বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অধ্যায়ের টীকা | সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর

মাধ্যমিক ভূগোল : বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

*** জৈব ভঙ্গুর বা জীব বিশ্লেষ্য বর্জ্য পদার্থ (Bio-degradable Waste)

সংজ্ঞা : যে সকল বর্জ্য পদার্থ পরিবেশের বিয়োজক (ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া প্রভৃতি) দ্বারা বিপাকীয় ক্রিয়ার মাধ্যমে বিয়োজিত হয়ে সরল উপাদানে পরিণত হয় তাকে জৈব ভঙ্গুর বা জীব বিশ্লেষ্য বর্জ্য পদার্থ বলে।

বৈশিষ্ট্য :

  • এই ধরনের বর্জ্য পদার্থ থেকে জৈবসার, জৈবগ্যাস প্রভৃতি প্রস্তুত করা সম্ভব।
  • এগুলি বিয়োজক দ্বারা মাটিতে মিশে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে।
  • এই বর্জ্য পদার্থ থেকে পরিবেশ দূষণ কম হয়।

উদাহরণ : কাগজ, কাঠবোর্ড, কাঠ, কাপড়, চামড়া, সবজির খোসা, কৃষিজ বর্জ্য প্রভৃতি।

***জৈব অভঙ্গুর বর্জ্য বা জীব অবিশ্লেষ্য বর্জ্য

সংজ্ঞা : যে-সমস্ত বর্জ্য বিয়োজক (ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদি) দ্বারা বিয়োজিত হয় না বা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়
বিয়োজিত হয় না বা বিয়োজিত হতে দীর্ঘ সময় লাগে, তাদের জৈব অভঙ্গুর বা জীব অবিশ্লেষ্য বর্জ্য বলে।

বৈশিষ্ট্য :

  • এগুলি পরিবেশে বহুকাল ধরে অবিকৃত অবস্থায় পড়ে থাকে।
  • এগুলি দ্বারা পরিবেশ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
  • পরিবেশের ক্ষতি রোধ করতে এগুলিকে পুনর্ব্যবহার কিংবা ভস্মীভূত করা হয়।

উদাহরণ : প্লাস্টিক, পলিথিন, কাচ, বিভিন্ন ধাতু, ডিডিটি, থার্মোকল প্রভৃতি।

***বায়বীয় / গ্যাসীয় বর্জ্য (Gaseous Waste)

সংজ্ঞা :

যে-সমস্ত গ্যাসীয় বা বায়বীয় অতিরিক্ত পদার্থ যা ব্যবহারের অযোগ্য এবং মানুষ ও পরিবেশের ক্ষতি করে তাদের গ্যাসীয় বা বায়বীয় বর্জ্য বলে।

উৎস :

প্রাকৃতিক উৎস :

বনভূমির দাবানল, কৃষিক্ষেত্র বা জলাভূমির পচন ইত্যাদি।

মনুষ্যসৃষ্ট উৎস :

শিল্প কারখানা ও যানবাহন থেকে নির্গত SO2, CO, NO, ইত্যাদি বায়ুমণ্ডলে মিশে বায়বীয় বর্জ্যের সৃষ্টি করে।

বৈশিষ্ট্য :

  • গ্রামাঞ্চল অপেক্ষা শহরাঞ্চল তথা শিল্পাঞ্চলের বায়ুতে গ্যাসীয় বর্জ্যের পরিমাণ বেশি।
  • এই প্রকার বর্জ্য সরাসরি বায়ুমণ্ডলে যুক্ত হয়।
  • গ্যাসীয় বর্জ্য সরাসরি মানবদেহে প্রবেশ করে বলে নাক জ্বালা, চোখ জ্বালার ন্যায় ক্ষণস্থায়ী প্রভাবের সঙ্গে সঙ্গে ব্রংকাইটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবও দেখা যায়।

প্রভাব :গ্যাসীয় বর্জ্যগুলি প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানব শরীরে প্রবেশ করে নানাবিধ রোগের সৃষ্টি করে। ও বিশ্ব উন্নায়নে গ্যাসীয় বর্জ্যগুলির প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। যা গ্রিনহাউস এফেক্ট নামে পরিচিত।

*** তেজস্ক্রিয় বর্জ্য (Nuclear Waste) [ME 19]

সংজ্ঞা :

পারমাণবিক চুল্লি, পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র, পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ও পারমাণবিক গবেষণার কারণে সৃষ্ট তেজস্ক্রিয় পদার্থকে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য (Nuclear Waste) বলে। তবে অনেক সময় প্রাকৃতিক কারণে বা চিকিৎসাজনিত কারণেও এই বর্জ্য উৎপন্ন হয়ে থাকে।

উদাহরণ :

প্লুটোনিয়াম-239, ইউরেনিয়াম-235, 238, থোরিয়াম-230, রেডিয়াম-226, বেরিয়াম-142, কার্বন-14 প্রভৃতি।

প্রভাব :

এই বর্জ্য পদার্থের প্রভাবে বন্ধ্যাত্ব,স্নায়ুরোগ, বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম, পঙ্গুতা সৃষ্টি, লিউকেমিয়া, ম্যালিগনান্ট টিউমার, আয়ুহ্রাস প্রভৃতি দেখা যায়। বর্জ্য পদার্থের প্রভাব দীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকে, জাপানের হিরোসিমা যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

বিপজ্জনক বর্জ্য (Hazardous Waste) :

সাধারণত যে-সকল বর্জ্য মানুষ, প্রাণীজগৎ ও উদ্ভিদ জগতের পক্ষে ক্ষতিকর, বিস্ফোরক, ক্ষয়কারী, অগ্নিসজ্ঞারক ও পরিবেশের অবক্ষয়ের জন্য দায়ী, তাদেরকে বিপজ্জনক বর্জ্য বলে।

এগুলি বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে। যথা—

ভারী ধাতু : সিসা, পারদ, আর্সেনিক,
ক্যাডমিয়াম প্রভৃতি।
অর্গ্যানোক্লোরিন : ডিডিটি, অর্গ্যানোফসফেট;
● জৈব পদার্থ : পিসিবি, ডাইঅক্সিন; ও তেজস্ক্রিয় : প্লুটোনিয়াম-239, ইউরেনিয়াম-235 প্রভৃতি।
বিস্ফোরক : মিথাইল আইসোসায়ানেট।
ক্ষয়কারী পদার্থ : সালফিউরিক অ্যাসিড, নাইট্রিক অ্যাসিড।
● অগ্নিসঞ্চারক : মিথানল, বিউটেন প্রভৃতি।

*** বৈদ্যুতিন বর্জ্য (Electronic Waste) অথবা, E-waste বা E-বর্জ্য :

সংজ্ঞা :

বিভিন্ন বৈদ্যুতিন সামগ্রী থেকে যেসব বর্জ্য পরিবেশেবর্জিত হয়, তাদের বৈদ্যুতিন বর্জ্য বলে।

উদাহরণ :

কম্পিউটার, সেলফোন, টিভি, রেডিয়ো, টেপ রেকর্ডার, সিডি প্লেয়ার, বৈদ্যুতিন খেলনা, হাউস ওয়ারিং-এর (ফ্যান,লাইট, তার, সামগ্রী সুইচ প্রভৃতি) ইত্যাদি থেকে বৈদ্যুতিন বর্জ্য পরিবেশে নিঃসৃত হয়।

প্রভাব :

এই বৈদ্যুতিন বর্জ্য নিকেল, সকল বর্জ্য পদার্থ থেকে নির্গত সিসা, ক্রোমিয়াম, পারদ, আর্সেনিক প্রভৃতি মানব তথা জীব শরীরে নানা ধরনের রোগের (মিনামাটা, ব্ল্যাকফুট, ইটাই-ইটাই, অস্থিক্ষয় প্রভৃতি) সংক্রমণ ঘটায়।

ম্যানিওর পিট (Manure Pit) :

গ্রামঞ্চলে বর্জ্য পদার্থের সংগ্রহ ও নির্বিষকরণ পদ্ধতির সুবিধা না থাকার কারণে বর্জ্য পদার্থ যত্রতত্র ফেলার ফলে মাটি, জল, বায়ুদূষণ ঘটে। এই সমস্যার একটি সন্তোষজনক সমাধান হল ম্যানিওর পিট। এই পদ্ধতিতে প্রথমে বাড়ির আশপাশে একটি গর্ত খোঁড়া হয়। গৃহস্থালির সমস্ত বর্জ্য পদার্থ এই গর্তে বহুদিন ধরে সঞ্চয় করা হয়। গর্তটি বর্জ্য পদার্থ পূর্ণ হলে তা মাটি দিয়ে ভালো করে ঢেকে দেওয়া হয়। এই সময় অপর একটি গর্ত খুঁড়ে সেখানে বর্জ্য পদার্থ সঞ্চয় করা হয়। ঢাকা দেওয়ার 5 – 6 মাস পরে গর্তের বর্জ্য পদার্থগুলি জৈবসারে পরিণত হয়। এই সার কৃষিকাজে ব্যবহার করা হয়।

ফ্লাই অ্যাশ (Fly Ash) ★

সংজ্ঞা : তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা দহনের ফলে চিমনি দিয়ে ধোঁয়ার সঙ্গে যে সূক্ষ্ম (0.2 – 0.6 মিমি ব্যাসযুক্ত) ছাই নির্গত হয়ে বাতাসে উড়তে থাকে, তাকে ফ্লাই অ্যাশ বলে।

উৎস : তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ছাড়াও যেখানে প্রচুর কয়লা হয় পোড়ানো (লৌহ-ইস্পাত কারখানা) সেই সকল শিল্পকেন্দ্র থেকেও ফ্লাই অ্যাশ নির্গত হয়।

প্রভাব : ফ্লাই অ্যাশ বায়ুতে থেকে বায়ুদূষণ ঘটায়, মাটিতে পড়ে মাটিদূষণ ঘটায়, জলের ওপর আস্তরণ সৃষ্টি করে জলদূষণ ঘটায়। সর্বোপরি মানুষের বিভিন্ন রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

পুনর্ব্যবহার : তবে বর্তমানে ফ্লাই অ্যাশকে সংগ্রহ করে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। যথা—
(i) ইট, টালি এমনকি অ্যাসবেস্টস তৈরিতে, (ii) সিমেন্ট তৈরিতে,
(iii) রাস্তা তৈরিতে,
(iv) নীচু জমি ভরাট করতে ফ্ল্যাই অ্যাশ ব্যবহৃত হয়।

***ভার্মি-কম্পোস্টিং(Vermi-composting)

কেঁচোর স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে কাজে লাগিয়ে জৈব বর্জ্য পদার্থের বিয়োজন ঘটিয়ে হিউমাস জাতীয় কম্পোস্ট বা মিশ্র সার উৎপন্ন করার প্রক্রিয়াকে ভার্মি-কম্পোস্টিং বলে। এই প্রক্রিয়ায় কঠিন বর্জ্যের পৃথকীকরণ আবশ্যিক এবং কেঁচোর আর্দ্র পরিবেশের জন্য জল ও গাছের আচ্ছাদন প্রয়োজন।

পাইরোলিসিস (Pyrolysis)

সংজ্ঞা : পদার্থের অক্সিজেনবিহীন দহনকে পাইরোলিসিস প্রক্রিয়া বলে।

প্রভাব : বর্জ্য পদার্থের ওপর এই প্রক্রিয়া করা হলে বর্জ্য পদার্থের তাপীয় বিয়োজন ঘটে। এর ফলে বিভিন্ন গ্যাস, জলে অদ্রাব্য তেল, মিথাইল ও অন্যান্য জ্বালানি শক্তি উৎপন্ন হয়। দহনের পর বর্জ্য পদার্থের অবশিষ্টাংশ পড়ে থাকে। একে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করলে কম ধোঁয়ার সৃষ্টি হয় ও উত্তাপ বেশি পাওয়া যায়। পাইরোলিসিস প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন ছাড়া দহন হওয়ায় ক্ষতিকারক অক্সাইডগুলি (CO2, SO2, NO2) উৎপন্ন হয় না।

