রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাচিন্তা ও শান্তিনিকেতন ভাবনা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাচিন্তা ও শান্তিনিকেতন ভাবনার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও । ৫ + ৩



রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে তার শিক্ষাচিন্তার বিষয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা চালান। তার শিক্ষাভাবনায় মানুষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। তিনি শিক্ষাভাবনার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলির ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

[i] মানুষের দুর্দশা দূর করা: দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর পুত্র রবীন্দ্রনাথকে জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব দিলে রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম গ্রামের সাধারণ মানুষের দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পান। তিনি উপলব্ধি করেন, গ্রামই হল ভারতের প্রাণ, গ্রামের উন্নতি না হলে দেশের উন্নতি হবে না। এজন্য তিনি গ্রাম সংগঠনের মাধ্যমে পল্লিমঙ্গল সাধনের উদ্যোগ নেন।

[ii] কৃষির উন্নতি: রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেন, গ্রামের মানুষের কৃষিভিত্তিক জীবন-জীবিকার উন্নতি না হলে তাদের প্রকৃত উন্নতি হবে না। এজন্য গ্রামের কৃষিবিদ্যার উন্নয়নের উদ্দেশ্যে তিনি ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে আমেরিকায় পাঠান পরে জামাতা নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলিকেও তিনি ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে বিদেশে কৃষিবিদ্যা পড়ার জন্য পাঠান। রথীন্দ্রনাথ, তার বন্ধু ও নগেন্দ্রনাথ ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে স্বদেশে ফিরে রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষবাস এবং বীজ, সার, সেচ প্রভৃতির ব্যবহার শুরু করেন।

[iii] কুটিরশিল্পের বিকাশ: রবীন্দ্রনাথ গ্রামের মানুষের মধ্যে কুটিরশিল্পের প্রসারের বিষয়েও চিন্তাভাবনা করেন। তিনি একজন তাতিকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়ে সেখানকার দরিদ্র মানুষকে তাঁতের কাজ শিখতে উৎসাহিত করেন। এ ছাড়া মৃৎশিল্প-সহ বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্পের প্রসার ঘটানোর বিষয়েও তিনি চিন্তাভাবনা করেন।

[iv] শিক্ষার প্রসার: গ্রামের মানুষের অজ্ঞতা দূর করার উদ্দেশ্যে তাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানো অত্যন্ত জরুরি বলে রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন। তাঁর মতে, গ্রামের মানুষের সেবা করতে হলে তাদের সম্পর্কে আগে শিক্ষালাভ করতে হবে। গ্রামের মানুষের মধ্যেও শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে।

[v] সম্প্রীতির প্রসার: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাজের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির প্রয়োজনের ওপর গুরুত্ব দেন। সম্ভাব্য সংঘাতের অনুমান করেও তিনি হিন্দু-মুসলমান ব্রাহ্মণচণ্ডালের বিভেদ দূর করে কর্মক্ষেত্রে প্রাণচঞ্চলতা নিয়ে আসার কথা বলেন। তিনি বলেন, “সাহাদের হাত থেকে শেখদের বাঁচাতে হবে।” এই সাহা ও শেখ কোনো বিশেষ সম্প্রদায় ছিল ।তারা হল আসলে ‘আমলা’ ও ‘চাষা’।

বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাচিন্তা :



প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে মানুষের জীবন ও অস্তিত্ব ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত—এ কথা রবীন্দ্রনাথ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তার শিক্ষাভাবনায় প্রকৃতি ও পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়েছিল। বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তার শিক্ষা ভাবনার এই বৈশিষ্ট্যটি বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল।

[i] বিশ্ববিদ্যার সাধনা: রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যা সাধনার ক্ষেত্র হিসেবে দেখেছেন। তার মতে, “বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিশেষ সাধনার ক্ষেত্র। সাধারণভাবে বলা চলে সে সাধনা বিদ্যার সাধনা। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য উদ্দেশ্য হল বিদ্যা উদ্ভাবন, গৌণ উদ্দেশ্য হল বিদ্যা দান।

[ii] শিক্ষার অবারিত দ্বার: রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার সকলের জন্য উন্মুক্ত করার পক্ষপাতী ছিলেন। দেশবিদেশের সকল পণ্ডিত ও শিক্ষার্থীরা যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যা সাধনার সুযোগ পায়, রবীন্দ্রনাথ তা নিশ্চিন্ত করতে চেয়েছিলেন।

[iii] পাঠক্রমের বৈচিত্র্য: রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে বৈচিত্র্য আনার পক্ষপাতী ছিলেন। এজন্য বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দি ভবন, চিনা ভবন, কৃষি অর্থনৈতিক গবেষণাকেন্দ্র, পল্লি শিক্ষাভবন প্রভৃতির প্রতিষ্ঠা হয়। রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে দেশবিদেশের বহু খ্যাতনামা পন্ডিত এখানে শিক্ষকতা করতে আসেন।

[iv] মানবসত্তার বিকাশ: রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রে মানুষের মানবসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে তাকে সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণকামী সদস্য হিসেবে গড়ে তোলার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “মানুষের অভ্যন্তরের মানুষটিকে পরিচর্যা করে খাঁটি মানুষ বানানোর প্রচেষ্টাই শিক্ষা।

উপসংহার: রবীন্দ্রনাথ নিজে এমন এক বিশ্ববিদ্যালয় ভাবনা পোষণ করতেন যেখানে মুক্তচিন্তা, সত্যানুসন্ধান, স্বাধীনতা প্রভৃতির দ্বারা মানুষ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠবে| তার এই ভাবনা বাস্তবায়িত হয়ে উঠেছিল তার বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে।