বাংলা রচনা সম্ভার|দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান |বাংলার উৎসব|বিজ্ঞান ও কুসংস্কার |বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বাংলা রচনা

1. দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান

“ বিজ্ঞানই সভ্যতার উন্নতির মাপকাঠি । বিজ্ঞানের অগ্রগতি মানেই সমাজের অগ্রগতি ।” – আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।
ভূমিকা : – প্রাচীনকালে মানুষ ছিল অরণ্যচারী, গুহাবাসী । কালক্রমে তার বুদ্ধির বিকাশ ঘটল । জ্ঞানবিজ্ঞান ও চেতনার আলােয় উদ্ভাসিত হল মানবসমাজ । ফলে মানুষ ক্রমে দুরন্ত নদীকে করল বশীভূত, দুস্তর সমুদ্র হার মানল তার কাছে, অনন্ত মহাকাশ হল বিজিত, গড়ে উঠল মানবসভ্যতার সুরম্য ইমারত । এই গঠনকার্যে যার প্রত্যক্ষ কিংবা পরােক্ষ অবদান রয়ে গেল, সে হল বিজ্ঞান । বিজ্ঞান হল সেই বিমূর্ত জ্ঞান যা মূর্ত হয়ে ওঠে প্রযুক্তির সংস্পর্শে ।

বিজ্ঞানের জয়যাত্রা : – স্মরণাতীত কালে আগুনের সংস্পর্শে বিজ্ঞানের জয়যাত্রার সূচনা হয়েছিল । এরপর বিজ্ঞান সারথী হয়ে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সভ্যতার বৈজয়ন্তী রথ । শিল্পবিপ্লবের সময়কালে, বাষ্পশক্তির আবিষ্কার এই জয়যাত্রাকে করল ত্বরান্বিত । এরপর এল বিদ্যুৎশক্তি । এই মহার্ঘ্য দানে বলীয়ান মানুষ গড়ে তুলল নতুন সভ্যতা ।বিজ্ঞানলক্ষ্মীর সর্বশেষ শক্তিবর হল পারমাণবিক শক্তি । এইরূপ বিজ্ঞানের দানে প্রতি মূহুর্তে আমরা সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠেছি ।

দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের দান : – দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য । আমাদের জীবন ও বিজ্ঞান যেন অবিচ্ছেদ্য সত্তা । প্রভাতের প্রত্যুষ লগ্ন থেকে নিশীথে শয্যাগ্রহণ পর্যন্ত আমাদের জীবনে লগ্ন হয়ে রয়েছে বিজ্ঞান । প্রভাতে অ্যালার্ম ঘড়ির কলরবে শুরু হয় আমাদের সকাল । বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সংবাদ ঘরে ঘরে পেীছিয়ে যায় সংবাদপত্রের মারফৎ বিশ্ববার্তা ধ্বনিত হয় বেতারে, বিভিন্ন প্রান্তের ছবি ফুটে ওঠে দূরদর্শনের পর্দায় । দূরভাষে প্রিয়জনের সাথে সেরে নিই প্রয়ােজনীয় কথাবার্তা । প্রিয়মুখকে ধরে রাখতে পারি সেলুলয়েডের স্বচ্ছ আধারে, প্রিয়াকণ্ঠকেধরে রাখতে পারি টেপরেকর্ডের রেখা তরজ্ঞে । এভাবেই দৈনন্দিন জীবনের মহতী যক্তের প্রধান উপাচার হয়ে উঠেছেবিজ্ঞান । প্রতিনিয়ত সে আমাদের সরবরাহ করছে স্বপ্ন দেখার নব নব উপঢৌকন ।

কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে বিজ্ঞান : – কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের যথেষ্ট অবদান রয়েছে । বীজ বপন, জলসেচ, ফসল তােলা, ঝাড়াই মাড়াই, সংরক্ষণ ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই লেগেছে বিজ্ঞানের জিয়নকাঠির পরশ । বিজ্ঞানলক্ষ্মীর অকৃপণ দানেই ঊষর মরু হয়ে উঠেছে শস্য প্রসবিনী । শিল্পে বিপ্লব এনেছে বিজ্ঞান । বিজ্ঞান চালিত বিভিন্ন যন্ত্রপাতির দানবীয় শক্তিতে কাজে এসেছে গতিময়তা । কম্পিউটার নামক গণক যন্ত্রের আবিষ্কার বিজ্ঞানলক্ষ্মীর অন্যতম দান।মানুষের বাসগৃহগুলি ভ্যাকুয়ম ক্লিনার, টিভি, রেফ্রিজারেটর, ওয়াশিং মেশিন, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র ওভেন ইত্যাদির উপস্থিতিতে পরিণত হয়েছে ছােট ছােট বিজ্ঞান কক্ষে । সড়কপথে বাস, মােটর, রেলপথে রেল, জলপথে জাহাজ, বােট ও আকাশপথে উড়ােজাহাজ আমাদের জীবনকে গতিময়তা প্রদান করেছে ।

চিকিৎসা ও শিক্ষাক্ষেত্রে বিজ্ঞান : – বিজ্ঞান চিকিৎসাজগতে এনেছে অভাবনীয় পরিবর্তন । বিভিন্ন দুরারােগ্য রােগের প্রতিষেধক ওষুধপত্র ও টিকা আবিষ্কারের ফলে মৃত্যুহার বহুলাংশে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে । বর্তমানে বিভিন্ন শল্যচিকিৎসা, অঞ্জা প্রতিস্থাপন ও আধুনিক যন্ত্রপাতির কল্যাণে সহজসাধ্য হয়ে উঠেছে । আন্ট্রাসােনােগ্রাফি, এক্স-রে পরীক্ষার মাধ্যমে অতি সহজেই রােগ নির্ণয় করতে পারায় মৃত্যুকে রােধ করা কিয়দংশে সম্ভবপর হয়েছে । শিক্ষা সংক্রান্ত অধিকাংশ জিনিসই বিজ্ঞানের কৃপাধন্য। বই, খাতা, পেন, বাের্ড সবই বিজ্ঞানের আবিষ্কার । বর্তমানে ‘Digital learning’ পদ্ধতি প্রবর্তনের মাধ্যমে গ্রন্থকেন্দ্রিক নীরস শিক্ষাব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে, যার পশ্চাতে রয়েছে বিজ্ঞানেরই আশীর্বাদ ।

প্রযুক্তিবিদ্যায় বিজ্ঞান : – দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তিবিজ্ঞানও বিশেষভাবে বলার দাবি রাখে । প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে যােগাযােগ ব্যবস্থায় বিপ্লব এসেছে । ফেসবুক, ইমেল, ইন্টারনেট, হােয়াটঅ্যাপের ফলে মানুষ আজ দ্রুত কোনাে সংবাদ বা বার্তা অপরের কাছে পৌছে দিতে পারছে । হাতে ধরা মুঠোফোনের এক ছোঁয়ায় তামাম দুনিয়া চলে আসছে মুঠোর মধ্যে । রােবট প্রযুক্তি শ্রমকে করেছে লাঘব । বিজ্ঞানের উন্নতিতে পৃথিবী পরিণত হয়েছে এক ‘Global village’-এ।

উপসংহার : – আমাদের দৈনন্দিন জীবনে চব্বিশ ঘন্টাই আমরা বিজ্ঞান নির্ভর । বিজ্ঞান ব্যতীত জীবন যেন অকল্পনীয়,বিকলাঙ্গ, তবে প্রদীপের উধ্বশিখার তলায় যেমন থাকে গভীর অন্ধকার, ঠিক তেমনি বিজ্ঞানেরও এক হাতে রয়েছে সুধাপাত্র ও অপর হাতে বিষভান্ড । বিজ্ঞান মানুষকে গতিময়তা দিয়েছে, কিন্তু তাদের পরিণত করেছে আবেগহীন যন্ত্রে । বিজ্ঞান বলে বলীয়ান মানুষ আজ মারণাত্মক অস্ত্র নিয়ে রণােন্মত্ত । ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতেই সে আজ উদগ্রীব । তাই গভীরতর ব্যাধি ঘনিয়ে ওঠার আগে আমাদের আত্মসচেতন হতে হবে । সংযত করতে হবে আমাদের লােভ জিঘাংসার মতন ঘৃণ্য প্রবৃত্তিগুলিকে।

অকল্যাণকর কাজে নয় মানুষের মঙ্গলসাধনে ব্যবহার করতে হবে বিজ্ঞান ও তার প্রযুক্তিকে, তবেই আমরা পৃথিবীতে চির আকাঙ্খিত স্বপ্নের স্বর্গ গড়ে তুলতে পারব, নয়তাে ‘যাযাবর’ কবির ন্যায় বিলাপ করে বলতে হবে –
“ বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ,
কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ ।”

2.রচনা :বাংলার উৎসব
ভূমিকা :
এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ

তবু রঙ্গে ভরা ” – ঈশ্বর গুপ্ত
বাঙালির ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের মেঘ, বারবার ঘনিয়েছে। কখন দুর্ভিক্ষ মহামারি মেতেছে বীভৎস মারণ যজ্ঞে। কখনও রাষ্ট্রীয় বিপর্যয় তাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেছে স্থান থেকে স্থানান্তরে। তবু আনন্দ স্রেতে ভাটা পড়েনি কারণ বাঙ্গালি উৎসব প্রিয় জাতি।

উৎসব এর উদ্দেশ্য:

বাঙালির জীবন যাপন ক্ষুদ্র হলেও কিন্তু উৎসবের দিনে তারা প্রত্যেকের সঙ্গে মিশিয়ে হয়ে যায় বৃহৎ।গতানুগতিক জীবনধারা, নিজেকে অপরের কাছে প্রকাশ করা ও বিভিন্ন জিনিস থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বাঙালিরা বিভিন্ন রকম উৎসবের আয়োজন করে থাকে।উৎসবের দিনে বাঙালিরা আনন্দে মেতে ওঠে, একে অপরের সাথে আনন্দ উপভোগ করে এবং তারা একে অপরের সাথে দীর্ঘ দিনের পর আলাপ আলোচনায় মেতে ওঠে।বাঙালিরা এই সমস্ত উৎসবের মধ্য দিয়ে তারা এক বিশাল আনন্দ উপভোগ করে।বাঙালির সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে তার উৎসবের বৈচিত্র্যকে সূচিত করেছে।

মেলামেশার প্রাঙ্গণ :

আমার আনন্দে সবার আনন্দ হউক, আমার সুখে সবাই সুখী হউক, এই কল্যানী ইচ্ছাই উৎসবের প্রাণ। মানুষ চায়
গতানুগতিক একঘেয়েমির জীবন থেকে মুক্তির উৎসব ছাড়া ভালাে উপায় কী?
উৎসবের শ্রেণিকরণ :
এই উৎসবকে চারটি ভাগে মূলত ভাগ করা যায় যথা –
(ক) ঋতু উৎসব (খ) ধর্মীয় উৎসব (গ) সামাজিক-পারিবারিক উৎসব (ঘ) জাতীয় উৎসব
(ক) ঋতু উৎসব : বিশেষ বিশেষ ঋতুর সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বাঙালিরা মেতে ওঠে নানা ঋতু উৎসবে। বছরের শুরুতে নববর্ষ উদ্যাপন হয় নানারকমভাবে। নবান্ন ও পৌষপার্বণ দুটি উৎসব নতুন ফসল কাটার সময় হয়। শীত ঋতুতে এইউৎসবকে কেন্দ্র করে নানারকম পিঠেপুলি ও মিষ্টান্ন তৈরি হয়। দোলযাত্রা হয় বসন্ত ঋতুকে কেন্দ্র করে। রঙের উৎসবে মেতে ওঠে বাঙালি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরােপণ উৎসব, বর্ষামঙ্গল, বসন্তোৎসব-এর প্রচলন করেন,যা আজ বাঙালির জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

(খ) ধর্মীয় উৎসব : বাঙালি জাতি নানারকম ধর্ম বিশ্বাসে বিশ্বাসী। তাই ধর্মকেন্দ্রিক নানা উৎসবের আয়ােজন চলে বছরের বিভিন্ন সময়ে। হিন্দুদের প্রধান উৎসব দুর্গাপুজা। এ ছাড়া কালীপূজা, সরস্বতী পূজা, লক্ষ্মী পূজা, বিশ্বকর্মা পূজারআয়ােজন করা য়। মুসলমানদের ঈদ, মহরম, শবেবরাত কিংবা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের গুড ফ্রাইডে, বড়দিন, ইস্টারস্যাটারডে পালিত হয় বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে। ধর্ম আলাদা হলেও বাঙালিরা কিন্তু একে অন্যের ধর্মীয় উৎসবে অংশগ্রহণ করে, একে অপরকে শুভেচ্ছা বিনিময় করে।

(গ) সামাজিক-পারিবারিক উৎসব : বেশ কিছু উৎসব আছে যেগুলিতে পরিবারের কোনাে আনন্দ অথবা দুঃখের অনুভূতিকে সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া হয়। বিবাহ, অন্নপ্রাশন, জামাইষষ্ঠী, ভাইফোঁটা – এই সকল অনুষ্ঠান আত্মীয়স্বজন,বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীর মিলনানুষ্ঠানে পরিণত হয়। এই সকল অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে পারস্পারিক মনােমালিন্য যেমন দূর হয়, তেমনি দূরের আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মিলনের সুযােগ তৈরি হয়।
(ঘ) জাতীয় উৎসব : আমরা যে রাষ্ট্রে বাস করি সেই ভারতবর্ষে বিভিন্ন মনীষীদের জন্মদিবস – রবীন্দ্রজয়ন্তী, মহাত্মা গান্ধির জন্মদিন, নজরুল জয়ন্তী এবং বিশেষ কিছুদিন যেমন – স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবসও সারা ভারতবাসীদের সঙ্গে বাঙালিরা যথাযােগ্য মর্যাদায় উদ্যাপন করে থাকে।

উপসংহার : যতই কৃত্রিমতা চেপে বসুক না কেন বাঙালি আজও উৎসবমুখর থাকতেই ভালােবাসে। তাই আজ নতুন প্রজন্ম অনেক হারিয়ে যাওয়া উৎসব নতুন করে পালন করছে। লাইট, প্যাণ্ডেল, প্রতিমা নির্মাণে যে প্রতিযােগিতা চলে৷তার মধ্যেও বাঙালির শিল্পভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। কর্মব্যস্ত মানুষও আজকাল উৎসবের দিনগুলিতে কাজ থেকে দুরে থাকতে চায়। ফিরে আসতে চায় নিজভূমিতে।তাই অদূর ভবিষ্যতে বাঙালির উৎসব প্রাণের উৎসব হয়ে উঠবে এই প্রত্যয় জাগে।

3. বিজ্ঞান ও কুসংস্কার

ভূমিকাঃ সেই আদিম কাল থেকেই বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষ জগৎ ও জীবনকে ক্রমশ বেশি বেশি করে জানতে,বুঝতে ও চিনতে শিখেছে।মানুষের বুদ্ধির বিকাশ ঘটেছে দিন দিন।সে জানতে পেরেছে যে এই পার্থিব জগতের কোনো কিছুই অলৌকিক ভাবে ঘটেনা ।
প্রত্যেক ঘটনার পেছনেই থাকে তার যুক্তিনির্ভর কারণ।কিন্তু এই কারণ গুলো বোঝার মতো মেধা ও মানসিকতা সব মানুষের হয়না।মানুষ তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে বিশ্বের অনেক নিগূঢ় সত্যের দ্বার খুলে দিয়েছে।একদিকে যেমন হয়েছে জ্ঞানের অগ্রগতি তেমনই অন্য দিকে লক্ষ লক্ষ মানুষের চেতনায় থেকে গিয়েছে অজ্ঞানতার অন্ধকার।সূচনা হয়ছে বিজ্ঞান চেতনার সাথে কুসংস্কারের সংঘাত।
কুসংস্কারের স্বরূপঃ
যে বিশ্বাসের পিছনে কোন যুক্তি নির্ভরতা নেই, কোন তথ্যভিত্তিক প্রমাণাদি নেই , তাকেই আমরা কুসংস্কার বলি। অর্থাৎ যুক্তিহীন অন্ধবিশ্বাসই হল কুসংস্কার।
বিজ্ঞানের স্বরূপঃ
বিজ্ঞান কথাটির অর্থ হল বিশেষ জ্ঞান। অর্থাৎ কোন কিছু অজানা বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে কোন কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহন। সেক্ষেত্রে একই কার্যকরণের ফলে একই ফল হয়। সেটাই অমোঘ সত্য। সেটাই বিজ্ঞান। এখানে আছে শুধু বিচার-বিবেচনা, যুক্তি দিয়ে বিশেষ জ্ঞানে পৌছানো।
কুসংস্কারের বিভিন্ন প্রকাশঃ
একবিংশ শতাব্দীর ঊষালগ্নে, কম্পিউটার, রোবট ইত্যাদির যুগে পাহাড়ের মত উচু করে দাঁড়িয়ে আছে হাচি, টিকটিকি, পিছু ডাকা আরও কত কী। ভোরের স্বপ্ন নাকি বিফল হয় না, মেয়েদের বাম চোখ নাচলে নাকি শুভ হয় অপরপক্ষে ডান চোখ নাচা নাকি ভারি অপায়া, কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া মেয়েদের চুল কাটা ভূতের উপস্থিতি প্রভূতি। এছাড়া এমনকি পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যক্ষ বাড়ির বাইরে বের হওয়ার সময় ঝাঁট দেখেছিলেন বলে সেদিনটি আর কাজেই যাওয়া হল না, এইরকম অনেক হাজার হাজার নাগপাশে আমাদের দিনক্ষণ বাঁধা।
কুসংস্কারে আস্থার কারণঃ
বিজ্ঞানের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। বিজ্ঞান কখনো কোন মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। বিজ্ঞান কোনো পরীক্ষার্থীর ভালো করে দিতে পারে না। কোন খেলায় কোন পক্ষ জয়ী হবে তা বলে দিতে পারে না। তাই এই সব যে অনিশ্চয়তা সেখানে বিজ্ঞান আপাত পরাজয়। আর সেখানেই শুরু দৈব বিশ্বাসের। জয় হয় দৈব নির্ভরতার। অতএব কুসংস্কার থাকবেই। যে কুসংস্কারের প্রভাবে মানুষ শুধুমাত্র ভাগ্যবাদী হয়। কোন কর্ম না করে শুধুমাত্র সৌভাগ্যের অপেক্ষায় থাকে তা নিশ্চয় মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর। তাই কর্ম করে যেতে হবে নিষ্ঠার সঙ্গে অর্থাৎ কর্ম ও ভাগ্যের সমন্বয়ে আসে সাফল্য।
কুসংস্কার দূরীকরণে আমাদের করণীয়ঃ
কুসংস্কার দূরীকরণের প্রধান হাতিয়ার হল বিজ্ঞান। মানুষের বিজ্ঞান চেতনাকে বৃদ্ধি করতে পারলেই এই দূরারোগ্য ব্যধি থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি। এ ব্যাপারে বিজ্ঞান পরিচালিত বিতর্ক সভা, আলোচনা চক্র, প্রদর্শনাদি অনেক সুফল দিতে পারে।
উপসংহারঃ
বিজ্ঞান চেতনাই পারে মানুষকে কুসংস্কার থেকে মুক্তি দিতে। তাই সব কিছুকে যুক্তি দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে, বিচার করে গ্রহন করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। আর তার জন্য চাই শিক্ষা , সার্বিক শিক্ষা । শিক্ষা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে কুসংস্কারের অপসারণ অবশ্যম্ভাবী।
4.বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ
“সভ্যতা ধরেছে আগেই বিজ্ঞানের হাত ।
রাত তাই দিন হল, দিন হল রাত ।”
আধুনিক কালে বিজ্ঞানের ভূমিকা : – “বিজ্ঞানমুচ্ছিষ্টম্ ইদম্ জগৎ” অর্থাৎ বিজ্ঞানের দ্বারা এ জগৎ উচ্ছিষ্ট । সভ্যতা যদি হয় যন্ত্র, তবে বিজ্ঞান সেখানে যন্ত্রী । কিন্তু, বিজ্ঞানের এত উন্নতি সত্ত্বেও সভ্যতার কপালে দুশ্চিন্তার কলঙ্করেখা । বিজ্ঞানের জয়যাত্রার মাঝে একদিকে সৃজন অন্যদিকে ধ্বংস । বিজ্ঞানের মারণযজ্ঞে ত্রস্ত মানুষ তাই প্রশ্ন তুলেছে-
“বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ ?”
বৃহত্তর মানবকল্যাণে বিজ্ঞানের অবদান :-
মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য-সমৃদ্ধি সাধনে, তার বৃহত্তর কল্যাণকর্মে অতন্দ্র ও নিরলস সেবায় তুলনাহীন নজির রেখে ছেবিজ্ঞান । বিজ্ঞান-বলে বলীয়ান মানুষ দুরন্ত নদীকে বশীভূত করে তার অমৃত প্রভাবে ঊষর মরুকে করেছে শস্যপ্রসবিনী । দুস্তর সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পৃথিবীর দূরতম ঘাটে নামিয়ে দিয়েছে পণ্যসম্ভার । কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানসৃষ্ট যন্ত্রের কৃপায় সফল হয়েছে সবুজ বিপ্লব । শিল্পক্ষেত্রে যন্ত্রদানবের আসুরিক শক্তিতে গড়ে উঠেছে অতুল বিভব । শিক্ষাক্ষেত্রে গ্ৰন্থকেন্দ্রিক নীরস কৃত্রিম শিক্ষা-পদ্ধতির অবসান হয়ে বিজ্ঞানসম্মত বাস্তবমুখী শিক্ষার দ্বার হয়েছে উদঘাটিত । বিজ্ঞানের এরকম কল্যাণকর কার্যকারিতা দেখলে, স্বাভাবিকভাবে মনে হয়, এত বড়ো আশীর্বাদ মানবজীবনে আর নেই ।
বিজ্ঞান বনাম মানুষ : জীবনের নানা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে । রবীন্দ্রনাথ ও মাহাত্মা গান্ধি অতিযান্ত্রিকতার অশুভ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করেছেন । ”বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ ।” অতিরিক্ত বিজ্ঞান-নির্ভরতা মানুষকে পঙ্গু করেছে । যন্ত্র সভ্যতায় মানুষ আজ যন্ত্র তুল্য । -মানুষ তার মনুষ্যত্ব হারিয়ে চলেছে ।
বিজ্ঞানের অশুভ দিক : ‘বাঘ বাঘকে খায় না’, -কিন্তু বর্তমান যান্ত্রিক সভ্যতায় পাশবিকতা রয়েছে, যে বিজ্ঞান নিয়ত মানুষের কল্যাণকর্মে রত, সেই বিজ্ঞানকেই মানুষ কাজে লাগিয়েছে এই সুন্দর সৃষ্টিকে ধ্বংসের কাজে । খাদ্যে ও ওষুধে ভেজাল, মারণাস্ত্রের আবিষ্কার, নিত্য নতুন অশুভ আণবিক শক্তির উদ্ভাবনে মানুষ এখন এত পরিপক্ক যে, একটি ছােট্ট বােতাম টিপলেই মুহূর্তে পৃথিবীর একটি বৃহত্তম অংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে । হিরােসিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বােমার যে বিষময় পরিণতি, তা আজও বিশ্ববাসী ভুলতে পারেনি । আজকের সন্ত্রাসবাদও বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করেছে ।
বিজ্ঞান ও ধ্বংস : – যে বিজ্ঞান জীবনদায়ী ওষুধ ও যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করে মানুষকে নবজীবন দান করেছে, সেই বিজ্ঞানই আবার মারণাস্ত্র আবিষ্কার করে জীবনকে ধ্বংসের কাজে ব্যাপৃত থাকছে । এর প্রভাবে পৃথিবীর বায়ু, জল, মৃত্তিকা আজ দূষিত ।
মঙ্গল ও শুভবুদ্ধি : – বিজ্ঞানের ধ্বংসলীলার জন্য বিজ্ঞান দায়ী নয়, দায়ী মানুষ । বিজ্ঞান যদি মানুষের শুভ বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হয়, তাহলে বিজ্ঞান কেবলমাত্র মানব কল্যাণী রূপেই মানুষের ভৃত্য হয়েই থাকবে । আইনস্টাইন বলেছেন “religion without science is lame, science without religion is dead.” তাই, শুভবুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত বিজ্ঞান মানব কল্যাণে ব্রতী হয়ে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেবে । বর্তমান সভ্যতার যে অগ্রগতি তা তাে বিজ্ঞানেরই দান । সুতরাং শুভবুদ্ধি দ্বারা চালিত বিজ্ঞান মানুষের সমাজ সভ্যতার ক্ষেত্রে কল্যাণের বার্তাই বয়ে আনে, সে কথা আজ প্রমাণিত সত্য ।
উপসংহার : – মানুষ যদি মানুষ হয়, বিজ্ঞানকে যদি মানব কল্যাণে প্রয়ােগ করতে পারে, তাহলে বিজ্ঞান হবে আশীর্বাদ । আর যদি অমানুষ হয়ে বিজ্ঞানকে ধ্বংসের কাজে প্রয়ােগ করে, তাহলে বিজ্ঞান হয়ে উঠবে অভিশাপ । এজন্য জনৈক কবি বিজ্ঞানের হয়ে দুঃখ করে বলেছেন
“বিজ্ঞান বলে দোষ কি আমার
কেন মিছে দাও গালি।
প্রয়ােগের গুণে সুন্দর মুখে
তােমরা মাখাও কালি ।”

One thought on “বাংলা রচনা সম্ভার|দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান |বাংলার উৎসব|বিজ্ঞান ও কুসংস্কার |বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ”

Comments are closed.