গমন : জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ

গমন : জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ | মাধ্যমিক জীবনবিজ্ঞান

প্রশ্ন : গমন কাকে বলে ? গমনের উদ্দেশ্য বা গমনের চালিকা শক্তিগুলি লেখো ।

উত্তর : যে প্রক্রিয়ায় জীব স্বতঃস্ফূর্তভাবে বা উদ্দীপকের প্রভাবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঞ্চালনের মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে স্থান পরিবর্তন করে তাকে গমন বলে ।

গমনের চালিকা শক্তি : প্রাণীদের গমনের উদ্দেশ্যগুলি  হল – ১) খাদ্য অন্বেষণ : প্রাণীদের খাদ্যের জন্য স্খানান্তরে গমন করতে হয়।  ২) খাদক প্রাণী থেকে আত্মরক্ষা : প্রাণীদের আত্মরক্ষার জন্য গমন করতে হয় ।  ৩) আশ্রয় বা বাসস্থান খোঁজা : প্রাণীরা তাদের পছন্দমতো ও নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে স্থানান্তরে গমন করে।  ৪) প্রজনন : প্রজনন অর্থাৎ বংশবিস্তারের উদ্দেশ্যে প্রাণীদের গমনের প্রয়োজন হয় ।

বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর গমন:

সিউডােপােডিয়ার সাহায্যে গমন : সিউডােপােডিয়া বা ক্ষণপদের সাহায্যে অ্যামিবয়েড গমন সম্পন্ন হয়। অ্যামিবা, শ্বেত রক্তকণিকা, স্পঞ্জের এই ধরনের গমন দেখা যায়।

সিলিয়ার সাহায্যে গমন : সিলিয়ার সাহায্যে প্যারামােসিয়াম গমন সম্পন্ন করে। এই ধরনের গমনকে সিলিয়ারি গমন বলে।

ফ্ল্যাজেলার সাহায্যে গমন : ফ্লাজেলার সাহায্যে ইউগ্নিনা নামক এককোশী প্রাণী গমন সম্পন্ন করে। এদের গমনকে ফ্ল্যাজেলীয় গমন বলে।

মাছের সন্তরণ : মাছ জলে সন্তরণ পদ্ধতিতে গমন সম্পন্ন করে। এই কাজে পাখনা (বক্ষ পাখনা, শ্রোণিপাখনা, পৃষ্ঠ পাখনা, পায়ু পাখনা, পুচ্ছ পাখনা) ও মায়ােটোম পেশি সাহায্য করে। এছাড়াও পটকা এই কাজে সাহায্য করে।

পাখির উড্ডয়ন : পাখি মুখ্য খেচর অভিযােজিত প্রাণী। এরা উড্ডয়ন পদ্ধতিতে গমন সম্পন্ন হয়। এই উড্ডয়ন পদ্ধতিতে ডানা, পালক, উড্ডয়ন পেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রেমিজেস (23 টি) ও রেকট্রিসেস (12টি) পালক উড্ডয়নে সাহায্য করে।

মানুষের গমন : মানুষ দ্বিপদ গমন সম্পন্ন হয়। এই গমনে পায়ের সঙ্গে দুটি হাত, অস্থি, অস্থিসন্ধি এবং অস্থিসংলগ্ন পেশিও সমানভাবে সাহায্য করে। গমনের সময় লঘু মস্তিষ্ক ও অন্তঃকর্ণের অর্ধচন্দ্রাকার নালি ও অটোলিথ যন্ত্র দেহের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করে।

মানুষের গমনে সচল সন্ধি ও কঙ্কাল পেশির ভূমিকা :

মানুষের গমনে সচল সদ্ধি ও কঙ্কাল পেশির ভূমিকা : যেসব অস্থিসন্ধি নড়াচড়া করতে পারে তাদের সচল সন্ধি বলে। যেমন বল ও সকেট সন্ধি, কবজা সন্ধি ইত্যাদি।
অস্থিসন্ধি বেষ্টিত পর্দা সাইনােভিয়াল পর্দা, সাইনােভিয়াল পর্দার মধ্য যে ক্ষুদ্র গহ্বর থাকে তাকে সাইনােভিয়াল গহ্বর বলে। এই গহ্বরে অবস্থিত তরল হল সাইনােভিয়াল তরল। অস্থিসন্ধিগুলি লিগামেন্ট নামক বন্ধনী দ্বারা আবদ্ধ থাকে এবং টেনডন অস্থিকে পেশির সঙ্গে যুক্ত রাখে। গমনে কেবল সচল অস্থিসন্ধি সাহায্য করে।
কবজা সন্ধি : একটি অস্থির গােল প্রান্ত অপর অস্থির অর্ধগােলাকার অবতল অঙ্গে যুক্ত থাকে। এই প্রকার অস্থিসন্ধিগুলাে কেবল একটি নির্দিষ্ট দিকে সঞ্চালিত হয়। হাঁটু ও কনুইয়ের অস্থিসন্ধি এই প্রকার অস্থিসন্ধির উদাহরণ।

