্ট্য: ইক্তা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলি ছিল—[i] ইক্তা গ্রহীতাগণ পরিচিত ছিলেন মাকৃতি বা মুক্তি বা ইক্তাদার নামে। [i] ইক্তাদাররা কৃষকদের কাছ থেকে নিয়মিত রাজস্ব আদায় করতেন। [i] রাজস্ব পরিশােধকারী প্রজাদের জীবন, সম্পত্তি ও পরিবারের ওপর ইক্তাদারদের কোনো অধিকার ছিল না। [iv] ইক্তাদারদের নিজস্ব সেনাবাহিনী রাখতে হত। প্রয়োজনে সুলতানকে সেই সেনা সরবরাহ করতে হত।
ইক্তা প্রথার বিবর্তন ও ফলাফল
[1] বিবর্তন
ইলতুৎমিসের আমলে: ইক্তা প্রথা প্রবর্তনের পর সুলতান ইলতুৎমিস তাকে এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে উদ্যোগী হন। কোনাে ইক্তার ওপর বংশানুক্রমিক অধিকার যাতে গড়ে না ওঠে, তার জন্য তিনি ইক্তাদারদের বদলির নীতি নেন।
বলবনের আমলে: যে সমস্ত ইক্তাদার ভাতা ও জমি ভােগদখল করলেও প্রয়ােজনের সময় সামরিক সাহায্য দিতেন না, বলবন তাদের তালিকা তৈরি করান। ইক্তাদাররা যাতে সুলতানের প্রাপ্য রাজস্ব ফাঁকি দিতে না পারে, তার জন্য বলবন প্রতিটি ইক্তায় খােয়াজা নামে এক ধরনের হিসাবপরীক্ষক নিয়ােগ করেন।
আলাউদ্দিন খলজির আমলে: আলাউদ্দিন খলজি সেনাদের ইক্তাদানের পরিবর্তে নগদ বেতন দানের প্রথা চালু করেন।
ফিরােজশাহ তুঘলকের আমলে: ফিরােজশাহ তুঘলক ব্যাপকভাবে ইক্তা বিতরণ করলে খালিসা জমির পরিমাপ কমে। তিনি ইক্তা ব্যবস্থাকে বংশানুক্রমিক করে দেন। সেনাদলকে নগদ বেতনের পরিবর্তে ইক্তা দানের রীতি পুনঃপ্রবর্তিত হয়।
[2] ফলাফল:
শহরের শ্রীবৃদ্ধি: ইক্তাদারদের অনেকেই তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ শহরে ব্যাবসাবাণিজ্যে বিনিয়ােগ করত। ব্যাবসাবাণিজ্যের সুবাদে শহরের অর্থনীতি সুদৃঢ় হলে, শহরগুলির শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে থাকে।
কৃষক শ্রেণির দুর্দশা বৃদ্ধি: অনেকসময় অতিরিক্ত অর্থের লােভে ইক্তাদাররা নিজের নির্দিষ্ট ইত্তাটি অপরকে ইজারা দিত। ইজারাদাররা অধিক মুনাফার লক্ষ্যে কৃষক সমাজের ওপর আর্থিক শােষণ চালাত।
পূর্ববর্তী শাসকদের মর্যাদা হ্রাস: ইক্তা ব্যবস্থা পূর্ববর্তী গ্রামীণ শাসকশ্রেণির সামাজিক মর্যাদা হ্রাস করে। তাই গ্রামের নিম্নতর অভিজাতরা কৃষক বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয়।
মােগল প্রশাসনের অঙ্গ হিসেবে মনসবদারদের পরিচালনাধীন মনসবদারি ব্যবস্থার বর্ণনা দাও।
সূচনা: আকবর মােগলপ্রশাসনের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবেতিনি ভারতে প্রথম মনসবদারি প্রথা চালু করেন (১৫৫৭ খরি.)।সামরিক অসামরিক যে-কোনাে কর্মচারী মনসবদার হতে পারতেন।
[1] অর্থ: ‘মনসব’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ “পদমর্যাদা’, মতভেদে উচ্চপদ বা অবস্থান। এই অর্থে মনসবদার হলেন প্রশাসনের উচ্চপদাধিকারী। মােগল যুগে ‘মনসব’ শব্দটি একটি পদকে বােঝাত। ধীরে ধীরে এই পদের সঙ্গে দায়িত্ব, মর্যাদা প্রভৃতি যােগ হয়।
