ভৌমজলের কার্য ও সংশ্লিষ্ট ভূমিরূপ: দ্বিতীয় পর্ব

উচ্চমাধ্যমিক ভূগোল ( HS Geography) : ভৌমজলের কার্য ও সংশ্লিষ্ট ভূমিরূ

আলোচ্য বিষয় :
আর্টেজীয় বা আর্তেজীয় কূপের গঠন
গিজার কি ?
গিজারের উৎপত্তি
পৃথিবীর প্রধান প্রধান কার্স্ট অঞ্চলগুলির নাম
কার্স্ট ভূমিরূপ গঠনের শর্তসমূহ
কার্স্ট অঞ্চল অনুর্বর হওয়ার কারণ
চুনাপাথরযুক্ত অঞ্চলে উভালা ও পােলজি সৃষ্টি হওয়ার কারণ |

আর্টেজীয় বা আর্তেজীয় কূপের গঠন :
পাম্পের সাহায্য ছাড়াই যে কূপ থেকে ভৌমজল স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফোয়ারার মতাে ভূপৃষ্ঠে বেরিয়ে আসে তাকে আর্টেজীয় বা আর্তেজীয় কূপ বলে। উত্তর-পূর্ব ফ্রান্সের আ্তোয়েস (Artois) অঞ্চলে 1126 খ্রিস্টাব্দে এই প্রকার কূপ প্রথম খনন করা হয় বলে, এই ধরনের কূপকে আর্তেজীয় কূপ বলে।


গঠন : আর্তেজীয় কূপ মূলত ভাজপ্রাপ্ত শিলার অধােভঙ্গে গঠিত হয়। ভাজের অধােভঙ্গ অংশে দুটি অপ্রবেশ্য শিলাস্তরের মাঝে একটি প্রবেশ্য শিলাস্তর অবস্থান করলে এবং প্রবেশ্য শিলাস্তরের মুখ ভূপৃষ্ঠে উন্মুক্ত হলে বৃষ্টির জল প্রবেশ্য শিলাস্তরে সঞ্চিত হয়ে আবদ্ধ জলবাহী স্তরে (অ্যাকুইফার) ভৌমজল ভাণ্ডার গড়ে ওঠে। এই জলবাহী স্তরের উন্মুক্ত জলতল অর্থাৎ জলচাপ তল অনেক উঁচুতে অবস্থান করলে এই জলস্তরের নীচের দিকে জলের উর্ধ্বমুখী চাপ অনেক বেশি থাকে। জলবাহী স্তরের এইরুপ অবস্থাকে আর্তেজীয় অবস্থা এবং ওই স্তরকে আর্তেজীয় স্তর বলে। জলের এই উর্ধ্বমুখী চাপের জন্য আর্তেজীয় স্তরের ওপরের অপ্রবেশ্য শিলাস্তরের কোনাে দুর্বল অংশ দিয়ে কিংবা অপ্রবেশ্য স্তরের মধ্য দিয়ে কূপ খনন করলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভৌমজল ফোয়ারার মতাে ভূপৃষ্ঠে বেরিয়ে আসে। এভাবে আর্তেজীয় প্রস্রবণ গঠিত হয়। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে, ওডিশার বালেশ্বর জেলায় অনেক আর্তেজীয় কূপ আছে। রাজস্থানের উদয়পুর, আজমীর ও জয়পুর প্রভৃতি শহরের নীচে আর্তেজীয় স্তরের অস্তিত্ব থাকায় এখানে চিরস্থায়ী হ্রদের সৃষ্টি হয়েছে।


গঠনের শর্ত : অধােভঙ্গের আকারে দুই অপ্রবেশ্য শিলাস্তরের মধ্যে প্রবেশ্য শিলাস্তরের অবস্থান আর্তেজীয় কূপ খননের প্রথম শর্ত। জলচাপ তল অবশ্যই কূপের উর্ধ্বে অবস্থান করবে। আবদ্ধ জলবাহী স্তরের প্রবেশ্য শিলাস্তরের প্রান্তভাগ অধিক বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলে উন্মুক্ত থাকা প্রয়ােজন।

গিজার :
আইরিশ শব্দ Geyser শব্দের অর্থ হল গর্জন। গিজার বা গাইজার একপ্রকার পর্যাবৃত্ত (Periodic) উয় প্রস্রবণ। এইরূপ প্রস্রবণ দিয়ে ভূগর্ভে সঞ্চিত অত্যুয় জল ও বাষ্প নিয়মিতভাবে একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর গর্জন করতে করতে প্রবল বেগে ভূগর্ভের সংকীর্ণ পথ ধরে ভূপৃষ্ঠে উৎক্ষিপ্ত হয়, তাই এর নাম গিজার। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানা প্রদেশের ইয়েলােস্টোন জাতীয় উদ্যানের ওল্ড ফেথফুল গিজার পৃথিবীবিখ্যাত।