বল ও সকেট অস্থি সন্ধি : একটি অস্থির গােলাকার প্রান্তে অপর অস্থির সকেটের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এই ধরনের অস্থিসন্ধি প্রায় সকল দিকে সঞ্চালিত হয়। স্কন্ধসন্ধি, উরুসন্ধি এই প্রকার অস্থিসন্ধির উদাহরণ।

কঙ্কালসংলগ্ন বা অস্থি সংলগ্ন পেশি : কঙ্কালের সঙ্গে সংযুক্ত পেশিকে কঙ্কাল সংলগ্ন পেশি বলে। এরা পাঁচ প্রকার যথা-
(a) ফ্লেক্সন পেশি : এরা দুটি অস্থিকে কাছাকাছি আসতে সাহায্য করে। যেমন—বাইসেপস্ পেশি।
(b) এক্সটেনসন পেশি : এরা ভাঁজ করা দুটি অস্থিকে দূরে সরে যেতে সাহায্য করে। যেমন—ট্রাইসেপস্ পেশি।
(c) অ্যাবডাকশন : এরা অঙ্গকে দেহাক্ষ থেকে দূরে সরে যেতে সাহায্য করে। যেমন- ট্রাইসেপস পেশি।
(d) অ্যাডাকশন : এরা কোনাে অঙ্গকে দেহাক্ষের কাছে আসতে সহায়তা করে। যেমন—ল্যাটিসিমাস ডরসি পেশি।
(e) রােটেশন : এরা দেহের কোনাে অঙ্গকে আবর্তিত করতে সাহায্য করে। যেমন—পাইরিফরমিস পেশি।

গমন : জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় | মাধ্যমিক জীবনবিজ্ঞান

গমনে মায়ােটোম পেশির ভুমিকা :

অবস্থান : মাছের নমনীয় মেরুদণ্ডের দু-পাশে লেজের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত অক্ষ বরাবর অসংখ্য ‘V‘ আকৃতির মায়ােটোম পেশি বিস্তৃত থাকে।

ভূমিকা : মায়ােটোম পেশিগুলির তরঙ্গায়িত
সংকোচন মাছের দেহের অগ্রপ্রান্ত থেকে পশ্চাদপ্রান্ত পর্যন্ত প্রবাহিত হওয়ার ফলে, মেরুদণ্ড দু-পাশে পর্যায়ক্রমে আন্দোলিত হয় এবং মাছ সামনের দিকে এগিয়ে যায়। পেশি যেদিকে সংকুচিত হয় মেরুদণ্ড সেদিকে বেঁকে যায়। ওই সময় বিপরীত দিকে পেশি প্রসারিত থাকে। মায়ােটোম পেশিগুলির পর্যায়ক্রমে সংকোচন ও প্রসারণের জন্য মেরুদণ্ডটিও পর্যায়ক্রমে দু-পাশে আন্দোলিত হতে থাকে, ফলে মাছ সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

গমন :জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ
গমন :জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ

মাছের গমনে পাখনার ভূমিকা :

মাছের সাতটি পাখনা থাকে –

১) বক্ষপাখনা : একজোড়া ।

অবস্থান : বক্ষদেশে অবস্থিত ।

ভূমিকা : জলে ওঠা-নামা করতে এবং স্থিরভাবে ভেসে থাকতে সাহায্য করে।

২) শ্রোণি পাখনা : একজোড়া।

অবস্থান : শ্রোণিদেশে ।

ভূমিকা : বক্ষ পাখনার মতো কাজ করে।

৩) পৃষ্ঠ পাখনা : একটি।

অবস্থান : পৃষ্ঠদেশে।

ভূমিকা : মাছকে জল কেটে এগিয়ে যেতে এবং দেহের ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে ।

৪) পায়ু পাখনা : একটি।

অবস্থান : অঙ্কদেশে পায়ুর ঠিক পিছনে অবস্থিত।

ভূমিকা : গমনে বিশেষ ভূমিকা নেই।

৫) পুচ্ছ পাখনা : একটি।

অবস্থান : লেজের শেষ প্রান্তে ।

ভূমিকা : গমনের সময় দিক পরিবর্তনে সাহায্য করে।

গমন :জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ
গমন :জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ

মাছের গমনে পটকার ভূমিকা :

পটকা মাছকে জলে ডুবতে ও ভাসতে সাহায্য করে পটকার অগ্র প্রকোষ্ঠে অবস্থিত রেডগ্রন্থি থেকে গ্যাস নির্গত হয়ে পটকার অগ্র প্রকোষ্ঠ স্ফীত হয়, তখন মাছ জলে ভেসে ওঠে ৷ ওই গ্যাস পশ্চাদ্ প্রকোষ্ঠে অবস্থিত রেটিয়া মিরাবিলিয়া নামক রক্তজালকে শোষিত হলে পটকা চুপসে যায় তখন মাছ জলে ডুবে যায়

মানুষের গমনকালে ভারসাম্য রক্ষায় লঘুমস্তিষ্ক ও অন্তঃকর্ণের ভূমিকা :

লঘুমস্তিষ্কের ভূমিকা : লঘুমস্তিষ্ক, পশ্চাৎ মস্তিষ্কের করোটির পশ্চাদভাগে অবস্থান করে । লঘু মস্তিষ্কের ফ্লোকু – লোনোডুলার লোব ভেস্টিবিউলার যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত থেকে দেহভঙ্গি ও ভারসাম্য নিয়ন্ত্রন করে।

অন্তঃকর্ণের ভূমিকা : অন্তঃকর্ণ মধ্যস্থ অর্ধবৃত্তাকার নালি, ইউট্রিকল ভারসাম্য রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে । এটি স্থির অবস্থায় মাধ্যাকর্ষন জনিত ভারসাম্য রক্ষা করে এবং গতিশীল অবস্থায় ভারসাম্য রক্ষা করে।

পাখির উড্ডয়নে ডানা, পালক ও উড্ডয়ন পেশির ভূমিকা :

ডানা : পাখিদের সামনের পা ডানায় রূপান্তরিত ডানাগুলি অভ্যন্তরীণভাবে অস্থি, উড্ডয়ন পেশি এবং উপরিভাগে উড্ডয়ন পালক দ্বারা আবৃত যা এদের উড়তে সাহায্য করে। প্রতিটি ডানা সামনের দিকে
প্রশস্ত এবং পেছনের দিকে ক্রমশ সংকীর্ণ। এর ফলে উপরের দিক থেকে। নীচে বাতাসের চাপ ডানায় বেশি পড়ে বলে ডানাটি সহজে বাতাসে ভেসে থাকতে পারে।

পালক : পাখির সারাদেহ পালক দ্বারা আবৃত। দুটি
ডানার প্রান্তভাগে 23 টি বড়াে পালক, যেগুলি উড্ডয়নে সাহায্য করে এদের রেমিজেস (Remiges) এবং পুচ্ছভাগে 12 টি বড়াে পালক উড্ডয়নের
সময় দিক পরিবর্তনে সাহায্য করে, এদের রেকট্রিসেস (rectrices) বলে। পালকগুলি বার্ব, বার্বিউল ও হুকযুক্ত হওয়ায় বায়ুর চাপে সহজে ছিড়ে যায় না।

উড্ডয়ন পেশি (Flight muscle) : পাখির বক্ষে স্টারনাম সংলগ্ন অঞলে উড্ডয়ন পেশি থাকে। পেশিগুলি যথাক্রমে পেক্টোরালিস মেজর
(pectoralis major), পেক্টোরালিস মাইনর (pectoralis minor) এবং কোরাকো ব্রাকিয়ালিস (coracobrachialis)। পেক্টোরালিস মেজর সংকুচিত হয়ে পালক আবৃত ডানাকে উপর থেকে নীচের দিকে টেনে আনে। ডানার এই নিম্ন ঘাতের ফলে পাখি সামনের দিকে অগ্রসর হয়। পরবর্তী পর্যায়ে পেক্টোরালিস মাইনর সংকুচিত হলে উধ্বৰ্ঘাতের ফলে ডানা উপরের দিকে উঠে যায়। এইভাবে পেশিগুলির সংকোচন ও প্রসারণের ফলে পাখির ডানা দুটিকে অবিরাম প্রসারণ, অবনমন এবং উত্তোলনে সহায়তা করে পর্যায়ক্রমে দাঁড়ের মতাে কাজ করে পাখিকে সামনের দিকে এগােতে সাহায্য করে।