চলন : জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ

চলন : জীবজগতে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয়

যেসব পরিবর্তন শনাক্ত হয় এবং সাড়া প্রদানে সাহায্য করে তাদের উদ্দীপক বলে। এই উদ্দীপকের প্রভাবে সাড়া দেওয়ার ক্ষমতাকে সংবেদনশীলতা বলে।

বেশিরভাগ উদ্ভিদ নির্দিষ্ট স্থানে আবদ্ধ অবস্থায় কেবল অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঞ্চালন ঘটায়। লজ্জাবতী, বনচাঁড়াল প্রভৃতি উদ্ভিদের সংবেদনশীলতা দেখা যায়। নিম্ন শ্রেণির উদ্ভিদের (ডায়াটম, ভলভক্স) গমন পরিলক্ষিত হয়। নির্দিষ্ট স্থানে স্থির থেকে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সঞ্চালনকে চলন বলে।

বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু Resonant Recorder, Electric Probe, Crescograph প্রভৃতি যন্ত্রের সাহায্যে উদ্দীপক প্রয়ােগে উদ্ভিদের প্রতিক্রিয়া ভাগ করা হয়। যথা—ট্যাকটিক বা আবিষ্ট চলন, ট্রপিক বা দিগনির্ণীত চলন, ন্যাস্টিক বা ব্যাপ্তি চলন।

ট্যাকটিক চলন : উদ্দীপকের প্রভাবে সমগ্র উদ্ভিদ বা উদ্ভিদ অঙ্গের স্থান পরিবর্তনকে ট্যাকটিক চলন বলে।

ফোটোট্যাকটিক চলন : আলোেক উদ্দীপকের প্রভাবে সমগ্র উদ্ভিদদেহের স্থান পরিবর্তনকে ফোটোট্যাকটিক চলন বলে। যেমন— ভলভক্স, ক্ল্যামাইডােমােনাসের চলন।
কেমােট্যাকটিক চলন : রাসায়নিক উদ্দীপকের প্রভাবে সমগ্র উদ্ভিদদেহের স্থান পরিবর্তনকে কেনােট্যাকটিক চলন বলে। যেমন—ফার্নের শুক্রাণু ম্যালিক অ্যাসিডের প্রভাবে ডিম্বাণুর দিকে অগ্রসর হয়।

ট্রপিক চলন : উদ্দীপকের উৎসের গতিপথ অনুসারে সংঘটিত চলনকে ট্রপিক চলন বলে।
ফোটোট্রপিক চলন : আলাের গতিপথ অনুসারে উদ্ভিদ অঙ্গের সংঘটিত চলনকে ফোটোট্রপিক চলন বলে। যেমন—উদ্ভিদের মূল আলাের উৎসের বিপরীত দিকে অগ্রসর হয়।
হাইড্রোট্রপিক চলন : জলের উৎসের গতিপথ অনুসারে সংঘটিত উদ্ভিদ অঙ্গের চলনকে হাইড্রোট্রপিক চলন বলে। যেমন—উদ্ভিদের মূল সর্বদা জলের উৎসের দিকে বৃদ্ধি পায়।

জিওট্রপিক চলন : উদ্ভিদ অঙ্গের চলন যখন মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে অভিকর্ষের গতিপথ অনুসারে হয়, তাকে জিওট্রপিক চলন বলে। যেমন— উদ্ভিদমূলের অভিকর্ষের দিকে অগ্রসর হয়ে থাকে।

ট্রপিক চলন নিয়ন্ত্রণ : অক্সিন হরমোন উদ্ভিদের ফটোট্রপিক এবং জিওট্রপিক চলন নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। অক্সিন আলোর উৎসের বিপরীত দিকে বেশি মাত্রায় সঞ্চিত হয়ে ওই অঞ্চলের কোষগুলির দ্রুত বিভাজন ঘটায়, এর ফলে উদ্ভিদের কান্ড আলোর উৎসের দিকে বেঁকে যায়। উদ্ভিদের মূল স্বল্প অক্সিনে বেশি অনুভূতিশীল হওয়ায় আলোর উৎসের দিকের কোষগুলি দ্রুত বিভাজিত হয়, ফলে মূল আলোর উৎসের বিপরীত দিকে বৃদ্ধি পায়।

ন্যাস্টিক চলন : উদ্ভিদ অঙ্গের চলন যখন উদ্দীপকের তীব্রতা অনুসারে সম্পন্ন হয়, তখন তাকে ন্যাস্টিক চলন বলে। উদ্দীপকের প্রকৃতি অনুসারে ন্যাস্টিক চলন চার প্রকারের হয় ।
ফোটোন্যাস্টিক চলন : উদ্ভিদ অঙ্গের সঞ্চালন যখন আলােকের তীব্রতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তখন তাকে ফোটোন্যাস্টিক চলন বলে। যেমন— সন্ধ্যামালতী ফুল কম আলােতে ফোটে, বেশি আলােতে মুদে যায়।

থার্মোন্যাস্টিক চলন : উদ্ভিদ অঙ্গের চলন যখন উয়তার তীব্রতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তখন তাকে থার্মোন্যাস্টিক চলন বলে। যেমনটিউলিপ ফুলের পাপড়ি অধিক উন্নতায় খােলে আবর কম উয়তায় মুদে যায়।

