একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস | অর্থনীতির বিভিন্ন দিক|ইউরােপের ম্যানর প্রথা
মধ্যযুগে ইউরােপের সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতিতে ম্যানর প্রথার প্রধান বৈশিষ্ট্যাবলি উল্লেখ করাে।
সূচনা: মধ্যযুগের সামন্ততান্ত্রিক কাঠামােয় ইউরোপের বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বসবাস করত। এই রকম এক বা একাধিক গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠত ‘ম্যানর’। গ্রামে সামন্তপ্রভুর অধীনস্থ জমি চাষ করার জন্য ইউরােপে যে ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তাকে ম্যানর ব্যবস্থা বলা হত। ফ্রান্সে ম্যানর ব্যবস্থা সেইন্যরি (Seigneurie) নামে পরিচিত ছিল।
মধ্যযুগের ইউরােপে গড়ে-ওঠা ম্যানর-ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি ছিল নিম্নরূপ一
[1] ম্যানর হাউস: প্রতিটি ম্যানর অঞ্চলে ম্যানর প্রভুর খামার বাড়ি অর্থাৎ ম্যানর হাউস থাকত। এটি ছিল সামন্তপ্রভুদের স্থানীয় প্রশাসনিক কেন্দ্র। ম্যানর হাউসে খাওয়ার হল-ঘর, শােওয়ার ঘর, উপাসনা কক্ষ, ভৃত্যদের ঘর, ঘােড়ার আস্তাবল প্রভৃতি সবকিছুই থাকত।
[2] অর্থনৈতিক দিক: ম্যানরে সামন্তপ্রভুর অধীনে কৃষক ও ভূমিদাসরা উৎপাদন কার্যে অংশ নিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখত। তবে এখানকার অর্থনীতি ছিল একেবারেই অঞ্চলভিত্তিক।
[3] জমির চরিত্র: প্রতিটি ম্যানরের যে বিপুল পরিমাণ জমি ছিল তার মধ্যে ছিল চাষের জমি, পশুচারণ ভূমি, জলাভূমি, পতিত জমি, জঙ্গল, কৃষকের গৃহ, গির্জা ও শ্রমিক- কারিগরদের বাসগৃহ ইত্যাদি। এখানে মূলত দুপ্রকার জমি ছিল—[i] ডিমিন বা প্রভুর খাস জমি এবং [ii] কৃষকের বসতি, আবাদি ও পশুচারণ জমি।
[4] জমির বন্টন: আবাদি জমির কিছু অংশ সামন্তপ্রভু নিজের দখলে রেখে বাকি জমি কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন৷ সামন্তপ্রভু তাঁর নিজের দখলে রাখা জমিতে স্বাধীন কৃষক আধা-স্বাধীন কৃষক বা ভিলেইন এবং ভূমিদাস বা সার্ফদের বেগার শ্রমের দ্বারা উৎপাদন কার্য চালাতেন। অবশিষ্ট জমি ম্যানরে বসবাসকারী অন্তত বারো থেকে ষাটটি কৃষক পরিবারের মধ্যে বণ্টিত হত। প্রভুকে বার্ষিক বিভিন্ন ধরনের কর ও বেগার শ্রম দিয়ে তারা এই জমি ভােগ করতে পারত।
[5] উৎপাদন ব্যবস্থা: ম্যানরের জমিতে প্রথমদিকে বছরে দুটি এবং পরে তিনটি চাষ হত। উৎপাদন হত মূলত গ্রামের প্রয়ােজনের ওপর ভিত্তি করেই।
[6] রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র প্রতিরূপ: ম্যানরগুলি ছিল রাষ্ট্রের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ। এর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ম্যানর হাউস-এ প্রভু বসবাস করতেন। এখানে থেকে প্রভু ম্যানরে বসবাসকারী তার অধীনস্থ প্রজাদের ওপর শাসন ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতেন। ম্যানর অঞ্চলে প্রভুর ক্ষমতাই ছিল চূড়ান্ত।
