
বহুরুপী গল্প : মাধ্যমিক বাংলা | মাধ্যমিক সাজেসান
প্রশ্ন: ‘ বহুরুপী ‘গল্পে হরিদার চরিত্রটি আলােচনা করাে।
উত্তর: সুবােধ ঘােষের লেখা ‘বহুরূপী’ গল্পের প্রধান চরিত্র হরিদা।
পরিচয় : হরিদা দরিদ্র, সমাজের প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ’। শহরের সবচেয়ে সরু গলির প্রান্তে একটি ঘরে তার মাথা গোঁজার ঠাই। কিন্তু তিনি বন্ধুবৎসল। অসমবয়সিদের তিনি সহজেই বন্ধু করে নেন।
শিল্পীর মন: হরিদা পেশায় বহুরূপী। সপ্তাহে একটা দিন বহুরূপী সেজে যে অর্থোপার্জন হয়, তাতে তার সাত দিনের ক্ষুধানিবৃত্তি হয় না। কিন্তু ঘড়ি ধরে চলা সময় বাঁধা জীবন মানতে তার তীব্র আপত্তি। এখানেই তার শিল্পীসুলভ মানসিকতার প্রকাশ।
সহজসরল জীবনযাপন : সহজসরল জীবনে অভ্যস্ত হরিদা। সমাজের ওঠা-নামা নিয়ে আগ্রহী নন। সমাজও তাকে মানুষের সম্মান খুব একটা দেয় না। তাই তিনি বলেন—“না রে ভাই, বড়াে মানুষের কাণ্ডের খবর আমি কেমন করে শুনব? আমাকে বলবেই বা কে?
বহুরূপী জীবন : হরিদার জীবনে নাটকীয় বৈচিত্র্য আছে। নানা ছদ্মবেশ ধারণে তিনি দক্ষ শিল্পী। অভিনয়ে এবং সাজের নৈপুণ্যে তিনি। মানুষকে মুগ্ধ করে দেন।
আদর্শবােধ : বিরাগীবেশে হরিদার আচরণ আসলে একজন শিল্পীর আচরণ। শিল্পের প্রতি নিষ্ঠা এবং সততায় তিনি সন্ন্যাসী বেশধারণ করে অর্থোপার্জন করতে পারেন না। তাই তিনি জগদীশবাবুর দেওয়া, প্রণামির টাকা প্রত্যাখ্যান করেন। এই ঘটনায় হরিদার জীবনের গভীর আদর্শবােধ স্পষ্ট হয়।
প্রশ্ন: বহুরূপী’ গল্প অবলম্বনে জগদীশবাবুর চরিত্র বিশ্লেষণ করাে।
উত্তর : সুবােধ ঘােষের লেখা বহুরূপী’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হরিদা হলেও জগদীশবাবু চরিত্রটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ঐশ্বর্যের অহংকার : জগদীশবাবু শহরের ধনী ব্যক্তি; সৌম্য, শান্ত ও জ্ঞানী মানুষ। কৃপণ স্বভাবের হলেও সাধুসন্ন্যাসীতে তার ভক্তিভাব প্রবল। যদিও এই ভক্তির আড়ালে তার ঐশ্বর্যের অহংকারও প্রকাশিত হয়ে যায়। তাই হিমালয় থেকে আসা সন্ন্যাসী কাউকে পায়ের ধুলাে দেন জেনে তিনি তাকে সােনার বােল লাগানাে কাঠের খড়ম এগিয়ে দিয়ে কৌশলে তার পায়ের ধুলাে গ্রহণ করেন। তার ঝােলায় প্রণামি হিসেবে দিয়ে দেন একশাে টাকার নােট।
অপরাধ স্বীকার : ছদ্মবেশী বিরাগী সন্ন্যাসীর চোখে অবশ্য জগদীশবাবুর অহংকার সহজে ধরা পড়ে যায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রথমে আমন্ত্রণ জানালেও তাই বিরাগীর ভৎর্সনার পর তিনি ক্ষমা চেয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসেন। তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য সেবা করতে চান।