[2] প্রেক্ষাপট: আকবরের আগে পর্যন্ত মােগল প্রশাসনের সামরিক, বেসামরিক সমস্ত উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে বেতনের বদলে জায়গির প্রদান করা হত। কিন্তু ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থায় নানা দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটলে নতুন এক প্রথা প্রবর্তনের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়। অপরদিকে যথেষ্ট হারে জায়গির বিতরণ করায় ‘খালিসা’ জমির পরিমাণ কমে যায়। এই প্রেক্ষাপটে প্রবর্তিত হয় মনসবদারি প্রথা।
[3] বিভিন্ন স্তর: আবুল ফজল তার আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, আকবর মনসবদারদের ৬৬টি পদমর্যাদার স্তর ধার্য করেন। সর্বনিম্ন স্তরে ছিল ১০ জন অশ্বারোহী সেনাবিশিষ্ট সেনাপতি এবং সর্বোচ্চস্তরেছিল ১০ হাজার অশ্বারোহী সেনাবিশিষ্ট সেনাপতি। তবে আবুল ফজলের ধারণায় কাগজে কলমে ৬৬টিস্তর দেখানাে হলেও প্রকৃত অর্থে মনসবদারি ব্যবস্থায় ৩৩টি স্তর ছিল বলে ইতিহাসবিদরা মনে করেন।
[4] বেতন: মােগল যুগে মনসবদারদের বেতন খুব একটা কম ছিল না। স্তরভিত্তিক মনসবদারগণ বেতন পেতেন। মনসবদারদের যা বেতন দেওয়া হত, সমস্ত খরচ মেটানাের পরেও তাদের হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে টাকা অবশিষ্ট থাকত।
[5] জাঠ ও সওয়ার: মনসবদার নামকরণের সঙ্গে জাঠ ও সওয়ার নামে দুটি পদ যুক্ত ছিল। এই দুই পদের স্বরূপ ও অর্থ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবু বলা হয় যে, জাঠ হল মনসবদারের ব্যক্তিগত পদমর্যাদা ও তার প্রাপ্ত বেতনের পরিচয়। আর সওয়ার হল মনসবদারের অধীনস্থ সেনার পরিচয়। আকবর তার রাজত্বকালের ৪০তম বর্ষে (১৫৯৫-৯৬ খ্রি.) জাঠ ও সওয়ার পদ দুটি চালু করেন।
[6] মনসবদারি প্রথার ফলাফল: [i] আকবর ও তাঁর পরবর্তী সম্রাটগণ মনসবদারি প্রথার সাহায্যে এক বিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন [ii] মনসবদার পদ এবং এর সঙ্গে যুক্ত জায়গির বংশানুক্রমিক না হওয়ায় মােগল যুগে সামন্ত প্রথার উদ্ভব ঘটেনি৷ [iii] মনসবদারি প্রথার ফলেই মােগল প্রশাসনে বিদেশি অভিজাত শ্রেণি, যথা- উজবেগি, আফগানি, তুরানি, ইরানি, এদের প্রাধান্য খর্ব হয়। [iv] মনসবদারি প্রথার ফলে মােগল রাজতন্ত্র শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
[7] ত্রূটি: মনসবদারি প্রথা ত্রূটিমুক্ত ছিল না। [i] মনসবদারি প্রথা ছিল এক জটিল ও অস্থায়ী পদ্ধতি। সময়ের সাথে সাথে এই প্রথার মধ্যে প্রশাসনিক জটিলতা বাড়তে থাকে। [ii] বেশিরভাগ মনসবদারদের অধীনস্থ সেনারা ছিল অদক্ষ অযোগ্য। [iii] বহু ক্ষেত্রে মনসবদারদের অধীনস্থ সেনাদের সঙ্গে সম্রাটের তরফে কোনাে যােগসূত্র না থাকায়, তাদের মধ্যে সম্রাট বা মােগল সাম্রাজ্যের প্রতি কোনাে আনুগত্য গড়ে ওঠেনি। এজন্য আরভিন (Irvine) বলেছেন—“মােগল সামরিক ব্যবস্থার মধ্যেই মােগলদের ধ্বংসের বীজ লুকিয়েছিল।”
উপসংহার: আকবর প্রবর্তিত মনসবদারি প্রথা ছিল সম্পূর্ণ নতুনভাবে উপস্থাপিত পুরানাে একটি প্রথা। আকবরের নিজ দক্ষতা গুণে এই প্রথায় সম্মিলিতভাবে সেনানায়ক, অভিজাতশ্রেণি ও আমলা সম্প্রদায় রাষ্ট্রের সেবায় নিয়ােজিত ছিল।