বাংলা রচনা সমগ্র /মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বাংলা রচনা

1.জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা বিল ২০১৩

ভূমিকা :ধনের ধর্ম যে অসাম্য তা ‘লােকহিত’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন। আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষ যেখানে খেতে পান না, ঠিক তার বিপরীতে এমন অনেক পরিবার আছে যাদের অপরিমিত ধন-ঐশ্বর্য রয়েছে। এই ধনবৈষম্য আমাদের খাদ্যের অধিকারকে কেড়ে নিয়েছে। যার ফলে দেশের অধিকাংশ মানুষ অনাহারে কিংবা অর্ধাহারে দিন কাটায়। একবিংশের এই পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে এখনও মানুষ বেঁচে থাকার সামান্য খাদ্যটুকু পায় না।

খাদ্য সুরক্ষা বিলের প্রয়ােজনীয়তা:দেশের সমস্ত মানুষ যাতে ঠিক মতাে খেতে পায় তার জন্যে এই এই বিল আনা হয়।সেপ্টেম্বর ১২ তারিখে এই বিল কার্যকরী হয়েছে। আমাদের দেশের দুই তৃতীয়াংশ মানুষকে নির্দিষ্ট পরিমান ভর্তুকি দিয়ে খাদ্য সরবরাহের কথা বলা হয়েছে এই বিলে।সেই লক্ষ্যে যে নির্দিষ্ট নিয়মগুলি গৃহীত হয়েছে তা হলাে :

১। একজন মানুষ প্রতিমাসে ৫ কেজি খাদ্য শস্য পাবেন।

২। প্রতি কেজি চাল ৩ টাকা, গম ২ টাকা এবং মােটা দানা খাদ্যশস্য ১ টাকা হারে পাবেন।

৩। গর্ভবতী মহিলা, সদ্য প্রসূতি মায়েরা এবং অনাহারে শিশুরা বিনামূল্যে খেতে পাবে।

খাদ্য সুরক্ষা বিলের সুবিধা:

লােকসভায় ২৬ অগস্ট খাদ্য সুরক্ষা বিল পাস হয়। এই বিলে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শিশু বৃদ্ধ এবং গর্ভবতী জননীদের সম্পর্কে বেশকিছু সুবিধার কথা ঘােষণা করা হয়। যেমন

১। ৭৫ ভাগ গ্রামীণ মানুষ এবং ৫০ ভাগ শহরের মানুষ তিন বছরের জন্যে প্রয়ােজনীয় খাদ্য পাবেন।

২। Public Distribution System (PDS) অনুযায়ী ৬ মাস থেকে ৬ বছরের মধ্যে যাদের বয়স তারা সঠিক খাদ্য বিনামূল্যে  পাবে।

৩। অন্যদিকে যে শিশুদের বয়স ৬ থেকে ১৪ তারা মিড-ডে-মিল পাবে।

৪। গর্ভবতী মহিলা এবং সদ্য প্রসূতি মায়েরা ৬ হাজার টাকা পাবেন গর্ভধারণ থেকে শিশু জন্মগ্রহণের ৬ মাস পর্যন্ত।

রেশন ব্যবস্থা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা:জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্যে রেশন ব্যবস্থাকে সবার কাছে পৌঁছে দেবার।কথা বলা হয়েছে এই বিলে। পরিবারের সব থেকে বয়স্ক মানুষ যিনি কিংবা যিনি সংসারের প্রধান ব্যক্তি তার নামে রেশনকার্ড বিলি করা হবে। আর এ জন্যে গঠন করা হয়েছে ‘State Food Commissions.‘ এই কমিশনের কাজ হলাে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ যাতে সমস্ত সুযােগ সুবিধা পায় তার ব্যবস্থা করা। বলাবাহুল্য এই বিলের দ্বারা খাদ্যের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা হয়েছে। এরফলে বহু মানুষ উপকৃত হবেন। বণ্টন ব্যবস্থা, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, শস্য সুরক্ষা ব্যবস্থা, পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি প্রক্রিয়াগুলি যাতে সুনিশ্চিত হয় তার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে এই বিলে।

খাদ্য সুরক্ষা বিলের সমালােচনা:কেন্দ্রীয় সরকারের আনা খাদ্য সুরক্ষা বিল রাজনৈতিক স্বার্থে আনা হয়েছে বলে বিরােধিরা মনে করেন তাদের বক্তব্য শুধুমাত্র ভােটের অঙ্ক অনুসারে এই বিলটি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। তারা মনে করে, শুধুমাত্র সরকারি টাকার অপচয় ছাড়া আর বিশেষ কোনাে লাভ হবে না এই বিলের মাধ্যমে বলে বিরােধীদের মনে হয়েছে। 

১। এই বিল খাদ্য সুরক্ষা বিল নয়, এ হলাে ভােট সুরক্ষা বিল।

২। ভােট বৈতরণী পার করার জন্যে দরিদ্র মানুষকে কাছে ডাকার ছদ্ম-ভালােবাসার প্রয়াস হলাে এই বিল।

৩। সুনির্দিষ্ট পরিকাঠামাে না থাকার কারণে এই বিল সদর্থক কোনাে ভূমিকা গ্রহণ করতে পারবে না।

স্বচ্ছতা ও গ্রহণযােগ্যতা:এই বিলের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযােগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেননা, সরকারি প্রচেষ্টা সত্ত্বেও রাজনীতির অঙ্গুলিহেলনের মধ্যে সাধারণ মানুষ যে খুব সুবিধা পাবে তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। ফলে এই বিল নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থেকেই যায়। তাছাড়া নির্দিষ্ট রাজনীতির মানুষরা ছাড়া অন্যেরা কতখানি উপকৃত হবে সে বিষয়েও সন্দেহের অবকাশ আছে।

উপসংহারঃ খাদ্য সুরক্ষা বিল নিয়ে বিতর্ক আছে। তবু সাধারণ মানুষের যদি সামান্যতম কল্যাণ  হয় তবেই সমস্ত বিতর্কের অবসান হবে। নিত্য দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও আগুন ছোয়া বাজার যেভাবে মানুষের স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে, সেখানে খাদ্য সুরক্ষা বিল  যদি আশার আলো 🔆 দেখায়, তাহলে আমরা খুশি হবাে।

                 🌺🌺🌺🌺

  2.একজন বেকার যুবকের আত্মকথা:

নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। বাবার সামান্য আয়ের সংস্থানে আর মায়ের নিতান্ত হিসেবিপনায় সংসারের রথটা কোনােরকমে খুঁড়িয়ে চলছিল। তাতেই আমরা  ভাই-বােনে মানুষ হচ্ছিলাম।  আমাকে ঘিরে মা-বাবার বাড়তি কিছু স্বপ্ন ছিল, লেখাপড়াও শিখেছিলাম ভালো করে । একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে আমার কিছু আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকা অপরাধের নয়। তাই এখন আমাকে ঘিরেই বাবার উম্মা, মায়ের মূক নীরব দৃষ্টি, ভাইবােনেদের ক্ষোভ আর অভিমান। আর আত্মীয়-পরিজনদের সবসময়ই কৌতূহলী প্রশ্ন—কিছু একটা হিল্লে হল? বলতে দ্বিধা নেই, এখন আমি হতভাগ্য এক বেকার যুবক।

শিক্ষাজীবনের নানা স্বপ্ন। ছাত্রজীবনে আমাকে ঘিরে কত আশা, কত স্বপ্ন। মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় বাবা বলল—“বাবা মাধ্যমিকটা ভালাে করে দে, এটা বাড়ির বুনিয়াদের মতাে। ভিত মজবুত না হলে বাড়ি টিকবে না। ” আমিও জান লড়াইয়ে দিলাম। ফল বের হলে দেখা গেল দুদাঁড়ি। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার আগে মাস্টারমশাই বললেন—“জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে উচ্চমাধ্যমিকে ভালাে রেজাল্ট করতেই হবে। কারণ ডাক্তার হবে, না ইঞ্জিনিয়ার হবে কিংবা জেনারেল লাইনে যাবে উচ্চমাধ্যমিক-ই তা ঠিক করে দেবে। ” 

আবার উঠে পড়ে লাগলাম। না, হল না। ল্যাং খেলাম। সেই কত ছােটো থেকে‘তােমার জীবনের লক্ষ্য রচনায় ডাক্তার’ হওয়ার কথা লিখে আসছি, আজ এক নিমেষেই সেই বাসনার বেলুন চুপসে গেল।আসলে ডাক্তারি আর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানাের যতগুলি সিট, আর তাতে আমাকে চান্স পেতে গেলে আরও যতগুলি সিট বাড়াতে হবে এবং তার জন্য যে আন্দোলনের প্রয়ােজন, জেনারেল লাইনে পড়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বাসনাকে তার চেয়ে কম কষ্টকর ভেবেছিলাম।

