HS HISTORY ( Eleven )

আদি মানব থেকে প্রারম্ভিক সভ্যতা সমূহ : একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস

নদীকেন্দ্রিক সভ্যতার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা করাে।

নদীকেন্দ্রিক সভ্যতার বৈশিষ্ট্য:


[1] কৃষির প্রসার: নদীকেন্দ্রিক সভ্যতার অধিবাসীদের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষি। নদীতীরবর্তী অঞ্চলে খাল কেটে অনুবর জমিতে জলসেচের সাহায্যে তারা ফসল ফলাতে শুরু করে।

[2] পশু শক্তির যথাযথ ব্যবহার: এসময় মানুষ পশুকে কৃষিকাজ ও পরিবহণের কাজে আরও ভালােভাবে ব্যবহার করতে শুরু করে। নদীকেন্দ্রিক সভ্যতায় গৃহপালিত পশুর মধ্যে অন্যতম ছিল কুকুর, ছাগল, গােরু, ভেড়া, শূকর প্রভৃতি।

[3] শিল্পের প্রসার: খাদ্যের জোগান নিশ্চিত থাকায় নদীকেন্দ্রিক সভ্যতার অনেকেই শিল্পকর্মের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করত। এ যুগের শিল্পের মধ্যে অন্যতম ছিল—ধাতুশিল্প, বয়নশিল্প, মৃৎশিল্প, অলংকার নির্মাণ শিল্প, গৃহনির্মাণ শিল্প ইত্যাদি।

[4] বাণিজ্যের প্রসার: নদীকেন্দ্রিক সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল বাণিজ্য। প্রধানত নদীপথে বাণিজ্য চলত। স্থলপথেও কিছু কিছু বাণিজ্য হত। বিনিময়প্রথার মাধ্যমেই মূলত বাণিজ্যিক লেনদেন চলত। নদীকেন্দ্রিক সভ্যতাগুলির সমাজে বণিক শ্রেণির প্রাধান্য ছিল।

[5] ধর্মবিশ্বাস : নদীকেন্দ্রিক সভ্যতার মানুষ বস্তু দেবদেবীর প্রতি বিশ্বাস রাখত। এইসব সভ্যতায় পুরােহিতদের ক্ষমতা ও মর্যাদা ছিল সমাজে অন্যান্য শ্রেণির তুলনায় বেশি। অধিবাসীরা প্রাকৃতিক শক্তি, উদ্ভিদ, বিভিন্ন পশুপাখির পূজা করত। এ ছাড়াও তারা পরলােকে বিশ্বাস করত।

[6] লিপির ব্যবহার: নদীকেন্দ্রিক সভ্যতার অপর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল লিপির ব্যবহার। সুমেরের কিউনিফর্ম লিপি, মিশরের হায়ারােগ্লিফিক লিপি থেকে নদীমাতৃক সভ্যতাগুলির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানতে পারা যায়।

কী কী সুবিধার জন্য প্রাচীন কালে নদীকেন্দ্রিক সভ্যতাগুলি গড়ে উঠেছিল?

নদীকেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে ওঠার কারণ:


আদিম যুগে নদীতীরবর্তী অঞ্চলগুলিতে বিভিন্ন সুপ্রাচীন সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল। সুপ্রাচীন সুমেরীয়, মিশরীয়, পিকিং, সিন্ধু প্রভৃতি সভ্যতা বিভিন্ন নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিল।

[1] বসবাসের সুবিধা: নদীতীরবর্তী সমভূমি অঞ্চল বসবাসের পক্ষে ও গৃহনির্মাণের ক্ষেত্রে আদর্শ হওয়ায় ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে জনবসতি। কৃষিজ ফসল রক্ষার জন্য মানুষ নদীতীরেই প্রথম ঘর বেঁধে বসবাস শুরু করে।

[2] কৃষিকাজের সুবিধা: নদীতীরবর্তী অঞ্চলগুলি প্রতি বছর বন্যায় পলিমাটিতে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে, যা কৃষিকাজের পক্ষে খুবই উপযােগী। এ ছাড়া অঞ্চলগুলিতে খাল কেটে নদী থেকে জল এনে সারাবছর জলসেচ করা যেত। এভাবে চাষবাস উন্নত হওয়ায় এবং নানাবিধ ফসল উৎপাদনের সুবিধা থাকায় নদীর তীরে মানুষ সভ্যতা গড়ে তােলে।

পশুপালনের সুবিধা: নদীতীরবর্তী অঞ্চলগুলিতে প্রচুর ঘাস জন্মায় যা তৃণভােজী পশুদের প্রধান খাদ্য। সহজেই এই পশুখাদ্য পাওয়ার সুবিধা থাকায় নদীতীরবর্তী অঞ্চলে মানুষ বসবাস শুরু করে।

ব্যাবসাবাণিজ্যের সুবিধা: নদীতীরবর্তী অঞ্চলের মানুষ নদীপথে ব্যাবসাবাণিজ্য চালাত। নৌকা ছিল সেসময়ের প্রধান পরিবহণ মাধ্যম। তাই দেশের মধ্যে বা বাইরে জলপথ ধরে ব্যাবসাবাণিজ্যের সুবিধা থাকায় নদীতীরে বসতি গড়ে ওঠে।

[3] যােগাযােগের সুবিধা: প্রাচীন কালে মানুষ নদীপথের মাধ্যমেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত করত। নদীপথে যেহেতু সহজে ও খুব তাড়াতাড়ি যাতায়াত করা যায় তাই অনেকেই নদীর ধারে বসবাস করতে শুরু করল।

[4] পানীয় জল ও খাদ্যের সুবিধা: প্রাচীন কালের মানুষ পানীয় জলরূপে নদীর জলকেই ব্যবহার করত। নদী ছিল পানীয় জলের অফুরন্ত ভাণ্ডার। এই সুবিধার জন্য প্রাচীন মানুষ নদীতীরে জনবসতি গড়ে তুলেছিল।

মেহেরগড় সভ্যতার পরিচয় দাও।

ভারতের প্রাচীনতম গ্রামীণ সভ্যতা হল নব্য প্রস্তর যুগের মেহেরগড় সভ্যতা। আধুনিক ধারণায় হরপ্পা সভ্যতা ছিল মেহেরগড় সভ্যতারই বিকশিত রূপ। এ প্রসঙ্গে শিরিন রত্নাগর বলেছেন, “মেহেরগড়ই হরপ্পা সংস্কৃতির ক্রমবিকাশের স্তরগুলি তুলে ধরে।

[1] আবিস্কার: ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদ যা ফ্রঁসোয়া জারিজ (Jean Francois Jarrige) পাকিস্তানের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রধান রিচার্ড মিডাে (Richard Medow)-কে সঙ্গে নিয়ে বালুচিস্তান ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলে খননকার্য চালান। তাদের এই প্রচেষ্টার ফলে কাচ্চি সমভূমি (বালুচিস্তানের পশ্চিমে সিন্ধু উপত্যকায়)- তে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে মেহেরগড় সভ্যতার প্রাচীন নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়।

[2] অবস্থান: পাকিস্তানের বালুচিস্তানের কাচ্চি জেলার‌ বােলান গিরিপথের ধারে মেহেরগড় প্রত্নক্ষেত্রের (প্রায় ৫০০ একর জুড়ে) অবস্থান। মেহেরগড় সভ্যতার উত্তরে বােলান গিরিপথ, কাকর পর্বতশ্রেণি, লােরলাই-ঝােব নদী, দক্ষিণে কাচ্চি সমভূমি, সিন্ধুনদ, কিরথর পর্বতশ্রেণি, পূর্বে সুলেমান পর্বতশ্রেণি, সিন্ধু উপত্যকা এবং পশ্চিমে রয়েছে হেলমান্দ, মারগাে ও তাহলাব মরুভূমি।

[3] প্রত্নকন্দ্র: মেহেরগড় ছিল একটি গ্রামীণ সভ্যতা। মেহেরগড় সভ্যতার উল্লেখযােগ্য কয়েকটি প্রত্নক্ষেত্র বা প্রত্নকেন্দ্র ছিল—নৌসেরা, রানা ঘুনডাই, পেরিয়ানো ঘুনডাই, কিলিগুল মহম্মদ, কাচ্চিবেগ, কুল্লি, দারারকোট, মুন্ডিগাক, কোটদিজি প্রভৃতি।

[4] কালসীমা: জাঁ ফ্রাসােয়া জারিজ মেহেরগড় সভ্যতার সময়ের ব্যাপ্তিকে তিন পর্বে ভাগ করলেও আসকো পারপােলা আটপর্বের যে কালসীমা নির্ণয় করেছেন তা হল—

প্রথম পর্ব: আনুমানিক ৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
দ্বিতীয় পর্ব: আনুমানিক ৬০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
তৃতীয় পর্ব: আনুমানিক ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৩৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
চতুর্থ-পঞ্চম পর্ব: আনুমানিক ৩৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
ষষ্ঠ-সপ্তম পর্ব: আনুমানিক ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
অষ্টম পর্ব: আনুমানিক ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।

[5] বৈশিষ্ট্য: মেহেরগড় সভ্যতার অন্যতম দুটি বৈশিষ্ট্য হল—

নব্য প্রস্তর যুগের সভ্যতা: ভারতে নব্য প্রস্তর যুগের সূচনা ঘটে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দ থেকে। ৭টি পর্যায়বিশিষ্ট মেহেরগড় সভ্যতার সময়কাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ অব্দ পর্যন্ত। তাই পণ্ডিতগণ সাধারণভাবে মেহেরগড় সভ্যতাকে নব্য প্রস্তর যুগের সভ্যতা বলে থাকেন।