ঐশ্বর্যের অহংকার চুর্ণ : বিরাগী জগদীশবাবুর সমস্ত সেবা প্রত্যাখ্যান করেন। জগদীশবাবু বিরাগীকে কয়েকদিন থাকার জন্য। অনুরােধ জানিয়ে ব্যর্থ হলে তার সমস্ত অহংকার চূর্ণ হয়। তীর্থভ্রমণের পাথেয় হিসেবে তিনি একশাে এক টাকা দিতে চাইলে বিরাগী সেই দানও প্রত্যাখ্যান করে জগদীশবাবুর ঐশ্বর্যের অহংকারকে সম্পূর্ণ চূর্ণ করে দেন।এভাবে কাহিনির পরিণতিতে জগদীশবাবু চরিত্রটি গল্পের কাহিনিতে প্রয়ােজনীয় হয়ে ওঠে।
প্রশ্ন: জগদীশবাবুর বাড়ি হরিদা বিরাগী সেজে যাওয়ার পর যে ঘটনা ঘটেছিল, তা বর্ণনা করাে।
উত্তর : সুবােধ ঘােষের লেখা বহুরূপী’ গল্পে হরিদা শহরের এক জ্যোৎস্নালােকিত স্নিগ্ধ, শান্ত সন্ধ্যায় বিরাগীর ছদ্মবেশে জগদীশবাবুর বাড়িতে উপস্থিত হন।
জগদীশবাবুর বাড়ির ঘটনা:হঠাৎ আসা বিরাগীর ছদ্মবেশধারী হরিদার ব্যক্তিত্বে বিস্মিত জগদীশবাবু নিজের জায়গা থেকে তাকে আমন্ত্রণ জানান। তখন হরিদা বলেন, অর্থের অহংকারেই তিনি হয়তাে। নিজেকে ভগবানের চেয়ে বড়াে বলে মনে করেছেন। এই কথার উত্তরে জগদীশবাবু তাকে রাগ করতে বারণ করলে হরিদা বিরাগীর চরিত্রে কোনাে রিপু নেই বলে জানান। জগদীশবাবু তার বাড়িতে বিরাগীজিকে থাকতে অনুরােধ করেন। তখন হরিদা বলেন বিপুলা এই পৃথিবীর মাটিতেই তার স্থান। জগদীশবাবুর বাড়িতে হরিদা কোনাে কিছু স্পর্শ করে কেবলমাত্র জলগ্রহণ করেন। অর্থের মােহ কেবল একটি বঞ্চনা, তাই সন্ন্যাসীরূপী হরিদা জগদীশবাবুকে সেই পরমেশ্বর, সৃষ্টিকর্তার সাধনা করতে বলেন। হরিদার সাজসজ্জা, কথনভঙ্গি এবং ব্যক্তিত্বময় উপস্থিতিতে মুগ্ধ হয়ে জগদীশবাবু তীর্থভ্রমণের জন্য একশাে এক টাকার একটি থলি দেন। কিন্তু সন্ন্যাসব্রত অনুযায়ী বিরাগী নিরাসক্ত। তাই হরিদা ধুলাে মাড়িয়ে যাওয়ার মতাে এই অর্থও অনায়াসে প্রত্যাখ্যান করেন। এভাবেই হরিদা জগদীশবাবুর বাড়িতে নিষ্ঠা ও আদর্শে এক প্রকৃত সন্ন্যাসী চরিত্র হয়ে ওঠেন।
বহুরুপী গল্প : মাধ্যমিক বাংলা | মাধ্যমিক বাংলা সাজেসান
প্রশ্ন: হরিদার জীবনে দুঃখকষ্ট থাকা সত্ত্বেও কীভাবে তিনি মানুষকে আনন্দদান করেছেন, তা ‘বহুরূপী’গল্প অবলম্বনে নিজের ভাষায় লেখাে।
উত্তর: ভূমিকা : সুবােধ ঘােষের লেখা বহুরুপী’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। হরিদা পেশায় বহুরুপী। সারা জীবন অত্যন্ত দারিদ্র্যে জীবনযাপন করেও বহুরূপী সাজে তিনি মানুষের মনােরঞ্জন করেন।
বন্ধুদের আনন্দদান: গল্পকথক ও তার বন্ধুরা শহরের সবচেয়ে সরু গলিতে হরিদার ছােটো ঘরে আড্ডা দেন। অর্থাভাবের জন্য হরিদার ঘরে উনুনে ভাতের বদলে বেশিরভাগ সময় শুধু জল ফোটে। তবু বন্ধুদের আনা দুধ-চিনি-চা পাতা দিয়ে চা বানিয়ে দিতে হরিদা কখনও বিরক্ত হন না। কারণ বন্ধুদের আনন্দ দিয়েই তার তৃপ্তি।
বহুরূপী সাজ : বহুরূপীর পেশা হরিদার জীবনে নাটকীয় বৈচিত্র্য এনেছে। সপ্তাহে একদিন হরিদা কখনও উন্মাদ, কখনও রূপসি বাইজি, কখনও পুলিশ, কখনও কাপালিক বা বাউল অথবা কাবুলিওয়ালা, কখনও বিরাগী সন্ন্যাসী সেজে সবাইকে চমকে দিত।
দারিদ্র্যকে জয় : দরিদ্র হরিদা ইচ্ছে করলেই পেশার পরিবর্তন ঘটিয়ে বাড়তি রােজগার করতে পারতেন। কিন্তু নিয়মে বাঁধা জীবনের একঘেয়েমি হরিদার পছন্দ নয়। বহুরুপী সেজেই তার মনের তৃপ্তি। এভাবেই হরিদা জীবনের দুঃখকষ্ট পেরিয়ে বহুরূপী সাজে কখনও মানুষকে মুগ্ধ করতেন, কখনও বিস্মিত করে আনন্দদান করতেন।
প্রশ্ন: ‘ বাঃ, এ তাে বেশ মজার ব্যাপার।’-বক্তা কে? কোন্ প্রসঙ্গে তিনি এ কথা বলেছেন? মজার বিষয়টি নিজের ভাষায় বিবৃত করাে।
উত্তর : বক্তা : সুবােধ ঘােষ রচিত ‘বহুরূপী’ গল্প থেকে গৃহীত উদ্ধৃতাংশের বক্তা হলেন গল্পের নায়ক হরিদা।
প্রসঙ্গ : জগদীশবাবুর বাড়িতে আতিথ্যগ্রহণকারী সন্ন্যাসীর পায়ের ধুলাে কৌশলে সংগ্রহ করার ঘটনা শুনে হরিদা উদ্ধৃত উক্তিটি করেছিলেন।
সন্ন্যাসীর পরিচয় : শহরের ধনী ব্যক্তি জগদীশবাবুর বাড়িতে হিমালয় থেকে আগত একজন সন্ন্যাসী আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ‘খুব উঁচু দরের সন্ন্যাসী। তিনি হিমালয়ের গুহায় বাস করেন। বছরে একটিমাত্র হরীতকী খেয়ে তিনি জীবনধারণ করেন। অনেকের মতে, তার বয়সূ হাজার বছরেরও বেশি।
সন্ন্যাসীর পদধূলি সংগ্রহ : সন্ন্যাসী চলে গেছেন শুনে হরিদা আক্ষেপ করে বলেন যে, সন্ন্যাসী থাকলে তিনি তার পায়ের ধুলাে নিতেন। তখনই জানা যায়, সন্ন্যাসীর পায়ের ধুলাে ‘ভয়ানক দুর্লভ জিনিস। কেউই সেই সন্ন্যাসীর ধুলাে নিতে পারে না। জগদীশবাবু কৌশলে একজোড়া কাঠের খড়মে সােনার বােল লাগিয়ে সন্ন্যাসীর পায়ের কাছে ধরেন। সন্ন্যাসী সেই খড়ম পরার জন্য পা বাড়িয়ে দিলে জগদীশবাবু সেই ফাঁকে সন্ন্যাসীর পায়ের ধুলাে সংগ্রহ করে নেন।
মজার ব্যাপার বলার কারণ : একজন সংসারত্যাগী, বিষয়বিমুখ সন্ন্যাসীর সােনার বােল লাগানাে খড়ম দেখে নিজের সংযম হারিয়ে ফেলার বিষয়টিকে হরিদা মজার ব্যাপার বলে বিদ্রুপ করেছিলেন।
বহুরুপী গল্প : মাধ্যমিক বাংলা | মাধ্যমিক সাজেসান
প্রশ্ন: “গল্প শুনে খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন হরিদা।”—গল্পটি নিজের ভাষায় লেখাে। গল্প শুনে হরিদা গম্ভীর হলেন কেন?