সিমােন্যাস্টিক চলন: স্পর্শ, ঘর্ষণ, আঘাত প্রভৃতি উদ্দীপকের তীব্রতার প্রভাবে উদ্ভিদ অঙ্গে যে চলন সংঘটিত হয়, তাকে সিমােন্যাস্টিক চলন বলে। যেমন–স্পর্শের প্রভাবে লজ্জাবতী গাছের পত্রকগুলি মুদে যায়।

কেমােন্যাস্টিক চলন : যখন কোনাে রাসায়নিক পদার্থের তীব্রতার প্রভাবে উদ্ভিদ অঙ্গের চলন সংঘটিত হয়, তখন তাকে কেমােন্যাস্টিক চলন বলে। যেমন—সূর্যশিশির গাছের পাতার কর্ষিকাগুলাে পতঙ্গে সংস্পর্শে এলে বেঁকে যায়।

প্রশ্ন : চলন ও গমন কাকে বলে ? চলন ও গমনের পার্থক্য লেখো

উত্তর : চলন : যে প্রক্রিয়ায় জীব এক জায়গায় স্থির থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বা উদ্দীপকের প্রভাবে দেহের কোনো অংশ বা অঙ্গপ্রতঙ্গ সঞ্চালন করে, তাকে চলন বলে ।

চলনের বৈশিষ্ট্য : (১) জীবের সামগ্রিক স্থান পরিবর্তন হয় না । (২) জীবের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সঞ্চালন ঘটে। (৩) কোনো নির্দিষ্ট স্থানে আবদ্ধ থেকে চলন সম্ভব। (৪) চলন হলে গমন হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।

গমন : যে পদ্ধতিতে জীব স্বতঃস্ফূর্তভাবে বা উদ্দীপকের প্রভাবে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঞ্চলনের মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে স্থান পরিবর্তন করে তাকে গমন বলে ।

গমনের বৈশিষ্ট্য : (১) জীবের সামগ্রিক স্থান পরিবর্তন হয়। (2) জীবের সামগ্রিক দেহের সঞ্চালন ঘটে। (৩) কোনো নির্দিষ্ট স্থানে আবদ্ধ থেকে গমন সম্ভব নয়। (৪) গমন হলে চলন অবশ্যই হবে ।

প্রশ্ন : লজ্জাবতী স্পর্শ করলে পত্রকগুলি নুয়ে যায় এবং বনচাঁড়া – লের পাতার নীচের পত্ৰক দুটি পর্যায়ক্রমে ওঠানামা করে—এর কারণ কী? অথবা, প্রকরণ চলন কাকে বলে ?

উত্তর : লজ্জাবতীর পাতা স্পর্শ করা মাত্র পাতার মধ্যস্থ রসস্ফীতি চাপ কমে যাওয়ায় পত্রকগুলি নুয়ে পড়ে (সিসমোন্যাস্টিক চলন)। আবার বনচাঁড়াল উদ্ভিদের (Desmodium gyrans) পরিণত কোশের রসস্ফীতির হ্রাস ও বৃদ্ধির ফলে বনচাঁড়াল উদ্ভিদের তিনটি ফলকের দুই পাশের ফলক দুটি পর্যায়ক্রমে ওঠানামা করতে থাকে। একে প্রকরণ চলন  বলে।

প্রকরণ চলন : কোশের রসস্ফীতির তারতম্যের জন্য উদ্ভিদ – অঙ্গের যে স্বতঃস্ফূর্ত বক্রচলন দেখা যায়, তাকে প্রকরণ চলন বলে ।

ট্রপিক চলন ও ন্যাস্টিক চলনের পার্থক্য লেখো

বিষয়

ট্রপিক চলন

ন্যাস্টিক চলন

উদ্দীপক

উৎসের অভিমুখ

তীব্রতা

চলনের প্রকৃতি

স্থায়ী, বৃদ্ধিজনিত।

অস্থায়ী, রসস্ফীতি জনিত।

হরমোনের ভূমিকা

অক্সিন হরমোন  দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

 অক্সিনের ভূমিকা নেই।

ট্যাকটিক চলন, ট্রপিক চলন ও ন্যাস্টিক চলনের মধ্যে পার্থক্য লেখো ।

বিষয়

ট্যাকটিক চলন

ট্রপিক চলন

ন্যাস্টিক চলন

প্রধান বৈশিষ্ট্য

বাহ্যিক উদ্দীপকের প্রভাবে সামগ্রিক উদ্ভিদদেহের স্থান পরিবর্তন হয় 

বাহ্যিক উদ্দীপকের গতিপথ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত উদ্ভিদ অঙ্গের বক্রচলন।

বাহ্যিক উদ্দীপকের তীব্রতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত উদ্ভিদ অঙ্গের বক্রচলন।

উদ্দীপকের প্রভাব

উৎসের গতিপথ ও তীব্রতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত

উৎসের গতিপথ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়

উৎসের তীব্রতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়

অক্সিন হরমোনের প্রভাব

কোনো প্রভাব নেই

বিশেষ প্রভাব আছে

কোনো প্রভাব নেই