[7] স্বয়ংসম্পূর্ণতা: প্রতিটি ম্যানর ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিভিন্ন পেশার মানুষ যেমন ম্যানরে বাস করত তেমনি নিত্য প্রয়ােজনীয় সামগ্রীও ম্যানরেই পাওয়া যেত। ম্যানরের প্রয়ােজনমতােই এখানকার যাবতীয় উৎপাদন কার্য চলত।
উপসংহার: মধ্যযুগের ইউরােপে প্রচলিত সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশেষ ধরনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামাে গড়ে উঠেছিল। এই কাঠামাের প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল ভূস্বামীর খামার বাড়ি, দুর্গ এবং গির্জা। সামন্তপ্রভুরা শিকার, যুদ্ধ ও অন্যান্য আনন্দ করে দিন যাপন করত।আর সমগ্র দেশের জন্য প্রয়ােজনীয় কৃষি উৎপাদন সম্পন্ন করত ম্যানরের কৃষকরা।
স্থানীয় শাসনের ভিত্তি হিসেবে ম্যানরের ভূমিকা উল্লেখ করাে।
ইউরােপের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্থানীয় শাসনের ক্ষেত্রে ম্যানরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এগুলি হল一
[1] রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র প্রতিরূপ হয়ে ওঠা: মধ্যযুগের ম্যানরগুলি ছিল একটি রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র সংস্করণ। স্বয়ংসম্পূর্ণ এই ম্যানরগুলির কেন্দ্রে অবস্থান করত ম্যানর হাউস, যেখান থেকে সামন্তপ্রভু তার বিভিন্ন কর্মচারীর সহায়তায় ম্যানরের শাসন পরিচালনা করতেন। কৃষক-প্রজারা নিজেদের জীবিকা নির্বাহের প্রয়ােজনে ম্যানরের জমির সঙ্গে যুক্ত থাকতে ও ভূস্বামীকে রাজস্ব ও বেগার শ্রমদানে বাধ্য থাকত।
[2] প্রভুর একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা: প্রভুর অধীনস্থ অঞ্চলে বসবাসকারীস্থানীয় স্বাধীন কৃষক,আধাস্বাধীন কৃষক,ভূমিদাস ও অন্যান্য প্রজার ওপর প্রভুর সীমাহীন আধিপত্য কৃষকদের যে কোনাে উদ্যোগের বিষয়ে প্রভুর সম্মতি নিতে হত। বলা বাহুল্য, প্রভুকে পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থদণ্ড দিলে সম্মতি পাওয়া যেত।
[3] আইন প্রণয়ন ও নিরাপত্তাবিধান: ম্যানরের প্রভু স্থানীয় অঞ্চল শাসনের উদ্দেশ্যে ফৌজদারি আইন প্রণয়ন করতেন এবং স্থানীয় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করতেন। এ ছাড়া বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরােধ করে ম্যানর-প্রভু ম্যানরের বাসিন্দাদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান করতেন।
[4] জনকল্যাণ সাধন: ম্যানর-প্রভু তার অধীনস্থ ম্যানরের রাস্তাঘাট, খাল, সাঁকো, বাঁধ প্রভৃতি নির্মাণ ও মেরামত করতেন। তিনি স্থানীয় বাজার প্রতিষ্ঠা, ব্যাবসার দেখাশােনা ও প্রশাসনিক কাজের পাশাপাশি বৃদ্ধ, অশক্ত ও অসুস্থদের সহায়তা প্রভৃতি কাজ করতেন।
[5] বিচারালয় পরিচালনা: ম্যানরের সকল বাসিন্দাদের বছরের নির্ধারিত সময়ে ম্যানর-প্রভুর বিচারালয়ে হাজিরা দিতে হত। বিচারে বহু ক্ষেত্রে অর্থ জরিমানা করা হত যার সবটাই ম্যানর প্রভুর তহবিলে জমা পড়ত। এ ছাড়া বিচারে আইন ভঙ্গকারীর শাস্তি ছিল কাছারিতে বন্দি করে রাখা, জরিমানা করা, বেত্রাঘাত, শারীরিক নির্যাতন, মৃত্যুদণ্ড প্রভৃতি।
ম্যানরের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পর্কে আলােচনা করাে।
ম্যানরের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার কয়েকটি বিশেষ দিক হল一
[1] চাষের পদ্ধতি: ম্যানরের জমির সীমানা যেমন সুনির্দিষ্ট ছিল না তেমনি এখানকার চাষবাসের পদ্ধতিও ছিল নিম্নমানের। বছরের পর বছর একই জমিতে একই ফসল চাষের ফলে জমির উৎপাদিকা শক্তি হ্রাস পেয়ে গিয়েছিল।
[2] কৃষকের পরিশ্রম: সঠিক পশুপালন পদ্ধতির অভাবে কৃষিকাজে গবাদিপশুর পরিমাণ কমে গিয়েছিল। ফলে কৃষিক্ষেত্রে কৃষকের কায়িক পরিশ্রম বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল।
[3] প্রভুর জমিতে বেগার শ্রম: প্রতিটি কৃষককে তার প্রভুর খাস জমিতে (ডিমিন) সপ্তাহে অন্তত তিন দিন বা তার বেশি বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দিয়ে উৎপাদন কার্য সচল রাখতে হত। অনেক সময় কৃষক প্রভুর জমিতে বাড়তি দু-একজন মজুর পাঠাতেও বাধ্য থাকত।
[4] খাদ্যসংকট: ম্যানরের পিছিয়ে পড়া কৃষি পদ্ধতির ফলে কৃষি উৎপাদন খুব কম হত। শস্য উদ্বৃত্ত না হওয়ায় দুর্ভিক্ষ বা যুদ্ধের সময় ফসল নষ্ট হয়ে দেশে চরম খাদ্য সংকট দেখা দিত।
উপসংহার: সামন্তপ্রভুদের শাসন ও কৃষি উৎপাদনের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য সামন্তপ্রভুদের প্রয়ােজন ছিল কৃষকদের কাছ থেকে কঠোর পরিশ্রম ও অর্থ শােষণ করা। ম্যানর-ব্যবস্থা সামন্তপ্রভুদের সেই প্রয়ােজন যথারীতি পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিল।
ম্যানরের কৃষকদের শ্রেণিবিভাগ করে এবং ভূমিদাসদের প্রদেয় করের উল্লেখ করাে।
সূচনা: মধ্যযুগীয় ম্যানরের কৃষি-উৎপাদন অব্যহত রাখত এখানে বসবাসকারী কৃষক পরিবারগুলি, যারা ছিল মোট জনসংখ্যার অন্তত ৯০ শতাংশ। এই কৃষকরা মূলত তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল।
[1] প্রথম শ্রেণি: প্রথম শ্রেণির কৃষকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল খুব সামান্য সংখ্যক স্বাধীন কৃষক (ফ্রি হােল্ডিং পেজ্যান্ট) যারা ম্যানর প্রভুর কাছ থেকে জমি পেয়ে স্বাধীনভাবে কৃষিকার্য করত। জমিতে চাষের অধিকারের বিনিময়ে তাদের সামন্ত প্রভুকে কর দিতে হত। চার্চকে দিত হত টাইদ (Tithe) নামে কর। এ ছাড়াও আরও নানাধরনের কর দিতে হত। তবে স্বাধীন কৃষকরা ইচ্ছে করলে ম্যানর ছেড়েও যেতে পারত।
