ইউরোপের সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো

একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস | অর্থনীতির বিভিন্ন দিক|ইউরোপের সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো

সামন্ততন্ত্র বলতে কী বােঝায়? ইউরােপে কখন এবং কীভাবে সামন্ততন্ত্রের উত্থান ও বিকাশ ঘটেছিল?

ল্যাটিন শব্দ ‘ফিওডালিস’ (Feodalis) এবং ফরাসি শব্দ ফোডালিতে (Feodalite) থেকে ইংরেজি ‘Feudalism কথাটি এসেছে যার বাংলা অর্থ হল ‘সামন্ততন্ত্র’। সামন্ত্রতন্ত্রের সংজ্ঞা নিয়ে বিভিন্ন অভিমত লক্ষ করা যায়।

মােটামুটিভাবে খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে ত্রয়ােদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে ইউরোপে জমির বিশেষ ধরনের মালিকানার ওপর ভিত্তি করে একপ্রকার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামাে গড়ে ওঠে। এই ব্যবস্থাকে সামন্ততন্ত্র বা ‘Feudalism’ বলে।

ইউরােপে সামন্ততন্ত্রের উত্থান ও বিকাশ


কোনাে কোনাে পণ্ডিত মনে করেন যে, প্রাচীন রােমান সাম্রাজ্যে সামন্ততন্ত্রের উত্থান ঘটেছিল। তবে মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্রের উত্থান শুরু হয় খ্রিস্টীয় নবম শতকের মধ্যভাগ থেকেই।

[1] সামন্ততন্ত্রের উত্থানের পটভূমি: ৮১৪ খ্রিস্টাব্দে শার্লামেনের মৃত্যুর পর ৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে ক্যারােলিঞ্জীয় সাম্রাজ্য তিনটি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। সাম্রাজ্যের এই দুর্বলতার সুযােগে স্থানীয় প্রভুরা অর্থাৎ বৃহৎ জমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের জমি ও জনগণের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে থাকেন। এভাবে সামন্ততন্ত্রের উত্থানের পটভূমি তৈরি হয়।

[2] সামন্ততন্ত্রের বিকাশ: ক্যারােলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যের অবক্ষয় শুরু হলে বিভিন্ন প্রান্তের ও বিভিন্ন স্তরের সামন্তপ্রভুরা শীঘ্রই নিজেদের অধীনস্থ তালুকদারকে জমির বন্দোবস্ত দিতে থাকেন। এভাবে একটি ক্রমােচ্চ প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক তৈরি হয়। সর্বনিম্ন জোতদাররা সরাসরি কৃষকের সঙ্গে জমির বন্দোবস্ত করত। এভাবে নবম শতকে ইউরোপে সামন্ততন্ত্র বিকাশ লাভ করে।

[3] সামন্ততন্ত্রের চূড়ান্ত বিকাশ: খ্রিস্টীয় নবম থেকে ত্রয়ােদশ শতক পর্যন্ত সময়ে ইউরােপে সামন্ততন্ত্র প্রসারের প্রক্রিয়া চললেও এর পরিপূর্ণ বিকাশের যুগ ছিল খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতক।

[4] সম্পর্কের প্রতিষ্ঠা: ছােটো ভূস্বামীরা নিজেদের সুরক্ষার জন্য তাদের উর্ধ্বতন বড়াে ভূস্বামীদের আশ্রয় গ্রহণ করে। বড়াে ভূস্বামীরা তাদের অধীনস্থ ছােটো ভূস্বামীদের সুরক্ষা দেয়। এভাবে একদিকে বিভিন্ন স্তরের সামন্তপ্রভুর মধ্যে এবং অন্যদিকে কৃষক ও সামন্তপ্রভুর মধ্যে সুরক্ষার বিনিময়ে সেবা ও আনুগত্যের একটি সম্পর্ক তৈরি হয়।

উপসংহার: পশ্চিম ইউরােপে সামন্ততন্ত্রের বিকাশলাভের পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে এই প্রথাই হয়ে ওঠে ইউরােপের সমাজ ও অর্থনীতির চালিকাশক্তি। দেশের সর্বোচ্চ শাসক অর্থাৎ রাজা থেকে শুরু করে ক্রমনিম্ন বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে তা গ্রামের হতদরিদ্র কৃষক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

মধ্যযুগে ইউরােপে সামন্তপ্রভুদের প্রধান ক্ষমতা ও কার্যাবলি উল্লেখ করাে।

সূচনা: ইউরোপে খ্রিস্টীয় নবম শতকের পরবর্তীকালে সামন্ততন্ত্রের উত্থান ঘটতে থাকে। সামন্তপ্রভুরা তাদের নিজ নিজ সামন্ত এলাকার যাবতীয় ক্ষমতা ভােগ করতেন।