প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা: যে প্রাচীন সভ্যতার কোনাে লিখিত বিবরণ নেই, শুধুমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক বিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে যে সভ্যতার পরিচয় জানা যায়, সেই সভ্যতাকে বলে প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা। মেহেরগড়ে বিভিন্ন প্রত্নক্ষেত্রে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলির ভিত্তিতেই কেবল সভ্যতাটির বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয়। তাই মেহেরগড় সভ্যতাকে প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা বলা হয়।

[6] ঘরবাড়ি: মেহেরগড়ে কৃষিভিত্তিক জীবনধারার বিকাশ ঘটলে স্থায়ী বসতি গড়ে ওঠে। রােদে শুকানাে কাদামাটির ইট দিয়ে বাড়ি তৈরি শুরু হয়। বাড়িগুলি ছােটোবড়াে কয়েকটি কামরায় বিভক্ত ছিল। বাড়িগুলিতে আগুন জ্বালিয়ে ঘর গরমের ব্যবস্থা ছিল।

[7] শিল্প: মেহেরগড়বাসী মৃৎশিল্প, অলংকারশিল্প, বয়নশিল্পে পারদর্শী ছিল। পােড়ামাটির নারীমূর্তি তৈরির পাশাপাশি তারা তামার পুঁতি, আংটি, ছুরি প্রভৃতি তৈরি করতে শিখেছিল| তারা বৈদূর্যমণি, নীলকান্তমণি, মাদার অফ পার্ল দিয়ে হার তৈরির কৌশল শিখেছিল। এ ছাড়াও তারা পশুর লোম ও উল দিয়ে কাপড় বুনতে শিখেছিল।

[8] জীবিকা: মেহেরগড়বাসীর জীবিকা ছিল পশুপালন, শিকার, কৃষিকাজ ও ব্যাবসাবাণিজ্য। তারা মূলত কৃষিকাজের সুবিধার জন্যই প্রথমদিকে পশুপালন শুরু করেছিল। তাদের উৎপাদিত কৃষিজ ফসল ছিল—যব, গম, তুলো, খেজুর প্রভৃতি।

[9] সমাধিপ্রথা: মেহেরগড়ে মৃতদেহকে সমাধিস্থ করার প্রথা প্রচলিত ছিল। সমাধির আগে মৃতদেহে গেরুয়া মাটি মাখানো হত। সমাধিস্থলে মৃতদেহের পাশে মূল্যবান অলংকার-সহ তার ব্যবহার্য জিনিসপত্র রাখা হত, যেমন—পাথর বা ঝিনুকের মালা, হাড়ের আংটি, বৈদূর্যমণি (বা লাপিস লাজুলি), নীলকান্তমণি (বা টার্কোয়াজ) প্রভৃতি।

মেহেরগড়বাসীর জীবিকা— সম্পর্কে আলোচনা করো।

মেহেরগড়বাসীর জীবিকা ছিল কৃষি, পশুপালন, ব্যাবসাবাণিজ্য ও বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্ম।

[1] পশুপালন: বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে জানা যায় যে, মেহেরগড়বাসীরা পশুপালনকে জীবিকা অবলম্বনের উপায় হিসেব গ্রহণ করেছিল। গৃহপালিত পশুদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল গােরু, ভেড়া, ছাগল, মহিষ, ষাঁড়, কুকুর প্রভৃতি।

[2] কৃষিকাজ: প্রথম থেকেই মেহেরগড়বাসীরা কৃষিকাজের সঙ্গে পরিচিত ছিল। তাদের উৎপাদিত ফসল ছিল যব, গম, তুলাে, খেজুর প্রভৃতি। কম বৃষ্টিপাতযুক্ত অশ্লে তারা ছােটো ছােটো জলাধার নির্মাণ করে জলসেচের ব্যবস্থা করেছিল। উৎপাদিত শস্য, মজুত রাখার জন্য তারা বড়াে বড়াে শস্যাগার নির্মাণ করতে শিখেছিল।

[3] শিকার: অনেক মেহেরগড়বাসী নিকটবর্তী নদী ও জলাশয় থেকে মাছ ও বনের জন্তুজানােয়ার শিকার করে জীবিকা চালাত।পাথর ও পশুর হাড়ের তৈরি হাতিয়ার দিয়ে তারা শিকার করত।

[4] ব্যাবসাবাণিজ্য: মেহেরগড়বাসী আন্তর্বাণিজ্যের পাশাপাশি বহির্বাণিজ্যেও লিপ্ত ছিল। আফগানিস্তান, মেসােপটেমিয়া ও ইরানের সঙ্গে তারা ব্যাবসাবাণিজ্য চালাত বলে অনেক ঐতিহাসিক অনুমান করেন।

[5] শিল্প

মৃৎশিল্প: মেহেরগড়ের বাসিন্দারা বিভিন্ন মৃৎপাত্র তৈরি করতে শিখেছিল। এই সভ্যতায় টেরাকোটার হলুদ কালাে রঙের জ্যামিতিক নকশাবিশিষ্ট মাটির পাত্রের বহুল প্রচলন ঘটে। এসময়ে পােড়ামাটির তৈরি নগ্ন ও অর্ধনগ্ন নারীমূর্তি নির্মাণ শুরু হয়।

ধাতুশিল্প: মেহেরগড়ের ধাতুশিল্পীরা তামা গলিয়ে তাকে ব্যবহারযােগ্য ধাতুতে পরিণত করার কৌশল জানত। তারা ব্যবহারের উপযোগী বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র যেমন- পুঁতি, আংটি, ছুরি, বড়শি-সহ বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে।

অলংকার শিল্প: মেহেরগড়বাসী তুরপুন জাতীয় যন্ত্র দিয়ে পাথর কেটে অলংকার তৈরিতে দক্ষ ছিল। তুরপুন নামক যন্ত্র দিয়ে তারা বৈদূর্যমণি বা লাপিস লাজুলি, টার্কোয়াজ বা নীলকান্তমণি প্রভৃতি শক্ত পাথরের মালা এবং নদীর ঝিনুক দিয়ে হার, লকেট, বালা, আংটি ইত্যাদি তৈরি করত।

বয়নশিল্প: পশুর লােম এবং উল দিয়ে মেহেরগড়বাসী কাপড় বুনতে শিখেছিল। এ প্রসঙ্গে ইরফান হাবিব বলেছেন—“মেহেরগড় সভ্যতার দ্বিতীয় পর্বে আগুনে পােড়া তুলােবীজের নিদর্শন মেলে, যা প্রমাণ করে মেহেরগড়বাসী সুতিবস্ত্র বুনতে জানতা”

মেহেরগড় সভ্যতার ধ্বংসের কারণগুলি আলোচনা করো।

প্রাচীন সভ্যতা মেহেরগড়ের আনুমানিক তিন হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যবর্তী সময়কালে বিভিন্ন কারণে পতন ঘটেছিল।

[1] জলবায়ুর পরিবর্তন: ঐতিহাসিকদের অনুমান মেহেরগড় অঞ্চলে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটায় বৃষ্টিপাত কমে যায়। দীর্ঘদিন অনাবৃষ্টির ফলে সমগ্র অঞ্চলটি ধীরে ধীরে মরুভূমির রূপ নেওয়া শুরু করলে মেহেরগড়বাসীরা অন্যত্র সরে যায়। ফলে অঞ্চলটি জনমানবশূন্য হয়ে় একসময় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়।

[2] প্রাকৃতিক বিপর্যয়: বন্যা বা ভূমিকম্প এই দুই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে কোনাে একটি মেহেরগড় সভ্যতার পতনের জন্য দায়ী ছিল বলে অনেক ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক মনে করেন।

[3] বাসভূমির পরিবর্তন: পণ্ডিতদের অনুমান মেহেরগড়বাসী উন্নত জীবন যাপন ও নিশ্চিত খাদ্যসংস্থানের লক্ষ্যে হরপ্পা, মহেনজোদারাের দিকে সরে গিয়ে বসবাস শুরু করেছিল।

[4] বহিঃশত্রুর আক্রমণ: মেহেরগড়ের সঙ্গে ইরান, আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান-এর বাণিজ্যিক সম্পর্কের সূত্র ধরে, বিদেশি শত্রুরা এখানে আসে ও অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে এই সভ্যতাকে ধ্বংস করে বলে কোনাে কোনাে ঐতিহাসিক মনে করেন।

উপসংহার: মেহেরগড়বাসীরা অজানা কোনাে কারণে স্বভূমি পরিত্যাগ করে পাঞ্জাবের হাক্রা নদী উপত্যকা অঙ্কুলে এসে (আনুমানিক ২৫০০ খ্রি.পূ.) এক সভ্যতা গড়ে তােলে। এভাবে ধীরে ধীরে তারা হরপ্পা সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যায় বলে অধিকাংশ গবেষক মত প্রকাশ করেছেন।

হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনার বিবরণ দাও।

সূচনা: সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতা এক নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। মহেনজোদারাে, হরপ্পা, চানুহূদড়াে, কালিবঙ্গান, লােথাল প্রভৃতি নগরগুলিব প্রাপ্ত ধবংসাবশেষ থেকে এই সভ্যতার নগর পরিকল্পনার ধারণা পাওয়া যায়।

