
কন্যাশ্রী প্রকল্প|Kanyashree Prakalpa|প্রবন্ধ রচনা কন্যাশ্রী প্রকল্প|বাংলা রচনা
ভূমিকা :
‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর,
অর্ধেক তার সৃজিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’ – নজরুল ইসলাম
নারী ও পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে সংসার। শুধু সংসারই নয়, গড়ে ওঠে নব নব সৃষ্টির উন্মাদনা, গড়ে ওঠে ভবিষ্যতের অঙ্কুর। তবুও যােগ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত নারী যেন দোহন করে কেবল ‘দুহিতা’ নামের সার্থকতা ফুটিয়ে তুলছে নারী তার নিজের জীবন দিয়ে। প্রদীপের নীচের সেই গাঢ় কালিমাটুকু মুছে দেওয়ার এক অনন্য প্রয়াসের নামই কন্যাশ্রী প্রকল্প। কন্যার সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকা কিছু বিশেষণ-ভাগ্যবিড়ম্বিতা, উপেক্ষিতা, লাঞ্ছিতা -এইসব অভিশপ্ত শব্দগুলি অবলুপ্ত করার এক প্রচেষ্টার নামই কন্যাশ্রী প্রকল্প। পরিবারের সমাজের অবহেলিত অনাদৃত কন্যাটির হাত ধরে তার চোখে স্বপ্নকাজল পরিয়ে দিতে চেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীময়ী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার মেয়েদের কাছে কন্যাশ্রী প্রকল্প হল অবহেলা আর বঞ্চনার জীবনে স্বপ্নের উড়ান।

কন্যাশ্রী প্রকল্প কী ?
‘কন্যাশ্রী প্রকল্প’ এমনই একটি প্রকল্প যেখানে মেয়েদের শিক্ষা ও শিক্ষাবিস্তারের জন্য সরকারের তরফ থেকে একটি আর্থ-সামাজিক অবলম্বন দিয়ে তাদের মানসিকভাবে দৃঢ় করে তােলা হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জনকল্যাণকর প্রকল্পগুলির অন্যতম প্রকল্পের স্বীকৃতি পেয়েছে এই ‘কন্যাশ্রী।
কাদের জন্য কন্যাশ্রী প্রকল্প
পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে ‘কন্যাশ্রী প্রকল্প’ ঘােষণা করেন। (১) যাদের বার্ষিক আয় এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকার নীচে সেইসব পরিবারের কন্যাসন্তানরা এই প্রকল্পের আওতাভুক্ত।
(২) উপরিউক্ত পরিবারের কন্যাসন্তানরা ১৩-১৮ বছর বয়স পর্যন্ত বার্ষিক ৫০০ টাকা করে পাবে। (৩) এই পরিবারের ১৮-১৯ বছরের মধ্যে অবিবাহিত কন্যারা পাবে বার্ষিক এককালীন ২৫ হাজার টাকা। সাম্প্রতিক প্রকল্প’ হিসেব অনুযায়ী (১৩ জুলাই ২০১৭) সারা পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৯৩ লক্ষ ছাত্রী কন্যাশ্রী প্রকল্পে নথিভুক্তির জন্য আবেদন করেছেন। এর মধ্যে প্রায় ৮৯ লক্ষ ছাত্রীর কন্যাশ্রী প্রকল্পভুক্ত হওয়ার আবেদন মঞ্জুর হয়েছে। গত চার বছরে প্রায় ৪০ লক্ষ ৮৯ হাজার ৬০৬ জন ছাত্রী কন্যাশ্রী প্রকল্পের বৃত্তি পেয়েছেন।
Kanyashree Application Process.
Kanyashree District Portlete
কন্যাশ্রী প্রকল্পের প্রয়ােজনীয়তা
সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে বীজবপন, কৃষিকাজ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত নারী তার বােধ, রুচি, শিক্ষা, বুদ্ধি দিয়ে প্রতিনিয়ত সমাজের অগ্রগতিতে নিজেকে আহুতি দিয়ে চলেছে। অথচ নারীর অধিকার, মর্যাদা, প্রতিষ্ঠা এখনও পুরুষশাসিত সমাজে স্বপ্নই। এখনও পর্দার আড়ালে তাকে লুকিয়ে রাখার অক্ষম প্রচেষ্টা চলে নিরন্তর। কন্যাসন্তান পিতামাতার কাছে এখনও বােঝা।‘গৌরীদান’-এর মতাে অভিশপ্ত প্রথা ভারতের তথা পশ্চিমবঙ্গের পিছিয়ে-পড়া গ্রামগুলিত আজও বিরল নয়। দারিদ্র্য, অপুষ্টি, অশিক্ষা আর কু-সংস্কারের অন্ধকার থেকে মেয়েদের আলােয় নিয়ে আসার প্রচেষ্টার নাম কন্যাশ্রী প্রকল্প।
কন্যাশ্রী প্রকল্পের উদ্দেশ্য
এই প্রকল্পের প্রকৃত উদ্দেশ্য হল নারীশিক্ষার ব্যাপক প্রসার। বাল্যবিবাহ’-এর মতাে এই কুপ্রথা দূরীকরণের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এই কন্যাশ্রী প্রকল্প। নারীসমাজকে পাদপ্রদীপের আলােয় আনার লক্ষ্যে দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের প্রয়াস অব্যাহত ছিল। সর্বশিক্ষা মিশনের দৌলতে মেয়েদের পড়াশােনার ক্ষেত্রটি প্রশস্ত ও আলােকিত হলেও আর্থিক সংকট ছিল প্রধান বাধা। এর সমাধান হল কন্যাশ্রী প্রকল্প। তাই এই প্রকল্প বাংলার পিছিয়ে-পড়া মেয়েদের সামনে এক নতুন দিগন্তের ঠিকানা।