গিজারের উৎপত্তি : সদ্যমৃত ও জীবন্ত আগ্নেয়গিরি অঞ্চলে ভূত্বকের গভীরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উয়তাও দ্রুত হারে বাড়তে থাকে। ভৌমজল ম্যাগমা চেম্বারের সংস্পর্শে এলে দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ভূ-অভ্যন্তরের গহরে জলীয়বাষ্প অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকে। ভূ-অভ্যন্তরের উয় জল থেকে উঠে আসা জলীয় বাষ্পের চাপ যখন বাতাসের বায়ুর চাপ অপেক্ষা বেশি হয়, তখন গহ্বরের মুখ দিয়ে অবরুদ্ধ বায়ু, বাষ্প ও উয় জল ফোয়ারার মতাে ভূপৃষ্ঠে বেরিয়ে এসে গিজার সৃষ্টি করে। জল ও বাষ্প গহর থেকে বেরিয়ে এলে সেখানে বায়ুর চাপ কমে। ফলে কিছুক্ষণের জন্য শান্ত অবস্থা বিরাজ করে। এই সময়ে ধীরে ধীরে জলের সঞ্চয় ঘটে এবং ক্রমান্বয়ে বাম্পচাপ বাড়ে। এই চাপ সঙ্কটসীমা অতিক্রম করলে পুনরায় জলীয়বাষ্প ও জলের উৎক্ষেপণ ঘটে। এইভাবে পর্যায়ক্রমে জলের উৎক্ষেপণ ও শান্ত অবস্থা চলতে থাকে।

পৃথিবীর প্রধান প্রধান কার্স্ট অঞ্চল :

  • ইউরােপে অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের তীরবর্তী ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া হার্জেগােভিনা ও সার্বিয়ায়, দক্ষিণ ফ্রান্সের কসেস, ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের ইয়র্কশায়ার, ডার্বিশায়ার।
  • আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস, নিউ মেক্সিকো, কেন্টাকি ও ইন্ডিয়ানা প্রদেশ।
  • কিউবা ও জামাইকার ককপিট অঞ্চল।
  • চিনের কোয়াংসি ও ইউনান প্রদেশ।
  • অস্ট্রেলিয়ার ব্লু পার্বত্য অঞ্চল।
  • ভিয়েতনামের বিভিন্ন অঞ্চল।
  • ভারতের উত্তরাঞ্চলের দেরাদুন, মধ্যপ্রদেশের পাঁচমারি, অন্ধ্রপ্রদেশের কেড প্রভৃতি অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কাস্ট ভূমিরূপ গড়ে উঠেছে।

কার্স্ট ভূমিরূপ গঠনের শর্তসমূহ :

[1] দ্রবণীয় শিলান্তরের উপস্থিতি : ভূপৃষ্ঠ বা তার ঠিক নীচে পুর দ্রবণীয় শিলাস্তরের উপস্থিতি একান্ত প্রয়ােজন।
[2] বিশুদ্ধ চুনাপাথরে গঠিত শিলান্তর : শিলাস্তরটি বিশুদ্ধ চুনাপাথরের হওয়া বাঞ্ছনীয়। এতে ক্যালশিয়াম কার্বনেটের মাত্রা 40 শতাংশের বেশি হওয়া প্রয়ােজন। শিলাস্তরটি ঘন, পুরু, অসংখ্য দারণযুক্ত হওয়া দরকার। কারণ, শিলার দারণ জলের প্রবাহকে অব্যাহত রাখতে সাহায্য করে।
[3] পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টিপাত : মাঝারি থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টিপাত হওয়া প্রয়ােজন। বার্ষিক বৃষ্টিপাত 30 সেমির কম হলে দ্রবণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
[4] সমুদ্র থেকে উচ্চে অবস্থিত ভূভাগ : দ্রাব্য শিলাস্তরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চে অবস্থিত হওয়া প্রয়ােজন।
[5] নদীর উপস্থিতি : দ্রাব্য শিলাস্তরটি অদ্রাব্য শিলাস্তর দ্বারা ঢাকা থাকলে ওই অঞ্চলে কর্তিত নদী থাকা প্রয়ােজন। কারণ নদী ওপরের অদ্রাব্য স্তরটি কেটে দ্রাব্য স্তরকে উন্মুক্ত না করলে কাস্ট ভূমিরূপ যথাযথভাবে গড়ে উঠতে পারে না।

কার্স্ট অঞ্চল অনুর্বর হওয়ার কারণ :
চুনাপাথর, ডলােমাইট প্রভৃতি দ্রবণীয় শিলায় গঠিত অঞ্চলে ভৌমজলের কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপকে কার্স্ট ভূমিরূপ বলে। কাস্ট অঞ্চল প্রধানত অনুর্বর প্রকৃতির হয়। এর কারণগুলি হল一