[1] আঞ্চলিক বিভাজন: হরপ্পা নগরটির দুটি অংশ ছিল একটি পশ্চিমের উঁচু দুর্গাঞ্চল, অপরটি পূর্বের নিম্নাঞ্চল। দুর্গাঞ্চলে শাসক শ্রেণির লােকেরা বসবাস করত। আর নিম্নাঞ্চলে সাধারণ শ্রেণির মানুষ বসবাস করত। দুর্গ এলাকা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা থাকত।

[2] রাস্তা: সরল ও প্রশস্ত রাস্তাগুলি পূর্ব থেকে পশ্চিম ও উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে সমান্তরালভাবে বিস্তৃত ছিল। বেশিরভাগ রাস্তা একে অপরকে সমকোণে ছেদ করায় শহরগুলি বর্গাকার ও আয়তাকার ব্লকের রূপ নিয়েছিল। ৯ থেকে ৩৪ ফুট পর্যন্ত চওড়া রাস্তাগুলি ছিল চুন, সুরকি, পাথর ও পােড়া ইট দিয়ে তৈরি। রাস্তার দুধারে বাঁধানাে ফুটপাতে রাত্রে আলাের জন্য ল্যাম্পপােস্টের ব্যবস্থা ছিল। ফুটপাথ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য ছিল ডাস্টবিন।

[3] ঘরবাড়ি: আগুনে পােড়ানাে বা রােদে শােকানাে দুই ধরনের ইট দিয়েই ঘরবাড়ি তৈরি করা হত। দুকামরাবিশিষ্ট ছােটো গৃহ থেকে ত্রিশ কামরাবিশিষ্ট একতলা, দোতলা বা তিনতলা বাড়ির অস্তিত্ব ছিল বলে মনে করা হয়। পাশাপাশি নিম্ন অঞ্চলের উপকণ্ঠে শ্রমিক তথা গরিব শ্রেণির বস্তি গড়ে উঠেছিল। প্রতিটি গৃহেই শােবার ঘর, বসার ঘর, রান্নাঘর, স্নানঘর ও শৌচাগারের ব্যবস্থা ছিল। অধিকাংশ বাড়িতে রাস্তার দিকে কোনাে জানলা বা দরজা না রেখে ভেতরের উঠানের দিকে দু একটি জানলা, দরজা রাখা হত।

[4] পয়ঃপ্রণালী: হরপ্পা সভ্যতার পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত আধুনিক। জলনিকাশের জন্য রাস্তার নীচে দিয়ে পাথরের ঢাকনা দেওয়া নর্দমা থাকত। নর্দমাগুলি পরিষ্কার করার জন্য ইটের তৈরি ঢাকা ম্যানহােলের ব্যবস্থা ছিল। বড়াে নদমার সঙ্গে যুক্ত ছােটো নর্দমা দিয়ে প্রতিটি বাড়ির নােংরা জল বের করা হত।

[5] ম্নানাগার: মহেন-জো-দারাের দুর্গাঞ্চলে সর্বসাধারণের ব্যবহারযােগ্য এক বিশাল বাঁধানাে স্নানাগারের অস্তিত্ব মিলেছে। এর আয়তন দৈর্ঘ্যে ১৮০ ফুট ও প্রস্থ ১০৮ ফুট। স্নানাগারটির চারিদিকে রয়েছে ৮ ফুট উঁচু ইটের দেওয়াল। ঋতুভেদে জল গরম অথবা ঠান্ডা করার ব্যবস্থা ছিল। কাছের এক কূপ থেকে স্নানাগারটিতে জল সরবরাহ এবং পয়ঃপ্রণালীর দ্বারা এখানকার ময়লা জল বের করার ব্যবস্থা ছিল। স্নানাগারটিতে নামা-ওঠার জন্য দুপাশে ইটের সিঁড়ি ছিল।

[6] শস্যাগার: মহেন-জো-দারাে ও হরপ্পা দুই নগরে দুটি বিশাল আকারের শস্যাগার আবিষ্কৃত হয়েছে। হরপ্পার শস্যাগারটি রাভি নদীর প্রাচীন খাতের কাছে অবস্থিত ছিল। মহেন-জো-দারাের ধবংসাবশেষে প্রাপ্ত সর্ববৃহৎ দালানটিকে শস্যাগার বলেই অধিকাংশ পণ্ডিত মনে করেন।

[7] নির্মাণশৈলী: হরপ্পার ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং জলনিকাশি ব্যবস্থা সবকিছুতেই ছিল সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ছাপ, যা আধুনিক নগরের সঙ্গে তুলনীয়| নগরপুলিকে বিভিন্ন ধাপে একাধিকবার ভাঙাগড়ার মাধ্যমে নির্মাণ করা হয় বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন।

[8] পৌরব্যবস্থা: নগরগুলিতে কেন্দ্রীভূত পৌরব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল। নগরগুলির দেখাশােনার দায়িত্ব পালন করত পৌর প্রতিষ্ঠান। পৌর শাসনব্যবস্থার মান ছিল উন্নত। অধ্যাপক সরসীকুমার সরস্বতী বলেছেন, “এখানে একই প্রকৃতির শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা ছিল যা জনগণের জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করত৷”

উপসংহার: সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা আধুনিক যুগের মতােই উন্নত ও বৈচিত্র্যপূর্ণ ছিল। সুষ্ঠু নাগরিক পরিকল্পনা নগরবাসীকে সুখস্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাত্রা উপহার দিয়েছিল। প্রাচীন যুগের এমন উন্নত নগর পরিকল্পনা শুধু প্রাচীন ভারত নয় সমগ্র বিশ্বের প্রাচীন সভ্যতার এক অনন্য নজির।

হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীদের সামাজিক জীবনের পরিচয় দাও।

সূচনা: সিন্ধু নদের তীরে অবস্থিত হরপ্পা সভ্যতা ছিল ভারতের প্রথম নগর সভ্যতা/ সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার সমাজ ছিল শ্রেণি- বিভক্ত। হরপ্পার সিলমােহরে যে লিপি ব্যবহৃত হয়েছে। তার আজও পাঠোদ্ধার হয়নি। তাই হরপ্পার সমাজ সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য মেলেনি। তবে যতুটুকু তথ্য মিলেছে তা থেকে হরপ্পার সমাজের বেশ কয়েকটি দিক জানা যায়।

[1] সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস: হরপ্লার সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির অবস্থান ছিল।

কোশাস্বীর মত: হরপ্লার সমাজে উচ্চবর্গীয় ও নিম্নবর্গীয় মানুষের স্পষ্ট বিভাজন লক্ষ করে ঐতিহাসিক দামােদর ধর্মানন্দ কোশাম্বী বলেছেন (a) প্রভাবশালী পুরােহিত ও শাসকগােষ্ঠী, (b) বেতনভুক যােদ্ধা সম্প্রদায়, (c) বণিক, কারিগর ও ভূস্বামীদের দল এবং (d) চাষি, দরিদ্র শ্রমিক, ভৃত্য ও দাস এই চারশ্রেণির মানুষ নিয়ে গড়ে উঠেছিল হরপ্পা সভ্যতার সমাজব্যবস্থা।

পুসলকর মত: অধ্যাপক পুসলকর হরপ্পার জনসমাজকে চারভাগে ভাগ করেছেন। যথা (a) শিক্ষিত সম্প্রদায়, (b) যােদ্ধাশ্রেণি, (c) বণিকশ্রেণি, (d) করিগর ও শ্রমিক শ্রেণি।

[2] সামাজিক অবস্থান: সিন্ধুর সমাজব্যবস্থায় এক কেন্দ্রীয় শাসকগােষ্ঠীর অবস্থান ছিল। যাদেরকে সাহায্য করার জন্য গড়ে উঠেছিল আমলাতন্ত্র। সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে শাসক এবং পুরােহিতদের অবস্থান ছিল সর্বোচ্চে। সমাজের এক শ্রেণি যুদ্ধবিগ্রহকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। পাশাপাশি বিত্তবানদের একাংশ ব্যাবসাবাণিজ্য ও নানা ধরনের কারিগরি শিল্পের সাথে যুক্ত ছিল। সমাজের একবারে নীচু তলায় অবস্থান ছিল চর্মকার, চাষি, শ্রমিক, ভৃত্য ও দাসদের।

[3] সমাজব্যবস্থার প্রকৃতি: সিন্ধু উপত্যকায় প্রাপ্ত অসংখ্য নারীমূর্তি দেখে ঐতিহাসিকদের অনুমান এখানে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। কিন্তু অপর একদল ঐতিহাসিক মনে করেন যে হরপ্লার সমাজব্যবস্থা ছিল পিতৃতান্ত্রিক। এই মতের সমর্থকরা মনে করেন দূরপাল্লার বাণিজ্য, কৃষির প্রসার এবং ধাতব শিল্পের বিকাশের মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতিফলন মেলে।

[4] খাদ্যাভ্যাস: হরপ্লাবাসীরা গম ও যবের তৈরি খাবার খেত। তবে ধানের চাষও অল্পবিস্তার চালু থাকায় ভাতও তাদের খাদ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়। এ ছাড়াও তারা বিভিন্ন পশুর মাংস, খেজুর, দুধ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করত। সিন্ধু উপত্যকায় প্রচুর পরিমাণে আঙুর ও আনারস উৎপাদিত হত। সিন্ধু অঞ্চলে তামার বড়শির নিদর্শন মেলায় মনে করা হয় মাছ ও কচ্ছপের মাংস তাদের খাদ্য ছিল।

