✪ আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনায় , “ জীবন স্মৃতি” -র গুরুত্ব আলােচনা করাে ।
উ : ভূমিকা : আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ জীবন স্মৃতি ’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । এই গ্রন্থটি প্রবাসী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল । পরে তা ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় । যদিও নিজের কথা বলার জন্যই রবীন্দ্রনাথ তাঁর আত্মচরিত লেখেন । তবুও তার থেকে আমারা তখনকার দিনের অনেক কথাই জানতে পারি
ঠাকুরবাড়ির ও তখনকার দিনের বিভিন্ন বড়োবাড়ির ছেলেদের বিবরণ :-
এই স্মৃতি কথা থেকে ঠাকুর বাড়ি সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া যায় । ঠাকুর বাড়ির পরিবেশ কেমন ছিল তার খুঁটিনাটি বিবরণ তিনি দিয়েছেন । কীভাবে তাঁর সাহিত্য প্রতিভা বিকশিত হয়েছিল , সেকথাও তিনি বলেছেন । ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনা ও অভিজ্ঞতা এবং সাহিত্য সংক্রান্ত নানা তথ্য ছড়িয়ে রয়েছে ‘ জীবন স্মৃতির ‘ পাতায় পাতায় । ‘ জীবন স্মৃতি ’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম জীবনের স্মৃতির সূত্র ধরে বাল্য জীবনের ঘরােয়া পরিবেশ ও সমাজের চিত্র তুলে ধরেছেন । তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় রবীন্দ্রনাথের মতাে অভিজাত পরিবারের সন্তানরা , বাল্যকালে মা – বাবা – গুরুজনদের প্রতিপালক রূপে পাননি । তারা মূলত পরিচালকদের তত্ত্বাবধানে বড়াে হয়ে উঠতেন । অন্যান্য ঘরের কাজে নিযুক্ত লােকজন ছােটদের ওপর কর্তৃত্ব ফলাত । ঠাকুর বাড়ির এই বিষয়টি তৎকালীন সমাজের সম্ভ্রান্ত পরিবারের বৈশিষ্ট্যকেই সূচিত করে ।
কলকাতা শহরের বিবরণ :-
‘ জীবন স্মৃতি ‘ গ্রন্থে শহর কলকাতার বাবু শৌখিনতার পাশাপাশি পল্লী স্বভাবের চিহ্নও ধরা পড়ে ।কলকাতার বিভিন্ন উৎসবের কথাও রয়েছে এই গ্রন্থে ।
স্বাদেশিকতা :-
রাজনীতির কথা সেভাবে কবি লেখেননি । কিন্তু স্বল্প পরিসরে ‘ স্বাদেশিকতা ’ নিয়ে সরস ভাষায় যে অনবদ্য রচনা তিনি লিখেছেন , তা ইতিহাসের যেকোনাে ছাত্রকে মুগ্ধ না করে পারে না । স্বাদেশীকতার আবেগ নিয়ে এত সুন্দর ও মজার বর্ণনা আর কোথাও পাওয়া যায় না ।
উপসংহার :- ইতিহাসের উপাদান হিসেবে ‘ জীবন স্মৃতি ’ যে ভবিষ্যৎ ঐতিহাসিকরা কতটা কাজে লাগাবে , তা নিয়ে বিশ্বকবি নিজেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন ।
তাঁর ভাষায় “ এই স্মৃতি ভাণ্ডারে অত্যন্ত যথাযথভাবে ইতিহাস সংগ্রহের চেষ্টা ব্যর্থ হইতে পারে … ” কিন্তু যতটুকু পাওয়া যায় , তার মূল্যও ইতিহাসের ছাত্রদের কাছে অপরিসীম ।
✪✪✪ নারী ইতিহাসের উপর একটি টীকা লেখাে ।
উত্তর :- ভূমিকা : উনিশ শতকের সূচনাকাল থেকে ঔপনিবেশিক বাংলায় যে সকল সামাজিক পরিবর্তন ঘটেছিল তার প্রভাব নারী সমাজের ওপর পড়ে । সভ্যতার ইতিহাসে নারীদের অবদান , পুর্নমূল্যায়ন করার জন্য বিংশ শতকের শেষার্ধে যে ইতিহাস চর্চা শুরু হয় তাকে বলা হয় নারী ইতিহাস চর্চা ।