কন্যাশ্রী প্রকল্পের সাফল্য
পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, বীরভূম, মালদহ প্রভৃতি জেলায় এখনও লেগে রয়েছে বাল্যবিবাহের কলঙ্কের দাগ। এখানে শতকরা ৫৮ ভাগ মেয়েদের ১৭ বছরের কম বয়সে বিবাহ হয়ে যায় এখনও। বর্তমানে কন্যাশ্রী প্রকল্প তা রােধে অনেকখানি সফল হয়েছে। দরিদ্র পরিবারটিও তাঁদের মেয়েকে পড়াশুনার জন্য স্কুলে পাঠানাের উদ্যোগ নিচ্ছে। যেসব মেয়ে মাঝপথে পড়াশুনা ছেড়ে দিত, সেই ড্রপ-আউটের সংখ্যাও বেশ কমছে। তাড়াহুড়াে করে ১৮ বছর বয়সের আগে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সময় থমকে ভাবছেন গরিব অসহায় বাবা-মা। বরং গরিব মেয়েটিকে মর্যাদা দেওয়ার এই প্রচেষ্টার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে বিশেষত বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে অনেকেই সাধুবাদ দিচ্ছেন। জেলাশাসক, পঞ্চায়েত সমিতি, গ্রাম পঞ্চায়েতের তৎপরতায় কন্যাশ্রী প্রকল্পের সুষ্ঠু রূপায়ণ সম্ভব হয়েছে। তাই বলা যায়, এই প্রকল্পটি মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়ার পথে বলিষ্ঠ এক পদক্ষেপ।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
‘আমার সকল ব্যথা রঙিন হয়ে গােলাপ হয়ে উঠবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহুদিনের সঞ্চিত ব্যথা, অবহেলা, অশ্রদ্ধা, বঞ্চনার দীর্ঘ নদীটির সুখের সাগরে মিলিত হওয়ার দিন আসন্ন। কন্যাশ্রী প্রকল্প সমগ্র বিশ্বের নারীপ্রগতির নতুন দিশা। গত ২৩ জুন (২০১৭) বিশ্ব জনপরিষেবা দিবসে নেদারল্যান্ডসে আয়ােজিত রাষ্ট্রসংঘের অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়া হল বাংলার কন্যাশ্রী-কে। জনপরিষেবায় সারা বিশ্বের নজর কেড়েছে কন্যাশ্রী প্রকল্প। রাষ্ট্রসংঘের মঞ্চে দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কন্যাশ্রী প্রকল্পের জন্য রাষ্ট্রসংঘের প্রথম পুরস্কার গ্রহণ করেন। নিরলস অংশগ্রহণ এবং প্রচেষ্টার মাধ্যমে কীভাবে দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছে তাঁদের কষ্ট লাঘব করা যায়, এই প্রেক্ষিতে কন্যাশ্রী প্রকল্প সারা বিশ্বের দেশনেতাদের সমীহ আদায় করে নিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “কন্যাশ্রীর এই স্বীকৃতি বাংলার প্রতিটি মেয়ের কাছে গর্ব। কন্যাভ্ৰূণ হত্যা, কন্যাসন্তানকে অবাঞ্চিত মনে করা, এসব থেকে মুক্ত হয়ে, পরিবারের মেয়েদের জন্য নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গঠনের প্রয়ােজন।”
উপসংহার
শিক্ষাই মনের অন্ধকার দূর করতে পারে। বহুযুগের অন্ধ অচলায়তন, মিথ্যে দুর্গ ভেঙে বহু নারী তাদের সােনার পদচিহ্ন রেখে গেছেন ইতিহাসের দরজায়। নারীকে ‘আপন ভাগ্য জয় করিবার’ অধিকার দিতে হবে। ভবিষ্যতের নিরাপত্তার, অর্থনৈতিক ভিত্তির আশ্বাস এই ‘কন্যাশ্রী প্রকল্প’ দেশ ও জাতিকে প্রাণশক্তিতে পরিপূর্ণ করে তুলবে। তাই আমরা এই প্রকল্পের সাফল্য কামনা করি এবং তার সঙ্গে আমাদের মনকে দীনতামুক্ত করে নারী ও পুরুষকে একই বিহঙ্গের দুই ডানারুপে মেনে নিতে শিখি জীবনের প্রতি ক্ষণে। আজকের ছােট্ট মেয়েটিই তাে আগামীদিনের সমাজের জননী।
আজকের শ্রীময়ী ‘কন্যাশ্রী’আগামীদিনে মুক্তমনের পরিবার গড়ে তুলতে সহায়ক হবে। কন্যাশ্রী প্রকল্পের সুদূরপ্রসারী ফল হিসেবে আগামীদিনে আমরা পাব এক বলিষ্ঠ সমাজ, যেখানে থাকবে না নারী-পুরুষে মানসিক ভেদাভেদ, সেখানে মেয়েরা স্পর্ধায় মাথা তুলে দাঁড়াবে মর্যাদা ও মুক্তির আনন্দে।
আরও দেখুন : করোনা ভাইরাস প্রতিবেদন রচনা
AAP: মমতার কর্মতীর্থ ভুতুড়ে বাড়ি! রিপোর্ট বানিয়ে রাজ্যে পা রাখতে চায় কেজরীবালের আপ
You must be logged in to post a comment.