[5] পােশাক-পরিচ্ছদ: হরপ্পাবাসীরা সুতি ও পশমের পােশাক পড়ত। তারা সাধারণত দুটি বস্ত্র খন্ড পোশাক হিসেবে ব্যবহার করত। একটি দেহের উধর্বাংশে অপরটি দেহের নিম্নাংশে ব্যবহার করা হত।

[6] অলংকার: সিল্ধুবাসী নারী, পুরুষ উভয়েই ধাতুর তৈরি অলংকার পড়ত। কানের দুল, চুরি, আংটি, মল, কোমরবন্ধ, মালা প্রভৃতি তারা অলংকার হিসেবে ব্যবহার করত। তারা চোখে সুরমা টানতে জানত। নারীরা বিভিন্নভাবে চুল বাঁধতেও শিখেছিল। তারা চুলে হাতির দাঁতের তৈরি চিরুনি লাগিয়ে রাখত। পাখার মতাে দেখতে এক ধরনের অলংকার তারা মাথায় ব্যবহার করত।

[7] সিল ও লিপি: সিন্ধু উপত্যকা জুড়ে তামা, ব্রোঞ্জ এবং পােড়ামাটির তৈরি প্রায় ২০০০ সিল আবিষ্কৃত হয়েছে। এই সিল গুলিতে এক ধরনের চিত্রলিপি খােদিত ছিল। এগুলির নাম হল সিন্ধু লিপি বা হরপ্পা লিপি।পন্ডিত ও গবেষকগণ এই লিপিগুলির সঙ্গে সুমেরীয় ও মিশরীয় লিপির মিল খুঁজে পেয়েছেন। তারা অনুমান করেছেন এই লিপি ডানদিক থেকে বামদিকে পড়া হত। কিন্তু এই লিপিগুলি এখনও পাঠোদ্ধার করা যায়নি।

[8] বিনােদন: সিন্ধু উপত্যকায় মার্বেল পাথরের তৈরি এক‌ ধরনের বল ও পাশা আবিষ্কৃত হয়েছে। ঐতিহাসিকদের ধারণা এপুলি ছিল সিল্ধুবাসীর খেলার সরঞ্জাম। প্রাপ্ত বেশ কিছু সিলমােহরে শিকারের দৃশ্য রয়েছে। এই শিকারের দৃশ্যগুলি থেকে অনুমান করা হয় যে তাদের বিনােদনের আর-এক মাধ্যম ছিল শিকার করা। চিত্তবিনােদনের জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে নাচ, গান, ষাঁড় ও পাখির লড়াই আয়ােজিত হত।

হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীদের অর্থনৈতিক জীবনের পরিচয় দাও।

সূচনা: বিশ্বের প্রাচীন সভ্যতাগুলির মধ্যে অন্যতম হল হরপ্পা সভ্যতা। সিন্ধু ও তার উপনদী ইরাবতীর তীরে গড়ে উঠেছিল এই সুপ্রাচীন সভ্যতাটি। হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীরা মূলত কৃষি ও পশুপালন ভিত্তিক অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল ছিল। তবে বিভিন্ন ধরনের শিল্প ও বাণিজ্যও এই সভ্যতার অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছিল।

[1] পশুপালন: হরপ্লাবাসীদের অর্থনীতিতে পশুপালনের বিশেষ ভূমিকা ছিল। হরপ্লাবাসীদের গৃহপালিত পশু ছিল গােরু মহিষ, ভেড়া, ছাগল, শূকর ও উট। প্রয়ােজনে তারা গৃহপালিত পশুদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করত। এ ছাড়াও তারা গােরু ও মহিষকে চাষে লাঙল টানার কাজে ব্যবহার করত।

[2] কৃষি

কৃষিকাজের সূত্রপাত : সিন্ধুর উভয় তীরে উর্বর সমভূমিতে প্রথমে গম আর যব চাষ শুরু হয়। পাশাপাশি সিল্ধুবাসী এসময় অল্পবিস্তর ধান চাষও শুরু করে।

কৃষিজাত ফসল : হরপ্লাবাসীদের প্রধান প্রধান কৃষিজাত ফসল ছিল গম, যব, তিল, মটর, রাই, বাদাম প্রভৃতি। অন্যান্য কৃষিজাত ফসলের মধ্যে ছিল বাজরা, ধান, নানা ধরনের কলাই এবং কার্পাস।

[3] শিল্প: সিন্ধু সভ্যতায় ধাতুশিল্প, মৃৎশিল্প, অলংকারশিল্প ও বস্ত্রবয়নশিল্পের প্রচলন ছিল।

ধাতুশিল্প: সিন্ধু অঞ্চলে লােহার কোনাে চিহ্ন না পাওয়া গেলেও তামা ও ব্রোঞ্জের বর্শা, কুঠার, বড়শি, করাত, ছুঁচ, দাঁড়িপাল্লা প্রভৃতি নিদর্শন পাওয়া গেছে। ধাতুশিল্পের মধ্যে সােনা ও বুলুপাের অলংকার নির্মাণশিল্পের প্রচলন ছিল।

মৃৎশিল্প: উজ্জয়িনী শহরের অদূরে (২৫ কিমি পূর্বে) কায়থা অঞ্চলে তিন ধরনের প্রাচীন মাটির পাত্র মিলেছে। এগুলি হল বেগুনি রঙের নকশা কাটা বাদামি পাত্র, হালকা লাল নকশা কাটা পীতাভ পাত্র এবং সুদৃশ্য আঁচড় কাটা লাল পাত্র। মৃৎশিল্পীরা পলিমাটি, বালি ও চুনের গুঁড়াে মিশিয়ে কলশি, জালা, থালা, পেয়ালা, ডেকচি, বয়াম প্রভৃতি নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি ও নানাপ্রকার খেলনা তৈরি করত।

বস্ত্রবয়নশিল্প : সিন্ধু উপত্যকার বসতি এলাকা থেকে পােড়ামাটি ও বিভিন্ন ধরনের বস্তুর মিশ্রণ দিয়ে তৈরি তকলি মিলছে। এই যন্ত্রের সাহায্যে হাত দিয়ে সুতাে কাটা হত বলে মনে করা হয়। মহেনজোদারােয় প্রাপ্ত রঙিন কাপড়ের টুকরােটি এখনও পর্যন্ত বিশ্বের প্রাচীনতম সুতি কাপড়ের নিদর্শন। সিন্ধু সভ্যতায় যে পুরােহিত রাজার পাথরের মূর্তিটি পাওয়া গেছে, তার পােশাকে ছুঁচ দিয়ে করা যে অলংকরণ বা নকশা দেখা যায়, তা উন্নত সূচিশিল্পের পরিচায়ক।

[4] বাণিজ্য

বাণিজ্যের ধরন: হরপ্পা সভ্যতায় তিন ধরনের বাণিজ্যের প্রচলন ছিল। যথা-স্থানীয় বাণিজ্য, অভ্যন্তরীণ দূরপাল্লার বাণিজ্য এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য।

স্থানীয় বাণিজ্য: স্থানীয় বাণিজ্য চলত নিকটবর্তী একটি অঞ্চলের সঙ্গে অপর অঞ্চলের। পশুতে টানা গাড়ি, ভারবাহী বলদ ও জলযানের সাহায্যে পণ্যসামগ্রীর লেনদেন চলত।

অভ্যন্তরীণ দূরপাল্লার বাণিজ্য: মূলত সিন্ধু নদ ধরেই দেশের মধ্যেকার দূরবর্তী অঞ্চলগুলিতে বাণিজ্য চলত। বণিকদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে লােথাল, কালিবঙ্গান, ধােলাভিরা ছাড়াও সুদূর হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের সঙ্গেও বাণিজ্যিক যােগাযােগ গড়ে উঠেছিল।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য: সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে বেলুচিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, মিশর, মেসােপটেমিয়া প্রভৃতি বাইরের দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্য চলত।

আমদানি-রপ্তানি পণ্য: বেলুচিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান থেকে সােনা, রুপা, সিসা, টিন ও দামি পাথর আমদানি করা হত। আর সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চল থেকে ওই সমস্ত দেশে রপ্তানি করা হত তুলাে, সুতি বস্ত্র, তামা ও হাতির দাঁতের তৈরি নানা ধরনের জিনিসপত্র। সিন্ধু সভ্যতার লােথাল বন্দরটি ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র।

হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীদের ধর্মীয় জীবনের পরিচয় দাও।

সূচনা: প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রীর উপর ভিত্তি করে পণ্ডিতগণ হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীদের ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে কিছুটা আভাস পেয়েছেন। তারা টোটেম পূজা অর্থাৎ প্রকৃতি, বিভিন্ন প্রাণী ও জড়পদার্থকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করত। তবে হরপ্লাবাসীদের ধর্মবিশ্বাসে মন্দির বা দেবালয়ের কোনো স্থান ছিল না বলেই মনে করা হয়।

[1] ধর্মীয় বিশ্বাস: হরপ্লাবাসী বহুত্ববাদ অর্থাৎ বহু দেবতায় নাকি একেশ্বরবাদ বা এক দেবতার পূজায় বিশ্বাসী ছিল তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। এই সভ্যতার প্রাপ্ত দেবদেবীর মূর্তিগুলি থেকে অনুমান করা হয় যে এসময়ে মাতৃমূর্তির পূজা করা হত। বিভিন্ন সিলে হাতি, বাঘ, মহিষ, ষাঁড়ের ছবি দেখে মনে করা হয় যে সেসময় পশুকেও পূজা করা হত। এ ছাড়াও হরপ্লাবাসীরা লিঙ্গ ও বৃক্ষ উপাসনায় বিশ্বাসী ছিল।