নারী ইতিহাস চর্চার সূচনা : ১৯৭০ – এর দশক থেকে নারী ইতিহাস চর্চার সূচনা হয় । এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ব্রিটেন ও আমেরিকার নারীবাদী ঐতিহাসিকরা । পরিবেশ ও নারী পরস্পর সম্পর্কযুক্ত, তাই ‘ Ecofeminism ‘ শব্দটির ব্যাপক প্রচলন ঘটে । ফ্রাঁসােয়া দোবান এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন । বাংলায় বিশেষত কলকাতা নারী শিক্ষার ও নারী ইতিহাস চর্চার কেন্দ্র হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে । যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় – এর মানবী বিদ্যাচর্চা কেন্দ্র বা ‘ School of women studies ‘ । নারী ইতিহাস সম্পর্কিত উল্লেখযােগ্য গবেষণামূলক গ্রন্থ হল- গের্ডা লার্নারের ‘ দ্য ক্রিয়েশন অব প্যাট্রিয়ার্কি ’ এবং নীরা দেশাইয়ের ‘ উত্তম্যান ইন মর্ডান ইন্ডিয়া ।
নারী ইতিহাস চর্চার উদ্দেশ্য :
ইতিহাসে নারীর ভূমিকা কতখানি সে বিষয়ে আলােকপাত করার লক্ষ্যে নারী ইতিহাস গুরুত্ব পেয়েছে ।
নারী ইতিহাস চর্চার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল :
1.ইতিহাসে নারীর ভূমিকার পুনর্মূল্যায়ন ।
2.প্রাক সভ্যতার যুগে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ হলেও সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকেই মানব সমাজ হয়ে পড়ে পিতৃতান্ত্রিক ।
3.সত্যতার ইতিহাসে নারীরা বরাবরই অবহেলিত । তাই অবহেলিত নারীদের সভ্যতায় অবদানের কথা তুলে ধরাই এর প্রধান উদ্দেশ্য ।
4.প্রান্তিক নারীদের অবদানের কথা তুলে ধরা ।
মানব সভ্যতার আদিকাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রেই নারীরা ছিল পুরুষের সমান পারদর্শিনী । যেমন- ঘােষা , অপালা বিশ্ববারার মতাে বিদূষি নারীরা প্রাচীন যুগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় আর নেফারতিতি
রাজিয়া ও দুর্গাবতীর মতাে মহিলারাও ইতিহাসে সমান স্থান অধিকার করে আছে ।
স্বাধীনতা সংগ্রামে নারী : ভারতের স্বাধীনতা । আন্দোলনে সরলাদেবী চৌধুরানী , বাসন্তী দেবী , মাতঙ্গিনী হাজরা , প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার , কল্পনা দত্ত প্রমুখের অবদান চিরস্মরনীয় । স্বাধীন ভারতের পরিবেশ রক্ষায় নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনে মেধা পাটেকার , চিপকো আন্দোলনে গৌরীদেবীর নেতৃত্ব প্রশংসনীয় ।
উপসংহার : নারী ইতহাস চর্চা কেবলমাত্র নারীদের কথা তা নয় , তাদের বিভিন্ন আন্দোলনে অন্তর্ভুক্তি ও সামাজিক অগ্রগতির কথাও তুলে ধরে । এই কারণেই নারী ইতিহাস চর্চা বিশ্বজুড়ে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে ।
সেই উদ্দেশ্যেই ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ‘ আন্তর্জাতিক নারী বর্ষ ‘ এবং ১৯৭৫-১৯৮৫ এর দশক ‘ নারীদশক হিসাবে পালিত হয়েছে ।
✪✪ সরলাদেবী চৌধুরানীর আত্মজীবনী `জীবনের ঝরাপাতা ’ গ্রন্থটি ইতিহাস চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ কেন ?