উত্তর: সন্ন্যাসীর গল্প : সুবােধ ঘােষের লেখা ‘বহুরূপী’গল্পে উল্লিখিত শহরের ধনী মানুষ জগদীশবাবুর বাড়িতে হিমালয় থেকে আগত একজন উঁচু দরের সন্ন্যাসী আতিথ্যগ্রহণ করেন। হাজার বছরেরও বেশি বয়সি সেই সন্ন্যাসীর বাস হিমালয়ের গুহায় এবং সারাবছরে তার খাদ্য বলতে একটিমাত্র হরীতকী। সর্বত্যাগী সেই সন্ন্যাসী কাউকে পায়ের ধুলাে নিতে দিতেন না। কিন্তু জগদীশবাবু একজোড়া কাঠের খড়মে সােনার বােল লাগিয়ে সন্ন্যাসীর পায়ের কাছে ধরলে সন্ন্যাসী তা পরার জন্য পা বাড়িয়ে দেন। সেই ফাকে জগদীশবাবু তাঁর পায়ের ধুলাে সংগ্রহ করে নেন। শুধু তাই নয়, বিদায়বেলায় জগদীশবাবু সেই সন্ন্যাসীর ঝােলায় একশাে টাকার একটা নােট জোর করে দিয়ে দেন। বিষয়বিমুখ সন্ন্যাসী সেই দানও সহাস্যে গ্রহণ করেন। গল্পকথক ও তার বন্ধুরা হরিদাকে এই গল্পই বলেছিল। হরিদার গম্ভীর হওয়ার কারণ : দরিদ্র বহুরূপী হরিদার সংসারে অভাব ছিল তীব্র। বিচিত্র ছদ্মবেশ ধারণ করে জনমনােরঞ্জন করলেও তার উপার্জন সারা সপ্তাহের অন্নসংস্থানের উপযােগী ছিল না। তাই নির্লোভ হরিদার মধ্যে এই গল্প শুনে সাময়িক বিচ্যুতি দেখা গিয়েছিল সন্ন্যাসীর। সাজে জগদীশবাবুকে মুগ্ধ করে অর্থোপার্জনের কথা ভাবতে ভাবতেই হরিদা গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন।
প্রশ্ন: “হরিদার জীবনে সত্যিই একটা নাটকীয় বৈচিত্র্য আছে।”—বহুরূপী হরিদার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যেভাবে নাটকীয় বৈচিত্র্য ধরা পড়েছে, তার বিবরণ দাও।
উত্তর : ভূমিকা:সুবােধ ঘােষের লেখা ‘বহুরূপী’ গল্পে হরিদার জীবনের বর্ণময় অভিজ্ঞতা চরিত্রটিকে রঙিন করেছে।
একঘেয়ে কাজে আপত্তি: হরিদার জীবনে দারিদ্র্য চরম। কিন্তু কোনাে অফিসের কাজ বা দোকানের বিক্রিওয়ালার কাজে তিনি অন্তর থেকে বাধা পান। নিয়ম করে রােজ একই চাকরি করতে যাওয়ার একঘেয়েমি তার পছন্দ নয়। তাই তার উনুনের হাঁড়িতে বেশিরভাগ সময় ভাতের বদলে জল ফোটে। তবু বহুরূপী পেশার শিল্পগত আনন্দ তিনি হৃদয় দিয়ে উপভােগ করেন।
বহুরুপীর পেশা : হরিদার বহুরূপীর পেশাই তার জীবনে নাটকীয় বৈচিত্র্য আনে। কখনও তিনি উন্মাদ পাগল সেজে চকের বাসস্ট্যান্ডে ‘আতঙ্কের হল্লা’ বাজিয়ে তুলেছেন। আবার কখনও বা রূপসি বাইজি সেজে ঘুঙুরের মিষ্টি শব্দ তুলে সকলকে মােহিত করেছেন। কিংবা কখনও পুলিশ সেজে আটক ছাত্রদের মুক্ত করতে মাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকেও আট আনা ঘুষ আদায় করেছেন।
নাটকীয়তার চরম নিদর্শন : হরিদা নাটকীয়তার চরম নিদর্শন দেখিয়েছেন বিরাগীর ছদ্মবেশে। জগদীশবাবুর বাড়িতে জবর খেলা দেখাতে গিয়ে তিনি সন্ন্যাসী সেজে সকলকে বিস্মিত করে অভিনব চমক সৃষ্টি করেন। কিন্তু হরিদা হাত পেতে জগদীশবাবুর দান গ্রহণ করেননি। শিল্পীর অহংকারেই হরিদা অবহেলায় জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যের হাতছানি উপেক্ষা করেন। আবার পরদিন জগদীশবাবুর বাড়ি গিয়ে যখন তিনি বকশিশ আদায়ের কথা ভাবেন তখন চরিত্রটি নিজস্ব দ্বন্দ্বে বিশেষ হয়ে ওঠে।
প্রশ্ন: “এই শহরের জীবনে মাঝে মাঝে বেশ চমৎকার ঘটনা সৃষ্টি করেন বহুরূপী হরিদা।” হরিদার সৃষ্ট দুটি চমৎকার ঘটনার বিবরণ দাও। মানুষের মনে ওই ঘটনা দুটি কী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল, তা নিজের ভাষায় লেখাে।
উত্তর: ভূমিকা : সুবােধ ঘােষ রচিত বহুরূপী’ গল্পে বহুরূপী হরিদা বিভিন্ন রূপে নানা চমৎকার ঘটনার সৃষ্টি করেছেন।
প্রথম ঘটনা:একদিন দুপুরবেলা চকের বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটা ‘আতঙ্কের হল্লা’ বেজে উঠতে দেখা যায়। সকলের চোখে পড়ে, একটা বদ্ধপাগল থান ইট হাতে নিয়ে বাসের যাত্রীদের দিকে তেড়ে যাচ্ছে। তার মুখ থেকে ঝরে পড়ছিল লালা, চোখ কটকটে লাল, কোমরে জড়ানাে ছেড়া কম্বল এবং গলায় টিনের কৌটোর একটা মালা। এই পাগলই ছিল হরিদা।
দ্বিতীয় ঘটনা: শহরের এক সন্ধ্যায় হরিদা রূপসী বাইজি সেজেঘুঙুরের মিষ্টি শব্দে নাচতে নাচতে যাচ্ছিল। ব্যস্ত শহরের কৌতুহলী মানুষকে দেখে সে দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, মুচকি হাসে, চোখ টিপে ফুলের সাজি এগিয়ে দেয়।
প্রথম ঘটনার প্রতিক্রিয়া : উন্মাদ পাগলরূপী হরিদাকে দেখে প্রথমে যাত্রীরা কেউ কেউ ভয়ে চেঁচিয়ে উঠে দুটো একটা পয়সা ফেলে দেয়। তারপর ছদ্মবেশী হরিদাকে চিনতে পেরে বাসের ড্রাইভার কাশীনাথ ধমকে দিলেও বাসের যাত্রীরা কেউ বিরক্ত হয়, কেউ মুগ্ধ হয়ে হাসে, আবার কেউ বিস্মিত হয়। প্রশংসাসূচক মন্তব্যও করে তারা “সত্যিই, খুব চমৎকার পাগল সাজতে পেরেছে তাে লােকটা।” দ্বিতীয় ঘটনার প্রতিক্রিয়া : বাইজি ছদ্মবেশী হরিদাকে দেখে শহরের দোকানদাররা হেসে ফেলে এবং একটা সিকি তার ফুলের সাজিতে ফেলে দেয়। নবাগতরা তাকে দেখে অবাক হলেও পুরােনাে দোকানদাররা হরিদাকে চিনতে পেরেছিল।

বহুরুপী গল্প : মাধ্যমিক বাংলা | মাধ্যমিক সাজেসান
প্রশ্ন: ‘ তেমনই অনায়াসে সােনাও মাড়িয়ে চলে যেতে পারি।” –আলােচ্য উক্তির মাধ্যমে হরিদার নির্লোভ জীবনের যে পরিচয় ফুটে উঠেছে, তা আলােচনা করাে।
উত্তর: ভূমিকা : সুবােধ ঘােষের লেখা বহুরূপী’ গল্প থেকে গৃহীত উদ্ধৃতাংশে হরিদার নির্লোভ মানসিকতা প্রকাশিত হয়েছে।
দারিদ্র্য : পেশায় বহুরূপী হরিদা শহরের সবচেয়ে সরু গলির ছােটো একটা ঘরে বাস করেন। অভাবের তাড়নায় বেশির ভাগ দিন তার ভাত জোটে না। তা সত্ত্বেও তিনি অতিরিক্ত উপার্জনের লােভে পেশার পরিবর্তন করেননি।