কলেজে গেলাম। বিভাগীয় প্রধান বললেন, ‘ভূগোল নিয়ে পড়ে MA-তে চান্স না পেলে কোনাে দাম নেই। আমাদের চোদ্দো পুরুষ যেখানে যায়নি, আমি যেতে বাধ্য হলাম—বিশ্ববিদ্যালয়ে।

শচীনবাবু ভালােবাসতেন আমাকে বললেন, ‘MA-তে ৫৫% নম্বর পেতেই হবে। তবেই NET-এ বসতে পারবে’ | চমকে উঠলাম। ভাবলাম, সেই ছােটোবেলায় শ্লেটে লেখা ছেড়েছি, Net-এ করে মাছও ধরেছি, বুড়াে বয়সে করতে হবে নাকি! যাই হােক, নেটে বসতেই হবে, কারণ, সুযােগ পাই না পাই, অন্তত বলতে পারব, অধ্যাপক হওয়ার পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি। শিক্ষিত যুবকের গৌরব নিয়ে আমি তখন সংসারের ভাবী ত্রাণকর্তা। চাকরি হবে, সংসারের আর্থিকস্বাচ্ছল্য আসবে, ছােটো ভাই-বােনেরা লেখাপড়া শিখে মানুষ হবে, সংসারের অর্থাগমের সম্ভাবনা সুনিশ্চিন্ত হবে—কত স্বপ্ন।

শিক্ষা শেষে চাকরির সন্ধান। কিন্তু বাস্তব কত কঠোর! নির্মম! সেদিন রাজুদার সঙ্গে দেখা। বলল—“তিন বছর MAপাশ করে বসে আছি, কিছুই হচ্ছে না। বললাম—‘আমারও তাে একই অবস্থা। কর্মক্ষেত্রের বিজ্ঞাপন দেখে দরখাস্তেরপর দরখাস্ত করছি। ইন্টারভিউ-ও যে না পাচ্ছি, তা নয়। ‘সব জায়গায় গিয়েই মনে হয়েছে ব্যবস্থা আগে থেকেই হয়ে আছে।’

রবীন্দ্রনাথের ভাষায়

     ” ঠাই নাই ঠাই নাই—ছােটো সে তরী              

                আমারি সােনার ধানে গিয়েছে ভরি।  ”     

সর্বত্র ব্যর্থতা আর নৈরাশ্যের গ্লানি। কোথাও কোথাও ডােনেশনের নামে মােটা টাকার উৎকোচ প্রদানের নগ্ন প্রস্তাব।কোথাও বা পদপ্রাপ্তির প্রস্তাবকে নিলামে তুলে প্রার্থীদের কে কত দিতে পারে তার প্রতিযােগিতা। বেকার জীবনে এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা।

 এরই মাঝে স্কুল সার্ভিস কমিশন নামক মামদো ভূত ভয় দেখাচ্ছে। জানি না, টকের জ্বালায় পালিয়ে এসে তেঁতুল তলায় বাসা হবে কি না। তবু স্বপ্ন দেখতে হবে।

         ভারতচন্দ্র যেমন স্বপ্ন দেখেছিলেন—

                “আমার সন্তান যেন

                      থাকে দুধে ভাতে।” 

কিংবা শঙ্খ ঘােষ— 

            “ধ্বংস করে দাও আমাকে 

      যদি চাও আমার সন্তান স্বপ্নে থাক।”

ব্যর্থতা ও স্বপ্নভঙ্গ। সময় কারাের জন্য অপেক্ষা করে না। আমার চাকরি নিয়ে হন্যে হয়ে এরকম দাপাদাপি চলছে, আর অন্যদিকে বাবার সামান্য আয়ের সংস্থান।  আয়-ব্যয়ের সমান পাল্লা। কাজেই বাড়তি সঞ্চয়ের প্রশ্নই ছিল না। যদি থাকে, তা ছিল আমাকে ঘিরে। আজ এই অপদার্থ বেকার যুবকের অবস্থা হঠাৎ ফেল করা ব্যাংকের মতাে। আপনার সারা জীবনের সঞ্চিত সম্পদ ব্যাংকে গচ্ছিত রেখে আপনি ভাবী জীবনের জন্য নিশ্চিন্ত, আকস্মিক দুঃসংবাদ এল ব্যাংক লাল বাতি জ্বেলেছে। মূক স্তম্ভিত হতবাক আপনি। বাবাকে দেখলে তার অবস্থাও অমনি মনে হবে। সমস্ত সংসারটা বাজ-পড়া মুখ-থুবড়ানাে তালগাছটার মতাে। মা-বাবার বাকি জীবন, ভাই-বােনদের লেখাপড়া, সংসারের লােকলৌকিকতা—কী হবে; কী হতে পারে—সবই অনিশ্চিত অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া প্রতিকারহীন অসংখ্য প্রশ্ন। অথচ কেমন পরিহাস দেখুন, নিঃশেষ হয়েও সামাজিক ঠাটটুকু বজায় রাখতে হচ্ছে বাইরের মানুষের কাছে। না পারছি কুলিগিরি করতে, না পারছি খেতে-খামারে কাজ করতে। আমার এতদিনের সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়েছে। সেই সঙ্গে বাবারও। যাকে তিনি ভাবী সঞ্চয়ের তহবিল ভেবেছিলেন, সে এমন ফুটো তহবিল হয়ে সংসারকে বুড়াে আঙুল দেখাবে, বােধ করি তা ছিল তাঁর চিন্তার অতীত।বেকার জীবনের গ্লানি। অন্ধকারের মাঝে কখনও দেখি আলাের হাতছানি; পরক্ষণেই বুঝতে পারি সে আলাে নয়,আলেয়া। যে জীবনটাকে স্কুল-কলেজের চৌহদ্দিতে রেখে এসেছি; সেখানে কত উপদেশ, কত আশার কথাই না শুনেছি :

              ‘আত্মবিশ্বাস হারানাে পাপ। ” 

              “আশায় মানুষ বুক বাঁধে। ” 

           ” উচ্চাশা মহত্ত্বের ভিত্তিভূমি।” 

দিনের পর দিন প্রত্যাখ্যাত কর্ম প্রার্থী যুবকের কাছে এ সব উপদেশ ও বাণী কি ব্যর্থ পরিহাস হয়ে দেখা দেয় না? কঠোর বাস্তবের রূঢ় আঘাতের মর্মদাহই কিতাদের মানসিক বিকৃতির কারণ নয়? তারই পরিণামে কি ভাঙার নেশায়, ধ্বংসের উন্মাদনায়, চুরি রাহাজানির মতাে সমাজবিরােধী কাজে নিজেদের নষ্ট করে না?

ছেলেবেলায় শুনতাম ‘লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘােড়া চড়ে সে। কথাটা হয়তাে সেকালে খাটত। এ যুগের কবি হয়তাে লিখবেন—“লেখাপড়া করে যে গাড়ি চাপা পড়ে সে” কিংবা ” লেখাপড়া করে যে অনাহারে মরে সে’’—অন্ধকারময় ভবিষ্যতের আতঙ্কভরা দুঃস্বপ্ন দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে শুনি অনাহারে কর্মহীন অন্ধকারে ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাওয়ার মন্থর, নিশ্চিত, নিঃশব্দ পদধ্বনি।

বলতে পারবে আমি কে? আমি আর কেউ নই, আমি আপনাদের‘আমি  সেই কৌশিক ‘।

                


     3.যৌন নিপীড়ন, শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণ:বর্তমান সমাজ

সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করা বাঙালিএখন সভ্যতার সর্বস্ব গ্রাস করা অপসংস্কৃতির তলানীতে ঠেকেছে। সুস্থ মূল্যবােধ এখন আমাদের জীবন থেকে একপ্রকার উধাও হতে চলেছে।যে নারীত্বকে একসময় আমরা সবথেকে মর্যাদা দিয়েছি, সেই নারীত্ব এখন ভূলুণ্ঠিত।

আমাদের তরুণ সমাজ, আমাদের সভ্যতার মেরুদণ্ড এখন তন্দ্রাচ্ছন্ন। তাদের চেতনার।সবগুলি কক্ষ যেন রুদ্ধ। ফলে প্রতিমুহূর্তে সংবাদের শিরােনামে এসে যায় তরুণ ।প্রজন্মের ভেঙে পড়া মূল্যবােধের নানা চালচিত্র। বিপদগামী তরুণ সমাজ প্রতি নিরন্তর।মারদাঙ্গা, ধর্ষণ, যৌন নির্যাতনের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন? যে তরুণ প্রজন্ম।স্বপ্ন দেখেছিল এবং যাদের হাত ধরেই সভ্যতা এগিয়ে চলেছিল, তাদের এই ভাবান্তর।আমাদের ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আজকের তরুণ সমাজ :

বেকারত্ব, হতাশা আর তার সঙ্গে মিশেছে পাশ্চাত্য দুনিয়ার নানা লােভাতুর চিত্র। ফলে আজকের যুব সমাজের মধ্যে সেই প্রাচীন মূল্যবােধের অনেকটাই ক্ষীণ হয়ে এসেছে। এখন প্রতি নিরন্তর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষক বিবাদ, তরুণীর উপর নিগ্রহের অভিযােগ-অনুযােগ দূরদর্শনের যে কোনাে চ্যানেল ঘােরালেই চোখে পড়ে।আর এর ফলে সমস্যা হল সাধারণ বাবা-মা তাদের সন্তান-সন্ততিদের বিদ্যালয়ে পৌঁছে দিয়েও শান্তি পাননা। এমন এক অশান্তিকর পরিবেশে আমরা চাই তরুণরা আবার সেই প্রাক্-স্বাধীন পর্বের মানব-মূল্যবােধে ফিরে আসুক। তাদের উগ্র স্বভাব, চরম স্বার্থপরতা, রুচিহীন কার্যকলাপ যতক্ষণ না সঠিক পথে পরিচালিত না হবে ততক্ষণ সভ্যতার কোনাে সকালই আতঙ্কহীন সকাল হয়ে উঠবে না।

তরুণ সমাজের অবক্ষয়ের কারণ:

শুধুমাত্র ডিগ্রী অর্জন এবং তার পাশে বেকারত্ব বৃদ্ধির ফলে তরুণ সমাজের ভিত সম্পূর্ণভাবে নড়বড়ে হয়েছে। স্থায়ী চাকরি এবং একটি সুন্দর স্বাস্থ্যসম্মত জীবন পাওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা তা সম্পূর্ণভাবে আয়ত্তাতীত হওয়ার ফলে তরুণদের স্বপ্ন এবং প্রত্যাশার মধ্যে দুস্তর ব্যবধান দেখা গিয়েছে। ফলে রাজনৈতিক দাদাদের হাতের পুতুল হয়ে পড়েছে আমাদের তরুণ প্রজন্ম। উপরন্তু যৌন নিপীড়ন করবার অবদমিত ইচ্ছার ফলে প্রায়ই রাস্তাঘাটে মেয়েদের বিপদে পড়তে হয়। শুধুমাত্র তরুণদের দোষ দিয়েও লাভ নেই। কেননা, তাদের যারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন সেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের জীবনদর্শনগত ভুলভ্রান্তির ফলে যৌন নিগ্রহের ঘটনা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।

এইসময়ের অবস্থা : হাজারতর অশনি সংকেত রাজ্যে শহর ও শহরতলী এলাকাগুলিতে রীতিমত নাবালিকা-সাবালিকা, শিশু থেকে বয়স্কা রমণী—প্রত্যেকেই যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছে। সাম্প্রতিকতম এমন ঘটনারমধ্যে উল্লেখযােগ্য নিঃসন্দেহে দিদি রিংকুকে শ্লীলতাহানির হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে বারাসাতের রাজীবের মৃত্যু। এই ঘটনা আমাদের মনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে।কামদুনির ঘটনা নিয়ে বাংলার ভূগােল অবশেষে দিল্লীর আঙ্গিনাতেও পৌঁছে দিয়েছে।প্রায়ই জেলার বিভিন্ন জায়গায় এধরনের ঘটনা আমাদের উৎকণ্ঠার কারণ। ৪ অগস্ট,২০১৩ রবিবার ভােরে কাটোয়ার দাঁইহাটে দিদি আর বােনকে নিগ্রহের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে মারা গেলেন কুড়ি বছরের গণেশ মুর্মু। সম্প্রতি খাস কলকাতা শহরের বুকে এক নাবালিকাকে বন্দি রেখে দিনের পর দিন যৌন নির্যাতন চালানাের অভিযোগ দায়ের হয়েছে তিন আইনজীবীর বিরুদ্ধে। যৌন নির্যাতন ছাড়াও তাদের বিরুদ্ধে দাখিল হয়েছে মেয়েটিকে জবরদস্তি আটকে রাখা, মারধর করা, ভীতিপ্রদর্শন ও শিশু নিগ্রহের অভিযােগ। (আনন্দবাজার পত্রিকা, কিশােরীকে আটকে যৌন নিগ্রহের অভিযােগ, ২৩জুলাই, ২০১৩, পৃ. ১) লক্ষণীয় যারা আইনের রক্ষক তারাই প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত রয়েছেন নারী নির্যাতনের সঙ্গে। এমনকি যারা ক্ষমতাশীল ব্যক্তি তারাও কিন্তু এধরনের যৌননিগ্রহের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যুক্ত রয়েছেন। আরামবাগে এক অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীকে মারধর করার পর শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণের চেষ্টার অভিযােগ উঠেছে তৃণমূলকর্মীর বিরুদ্ধে।(এই সময়, ‘ধর্ষণের চেষ্টা, অভিযুক্ত তৃণমূল’, ৭ অগস্ট, ২০১৩, পৃ. ৫) এইসব ঘটনা সামাজিক সুস্থতার লক্ষণ নয়। বিগত প্রশাসন ও বর্তমান প্রশাসনের অনেক নেতা-নেত্রী কাছের মানুষ শুধুমাত্র রক্ষা পেয়েছেন ক্ষমতার জন্যে। ফলে একটি সত্য এ থেকে উঠে আসে যদি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা এবং পুলিশ প্রশাসন তাদের নিজেদের দায়িত্ব পালন না করেন তাহলে নারী নিগ্রহের ঘটনা নিত্য রুটিনে পর্যবসিত হবে। 