D-Waste :

ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল
দেশগুলিতে দ্রুত হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে শহরের জনসংখ্যা। ভারতবর্ষের মেট্রোপলিটন শহরগুলির অত্যধিক জনঘনত্বের চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে ব্যাপক নির্মাণ কার্য এবং পুরোনো নির্মাণগুলি ভাঙার কর্মযজ্ঞ চলছে। এর ফলে যে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য পদার্থ উৎপন্ন হচ্ছে, তাকেই সংক্ষেপে Construction and Demolition Waste বা D-waste বলা হয়। উল্লেখ্য যে, উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিতে এখন
D-waste একটি অন্যতম প্রধান সূচক।

জৈব সার (Bio-fertilizer) :

সংজ্ঞা :

বিভিন্ন প্রাণীজ বর্জ্য, উদ্ভিদ দেহাবশেষ, পশুর হাড়গুঁড়ো, তুষ-ভুসি, সবজি ও ফলের খোসা, খড় প্রভৃতির পচনের ফলে মাটির পুষ্টিদায়ী যে উপাদান তৈরি হয়, তাকে বয়োফার্টিলাইজার বা জৈব সার বলে।

গুরুত্ব : এই সার জমিতে প্রয়োগের ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং শস্যের উৎপাদন বেড়ে যায়। এই সর ব্যবহারের ফলে মাটি ও মাটির ওপর-নীচের জল দূষিত হয় না। রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জমিতে জৈব সার প্রয়োগ করলে মাটি দীর্ঘদিন উৎপাদনক্ষম থাকে। ও জৈব সারের ব্যবহার জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখে।

লিচেট (Leachate) :

সংজ্ঞা : ল্যান্ডফিল বা ভরাটকরণ করা বর্জ্য পদার্থ বৃষ্টির জলে ধুয়ে গেলে সেই বর্জ্য ধোয়া ময়লা জলকে লিচেট বলে।

ক্ষতিকর প্রভাব : লিচেট খুব বিষাক্ত প্রকৃতির হয়। এর দ্বারা যেমন মৃত্তিকার দূষণ ঘটে তেমনি জলাশয়ের জল ও ভৌমজল দূষিত হয়ে পড়ে।

ওশান ডাম্পিং (Ocean Dumping) :

সংজ্ঞা : সমুদ্রের তটভূমিতে গর্ত করে বর্জ্য ভরাটকরণ বা সমুদ্রে সরাসরি বর্জ্য নিক্ষেপ করাকে ওশান ডাম্পিং বলে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ফ্রান্স, প্রভৃতি দেশ প্রতি বছর কোটি কোটি টন বর্জ্য সমুদ্রে নিক্ষেপ করে থাকে।
ক্ষতিকর প্রভাব : ওশান ডাম্পিং-এর কারণে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের প্রভূত ক্ষতি হয়ে থাকে। যেমন : সমুদ্রের জলে তেল ও তেলজাত পদার্থ নিক্ষেপের কারণে সামুদ্রিক জীবের শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে অসুবিধা হয়, ফলে বহু প্রাণীর মৃত্যু হয়। সে কারণে প্ল্যাংকটন জন্মাতে পারে না। ফলে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র বিঘ্নিত হয়। ও কলকারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত বর্জ্য সমুদ্রের জলকে বিষাক্ত করে তোলে। ফলে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি হয়।সমুদ্রের জলে নোংরা, আবর্জনার পরিমাণ বাড়তে থাকায় সমুদ্রের জলে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। এর প্রভাবে সিল, ডলফিন, সার্ক প্রভৃতি সামুদ্রিক প্রাণীর মৃত্যু ঘটে থাকে।

Rlearn Education