বায়ুমন্ডলীয় গোলযোগ : দ্বিতীয় পর্ব

Content Topic :

  • ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের ক্রমবিকাশের চারটি পর্যায়|
  • নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাতের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের পর্যায় |
  • প্রতীপ ঘূর্ণবাতের উৎপত্তি ও গঠন বৈশিষ্ট্য|

বায়ুমন্ডলীয় গোলযোগ : উচ্চমাধ্যমিক ভূগোল


ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের চারটি পর্যায় :
নিরক্ষরেখার উভয় দিকে কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি রেখার মধ্যবর্তী অঞ্চলে যেসব ঘূর্ণবাত সৃষ্টি হয় তাদের ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত বলে।

প্রারম্ভিক পর্যায় : এই পর্যায়ে সমুদ্রের ওপর বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে উয়তার প্রভাবে বায়ুর চাপ ধীরে ধীরে কমে। এলােমেলােভাবে বাতাস বইতে থাকে এবং ক্রমাগত আবর্তিত হয়ে ঘূর্ণির সৃষ্টি হয়।

বিকাশশীল পর্যায় : এই পর্যায়ে বায়ুর চাপ ক্রমাগত কমতে থাকে, বাতাসের গতিবেগ বেড়ে যায় এবং ঝড়ের চক্ষুকে কেন্দ্র করে বাতাস প্রবলবেগে ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে যায়। আকাশ মেঘে ঢাকা থাকে। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বৃষ্টিপাত হয়। ঘূর্ণবাত ভেঙে কয়েকটি ছােটো ছােটো ঘূর্ণবাতে পরিণত হয়। এদের মধ্যে একটি ক্রমশ বড়াে হয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণবাতে পরিণত হয়।

পরিণত পর্যায় : এই পর্যায়ে ঘুর্ণিঝড় প্রবল আকার ধারণ করে। ঘূর্ণিঝড়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে 4টি বৃত্তীয় বলয়ে ভাগ করা যায়। যথা—(i) 10 কিমি 20 কিমি ব্যাসযুক্ত কেন্দ্রবলয়। এই অংশে বাতাসের গতিবেগ খুবই কম, আকাশ পরিষ্কার থাকে। (ii) এর পরবর্তী বলয় 50 কিমি – 150 কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত। এই অংশে বায়ুর চাপীয় ঢাল বেশ খাড়া। তাই বাতাসের গতিবেগ প্রবল, বৃষ্টিপাতের পরিমাণও খুব বেশি। (iii) বহিস্থ বলয়টি ঝঞ্চাবিক্ষুপ্ধ। (iv) সবচেয়ে শেষের বলয়ে দুর্বল ঝােড়াে বাতাস প্রবাহিত হয়।

সমাপ্তি পর্যায় : শক্তিশালী ঘূর্ণবাত স্থলভাগে প্রবেশ করার পর ভূপৃষ্ঠের ঘর্ষণজনিত বাধার জন্য এর গতিবেগ কমে যায়। স্থলভাগে সমুদ্র থেকে জলীয় বাম্পের জোগান কমে বলে ঘূর্ণবাতের শক্তি উল্লেখযােগ্যভাবে কমে যায়। ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কমে যায়। নিম্নচাপের কেন্দ্র ক্রমাগত উচ্চচাপে পরিণত হয়। অবশেষে ঘূর্ণবাতের পরিসমাপ্তি ঘটে।

নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাতের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের পর্যায় : নিরক্ষরেখার উভয় দিকে 35° থেকে 65° অক্ষরেখার মধ্যে দুই বিপরীতধর্মী বায়ুর মিলনের ফলে নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাত সৃষ্টি হয়।

নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাতের ব্যাখ্যায় ভি. বার্কনেস ও জে, বার্কনেসের প্রবর্তিত মেরু বাতাগ্র মতবাদ অধিক গ্রহণযােগ্য।