প্রতিকারের উপায়:শুধুমাত্র তরুণ প্রজন্মকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেককে ভাবতে হবে নতুন করে। কয়েকটি বিষয় আমাদের মনের মধ্যে যদি একবার গেঁথে যায় তাহলে নিঃসন্দেহে তা ভয়ঙ্কর। যেমন–তরুণ প্রজন্ম একেবারে অবক্ষয়ের শেষ সীমায় পৌঁছে। গেছে কিংবা তরুণ প্রজন্মকে দিয়ে আর কোনাে মঙ্গলই হবে না—এসব নেতিবাচক ধারণা পরিত্যাগ করতে হবে। বরং আমাদের বিশেষভাবে ভাবতে হবে কয়েকটি প্রসঙ্গ। যেমন—

ক। পরিবারের প্রথম থেকেই একটি সন্তানকে নীতিগতভাবে কিছু মূল্যবােধের দীক্ষা দেওয়া আবশ্যক।

খ। দূরদর্শনকেন্দ্রিক যে সংস্কৃতির জগৎ প্রতিমুহূর্তে প্রলােভিত করছে।শিক্ষার্থীদের; সেদিকে অভিভাবকদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

গ। প্রথম থেকে চলচ্চিত্র জগতের নায়ক-নায়িকারা, কিংবা টিভি সিরিয়ালের প্রধান চরিত্ররা যেন কোনভাবে মনের উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে না পারে সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে।

ঘ। বিদ্যালয়গুলিতে স্বামী বিবেকানন্দ-রবীন্দ্র-নজরুল-অরবিন্দ-গান্ধী প্রমুখের জীবন দর্শন যাতে পালিত হয় ও চর্চিত হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

ঙ। শিক্ষার্থীরা যাতে নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা ও মানবিক জীবনবােধে পরিচালিত হয় সেদিকেও শিক্ষকদের যত্ন নিতে হবে।  

 মূল্যায়ন :তরুণ প্রজন্মের অধােগামিতার জন্যে শুধু তারা নয়, সকলের দায় রয়েছে। উনিশ শতকে যে সমাজতাত্ত্বিক, ধর্মতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের আদর্শ অনুসরণ করেছিল তরুণরা; সেই আদর্শবান ব্যক্তি এখন সমাজজীবনে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ফলে সামনে অনুসরণ করে পথ চলবার মতাে মানুষ আমাদেরকে হতে হবে। শুধু সবকিছু শেষ হয়ে গেল—এমন নেতি নেতি ধারণা জীবনকে কখনও পূর্ণতার সন্ধান দিতে পারে না। আমরা বিশ্বাস রাখি, এই তরুণরাই একদিন সমস্ত ক্ষয় থেকে মুক্ত হয়ে আবার জেগে উঠবে, তারা দায়িত্বশীল ও সুবিবেচক হয়ে উঠবে।




One thought on “বাংলা রচনা সমগ্র /মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বাংলা রচনা”

Comments are closed.