নির্লভ মানসিকতা : বিভিন্ন সময় নানা সাজে হরিদা পথে নেমে মানুষের মনােরঞ্জন করেছেন। কিন্তু তাতে যে অর্থোপার্জন হয়েছে তা দিয়ে সারা সপ্তাহের অন্নসংস্থান হয়নি। অথচ সেই দারিদ্র্য নিয়েও কোনাে অনুযােগ বা অভিযােগ তিনি করেননি। জগদীশবাবুর বাড়িতে খেলা দেখানাের আগে তিনি বলেছিলেন—একবারেই যা ঝেলে নেব তাতে আমার সারা বছর চলে যাবে। কিন্তু বাস্তবে নির্লোভ হরিদা নিজের চরিত্রগুণেই সেই আশা পূরণ করতে পারেননি। বিরাগী সেজে জগদীশবাবুর কাছ থেকে পানীয় ঠান্ডা জল ছাড়া অন্য কোনাে সেবা নেননি। কয়েকদিন তার বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণের অনুরােধ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন। এমনকি জগদীশবাবু একশাে এক টাকা প্রণামি দিতে চাইলে সেই প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করে তিনি উদ্ধৃত মন্তব্য করেছেন। অর্থাৎ বিরাগীবেশী হরিদার কাছে অর্থ ধুলাের মতােই নগণ্য। এভাবে প্রমাণিত হয়েছে বহুরূপী হরিদা দরিদ্র কিন্তু তিনি আসলে একজন নির্লোভ মানুষ।
প্রশ্ন : “তাতে যে আমার ঢং নষ্ট হয়ে যায়।”—বহুরূপী’ গল্পের আলােকে উদ্ধৃতিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করাে।
উত্তর : সুবােধ ঘােষের লেখা বহুরূপী গল্পের প্রধান চরিত্র হরিদা উদ্ধৃত উক্তিটি করে।
তাৎপর্য : গল্পে বর্ণিত হরিদা ছিলেন পেশায় বহুরূপী। সপ্তাহে একদিন ছদ্মবেশ ধারণ করে দর্শকদের মনােরঞ্জন করে তিনি যে অর্থ উপার্জন করেন, তাতে সারা সপ্তাহের অন্নসংস্থান হয় না। তাই হরিদা যখন জগদীশবাবুর বাড়িতে আসা হিমালয়ের সন্ন্যাসীর কথা শুনেছিলেন, তখন তিনিও সন্ন্যাসী ছদ্মবেশের কথা ভাবেন। তিনি আরও স্থির করেন যে এই সন্ন্যাসীর রূপ ধারণ করেই তিনি বেশি পরিমাণ অর্থ আয় করবেন। কিন্তু হরিদা যখন প্রকৃতই সন্ন্যাসীর বেশে জগদীশবাবুর বাড়িতে যান, তখন তিনি তার থেকে সমস্ত সেবা প্রত্যাখ্যান করেন।এমনকি প্রণামি হিসেবে একশাে এক টাকাও তিনি গ্রহণ করেন না। হরিদার এই আচরণে তার বন্ধুরা অবাক হলে তিনি উদ্ধৃত উক্তিটি করেন। হরিদার এই উত্তরে এক গভীর সত্য লুকিয়ে ছিল। যিনি সন্ন্যাসী তিনি সমস্ত রকম মােহ থেকে মুক্ত। তাই, সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে হরিদা কখনােই অর্থের প্রতি আসক্ত হতে পারেন না। হরিদার এই নিরাসক্তি থেকে আরও স্পষ্ট হয় যে, তিনি আদর্শবাদী ও শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধ।
প্রশ্ন : “অদৃষ্ট কখনও হরিদার এই ভুল ক্ষমা করবে না।” হরিদা কী ভুল করেছিলেন? অদৃষ্ট ক্ষমা না করার পরিণাম কী?
উত্তর : ভুল: সুবােধ ঘােষ রচিত বহুরূপী’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হরিদা বিরাগী সেজে জগদীশবাবুর বাড়ি গিয়েছিলেন। কিন্তু শিল্পের প্রতি সততায়, তার বৈরাগী সাজের সার্থকতার জন্য তিনি চরম দারিদ্র্যেও জগদীশবাবুর থেকে একশাে এক টাকা প্রণামি গ্রহণ করেননি। তার এই নির্মোহ আচরণকেই উদ্ধৃতাংশে ভুল বলা হয়েছে।
পরিণাম:হরিদা হতদরিদ্র। দারিদ্র্যের চরম সীমায় দাঁড়িয়ে প্রায়ই তার ভাতের হাঁড়িতে শুধু জল ফুটে যায়। কিন্তু শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতায় হরিদা অর্থের প্রতি নির্মোহ থাকেন। তাই জগদীশবাবুর বাড়িতে তিনি তার প্রাপ্য প্রণামির অর্থ ফিরিয়ে দেন। এ কারণে তার সঙ্গীদের মনে হয় দরিদ্রজীবনে টাকা আসার সম্ভাবনাকে প্রত্যাখ্যান করায় অদৃষ্টে পরিণাম
লেখা থাকবে। সেই পরিণতিতে হরিদার দারিদ্র্য চিরকাল থেকে যাবে।
প্রশ্ন : “খাঁটি মানুষ তাে ” , বহুরূপীর জীবন এর বেশি কী আশা করতে পারে?’—এই উক্তির প্রেক্ষিতে বহুরুপী হরিদার চরিত্র বিশ্লেষণ করাে।
উত্তর : নির্লোভ মানসিকতা:সুবােধ ঘষের বহুরূপী’ গল্পে বহুরূপী হরিদা দরিদ্র জীবনের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। শহরের সবচেয়ে সরু গলির ছােটো একটা ঘরে তিনি বাস করতেন। বহুরূপী পেশাতে তার রােজগার ছিল অত্যন্ত স্বল্প। পরিচিতরা হরিদাকে বহুরূপীর বেশে দেখে এক-আনা, দু-আনা বকশিশ দেয়। অপরিচিতরা দেয় আরও কম—দুটো-একটা পয়সা। সেই অর্থে সংসার চালানাে ছিল দুঃসাধ্য। অথচ তা নিয়ে হরিদাকে কখনও অসন্তোষ বা ক্ষোভ জানাতে দেখা যায়নি। একটা অদ্ভুত নির্লোভ মনােভাব ফুটে উঠেছে তার আচরণে।
চরিত্রের দ্বন্দ্ব : ব্যতিক্রম ঘটেছে কেবল একবার, তাও
সাময়িক। জগদীশবাবুর বাড়িতে বিরাগীর ছদ্মবেশে ‘জবর খেলা’ দেখিয়ে কিছুটা বাড়তি রােজগার করতে চাইলেও নিজের শিল্পের প্রতি নিষ্ঠা ও নির্লোভ মনােভাব হরিদাকে সেই উপার্জনে বাধা দেয়।
জগদীশবাবু কয়েকদিন তার বাড়িতে থাকতে বললে বিরাগীরূপী হরিদা সেই প্রস্তাবে সম্মত হননি। প্রণামিস্বরূপ একশাে এক টাকা দিতে চাইলেও খাঁটি সন্ন্যাসীর মতাে তিনি তা প্রত্যাখান করেছেন।
শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা :হরিদা জগদীশবাবুর বাড়িতে বকশিশ চাইতে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলেও আট আনা বা দশ আনার বেশি টাকা চাইতে পারেন না। বিরাগীর নির্মোহ মানসিকতাই তার কারণ। উদ্ধৃত উক্তি থেকে হরিদার শিল্পের প্রতি ভালােবাসা এবং দায়বদ্ধতা প্রকাশিত হয়।
You must be logged in to post a comment.