[2] টোটেম পূজা: হরপ্লাবাসীরা টোটেম অর্থাৎ বিভিন্ন প্রাণী, প্রকৃতি ও জড় বস্তুকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করত।

লিঙ্গ ও যােনি মূর্তির উপাসনা: হরপ্পাবাসীরা লিঙ্গ ও যােনি মূর্তির উপাসনা করত। লিঙ্গ পূজার সঙ্গে পরবর্তীকালে দেবতা শিবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তুলে ধরা হয়।

বৃক্ষ উপাসনা: হরপ্পাবাসীরা বৃক্ষ পূজাও করত। তারা মূলত অশ্বখ বৃক্ষের উপাসনা করত। হরপ্পায় প্রাপ্ত এক সিলমােহরে পা-তােলা ভঙ্গিতে দণ্ডায়মান নারীর উদর থেকে এক চারা গাছ বের হওয়ার দৃশ্য দেখা যায়। ঐতিহাসিকদের অনুমান একটি ছিল ভূ-মাতার মূর্তি।

পশুর উপাসনা: হরপ্লাবাসীরা বিভিন্ন পশুর পূজা করত। বিভিন্ন পশুর মধ্যে কুঁজবিশিষ্ট ষাঁড়ের পূজার প্রচলন ছিল সব থেকে বেশি। কালিবঙ্গানে প্রাপ্ত একটি সিলমােহরে ছাগলের প্রতিকৃতি দেখে মনে করা হয় আদি শিবের পূজাতে ছাগ বলি দেওয়া হত।

[3] যােগী মূর্তির উপাসনা: হরপ্পায় একটি সিলমােহরে পশুবেষ্টিত পদ্মাসনে উপবিষ্ট, তিন মুখ ও তিনটি শিং বিশিষ্ট একটি দেবমূর্তি পাওয়া গেছে। জন মার্শাল হিন্দু দেবতা পশুপতি শিবের সঙ্গে এই দেবতার অনেক মিল খুঁজে পেয়েছেন। তবে ব্যাসাম একে সরাসরি শিব না বলে আদি শিব বলেছেন।

[4] মাতৃমূর্তির পূজা: হরপ্পা সভ্যতার কেন্দ্রগুলি থেকে অসংখ্য নারীমূর্তি আবিষ্কৃত হওয়ায় ঐতিহাসিকদের অনুমান সেসময়ে, এখানে মাতৃদেবীর পূজা খুব জনপ্রিয় ছিল। কোনাে কোনাে মূর্তির গায়ে ধোঁয়ার স্পষ্ট চিহ্ন দেখে মনে হয়, দেবীকে প্রসন্ন করতে অধিবাসীরা ধূপ ও প্রদীপ জ্বালাত।

[5] ধর্মীয় প্রতীকসমূহ: হরপ্লাবাসীর ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে পদ্ম, স্বস্তিকা, চক্র, স্তম্ভ ও ত্রিশূল প্রভৃতি প্রতীক বা চিহ্ন জড়িত ছিল। মহেনজোদারাে ও হরপ্পায় প্রাপ্ত বেশ কয়েকটি স্বস্তিকাচিহিত সিলে শিংবিশিষ্ট মাথার ছবি মিলেছে। এ ছাড়াও বেলুচিস্তানে কেজ উপত্যকায় স্বস্তিকাচিহ্ন বা চক্রচিহ্নবিশিষ্ট কিছু মাটির পাত্র মিলেছে।

[6] পারলৌকিক বিশ্বাস

অতিপ্রাকৃত ধারণা: সিন্ধু উপত্যকার ধ্বংসাবশেষে মন্ত্রপূত কবচের মতাে দেখতে এক ধরনের বস্তু মিলেছে। এগুলি দেখে মনে করা হয় যে, সিল্ধুবাসী অতিপ্রাকৃত অর্থাৎ অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস করত। বজ্রপাত, ঝড়, বন্যা প্রভৃতি ঘটনাকে তারা অতিপ্রাকৃত শক্তির রােষের কারণ বলে মনে করত।

অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া: হরপ্লাবাসী বিশ্বাস করত মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সমস্ত কিছু শেষ হয়ে যায় না। এসময় তিন ধরনের পদ্ধতিতে মৃতদেহ সমাধির নমুনা মিলেছে-

প্রথম পদ্ধতি: মৃতদেহের সঙ্গে তার ব্যবহার্য বিভিন্ন সামগ্রী সমাধিস্থ করা হত। একে বলা যায় সম্পূর্ণ সমাধি।

দ্বিতীয় পদ্ধতি: এই পদ্ধতিতে কেবলমাত্র মৃতদেহটিকে সমাধিস্থ করা হত।

তৃতীয় পদ্ধতি: মৃতদেহ ভস্মীভূত করে সেই ভস্ম একটি আধারে ভরে, আধারটিকে সমাধিস্থ করা হত। মৃতদেহকে সাধারণত সমাধিস্থানের উত্তর থেকে দক্ষিণে শায়িত করার নিয়ম ছিল।

হরপ্পা সভ্যতার নগরজীবন সম্পর্কে টীকা লেখো ।

[1] পরিকল্পিত নগর প্রতিষ্ঠা: হরপ্পা সভ্যতায় এক সুপরিকল্পিত ও উন্নত নগর গড়ে ওঠে। সেখানকার অধিকাংশ রাস্তাই সরল ও সমান্তরাল ছিল। রাস্তাগুলি ছিল ৯ থেকে ৩৪ ফুট পর্যন্ত চওড়া। রাস্তার ধারে ছিল বাঁধানাে ফুটপাত, বাড়ির নোংরা জল বের করার জন্য ছিল পয়ঃপ্রণালী, রাস্তার ধারে ল্যাম্পপােস্টও অবস্থিত ছিল। আগুনে পােড়ানাে ইট দিয়ে তৈরি বহুতল বিশিষ্ট অনেক ঘরবাড়ির অবশিষ্টাংশও পাওয়া গেছে এই সভ্যতায়। মহেঞ্জোদারােতে একটি স্নানাগার এবং হরপ্লায় একটি শস্যাগার পাওয়া গেছে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে।

[2] নগরজীবনের সমাজ: হরপ্পা সভ্যতায় সামাজিক বিভাজন ছিল বিদ্যমান। বাসিন্দারা নাগরিক জীবনের সঙ্গে মানানসই সুন্দর পােশাক ও অলঙ্কার ব্যবহার করত। নাচ, গান, শিকার প্রভৃতি ছিল নাগরিক জীবনের প্রধান বিনােদন মাধ্যম।

[3] নগরজীবনের অর্থনীতি: এই সভ্যতার বহু মানুষ শহুরে পেশা, যেমন-শিল্পকর্ম, বাণিজ্য প্রভৃতির সঙ্গে যুক্ত ছিল। তবে কৃষি এবং পশুপালনের সঙ্গেও বহু মানুষ যুক্ত ছিল।

[4] নগরজীবনের রাজনীতি: হরপ্পার নগরজীবন সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যে এখানকার নাগরিকগণ কেন্দ্রীভূত নগর বা পৌরপ্রশাসন গড়ে তুলেছিলেন বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন।

[5] নগরজীবনের ধর্মীয় বিশ্বাস: হরপ্পা সভ্যতার নাগরিকরা মূর্তিপূজা করত এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির আরধনা করত বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন। তখন মাতৃমূর্তির পূজা জনপ্রিয় ছিল।

হরপ্পা সভ্যতার পতনের কারণগুলি আলােচনা করাে।

সূচনা: আনুমানিক ১৭৫০ খ্রি.পূ. নাগাদ হরপ্পা সভ্যতার অবলুপ্তির সূচনা ঘটে এবং পরবর্তী ১০০ বা ১৫০ বছরের মধ্যে সমগ্র হরপ্পা সভ্যতার সম্পূর্ণ অবলুপ্তি ঘটে। এই অবলুপ্তির প্রকৃত কারণ নিয়ে মতভেদ থাকলেও অধিকাংশ ঐতিহাসিক এই সভ্যতার পতনের সুনির্দিষ্ট কিছু কারণের ওপর জোর দিয়েছেন।

[1] ভূপ্রকৃতির পরিবর্তন: একদা সিন্ধু অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হত। কিন্তু ভূপ্রকৃতির পরিবর্তনের ফলে ক্রমে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যায়। ফলে সিন্ধু অঞ্চলে মরুভূমির সূচনা ঘটে। ভূস্তরের নীচের জল ক্রমশ নিঃশেষ হয়ে পড়লে কৃষি-উৎপাদন অত্যন্ত কমে যায় এবং খাদ্যাভাব তীব্রতর হয়।

[2] ভূমিকম্প: গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, সিন্ধু উপত্যকার নিকটবর্তী অঞ্চলে ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল। খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত, সৎকারের নমুনা না থাকা ক্ষতবিক্ষত নরকঙ্কালগুলি থেকে এই ধারণা করা হয় যে, ভূমিকম্পের ফলে এই সভ্যতার বিনাশ ঘটে।

[3] বন্যা: অনেকের মতে বন্যা ও প্লাবন সিন্ধু সভ্যতার বিনাশ ঘটিয়েছিল। সিল্ধুবাসীরা নদীতে বাঁধ দিয়ে চাষাবাদ করত। এর ফলে সিন্ধু নদের জল অবরুদ্ধ হয়ে পলি জমে নদীগর্ভের উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। ফলে প্রতি বর্ষাতেই নদীর জল দু- কূল ছাপিয়ে নগরগুলিকে প্লাবিত করে| এম. আর. সাহানির মতে, প্লাবন সিন্ধু সংস্কৃতিকে ভাসিয়ে দেয়।