উত্তর:- আধুনিক ভারতের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল বিভিন্ন ব্যক্তির লেখা আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা ।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগ্নি সরলাদেবী চৌধুরানীর ( স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা ) আত্মজীবনী ‘ জীবনের ঝরাপাতা ’ থেকে আধুনিক ভারতের ইতিহাসের নানা তথ্য পাওয়া যায় । সরলাদেবী ছিলেন একাধারে কবি , সাহিত্যিক , শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিক ।
সামাজিক ইতিহাসের উপাদান : –
“ জীবনের ঝরাপাতা ’ আত্মজীবনীতে সামাজিক ইতিহাসের নানা উপাদান রয়েছে । এই গ্রন্থে একদিকে যেমন একজন মেয়ের বড়াে হয়ে ওঠার কাহিনি রয়েছে তেমনি সেই সময়ে সমাজের নানান খণ্ডচিত্র । এই গ্রন্থ থেকে অভিজাত পরিবারের কায়দাকানুন , দাইমা দিয়ে সন্তান পালন , গৃহশিক্ষক প্রথা প্রভৃতি নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় ।
ঠাকুর বাড়ির অন্দরমহল :-
ঠাকুর বাড়ির অন্দরমহলের বিভিন্ন ঘটনা যেমন সেখানকার সাংস্কৃতিক চর্চা ,ঈশ্বরভাবনা , বিভিন্ন সামাজিক বিধান প্রভৃতি বিষয়ের খণ্ডচিত্র জীবনের ঝরাপাতায় উঠে এসেছে ।
সাংস্কৃতিক ইতিহাস : জীবনের ঝরাপাতা গ্রন্থটি থেকে সমকালীন ইতিহাস , সংগীতের ইতিহাস , নারী শিক্ষার নানান দিক জানা যায় । এই গ্রন্থটি ছিল উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশে নারী সমাজের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল ।
রাজনৈতিক ইতিহাসের উপাদান :
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের স্বদেশি আন্দোলনের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জীবনের ঝরাপাতায় পাওয়া যায় । অগ্নিযুগের অগ্নিকন্যা ’ সরলাদেবীর ওপর গান্ধিজির প্রীতির সম্পর্ক সুবিদিত হলেও তিনি গান্ধিজির অহিংস নীতি পরিত্যাগ করে বিপ্লবী জাতীয়তাবাদের সমর্থক হয়ে ওঠেন । তাঁর আত্মজীবনী থেকে জানা যায় যে মহারাষ্ট্রে যখন ‘ শিবাজী উৎসব ’ জাতীয় আন্দোলনের রূপ নিয়েছে তখন কলকাতায় তিনি প্রতাপাদিত্য উৎসব পালন করেন । এছাড়া তিনি বীরাষ্টমী ব্রতও পালন করেন । স্বদেশি আন্দোলনের সময় সরলাদেবীর ‘ লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ’ তাঁর সাংগঠনিক প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে ।
অর্থনৈতিক শোষণের চিত্র:- ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে অর্থনৈতিক শোষণের নানা চিত্র এই গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে । নীলচাষী , চা বাগানের কুলি ও শ্রমিক , সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ কীভাবে ব্রিটিশদের অত্যাচার ও শোষণের শিকার হয়েছিল তা তার গ্রন্থে তিনি স্পষ্ট ভাবে আলোচনা করেছেন । এইভাবে ছােটো বড়াে গভীর ব্যঞ্জনাময় বর্ণনার ফলে গ্রন্থটি ইতিহাসের অন্যতম দলিলে পরিণত হয়েছে ।