(1) প্রারম্ভিক পর্যায় : এই পর্যায়ে মেরু অঞ্চলের ভারী শুষ্ক ও শীতল বায়ুপুঞ্জ এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চল থেকে আগত হালকা, উয় ও আর্দ্র বায়ুপুঞ্জ নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে এসে মিলিত হয়। ফলে এই অঞ্চলে একটি সীমান্ত বা বায়ুপ্রচৗীর সৃষ্টি হয়। মেরু বায়ু পূর্ব থেকে পশ্চিমে এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চলের পশ্চিমা বায়ু পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়। এই পর্যায়ে সীমান্ত প্রায় স্থির থাকে। বাতাসের কোনাে স্থানান্তর ঘটে না।

(2) জন্মলাভ পর্যায়ে : এই পর্যায়ে সীমান্ত বরাবর তরঙ্গের সৃষ্টি হয়। বায়ুর চাপ ঢালের পার্থক্যের কারণে শীতল বায়ুপুঞ্জ উয় বায়ুপুঞ্জের মধ্যে প্রবেশ করে শীতল সীমান্ত সৃষ্টি করে। ফলে উয় বায়ুপুঞ্জ সংকুচিত হয় এবং শীতল বায়ুপুঞ্জকে সরিয়ে উয় সীমান্ত সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় দুই সীমান্তের মিলন বিন্দুতে একটি তরঙ্গশীর্ষ সৃষ্টি হয়। এইভাবে ঘূর্ণবাত জন্মলাভ করে।

(3) পরিণত পর্যায় : এই পর্যায়ে সীমান্ত বরাবর তীব্র আলােড়ন শুরু হয়। এই সময়ে শীতল বায়ু মাটি ঘেঁসে উয় বায়ুকে দ্রুত হারে সরাতে থাকে এবং উয় বায়ু সংকুচিত হয়ে শীতল বায়ুপুঞ্জের দিকে অগ্রসর হয়। উয় বাতাস শীতল ও ভারী বাতাসকে সরিয়ে এগােতে পারে না। তাই উয় বাতাস শীতল বাতাসের সঙ্গে একটি তির্যক তল সৃষ্টি করে শীতল বাতাসের ওপর দ্রুত উঠতে থাকে এবং ধীরে ধীরে শীতল বায়ুপুঞ্জকে সরাতে থাকে। এই পর্যায়ে তরঙ্গের বিস্তার ও বক্রতা বৃদ্ধি পায় এবং ঘূর্ণবাত পরিণতি লাভ করে। উয় বায়ু শীতল বায়ুপুঞ্জের ওপরে উঠে শীতল ও ঘনীভূত হয়। ফলে ওই অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটে। এই পর্যায়ের শেষে শীতল সীমান্ত উয় সীমান্তকে এদের শীর্ষবিন্দুর কাছে ধরে ফেলে। ফলে এই সময় থেকেই বন্ধ সীমান্ত বা অন্তর্লীন পর্যায় শুরু হয়।

(4) সীমান্ত পর্যায় : এই পর্যায়ে শীতল সীমান্ত উষ্ণ সীমান্তকে অতিক্রম করে। ফলে শীতল বায়ুপুঞ্জ উয় ক্ষেত্রের বায়ুপুঞ্জকে ঠেলে শীতল বায়ুপুঞ্জের ওপরে তুলে দেয়। উষ্ণ বায়ুপুঞ্জের সঙ্গে ভূপৃষ্ঠের আর কোনাে সংযােগ থাকে না। সমগ্র অঞ্চল শীতল বায়ুর দখলে আসে। ওই সময়ে কেবলমাত্র শীতল বায়ুর মৃদু আবর্তন লক্ষ করা যায়। ভূপৃষ্ঠ থেকে তাপ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঘূর্ণবাতের পরিসমাপ্তি ঘটে।