[1] চ্যুতি ও দারণের উপস্থিতি : চুনাপাথর ঘন ও পুরু হওয়া সত্ত্বেও অসংখ্য চ্যুতি ও দারণ দিয়ে ভূপৃষ্ঠের জল অতি সহজেই ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। ফলে ভূপৃষ্ঠ শুষ্ক হয়ে পড়ে।
[2] বৃষ্টিপাতের স্বল্পতা : পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ কার্স্ট অঞ্চলগুলিতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ মাঝারি ধরনের। বৃষ্টিপাতের স্বল্পতা কাস্ট ভূমিরূপ গড়ে ওঠায় সহায়ক হলেও কৃষিকাজের জন্য অনুপযুক্ত।
[3] উদ্ভিদের প্রয়ােজনীয় পুষ্টিমৌলের অভাব : এই অঞ্চলের মৃত্তিকা প্রশমিত নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মৃত্তিকা ক্ষারকীয় রেনজিনা প্রকৃতির। দ্রবণ প্রক্রিয়ায় দ্রবীভূত চুনাপাথর অপসারিত হওয়ার পর অদ্রাব্য লৌহযৌগ মাটির ওপরে সঞ্চিত হয়ে অম্লধর্মী লাল কাদামাটি সৃষ্টি করে। তাই এই অঞ্চলের মৃত্তিকায় উদ্ভিদের প্রয়ােজনীয় সকল প্রকার খাদ্য-মৌল উপস্থিত থাকে না। ফলস্বরূপ এই অঞ্চলের মৃত্তিকা অনুর্বর।
[4] মৃত্তিকার জলধারণ ক্ষমতার অভাব : এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম হওয়ার সাথে সাথে মৃত্তিকার জলধারণ ক্ষমতাও কম। তাই মৃত্তিকা শুষ্ক প্রকৃতির এবং অনুর্বর হয়।
[5] গর্তের উপস্থিতি : কার্স্ট অঞ্চলে কার্বনেশন ও দ্রবণ প্রক্রিয়ায় চুনাপাথর খুব তাড়াতাড়ি ক্ষয়িত হয়ে ভূপৃষ্ঠে সােয়ালাে হােল, ডােলাইন, উভালা, পােলজি প্রভৃতি ছােটো বড়াে নানা আকৃতির গর্ত সৃষ্টি হয় এবং ভূপৃষ্ঠ হয়ে ওঠে অনুর্বর।

চুনাপাথরযুক্ত অঞ্চলে উভালা ও পােলজি সৃষ্টি হওয়ার কারণ :
বিশুদ্ধ চুনাপাথরগঠিত অঞ্চলে জলের দ্রবণ কার্যের ফলে সৃষ্ট ফাঁদল আকৃতির অবনত ভূমিরূপকে সিঙ্কহােল বলে। সিঙ্কহােল অধ্যুষিত অঞ্চলে একাধিক সিঙ্কহােল প্রসারিত এবং পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যৌগিক সিঙ্কহােল বা ডােলাইন সৃষ্টি হয়। চুনাপাথর যুক্ত অঞ্চলে গুহার ছাদ বসে গিয়েও ডােলাইন সৃষ্টি হতে পারে। একাধিক সিঙ্কহােল বা ডােলাইন পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়ে যে বৃহদাকৃতির গর্ত সৃষ্টি হয়, তাকে উভালা বলে। উভালা বিভিন্ন আকৃতির হয়। শিলাস্তরের আয়াম বা চ্যুতি রেখা বরাবর সিঙ্কহােলগুলি মিলিত হলে উভালা দীর্ঘাকৃতির হয়। অনুভূমিক স্তরের ওপর সৃষ্ট উভালাগুলি অধিবৃত্তাকার বা উপবৃত্তাকার হয়। উভালা কয়েক হেক্টর স্থান জুড়ে বিস্তৃত হয়।


উভালা অপেক্ষা বৃহদাকৃতির উপবৃত্তাকার অবনত ভূভাগকে পােলজি বা পােলিয়ে বলে। পােলজির তলদেশ সমতল প্রকৃতির। এগুলি খাড়া ঢাল দ্বারা আবদ্ধ। যুগােস্লাভিয়ার লিভেনাে পােলজি প্রায় 65 কিমি দীর্ঘ এবং 5-11 কিমি প্রশস্ত। ছত্তিশগড়ের রায়পুরের দক্ষিণে রায়পুর বস্তার সড়কের পাশে যে বিশাল আকৃতির উপবৃত্তাকার দ্রবণগর্ত সৃষ্টি হয়েছে তার সঙ্গে পােলজির মিল রয়েছে। পােলজির ভেতরে চুনাপাথরের অবশিষ্ট অংশগুলি যখন টিলার মতাে অবস্থান করে তখন তাকে হামস্ বা হে-স্ট্যাক পাহাড় বা পেপিনাে পাহাড় বলে। ছত্তিশগড়ের রায়পুর জেলার মধ্যভাগে শেল দ্বারা গঠিত হামস্গুলিকে রাবণভাটা বলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *