HS GEOGRAPHY SUGGESTION
আলোচনার বিষয় :
মৃত্তিকার সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য |
মাটি সৃষ্টির প্রভাবক বা নিয়ন্ত্রক |
মাটি গঠনে সক্রিয় উপাদানের প্রভাব |
মৃত্তিকার সংজ্ঞা :
ইংরেজি ‘Soil শব্দটি ল্যাটিন ‘Solum’ থেকে এসেছে। যার অর্থ হল ভূমিতল’ বা ‘মেঝে’। সাধারণভাবে দীর্ঘকাল ধরে বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আদি শিলা পরিবর্তনের ফলে ভূপৃষ্ঠের ওপরে বিভিন্ন খনিজ ও জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ হয়ে যে পাতলা ভঙ্গুর আবরণ বা স্তর সৃষ্টি হয়, যা উদ্ভিদ বৃদ্ধির সহায়ক তাকে মৃত্তিকা বলে।
মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্য সমূহ :
(১) ভূত্বকের সর্বোচ্চ স্তর : মৃত্তিকা হল ভূত্বকের ওপরে অবস্থিত সর্বোচ্চ স্তর। এটি শিলাস্তরের ওপর আচ্ছাদন হিসেবে অবস্থান করে।
(২) বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্ট : মৃত্তিকা দীর্ঘকালীন নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে বিবর্তিত হয়ে সৃষ্টি হয়।
(৩) দীর্ঘ সময়ের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্ট : মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ। একটি পরিণত মৃত্তিকা সৃষ্টি হতে কয়েক শত বছর থেকে কয়েক হাজার বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।
(৪) জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ : জৈব পদার্থ মৃত্তিকার একটি অপরিহার্য উপাদান। বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদের মৃত্যুর পর তাদের দেহাবশেষ মৃত্তিকার সাথে যুক্ত হয়।
(৫) স্তরবিন্যাস : মৃত্তিকার মধ্যে একাধিক স্তর লক্ষ করা যায়। উল্লেখযােগ্য স্তরগুলি হল O, A, B, C, D মৃত্তিকার স্তরগুলির উল্লম্ব প্রস্থচ্ছেদ মৃত্তিকার পরিলেখ নামে পরিচিত।
(৬) উদ্ভিদের পুষ্টিমৌল স্থল : মৃত্তিকার মধ্যে থেকেই উদ্ভিদ তার প্রয়ােজনীয় বিভিন্ন পুষ্টিমৌলগুলি গ্রহণ করে।
(৭) জলবায়ু ও স্বাভাবিক উদ্ভিদের প্রভাব সর্বাধিক : মৃত্তিকার উৎপত্তিতে জলবায়ু ও স্বাভাবিক উদ্ভিদের প্রভাব সর্বাধিক লক্ষ করা যায়।
(৮) অঞ্চলগত পার্থক্য : সৃষ্টির বিভিন্ন নিয়ন্ত্রকের পার্থক্যের দরুণ বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের মৃত্তিকা গড়ে উঠতে দেখা যায়। যেমন-নিরক্ষীয় বৃষ্টিঅরণ্য অঞ্চলে ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা আবার নাতিশীতােয় সরলবর্গীয় অরণ্য অঞ্চলে পডসল মৃত্তিকা গড়ে উঠতে দেখা যায়।
মাটি সৃষ্টির প্রভাবক বা নিয়ন্ত্রক :
মাটি গঠনে প্রভাব বিস্তারকারী নিয়ন্ত্রকগুলি হল一 [1] জনক বা আদি শিলা, [2] ভূপ্রকৃতি, [3] সময়, [4] জলবায়ু ও [5] জীবজগৎ।
মাটি গঠনে সক্রিয় উপাদানের প্রভাব :
মাটি গঠনে প্রত্যক্ষ বা সক্রিয় উপাদান দুটি হল- [1] জলবায়ু ও [2] জীবজগৎ। নিষ্ক্রিয় উপাদান অপেক্ষা মাটির উৎপত্তিতে এদের প্রভাব বেশি লক্ষ করা যায়।
[1] জলবায়ু : মাটি গঠনে জলবায়ু সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জলবায়ুর দুটি প্রধান উপাদান হল বৃষ্টিপাত ও উষ্ণতা।
বৃষ্টিপাত : মাটির নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও তীব্রতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়-
- (i) বৃষ্টিপাত বেশি হলে মাটিতে হাইড্রোজেন আয়নের পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে pH-এর পরিমাণ কমে এবং মাটি আম্লিক হয়।
- (ii) বেশি বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলে উদ্ভিদের প্রাচুর্য লক্ষ করা যায়। ফলে বেশি জৈব পদার্থের সঞ্চয়ের কারণে মৃত্তিকায় নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেড়ে যায়।
- (iii) বেশি বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলে ক্যালশিয়াম কার্বনেট কার্বনেশন পদ্ধতিতে ক্যালশিয়াম বাই কার্বনেটে পরিণত হয়ে মাটির অনেক গভীরে স্থানান্তরিত হয়।
- (iv) আর্দ্র-ক্রান্তীয় অঞ্চলে বেশি বৃষ্টিপাতের কারণে রাসায়নিক আবহবিকার দ্রুত হয় এবং মাটিতে কাদার পরিমাণ বাড়ে |
- (v) আর্দ্র ক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলে এলুভিয়েশন পদ্ধতিতে পটাশিয়াম, সােডিয়াম, ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম প্রভৃতি মাটির ওপরের স্তর থেকে নীচের স্তরে অপসৃত হয়।
- (vi) মরুভূমি অঞ্চলে রাসায়নিক আবহবিকারের মাধ্যমে ক্যালশিয়াম, পটাশিয়াম, সােডিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম প্রভৃতি খনিজ থেকে মুক্ত হলেও, বৃষ্টিপাত অল্প হওয়ায় মৃত্তিকার উধ্বস্তর থেকে অপসৃত হয় না।
- (vii) বৃষ্টিপাত ও বাষ্পীভবনের অনুপাতের ওপর নির্ভর করে যেখানে ধৌত প্রক্রিয়ায় মুক্ত ক্যালশিয়াম অপসারিত হয়ে কেবলমাত্র অ্যালুমিনিয়াম ও লােহার অক্সাইড পড়ে থাকে, সেখানে পেডালফার (Pedalfer = Ped-Al-Fe-rs) মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়। তুন্দ্রা মৃত্তিকা, পডসল ও ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা এর উদাহরণ।
- (viii) বাষ্পীভবন অপেক্ষা বৃষ্টিপাত কম হলে (শুষ্ক জলবায়ুতে) কৈশিক প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকার নীচ থেকে ওপরের দিকে ক্যালশিয়াম কার্বনেট ও লবণ উঠে এসে মাটির ওপরের স্তরে সঞ্চিত হয়। এভাবে পেডােক্যাল (Pedocal = Pedo-ca-ls) মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়। চেস্টনাট, চারনােজম মৃত্তিকা এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।
উষ্ণতা : অধিক উয়তা ধৌত প্রক্রিয়ায় বাধাপ্রদান করে এবং দ্রবণীয় লবণকে ওপরে উঠতে সাহায্য করে। যেখানে অধিক আর্দ্রতা ও উয়তা সবুজ বনভূমি সৃষ্টিতে সহায়তা করে, সেখানে জীবাণুর (Micro-organism) খুব বেশি সক্রিয়তা জৈব পদার্থের পচনকে ত্বরান্বিত করে। অপরপক্ষে, অল্প উয়তা বাষ্পীভবনের মাত্রাকে কমিয়ে দেয় এবং ধৌত প্রক্রিয়াকে সাহায্য করে ও সেইসঙ্গে পচন প্রক্রিয়াকে মন্থর করে দেওয়ার মাধ্যমে জৈব পদার্থের সঞ্চয় ঘটায়। এইভাবে উয়তা আদি শিলায় রাসায়নিক ও জৈবিক আবহবিকারকে এবং জৈব পদার্থে পচন প্রক্রিয়ার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে।
উষ্ণতা দ্বারা মৃত্তিকার নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়ন্ত্রিত হয়—
- (i) অধিক উষ্ণতার জন্য আবহবিকার ভূত্বকের অনেক গভীরতা (Deep Weathering) পর্যন্ত ক্রিয়াশীল থাকে।
- (ii) তাপমাত্রা বেশি হলে জৈব পদার্থ ও নাইট্রোজেনের পরিমাণ হ্রাস পায়।
- (iii) আর্দ্র-ক্রান্তীয় অঞ্চলে গড় বার্ষিক উষ্ণতা বেড়ে গেলে রাসায়নিক বিয়ােজন বেশি হয় ও মাটিতে কাদার পরিমাণ বেড়ে যায়।
- (iv) আর্দ্র-ক্রান্তীয় অঞ্চলে উষ্ণতা বেড়ে গেলে সিলিকা সেসক্যুঅক্সাইডের অনুপাত কমে যায়|
[2] জীবজগৎ : উদ্ভিদ ও প্রাণী হল জীবগতের প্রধান দুটি উপাদান। এরা মাটি গঠনে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। যেমন一
- উদ্ভিদের শিকড় শিলার ফাটলের মধ্যে প্রবেশ করে এবং জল ও বাতাসের চলাচলের পথ তৈরি করে দেয়। এর ফলে যান্ত্রিক ও রাসায়নিকভাবে শিলা চূর্ণবিচূর্ণ হয়।
- উদ্ভিদের শিকড় মাটির নীচে মরে ও পচে গেলে, এর থেকে উৎপন্ন অনেক জৈব অম্ল মাটিতে মিশে যায়। এ ছাড়া জীবিত উদ্ভিদের শিকড় কার্বনিক অ্যাসিড ও অন্যান্য পদার্থ নির্গত করে। এইসব অ্যাসিড ও অন্যান্য পদার্থ জলের মাধ্যমে মিশে শিলা ও খনিজের সঙ্গে বিক্রিয়া ঘটিয়ে মাটি গঠনে সাহায্য করে।
- পিঁপড়ে, কেঁচো, ইঁদুর প্রভৃতি প্রাণী মাটিতে গর্ত খুঁড়ে বিভিন্ন স্তরের উপাদানের মধ্যে মিশ্রণ ঘটায়।
- মৃত উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহাবশেষ বেশি থাকলে মাটি হিউমাসে পরিপূর্ণ হয় এবং মাটির রং কালাে হয়। এই মাটি পুষ্টিগুণসম্পন্ন হয়। এ ছাড়া মাটির স্তর পুরু ও খনিজসমৃদ্ধ হয়।