প্রতীপ ঘূর্ণবাতের উৎপত্তি ও গঠন বৈশিষ্ট্য :
প্রবল গতিসম্পন্ন উচ্চচাপ কেন্দ্রের বহির্মুখী ঘূর্ণমান অধােগামী বায়ুপ্রবাহকে প্রতীপ ঘূর্ণবাত বলে। সাধারণত হিমমণ্ডলে ও নাতিশীতােয় মণ্ডলের কোনাে কোনাে স্থানে অত্যধিক শৈত্যের জন্য অথবা শীতকালে শৈত্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে ওই অঞ্চলে গভীর উচ্চচাপ কেন্দ্রের সৃষ্টি হয়। চাপটালকে অনুসরণ করে উচ্চচাপ কেন্দ্র থেকে শীতল ও ভারী বাতাস বাইরের দিকে অর্থাৎ নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়। উত্তর গােলার্ধে বাতাস উচ্চচাপ কেন্দ্র থেকে দক্ষিণাবর্তে ও দক্ষিণ গােলার্ধে বাতাস বামাবর্তে প্রবাহিত হয়। এই বায়ু শুষ্ক ও শীতল হওয়ায় আকাশে কোনাে মেঘ সৃষ্টি হয় না। তাই এই বায়ুপ্রবাহের ফলে বৃষ্টিপাত হয় না। আকাশ রােদে ঝলমল করে। হিমমণ্ডল ও নাতিশীতােয় অঞ্চল ছাড়াও উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ অঞ্চলে ট্রপােস্ফিয়ারের উর্ধাংশে প্রতীপ ঘূর্ণবাত সৃষ্টি হয়।

নিম্ন মধ্য অক্ষাংশের ঘূর্ণবাত ও প্রতীপ ঘূর্ণবাত অনেক সময় উত্তরে অবস্থিত পশ্চিমা বায়ুপ্রবাহ অঞ্চলকে ভেদ করে প্রবিষ্ট হয় এবং তার ফলে মেরুপ্রদেশীয় ও ক্রান্তীয় বায়ু উভয়ই তাদের উৎপত্তিস্থল থেকে অপসারিত হয়। এভাবে ঘূর্ণবাত ও প্রতীপ ঘূর্ণবাতের মাধ্যমে মেরুপ্রদেশীয় ও ক্রান্তীয় বায়ু পরস্পরের মধ্যে স্থানবিনিময়ের দ্বারা ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন অংশে উয়তার তারতম্যে একটি সমতা আনার চেষ্টা করে।

প্রতীপ ঘূর্ণবাতের বৈশিষ্ট্য :
আঞ্চলিক অবস্থান : প্রতীপ ঘূর্ণবাত সাধারণত নাতিশীতােয়মণ্ডল ও হিমমণ্ডলে প্রবাহিত হয়। এই ঘূর্ণবাত প্রধানত শীতল স্থলভাগের ওপর সৃষ্টি হয়।

বায়ুর চাপ : প্রতীপ ঘূর্ণবাতের কেন্দ্রে থাকে উচ্চচাপ এবং বাইরের দিকে থাকে নিম্নচাপ। এর কেন্দ্র ও বহির্ভাগে বায়ুচাপের পার্থক্য থাকে প্রায় 10 থেকে 20 মিলিবার।
বায়ুপ্রবাহের দিক : এই বায়ু উত্তর গােলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে এবং দক্ষিণ গােলার্ধে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে প্রবাহিত হয়।
বায়ুর গতিবেগ : প্রতীপ ঘূর্ণবাতে বায়ুর গতিবেগ কম হয়।
বিস্তৃতি : প্রতীপ ঘূর্ণবাত বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে অবস্থান করে।
স্থায়িত্বকাল : প্রতীপ ঘূর্ণবাত দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়।
আবহাওয়া : প্রতীপ ঘূর্ণবাতে মেঘ সৃষ্টি হয় না। ফলে বায়ু শুষ্ক ও আকাশ পরিষ্কার থাকে।

Rlearn Education