[2] দ্বিতীয় শ্রেণি: ম্যানরের দ্বিতীয় শ্রেণির কৃষকদের ‘ভিলেইন’ (Villein) বলা হত। তারা ছিল আধা-স্বাধীন কৃষক। তারা হােট (Hote) বা মাঁনা (Manant) নামেও পরিচিত ছিল। তারা জমিদারের কাছ থেকে বসতি ও কৃষিজমি লাভ করত। এই প্রাপ্ত জমির বিনিময়ে কৃষক তার প্রভু অর্থাৎ জমিদারকে উৎপন্ন ফসলের একাংশ খাজনা হিসেবে দিত। তারা সপ্তাহে কমপক্ষে তিনদিন জমিদারের জমিতে বিনা মজুরিতে (বেগার শ্রম) চাষ করে বাকি সময় নিজের জমিতে চাষবাস করত।
[3] তৃতীয় শ্রেণি: ম্যানরে তৃতীয় বা সর্বনিম্ন স্তরের কৃষকরা ছিল অসংখ্য ভূমিদাস বা ‘সার্ফ’ (Serf)। তারা ছিল প্রকৃত অর্থে ক্রীতদাস। তারা এমন কোনাে প্রভুর অধীনে দাসত্ব করতে বাধ্য হত যে প্রভুকে সে নিজে নির্বাচন করতে পারত না। ভূমিদাসরা প্রভুর ডিমিন অর্থাৎ খাসজমিতে বেগার শ্রম দিয়ে সেখানে উৎপাদনকার্য সচল রাখত।
ম্যানরের ভূমিদাসদের প্রদেয় কর
ম্যানর-প্রভুকে ম্যানরে বসবাসকারী ভূমিদাসদের বিভিন্ন ধরনের কর দিতে হত। ভূমিদাসদের প্রদেয় উল্লেখযােগ্য করগুলি ছিল一
[1] বেগার শ্রম: প্রভুর জমি ও বাড়িতে ভূমিদাস নিজে ও তার পরিবারের সদস্যরা বছরের বিভিন্ন সময়ে বিনা পারিশ্রমিকে বা বেগার শ্রম দিতে বাধ্য ছিল। প্রভুর জাঁতাকল, আঙুর-মাড়াই কল, শস্যের গােলা প্রভৃতি সম্পৰ্কীয় কাজ করতে ভূমিদাস বাধ্য ছিল। এই শ্রম কর্ভি (Corvee) নামে পরিচিত ছিল।
[2] হেরিয়ট: কোনাে ভূমিদাসের পুত্র উত্তরাধিকারসূত্রে জমি লাভ করলে সামন্তপ্রভুকে এর জন্য ‘হেরিয়ট’ নামে কর দিতে হত।
[3] শিভাজ: ভূমিদাসরা তাদের প্রভুকে শিভাজ (Chevage) নামে একটি বাৎসরিক কর দিতে বাধ্য ছিল। শিভাজ থেকে প্রভুর বেশি আয় না হলেও এই কর আদায়ের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভূমিদাসত্বের প্রমাণ বজায় রাখা।
[4] বিবাহ-সংক্রান্ত কর: সাধারণভাবে প্রভুর অধীনস্থ জনগােষ্ঠীর বাইরে ভূমিদাসদের বিবাহ করার অধিকার ছিল। না। কখনাে কোনাে ভূমিদাস যুবক বা যুবতী অন্যত্র বিবাহ করার অনুমতি চাইলে প্রভু পর্যাপ্ত অর্থ লাভ করার পর ম্যানরের বাইরে বিবাহের অনুমতি দিতেও পারত।
[5] অন্যান্য কর: উপরােক্ত করগুলি ছাড়াও ভূমিদাসরা ট্যালেজ (জরিমানা), টাইদ (চার্চকে প্রদেয় ধর্মকর) প্রভৃতি করদানে বাধ্য ছিল।
উপসংহার: ম্যানর প্রভুর অধীনে উৎপাদনকার্যের সঙ্গে যুক্ত সব শ্রেণির কৃষকরা শােষিত হলেও সর্বাপেক্ষা শােষিত ও নির্যাতিত ছিল ভূমিদাসরা। মার্ক ব্লখ তাঁর ‘ফ্রেঞ্চ রুরাল হিষ্ট্রি গ্রন্থে লিখেছেন যে, “একজন ভূমিদাস মায়ের গর্ভে থাকাকালীন অবস্থাতেই তার পূর্ব নির্দিষ্ট প্রভুর ভূমিদাস হিসেবে গণ্য হত।”
To be Continue—Click Next Page