[4] সিন্ধু নদের গতিপথ পরিবর্তন: সিন্ধু নদের গতিপথ পরিবর্তনের ফলে মহেনজোদারাের বাণিজ্যিক গুরুত্ব নষ্ট হয়। পাশাপাশি তীব্র জলাভাবে এই অঞ্চলের কৃষিব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। শুধুমাত্র সিন্ধু নদ নয়, শতদ্রু ও যমুনা নদীও গতিপথ পরিবর্তন করায় সমগ্র সভ্যতাটি অবলুপ্তির পথে এগিয়ে যায়।

[5] রক্ষণশীলতা: হরপ্পা, মহেনজোদারাের ক্রমিক অবক্ষয়ের আর-একটি কারণ ছিল স্থবিরতা। জীবনযাত্রার কোনাে ক্ষেত্রেই উন্নত রীতির প্রয়ােগ ঘটাতে নাগরিকরা আগ্রহী ছিল না। এই রক্ষণশীল মনােভাব তাদের জনজীবনকে পঙ্গু করে তুলেছিল।

[6] বনাঞ্চল ধ্বংস: সিন্ধুবাসী গৃহ নির্মাণের প্রয়ােজনীয় ইট‌ পােড়ানাের জন্য তারা যথেচ্ছভাবে বনজঙ্গল ধ্বংস করে। ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দ্রুত কমে যায়। প্রত্নতত্ত্ববিদ প্রজেল- এর মতে, বনাঞ্চল ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে বন্যজন্তুর সংখ্যাও হ্রাস পায়। অথচ একটি সভ্যতার টিকে থাকার জন্য এগুলি ছিল অপরিহার্য।

[7] অন্তর্বিপ্লব বা গৃহযুদ্ধ: সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের কারণ হিসেবে অধিকাংশ পণ্ডিত সংঘাত ও রক্তপাতকে নির্দিষ্ট করেছেন|তবে এই সংঘাত ও রক্তপাত কেন ঘটেছিল সে-বিষয়ে দ্বিমত আছে। কারও মতে, অন্তর্বিপ্লব বা গৃহযুদ্ধ থেকেই এই রক্তপাত ঘটেছে।

[8] অভিনিস্ক্রমণ: কোনাে কোনাে ঐতিহাসিকের মতে প্রাকৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি কারণে সিন্ধুর অধিবাসীরা একসময় তাদের মাতৃভূমি ত্যাগ করে। তাই বলা যায় সিন্ধু উপত্যকার বাসিন্দারা আরও উন্নত জীবন ও নিরাপত্তার আশায় অভিনিক্রমণ (Exodus) করলে হরপ্পা সভ্যতা জনশূন্য হয়ে পড়ে।

[9] বহিরাক্রমণ: অনেকে ধারণা বহিরাগত শত্রুর আক্রমণকে, প্রধানত বৈদিক আর্যদের আক্রমণকে হরপ্পার পতনের জন্য দায়ী করেছেন৷ ধবংসন্ভূপে আবিষ্কৃত মৃতদেহের কঙ্কালে ভারী বস্তুর আঘাতের চিহ্ন প্রাপ্তি এবং আর্যদের ভারী অস্ত্রের ব্যবহারের সপক্ষে ঐতিহাসিকদের মত যুক্তিটিকে গ্রহণযােগ্য করেছে। পাশাপাশি বৈদিক দেবতা ইন্দ্রকে পুরন্দর বা নগর ধ্বংসকারী উপাধি প্রদান আর্যদের দ্বারা হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংসের যুক্তিটিকে আরও জোরালো করেছে।

সাম্প্রতিক গবেষণা: সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতা কীভাবে ধ্বংস হল তা নিয়ে আজও গবেষণা চলছে। অধুনা উপগ্রহের মাধ্যমে ভূত্বকের ছবি তুলে এই সভ্যতার বিলুপ্তির প্রকৃত কারণ সম্বন্ধে অনুসন্ধান চলছে। ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ বৈনই পৈসার-এর মতে, সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চলে মহাজাগতিক বিস্ফোরণে অথবা ধুমকেতুর ধাক্কায় জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটেছিল।

মিশরকে নীলনদের দান বলার কারণ লেখো।

ইতিহাসের জনক গ্রিক ঐতিহাসিক হেরােডােটাস সর্বপ্রথম তাঁর ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে মিশরকে নীলনদের দান বলে উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীকালে অন্যান্য ঐতিহাসিক গবেষকও হেরােডােটাসের এই মতকে সমর্থন করেছেন।

[1] উপত্যকা গঠনের দরুন: আজ থেকে প্রায় দশ হাজার বছর আগে নীলনদ অনেক বেশি চওড়া ও গভীর ছিল। সেসময় বদ্বীপ অঞ্চলগুলিতে পলি, বালি, কাকর জমে সমতল উপত্যকা গঠিত হয়েছিল। এই উপত্যকা অঞ্চলগুলিতে বসতি নির্মাণ শুরু হলে সভ্যতার উন্মেষের প্রেক্ষাপট রচিত হয়। ঐতিহাসিক বি. জি. ট্রিগার- এর মতে—সেই সময়ে মিশরের জনবসতিগুলি বন্যাবিধৌত অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল।

[2] কৃষিজ উৎপাদনের কারণে: প্রতি বছর বর্ষার সময় নীলনদে বন্যা হত। বন্যার সময় নদীর দুই তীরে নদীবাহিত পলিমাটি সঞ্চিত হত। এর ফলে নদীর উভয় তার কৃষিজ ফসল উৎপাদনের অনুকূল হয়ে ওঠে। সেসময়ে মিশরে গম, যব, ভুট্টা, তিসি, বিভিন্ন শাকসবজি উৎপাদিত হত। তাই বলা যায় মিশরকে শস্যশ্যামলা, সুজলা-সুফলারূপে গড়ে তােলার ক্ষেত্রে নীলনদের অবদান ছিল।

[3] পশুপালনের সুবিধা: মিশরে নীলনদের উভয় তীরে পলিমাটি যুক্ত অঞ্চলে তৃণভূমি গড়ে ওঠে।এই সুবিস্তৃত তৃণভূমিতে পশুখাদ্যের জোগান ও পশুপালনের সুবিধা মেলে। ছাগল, ভেড়া, শূকর ও গােরু ছিল সেসময়ের প্রধান গৃহপালিত পশু। তাই বলা যায় নীলনদের তীরবর্তী অঞ্চলে জীবিকা হিসেবে পশুপালনের সুবিধা থাকায় সভ্যতার বিকাশ ঘটে।

[4] পরিবহণের সুবিধা: প্রাচীন মিশরে জলপথই ছিল পরিবহণের মূল মাধ্যম। নীলনদ যেহেতু সেসময় সমস্ত বদ্বীপ অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত ছিল তাই মিশরের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে নীলনদ ধরে যােগাযােগের সুবিধা মিলেছিল।

[5] বহির্জনগােষ্ঠীর বসবাসের সুবাদে: এশিয়া থেকে সিমাইটগপ, আদিম ইউরােপীয় জনগােষ্ঠীভুক্ত লিবীয়গণ এবং আফ্রিকার উম্ন অঞ্চল থেকে আগত নুবীয়গণ নীলনদের তীরবর্তী অঞ্চলগুলিতে এসে বসবাস শুরু করে। বিভিন্ন বহিঃসম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ একত্রে বসবাস করার সুবাদে এখানে নতুন এক সভ্যতার উন্মেষ ঘটে।

প্রাচীন মিশরীয়রা পিরামিড তৈরি করত কেন?

প্রাচীন কালে মিশরের ফ্যারাও এবং সম্ভ্রান্তদের মৃতদেহের সমাধিস্থলে নির্মিত স্মৃতিসৌধকে বলা হত পিরামিড। মিশরের পিরামিডগুলি তৈরি করা হয়েছিল নানা কারণে।

[1] মৃতদেহের সংরক্ষণ: মিশরবাসী বিশ্বাস করত মৃত্যুর পরেও মানুষের আর-একটা জীবন রয়েছে। তাই তারা মৃতদেহকে মমি করে কাঠের বাক্সে ভরে সমাধিস্থ করত। প্রাচীন মিশরে কেবলমাত্র ফ্যারাও এবং ধনী অভিজাত শ্রেণির লােকেরাই মৃত্যুর পর মৃতদেহকে সংরক্ষণের অধিকারী ছিল। ধনী পুরােহিত শ্রেণির তত্ত্বাবধানে তৈরি হত পিরামিডগুলি।

[2] আত্মার সংরক্ষণ: প্রাচীন মিশরবাসী বিশ্বাস করত যে‌ মৃত্যুর পর আত্মা দেহের মধ্যেই অনন্তকাল ধরে বেঁচে থাকে। তাই আত্মাকে ইহলােকের দেহেই বাস করার সুযােগ দেওয়া উচিত। যাতে বিশেষ পরিস্থিতিতে মৃতদেহটি পুনরুজ্জীবিত হয়। এই ধারণা থেকেই মৃতদেহগুলিকে মমি হিসেবে সংরক্ষণ করা হত। আর সেই সমাধিস্থলে পিরামিড নির্মিত হত।