সামন্তপ্রভুদের ক্ষমতা ও কার্যাবলি ছিল নিম্নরূপ一

[1] শাসনকার্য: বিভিন্ন স্তরের সামন্তপ্রভুরা ছিলেন তাদের নিজ নিজ অঞ্চলের প্রধান শাসক। তাঁরা দুর্গ নির্মাণ করে সেখান থেকে এলাকাটির শাসন পরিচালনা করতেন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতেন।

[2] বিচারকার্য: সামন্তপ্রভুরা তাদের অধীনস্থ অঞ্চলের প্রজাদের যাবতীয় অন্যায়-অবিচার, বিবাদ-বিসংবাদের বিচার করতেন। প্রজাদের বিচার করার উদ্দেশ্যে নিজ এলাকায় তিনি একটি বিচারালয় প্রতিষ্ঠা করতেন।

[3] সংস্কারকার্য: সামন্তপ্রভু তার অধীনস্থ এলাকার রাস্তাঘাট, খাল-সাঁকো প্রভৃতি নির্মাণ ও মেরামত করতেন। এ ছাড়া তিনি স্থানীয় এলাকায় বাজার বসাতেন, পশুচারণ ভূমি সৃষ্টি করতেন।

[4] কর আদায়: সামন্তপ্রভু নিজ এলাকার কৃষকদের কাছ থেকে কর বা খাজনা আদায় করতেন। ভূমিকর, উৎপাদন কর, সম্পত্তি কর (টাইলে) সহ বিভিন্ন প্রকার কর তিনি আদায় করতেন| প্রভু প্রতি সপ্তাহে নির্দিষ্ট কয়েকটি দিন তার খামার বাড়িতে বা খাস জমিতে তার অধীনস্থ কৃষককে কর্ভি বা বেগার শ্রমদানে বাধ্য করতেন। কৃষকদের চার্চকে ‘টাইদ” নামে ধর্মকর দিতে হত।

[5] অধীনস্থ সামন্তের আশ্রয়: উধর্বতন সামন্তপ্রভু তাঁর অধীনস্থ বা অধস্তন সামন্তদের আশ্রয়দাতা এবং রক্ষাকর্তা হিসেবে কাজ করতেন। অধীনস্থ সামন্তের আকাল মৃত্যু হলে মৃতের নাবালক পুত্রের অভিভাবকত্বও উধর্বতন সামন্তপ্রভু গ্রহণ করতেন এবং তার জমিদারি দেখাশােনা করতেন।

[6] সেনা সরবরাহ: সামন্তপ্রভুরা বহিরাগত শব্দুর আক্রমণ থেকে নিজের এলাকাকে রক্ষার উদ্দেশ্যে তার উর্ধ্বতন সামন্তপ্রভু বা রাজাকে সৈন্য ও প্রয়ােজনীয় সামরিক সাহায্য দিতেন।

[7] জমিদারি বাজেয়াপ্ত: উত্তরাধিকারী না রেখে কোনাে সামন্তের মৃত্যু হলে উর্ধ্বতন সামন্তপ্রভু তার জমিদারি বাজেয়াপ্ত করে সেখানে নতুন জমিদার নিযুক্ত করতেন। তা ছাড়া কোনাে সামন্ত তাঁর জমিদারি চালাতে ব্যর্থ হলে বা প্রভুর বিরোধিতা করলে উ্ধ্বতন সামন্তপ্রভু সেই সামন্তের জমিদারি বাজেয়াপ্ত করতে পারতেন।

উপসংহার: সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশের অগণিত কৃষক থেকে শুরু করে সম্রাট পর্যন্ত একটি ধারাবাহিক পিরামিডাকার ক্রমােচ্চ স্তর সৃষ্টি হয়েছিল। এই স্তরবিন্যাসে উধর্বতন সামন্তপ্রভুর ক্ষমতা প্রয়ােগের ভিত্তি ছিল তার প্রতি তার অধস্তন সামন্তের আনুগত্য প্রদর্শন।

ইউরােপের সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা করাে।

সূচনা: খ্রিস্টীয় একাদশ শতক নাগাদ ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে। প্রায় সকল দেশেই সামন্ততন্ত্রের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়।

1] দূর্বল কেন্দ্রীয় শক্তি: সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনাে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শক্তির অস্তিত্ব থাকত না। কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতার সুযােগে দেশের সর্বত্র অসংখ্য সামন্তপ্রভুই হয়ে উঠতে থাকে দেশের শক্তির সকল আধার। আঞ্চলিক প্রভুদের সেনা সরবরাহের ওপরই কেন্দ্রীয় শাসককে নির্ভর করতে হত।

