নীল বিদ্রোহের কারণ ও প্রভাব | Nil bidroher karon o Probhab
প্রশ্ন : নীল বিদ্রোহের কারণ ও গুরুত্ব বর্ণনা করো। মান- ৮
উত্তরঃ উনিশ শতকে কৃত্রিম রাসায়নিক রঞ্জন দ্রব্যের আবিষ্কার না হওয়ায় কাপড় রং করার জন্য প্রচুর নীলের প্রয়োজন হত। শিল্প বিপ্লবের ফলে ব্রিটেন ও ইউরোপে বস্ত্রোৎপাদন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেলে ১৭৮০-এর পরবর্তী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইউরোপে প্রচুর নীল রপ্তানি করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করে। ফলে ব্রিটিশ খামার মালিকরা নীলচারে উৎসাহিত হয়। বহু নীলকর বাংলায় এসে নদিয়া, যশোহর, বর্ধমান, বীরভূম প্রভৃতি জেলায় নীলচাষ ছড়িয়ে দেয়।
(i) নীলচাষের বৈশিষ্ট্য :
প্রথমদিকে নীলকর সাহেবরা ব্রিটিশদের জমিতে শ্রমিক নিয়োগ করে নিজ খরচে নীলচাষ করত। একে ‘নিজ আবাদি’ প্ৰথা বলা হত। কিন্তু শীঘ্রই তাঁরা উপলব্ধি করেন যে, রায়তস্বত্বের জমিতে দাদন বা অগ্রিম নীলচাষ অধিক লাভজনক। নীল কমিশনের হিসাবানু – যায়ী নিজ জমিদারির দশ হাজার বিঘা জমিতে নীলচাষের জন্য নীলকরকে আড়াই লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করতে হত। কিন্তুই একই পরিমাণ (বাড়তি জমিতে নীলকর পেতে পারত) মাত্র কুড়ি হাজার টাকা দাদন ঋণ। তা ছাড়া রায়তের জমিতে নীলচাষ করলে চাষের জন্য শ্রমিক ও অন্যান্য উপকরণ জোগাড় করতে হত না। রায়তরা নিজ খরচ ও পরিশ্রমে নীল উৎপাদন করত। ফলে নীল- কররা সর্বদা চেষ্টা করত একবার দাদন গ্রহণ করলে কৃষক আর সেই ঋণ শোধ করতে পারত না। নিজের জমিতে সে খাদ্যশস্য বা বাণিজ্যিক কৃষিপণ্য উৎপাদনে সক্ষম হত না।
(ii) নীলচাষিদের অবস্থা :
- প্রথমত, নীল- চাষিদের জোর করে নীলচাষ করতে বাধ্য করা হত। তাদের নীলকরদের নির্ধারিত শর্তে নীল চাষের চুক্তি করা হত।
- দ্বিতীয়ত, অনিচ্ছুক কৃষকদের গবাদিপশু ধরে নিয়ে আসা হত ও নীলকরদের কুঠিতে আটকে রাখা হত।
- তৃতীয়ত, অনেক সময় কৃষকদের নামে মিথ্যা মামলা রুজু করা হত। এর থেকেই রেহাই পেতে তাদের নীলচাষ করতে হত।
- চতুর্থত, কৃষকদের চড়া হারে সুদ দিতে হত বলে তারা দাদন নিলে ঋণ শোধ করতে পারত না।
- পঞ্চমত, পরিমাপকালে নীলচাযিদের জমি কম দেখানো হত। সাধারণত আড়াই বিঘা জমিকে এক বিঘা দেখানো হত।
(iii) পঞ্চম আইন : লর্ড বেন্টিঙ্ক পঞ্চম আইন দ্বারা কৃষকদের বাঁচাবার প্রচেষ্টা চালান। অনিচ্ছুক কৃষকদের নীলচাষ করানো চলবে না বলে তিনি ঘোষণা করেন। কিন্তু তা বিশেষ কার্যকর হয়নি।
- প্রথমত, নীলকুঠিগুলি গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত ছিল বলে ওইসব অঞ্চলে সরকারি ঘোষণা কার্যকরী হত না।
- দ্বিতীয়ত, কৃষকদের অভিযোগ যাচাই করতে যেসব কর্মচারীরা আসতেন তাঁরা নীলকরদের বক্তব্যকে সমর্থন করতেন।
- তৃতীয়ত, কোনো দেশীয় জমিদার কৃষকদের পক্ষ নিলে তাদের নানাভাবে অত্যাচার করা হত। চতুর্থত, বেশিরভাগ ম্যাজিস্ট্রেট কৃষকদের প্রতি সুবিচার করত না।
(iv) বিদ্রোহের বিবরণ: হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কৃষকরা সংঘবদ্ধভাবে নীলচাষ বন্ধ করে দেয়। নীল চাষিদের মুক্তিলাভের ইচ্ছা তীব্রভাবে প্রকট হয়ে ওঠে।
(a) নেতৃবৃন্দ :
নীলবিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন যশোহর জেলার বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস। নারাইলের মহেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জয়রাম – পুরের নায়েব জয়রামপুরের রামরতন মল্লিক প্রমুখ। অমৃতবাজার শিশিরকুমার ঘোষ, দি হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং নীলদর্পণ গ্রন্থের লেখক দীনবন্ধু মিত্র এই অত্যাচারের ঘটনা লিপিবদ্ধ করেন।
(b) নীলকর সাহেবের দমন-পীড়ন :
সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের প্রতি নীলকর – গণ দরিদ্র কৃষকদের ওপর বীভৎস অত্যাচার চালাত। কৃষক হত্যা, গৃহ লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ করতেও তারা দ্বিধা বোধ করত না।
(c) ইন্ডিগো কমিশন : এরূপ পরিস্থিতিতে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে মার্চে ইংরেজ সরকার ইন্ডিগো কমিশন গঠন করে।নীলচাষিদের অভিযোগ তদন্তের ব্যবস্থা করেন।
কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়-
(ক) নীলকরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ
সত্য |(খ) নীলকরদের ব্যবসার পদ্ধতি ছিল দুর্নীতিপূর্ণ ও ক্ষতিকর। এরপর সরকার ঘোষণা করেন যে রায়তের বিরুদ্ধে জোর করে নীলচাষ করানো যাবে না। এ সময় রাসায়নিক পদ্ধতিতে নীলরং আবিষ্কৃত হলে নীলের প্রয়োজন হঠাৎ কমে যায়।
(v) নীল বিদ্রোহের গুরুত্ব : বাংলার ইতিহাসে নীল বিদ্রোহ এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
- প্রথমত, এটি ছিল বাংলার প্রথম গণ আন্দোলন। শিশির কুমার ঘোষ একে ‘প্রথম সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক বিপ্লব’ বলে আখ্যা দেন।
- দ্বিতীয়ত, স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন প্রমাণ করে যে কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ হলে ও সঠিক নেতৃত্ব পেলে তারা অত্যাচারকে দমন করার জন্য সফল আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে।
- তৃতীয়ত, এর ফলে কৃষক ও জমিদারদের মধ্যে দূরত্ব কিছুটা কমে আসে।
- চতুর্থত, নীল বিদ্রোহ সাম্রাজ্যবাদীরূপে প্রকাশিত হয়।
- পঞ্চমত, বঙ্গদেশের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় এই কৃষক আন্দোলনে সাহায্য করে।
মূল্যায়ন :
পরিশেষে বলা যায় যে ইংরেজ নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে কৃষকদের প্রতি সর্বশ্রেণির মানুষের সহানুভূতি ভারতের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।