[3] স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ: প্রাচীন মিশরের ফারাও এবং‌ অভিজাতগণ পিরামিড তৈরির মধ্যে দিয়ে নিজেদের সমাধিস্তম্ভ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। প্রকৃত অর্থে তারা চেয়েছিলেন মৃত্যুর পরেও তাদের স্মৃতিকে অমর করে রাখতে। নীলনদের তীরে ৪০০০ বছর পূর্বের স্মৃতিস্তম্ভগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি আজও টিকে রয়েছে।

[4] রক্ষণশীল মানসিকতা: প্রাচীন মিশরের অধিবাসীরা ছিল রক্ষণশীল মনােভাবাপন্ন| তারা মনে করত মানুষের দেহ থেকে শুরু করে সব কিছুই প্রকৃতির দান, যা কখনোই নষ্ট করা উচিত নয়। এই মনােভাব থেকেই তারা মৃতদেহকে রক্ষার জন্য মমি বানাত। প্রথমদিকে তারা এই মমিকে সাধারণভাবেই সমাহিত করত। মাটির নীচে শায়িত মমির পাশে তারা বহু ধনরত্ন এবং তার ব্যবহার্য জিনিসপত্র রাখত। কিন্তু অচিরেই সেগুলি লুঠ হয়ে যেত। তাই মমির সুরক্ষার প্রয়ােজনীয়তা থেকেই তৈরি হল পিরামিড।

[5] মহিমা প্রচার: মিশরের ফ্যারাওগণ পিরামিড তৈরির মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে নিজেদের মহিমা প্রচার করতে চেয়েছিলেন। মেনেস, খুফু, তুতেনখামেন, দ্বিতীয় রামেসিস, নেফরা- সহ বিভিন্ন ফ্যারাও এই লক্ষ্য নিয়েই বড়াে বড়াে পিরামিড তৈরি করে গেছেন।

নদীকেন্দ্রিক প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার পরিচয় দাও।

সূচনা: টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে যে ছােট্ট দেশটি অবস্থিত ছিল প্রাচীন গ্রিকরা তার নাম দিয়েছিল মেসােপটেমিয়া। উত্তরদিকে ছিল আসিরিয়া এবং দক্ষিণদিকে ছিল ব্যাবিলনিয়া। এই ব্যাবিলনিয়ার উত্তর অংশের নাম ছিল আক্কাদ আর দক্ষিণ অংশের নাম ছিল সুমের। এই সুমেরকে কেন্দ্র করে প্রাচীন কালে যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তার নাম ছিল সুমেরীয় সভ্যতা।

[1] নগরজীবন

নগর পরিকল্পনা: সুমেরীয় সভ্যতায় একাধিক নগর ও জনপদ গড়ে উঠেছিল। খননকাজের দ্বারা প্রাপ্ত এই অঞ্চলের বাড়ি, মন্দির এবং রাস্তাঘাটগুলির ধ্বংসাবশেষ-এ সুষ্ঠু পরিকল্পনার ছাপ মেলে।

শাসন পরিচালনা: সুমেরীয় নগরগুলিতে রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রচলন ছিল। অনেক ক্ষেত্রে পুরোহিত শ্রেণি সুমেরীয় নগরগুলির শাসন পরিচালনা করত। প্রশাসন পরিচালনায় সাহায্যের লক্ষ্যে অভিজাতদের নিয়ে গঠন করা হয়েছিল এক কাউন্সিল।

[2] সমাজ কাঠামাে: প্রাচীন সুমেরীয় সমাজ কাঠামাে তিনভাগে বিভক্ত ছিল।

উচ্চ শ্রেণি: সমাজের উচ্চ শ্রেণিভুক্ত ছিল পুরােহিত, অভিজাত, বণিক, শিল্পপতি এবং উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীগণ। সমাজে অন্যান্যদের তুলনায় পুরোহিতরা বিপুল ধনসম্পদের অধিকারী ছিল।

মধ্য শ্রেণি: এই শ্রেণিভুক্ত ছিল চিকিৎসক এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীগণ।

নিম্ন শ্রেণি: দাস ও সাধারণ শ্রমিকরা ছিল এই শ্রেণিভুক্ত। প্রাচীন সুমেরীয় সমাজে যুদ্ধবন্দিরাই দাস হিসেবে বিবেচিত হত।

[3] অর্থনৈতিক কাঠামাে: সুমেরের অর্থনৈতিক কাঠামাে নির্ভরশীল ছিল কৃষি, পশুপালন, ব্যাবসাবাণিজ্যের ওপর।

কৃষি: সুমেরবাসীর প্রধান জীবিকা ছিল কৃষিকাজ। ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর মধ্যবর্তী উর্বর অঞ্চলে প্রচুর কৃষিজ ফসল ফলত তাদের প্রধান কয়েকটি কৃষিজাত ফসল ছিল গম, যব প্রভৃতি। সুমেরে বিভিন্ন শাকসবজি আর খেজুরও যথেষ্ট পরিমাণে উৎপাদিত হত। সুমেরবাসীর কাছে খেজুর ছিল মূল্যবান ফসল। খেজুর গাছ থেকে সুমেরবাসীর বিভিন্ন চাহিদা মিটত বলে তারা খেজুর গাছকে জীবনবৃক্ষ বলত।

পশুপালন: সুমেরবাসীর অপর একটি জীবিকা ছিল পশুপালন। ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলের পশু খাদ্যের অভাব মিটিয়েছিল। সুমেরবাসীর প্রধান কয়েকটি গৃহপালিত পশু ছিল গােরু, ছাগল, ভেড়া। এই গৃহপালিত পশুগুলি থেকে তারা দুধ, মাংস, চামড়া ও পশম পেত।

ব্যাবসাবাণিজ্য: সুমেরীয় বণিকগণ বিক্রেতা নিয়ােগের মাধ্যমে দূরবর্তী অঞ্চলগুলির সঙ্গে বাণিজ্য চালাত। প্যালেস্টাইন, ফিনিশিয়া, ক্লিট ও ইজিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, এশিয়া মাইনর, প্রাচীন ভারত এবং প্রাচীন মিশরের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে সুমেরীয়দের বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

[4] সাহিত্য

গিলগামেশ মহাকাব্য: খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ নাগাদ সুমেরে গিলগামেশ নামে মহাকাব্যটি রচিত হয়েছিল। এটি ছিল বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সাহিত্য। এতে রাজা গিলগামেশের বীরত্ব, সাফল্য ও ব্যর্থতার কাহিনি রয়েছে।

পুরাণ: সুমেরীয় সাহিত্যের মধ্যে পুরাপগুলি ছিল অন্যতম। এগুলির মধ্যে রয়েছে রাখাল বালক এতানার কাহিনি, জেলে আদ-এর কাহিনি, তামমুজ-এর কাহিনি ইত্যাদি।

[5] লিপি: পণ্ডিতদের অনুমান সুমেরীয়রাই সর্বপ্রথম লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল। তাদের লিপি ছিল দুরকম। একটি ছিল চিত্রলিপি এবং অপরটি কিউনিফর্ম লিপি।

[6] বিজ্ঞান: ধর্মীয় উৎসবগুলির সময়কাল বের করতে গিয়ে সুমেরীয়রা জ্যোতির্বিজ্ঞানের উদ্ভাবন ঘটায়। তারা জলঘড়ি ও চন্দ্রপঞ্জিকা আবিষ্কার করে। তারা বছরকে মাসে ভাগ করতে শেখে।

[7] আইন: প্রাচীন সুমেরের অপরাধ, সম্পত্তি, বাণিজ্য, ঋণ, চুক্তি প্রভৃতি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন রচিত হয়েছিল।পরবর্তীকালে সুমেরের এই আইন অনুসৃত হয়েছিল আসিরীয়, ব্যাবিলনীয় প্রভৃতি সভ্যতায়।

[8] শিল্পকলা: সুমেরীয়রা মৃৎশিল্প, ধাতু বা অলংকার শিল্প,‌ বস্ত্রশিল্পে পারদর্শিতা দেখিয়েছিল। এ ছাড়াও তারা রােদে শােকানাে ইট দিয়ে স্থাপত্যকীর্তি নির্মাণে পারদর্শিতা দেখিয়েছিল। ধাতব দ্রব্য, খােদাই করা মূর্তি প্রভৃতি ভাস্কর্যে সুমেরীয় শিল্পকলা প্রতিফলিত হয়েছিল।

লুইস হেনরি মরগ্যানের মতানুযায়ী মানব-সমাজের ক্রমবিকাশের ধাপকে ব্যাখ্যা করাে।

লুইস হেনরি মরগ্যান তার ‘Ancient Society’ গ্রন্থে আদিম মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ধাপকে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন মানবসমাজের ক্রমবিকাশের তিনটি ধাপ রয়েছে। যথা— [1] বন্যদশা (Savagery), [2] বর্বরদশা (Barbarism), [3] সভ্যদশা (Civilisation)।

[1] বন্যদশা: আদিম মানব জীবিকার খোঁজে যখন বনে বনে ঘুরে বেড়াত সেই সময় থেকেই বন্যদশার সূচনা ঘটে। মরগ্যানের ধারণায় বন্যদশার তিনটি ধাপ রয়েছে। যথা-

আদি বন্যদশা: এই দশায় মানুষ শব্দ উচ্চারণ করে মনের ভাব প্রকাশ করত। মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল ফলমূল সংগ্রহ করা।