[2] যোদ্ধাশ্রেণির অস্তিত্ব: সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রয়ােজনে প্রাণপাত করাই ছিল এই বীরত্বের আদর্শের মূল কথা। সামন্ততান্ত্রিক সমাজে ‘নাইট বা বীর যোদ্ধা নামে একটি শক্তিশালী যােদ্ধা শ্রেণি অবস্থান করত। এই নাইট বা বীর যােদ্ধারা শিভালরির বীরত্বের আদর্শ মেনে চলত।

[3] অধীনস্থ কৃষক: ইতিহাসবিদ মার্ক ব্লখ মনে করেন যে, সামন্তপ্রভুর অধীনস্থ ও তার দ্বারা শােষিত কৃষক সম্প্রদায়েরর অস্তিত্ব সামন্ততন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন ধরনের কর, বেগার শ্রম প্রভৃতি আদায়ের মাধ্যমে সামন্তপ্রভু কৃষকের কাছ থেকে সম্পদ শােষণ করত।

[4] ম্যানর-ব্যবস্থা: সামন্ততন্ত্রে উৎপাদন ক্ষেত্র হিসেবে গ্রামগুলিকে কেন্দ্র করে ম্যানর-ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। ম্যানরে প্রভু তার ম্যানর হাউসে অবস্থান করে কৃষকদের উৎপাদনের কাজে নিযুক্ত রাখতেন এবং ভূমিদাস ও কৃষকদের শােষণ করতেন।

[5] অনুন্নত কৃষি ব্যবস্থা: ইতিহাসবিদ মরিস ডবের মতে, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কৃষি প্রযুক্তি, শ্রম-বিভাজন প্রভৃতি সবই হত নিম্নমানের। ফলে জমির পরিমাণ ও কৃষকের সংখ্যার অনুপাতে উৎপাদন যথেষ্ট কম হত।

[6] কর ব্যবস্থা: সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কৃষক তার সামন্তপ্রভুকে বিভিন্ন ধরনের কর প্রদানে বাধ্য ছিল। প্রভু ভূমিকর, উৎপাদন কর, সম্পত্তিকর (টাইলে), গৃহকর, জলকর প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের কর প্রভু আদায় করতেন। প্রভুরা সাফ বা ভূমিদাসদের কাছ থেকে ‘হেরিয়ট’ বা উত্তরাধিকার কর আদায় করতেন।

[7] কৃষকদের শ্রেণিবিভাগ: মধ্যযুগের ইউরােপের সমাজে অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এযুগের কৃষিজীবীদের প্রধানত তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। এগুলি হল一

স্বাধীন কৃষক: স্বাধীন কৃষকরা প্রভুকে বিভিন্ন ধরনের করদানের পরও প্রভুর জমিতে ও খামারে তাদের বিনা পারিশ্রমিকে সপ্তাহে নির্দিষ্ট সময় বেগার শ্রম (করভি) দিতে হত।

আধা-স্বাধীন কৃষক: আধা-স্বাধীন কৃষকরা প্রভুকে করদানের ক্ষেত্রে বা প্রভুর জমিতে বেগার শ্রম দেওয়ার বিষয়ে স্বাধীন কৃষকদের চেয়েও বেশি শােষিত ছিল।

ভূমিদাস: সামন্তসমাজে ভূমিদাসরা ছিল সর্বাপেক্ষা শােষিত শ্রেণি। সামন্তপ্রভুর অধীনে অসংখ্য ভূমিদাস থাকত। ভূমিদাসরা সামন্তপ্রভুর ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতাে ছিল। তারা প্রভুর দ্বারা চূড়ান্তভাবে নির্যাতিত ও শােষিত হত। তারা সারাবছর প্রভুর জমিতে বেগার শ্রম দিতে বাধ্য ছিল।

উপসংহার: পণ্ডিত বােলাভিয়ের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমর্থন ও প্রশংসা করেছিলেন। এজন্য তাঁর মৃত্যুর (১৭২২ খ্রি.) পরবর্তী তিন শতক ধরে বােলভিয়ের বিভিন্নভাবে সমালােচিত ও নিন্দিত হয়েছেন।

পশ্চিম ইউরােপে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের কারণগুলি উল্লেখ করাে।

সূচনা: বিভিন্ন বর্বর জাতির আক্রমণে ইউরোপে চরম অশান্তি ও নৈরাজ্য দেখা দিলে খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে পশ্চিম ইউরােপে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটতে থাকে। সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের বিভিন্ন কারণ ছিল।

1] অনুগত-পৃষ্ঠপােষক সম্পর্কের ভূমিকা: প্রাচীন রােমান সাম্রাজ্যে অনুগত-পৃষ্ঠপােষক সম্পর্ক নামে এক ধরনের সম্পর্ক প্রচলিত ছিল। এই সম্পর্ক অনুসারে, ধনী অভিজাতরা তাঁদের অনুগত সাধারণ মানুষদের রক্ষার দায়িত্ব নিতেন। বিনিময়ে অনুগতরা ধনী অভিজাত ব্যক্তিটিকে সেবা ও সীমাহীন আনুগত্য প্রদান করত। এই সম্পর্ক সামন্ততন্ত্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল।