মধ্য বন্যদশা: এই দশায় মানুষ আগুন সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। তারা মৎস্য শিকার করতে শেখে। এই পর্বে মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল পশুশিকার। এই পর্যায়ে পাথরের তৈরি হাতিয়ারগুলি ছিল অমসৃণ।

অস্ত বন্যদশা: এই পর্বে মানুষ তিরধনুকের ব্যবহার শুরু করে এবং মাটির পাত্র তৈরি করতে শেখে।

[2] বর্বরদশা: বর্বরদশার আবার তিনটি স্তর রয়েছে।

আদি বর্বরদশা: এই পর্বে মানুষ শিকার করেই মূলত জীবিকা চালাত। শিকারের তাগিদে তারা এসময়ে সংঘবদ্ধ হয়। পাশাপাশি তারা আগুনের ব্যবহার করতে শেখে।

মধ্য বর্বরদশা: এই পর্যায়ে কৃষির উদ্ভাবন ঘটে। ধাতুর আবিষ্কার হলে এই পর্যায়ের সমাপ্তি ঘটে।

অন্ত বর্বরদশা: এই পর্যায়ে ধ্বনি সংকেত লিপির উদ্ভব ঘটে। মানুষ তার উচ্চারিত ধ্বনিকে এক-একটি বর্ণ হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। এই পর্যায়ে মানুষের যাযাবর জীবনের অবসান ঘটে। কৃষিকাজের ওপর নির্ভর করে মানুষ স্থায়ী বসতি জীবনে প্রবেশ করে।

[3] সভ্যদশা: মানবসমাজের ক্রমবিকাশের শেষ ধাপ হল সভ্যদশা। আধুনিক মানুষ এই পর্যায়ভুক্ত। কৃষি থেকে শিল্পে উত্তরণের মধ্যে দিয়ে এই পর্বে মানুষ আধুনিক হয়েছে। এই পর্বে নগরের পত্তন হয় ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।

মধ্য প্রস্তর যুগের মানব সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক বর্ণনা করাে।

আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১০০০০ অব্দ থেকে শুরু করে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৮০০০ অব্দ পর্যন্ত সময়কাল মধ্য পাথরের যুগ নামে পরিচিত। অর্থাৎ পুরাতন পাথরের যুগ ও নতুন পাথরের যুগের অন্তর্বর্তীকালীন সময়কাল হল মধ্য পাথরের যুগ| এ যুগের মানব সংস্কৃতির তেমন উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য দেখা যায় না৷

[1] জীবিকা: মানুষ খাদ্যসংগ্রহ এবং শিকার করেই জীবিকা চালাত। তবে এই পর্বে পশুশিকারের তুলনায় বিভিন্ন ধরনের ফলমূল, শামুক-ঝিনুক, মধু, মৎস্য প্রভৃতি সংগ্রহের ওপর অধিক গুরুত্ব আরােপিত হয়। জলাভূমি বেড়ে যাওয়ায় মানুষ তার খাদ্য তালিকায় অনেক বেশি পরিমাণে মাছ, শামুক, ঝিনুক প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত করে।

[2] হাতিয়ার: পূর্ব প্রচলিত হাতিয়ারগুলি এসময়ে আকারে আরও ছােটো হয়, কিন্তু উন্নত রূপ পায়। পাশাপাশি এসময়ে প্রধান অস্ত্র হিসেবে তিরধনুকের ব্যবহার শুরু হয়।

[3] গুহাচিত্র: মধ্য প্রস্তর যুগের মানুষ গুহাচিত্র অঙ্কনে পারদর্শিতা দেখায়। বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ার, হরিণের শিং ও মাথা এবং মৎস্য শিকারের দৃশ্য ছিল তাদের গুহাচিত্রের উপজীব্য বিষয়। অনেকটা জ্যামিতিক নকশার ঢং-এ তারা গুহাচিত্রগুলি আঁকত। এইসব গুহাচিত্রগুলি ছিল ত্রিকোণ ও চতুষ্কোণ বিশিষ্ট এবং বৃত্তাকার। সুইডেনের কয়েকটি গুহায় মৎস্য শিকারের ওপর এই ধরনের কিছু জ্যামিতিক নকশা চিত্র মিলেছে।

নব্য প্রস্তর বা নতুন পাথরের যুগের মানবজীবনের নানা দিকগুলি উল্লেখ করাে।

সূচনা: পাথরের যুগের শেষ পর্যায় নতুন পাথর বা নব্য প্রস্তর যুগ (Neolithic Age) নামে পরিচিত। মধ্য প্রস্তর সংস্কৃতির শেষে এই পর্বে পৃথিবীর আবহাওয়া অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। এই অনুকূল পরিবেশে আদিম মানবের জীবনযাত্রায় উল্লেখযােগ্য সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন সূচিত হয়। আনুমানিক খ্রি.পূ. ৮০০০-৪০০০ অব্দ পর্যন্ত সময়কাল হল নতুন পাথরের যুগ।

[1] জীবিকা

পশুপালন: এযুগের মানুষ পশুপালনের কৌশল আয়ত্ত করে। কুকুর, ভেড়া, গােরু, গাধা, হাতি প্রভৃতি পশুকে তারা পােষ মানাতে শেখে।খাদ্যের জোগান ছাড়াও গৃহপালিত পশুকে তারা যাতায়াতের কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে।

কৃষির সূচনা: নব্য প্রস্তর পর্বে আবাসস্থলের পাশে বীজ বা গাছের শিকড় পুঁতে দেওয়া শুরু হয়। এভাবেই কৃষির সূচনা ঘটে।

[2] সমাজ: পূর্বেকার সমাজকাঠামাে এ যুগে আরও পরিশীলিত হয়। পরিবারগুলির কাঠামাে আরও সুসংঘবদ্ধ হয়ে ওঠে। সমাজে একক বা দলগত বিবাহরীতি চালু হয়। সমাজে বিনিময়প্রথার উদ্ভব ঘটে এবং শ্রমবণ্টন ব্যবস্থা চালু হয়।

[3] আশ্রয়স্থল: নব্য প্রস্তর যুগের শেষের দিকে মানুষ স্থায়ী আবাস নির্মাণ করতে শেখে। গাছের ডালপালা ও ঘাসপাতা দিয়ে তারা কুটির বানাতে শেখে। সুইটজারল্যান্ডের আদিম অধিবাসীরা হ্রদের মধ্যে খুঁটি পুঁতে তার ওপর মাচা বেঁধে বসবাস করত এমন নিদর্শন মিলেছে।

[4] হাতিয়ার: নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ আগের তুলনায় অনেক উন্নত মানের হাতিয়ার ব্যবহার করতে শুরু করে। এই পর্বের উল্লেখযােগ্য পাথরের হাতিয়ারগুলি ছিল কাটারি, নিড়ানি, ছেনি, বাটালি, কাস্তে, বর্শার ফলা, ছােরা, ছুঁচ প্রভৃতি। কুঠার, কোদাল-সহ বেশ কিছু হাতিয়ারে কাঠের হাতল লাগানাের কৌশল এসময় চালু হয়।

[5] আগুনের ব্যবহার: নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ পাথর ভাঙার মধ্য দিয়ে প্রথম আগুন জ্বালানাের কৌশল আবিষ্কার করে। আগুনের সাহায্যে তারা কাঁচা মাংস আগুনে পুড়িয়ে নিয়ে বা সেদ্ধ করে খেতে শিখল, গুহার মুখে আগুন জ্বালিয়ে বুনাে জানােয়ারদের তাড়াতে শিখল এবং শীতের হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে শিখল।

[6] চাকার আবিষ্কার: নব্য প্রস্তর যুগে এক তাৎপর্যপূর্ণ আবিষ্কার হল ‘চাকা’। চাকার ব্যবহারের মাধ্যমে মৃৎপাত্র উৎপাদনে পরিবর্তন আসে পাশাপাশি চাকাকে কাজে লাগিয়ে যানবাহন তৈরির ধারণা সৃষ্টি হয়।

[7] ভাষার উন্নয়ন: নব্য প্রস্তর যুগে ভাষার উন্নতি ঘটেছিল। এযুগে সমাজ কাঠামাে অনেক সংঘবদ্ধ হওয়ায় নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেশ কিছু ভাষার আত্মপ্রকাশ ঘটে।

[8] শিল্প

বস্ত্রবয়ন শিল্প: নব্য প্রস্তর যুগে বর্ষবয়ন শিল্পের সূচনা ঘটেছিল। শপের আঁশ থেকে তৈরি সুতাে দিয়ে এসময়ের কারিগররা লিনেন কাপড় বুনতে শেখে৷ মেসোপটেমিয়ার কারিগররা ভেড়ার লােম দিয়ে পশমি কাপড় বানাতে শেখে।

মৃৎশিল্প: নব্য প্রস্তর যুগে মৃৎশিল্পে অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটে। চাকাকে কাজে লাগিয়ে কম সময়ে অনেক বেশি সংখ্যক মাটির পাত্র তৈরি হতে থাকে। মাটির তৈরি পাত্রকে পুড়িয়ে শক্ত করার কৌশল আবিষ্কৃত হয়। পাত্রগুলির গায়ে নানা ধরনের নকশা এবং রং করার কৌশল চালু হয়।

[9] শিল্পকলা ও ধর্মবিশ্বাস: নব্য প্রস্তর যুগের মানুষ পাথর কেটে দেবীমূর্তি গড়তে শিখেছিল৷ মেসােপটেমিয়ার ইউবেইদ এবং ইজিয়ান সভ্যতার ক্রীটে এই ধরনের মূর্তি মিলেছে।