[2] কমিটেটাস প্রথার ভূমিকা: জার্মানিতে প্রচলিত কমিটেটাস’ (Comitatus) প্রথা অনুসারে, কিছু স্বাধীন যােদ্ধা স্বেচ্ছায় কোনাে উপদলীয় ক্ষমতাশালী নেতার অধীনতা মেনে তার স্বার্থপূরণের অঙ্গীকার করত। ক্ষমতাশালী সেই নেতা বা সেনাপতি তার অধীনস্থ যােদ্ধাদের আশ্রয় ও নিরাপত্তা দিতেন। এই রীতি পরবর্তীকালে সামন্ততান্ত্রিক কাঠামাে নির্মাণে সহায়তা করেছিল।

[3] আর্থসামাজিক পরিবর্তনের ভূমিকা: ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্যের পতনের পরবর্তীকালে ইউরােপে ব্যাবসাবাণিজ্যের অবক্ষয় শুরু হয়। ফলে নগরজীবন ভেঙে পড়ে, নগরের অবক্ষয় শুরু হয় এবং গ্রামীণ অর্থনীতির প্রসার ঘটতে থাকে। অর্থনীতির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে জমি। রােমান ও জার্মানি অভিজাত ও ভূস্বামীরা এর ফলে নিজেদের ভূসম্পত্তি বাড়ানাের দিকে বেশি নজর দেয়।

[4] বর্বর জাতির আক্রমণের প্রভাব: ক্যারােলিঞ্জীয় রাজকুমারদের মধ্যে সংঘর্ষ, ক্ষয়িম্বু পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্যে ম্যাগিয়ার, সারাসেন, ভাইকিং প্রভৃতি বর্বর জাতিগুলির আক্রমণ ইত্যাদি কারণে ইউরােপে চরম নৈরাজ্য ও অশান্তি দেখা দিয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ তাদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য চিন্তিত হয়ে পড়ে। নিরাপত্তার প্রয়ােজনে তারা উচ্চ পর্যায়ের কোনাে ভূস্বামীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে থাকে।

[5] স্থানীয় শক্তিশালী প্রভুর ভূমিকা: ইউরােপের বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের পরিস্থিতিতে জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তার তাগিদে সাধারণ মানুষ তার জমি স্থানীয় ক্ষমতাশালী প্রভু বা ভূস্বামীর হাতে তুলে দিয়ে তার কাছে আশ্রয় ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করে| প্রভুও কিছু শর্তের বিনিময়ে অধস্তন ব্যক্তিটিকে রক্ষার আশ্বাস দেয়।

[6] উর্ধ্বতন ক্ষমতাশালী প্রভুর ভূমিকা: স্থানীয় এই ক্ষমতাশালী ব্যক্তি আবার একই ধরনের শর্তের বিনিময়ে তাঁর। অধীনস্থ জমিজমা তার উর্ধ্বতন আরও বেশি শক্তিশালী ভূস্বামীর হাতে তুলে দিয়ে আপন আশ্রয় ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করে। এভাবে নিম্নস্তর থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত সামন্ততন্ত্রের নির্দিষ্ট গঠনতন্ত্র ও স্তর বিন্যাসের একটি পিরামিড কাঠামাে গড়ে ওঠে।

[7] মুসলিম আক্রমণের প্রভাব: শার্লামেনের মৃত্যুর (৮১৪ খ্রি.) পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতার সুযােগে ইউরােপে মুসলিম ও অন্যান্য বৈদেশিক জাতিগুলির আক্রমণ শুরু হয়। নিরাপত্তার তাগিদে মানুষ তার উর্ধ্বতন শক্তিশালী ভূস্বামীর কাছে তার সমস্ত জমিজমা অর্পণ করে। এভাবে বিভিন্ন স্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামন্তপ্রভুর উত্থান ঘটে। এরা আবার একইভাবে তাদের উর্ধ্বতন প্রভুর প্রতি আনুগত্য জানায়।

উপসংহার: খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকে উপরোক্ত বিভিন্ন কারণে ইউরােপের রাষ্ট্রীয় কাঠামােয় প্রভু ও আনুগত্যের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর ভিত্তিকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্তর অর্থাৎ সম্রাট থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন স্তর অর্থাৎ সাধারণ কৃষক পর্যন্ত একটি অবিচ্ছেদ্য সেবা বা আনুগত্যের বন্ধন ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের জন্ম দেয়।