বিজ্ঞানসাধনায় বাঙালি

বিজ্ঞানসাধনায় বাঙালি | মাধ্যমিক বাংলা রচনা

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বাংলা রচনা সাজেশান : বিজ্ঞানসাধনায় বাঙালি

নবীন সাধনা সব সাধনার বাড়া।
‘তপের প্রভাবে বাঙালি সাধক জড়ের পেয়েছে সাড়া/আমাদের —সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত।

ভূমিকা :

বাংলা ও বাঙালির বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাস সুপ্রাচীন। প্রাচীন যুগ থেকে বাঙালির ছিল আর্থিক ও বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি। নৌ- বিজ্ঞানে বাঙালির ছিল অতুল পারদর্শিতা। ভেষজ বিজ্ঞানে ও বাস্তু বিজ্ঞানেও বাঙালি বিজ্ঞানীদের খ্যাতির কদর আছে ইতিহাসে। ‘চিকিৎসা সংগ্রহ’, আয়ুর্বেদ-দীপিকা’ প্রভৃতি গ্রন্থের রচয়িতা পাল রাজার সভাসদ প্রসিদ্ধ আয়ুর্বেদজ্ঞ চক্রপানি দত্ত ছিলেন বাঙালি। খ্রিস্টীয় ছয় শতকের শ্রেষ্ঠ কৃষিবিজ্ঞানী খনা এই বাংলাদেশেরই মানুষ। তাঁর রচিত ‘কৃষিপ্রসার’ গ্রন্থটি কৃষিবিজ্ঞানের এক মূল্যবান দলিল, শ্রীধর আচার্য ছিলেন বিখ্যাত বাঙালি গণিতজ্ঞ।

বাঙালির আধুনিক বিজ্ঞান সাধনা—দ্বিমুখী ধারা :

বাঙালি আধুনিক বিজ্ঞান সাধনা ও গবেষণার সূত্রপাত হয় ইংরেজ রাজত্বকালে ঊনবিংশ শতকে। এই সময় বাঙালি পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় হিন্দু কলেজ। এই কলেজে এবং ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানচর্চার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে অনুমোদিত সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজও সেকালের বিজ্ঞান গবেষণার বিশিষ্ট কেন্দ্র হয়ে ওঠে। আচার্য জগদীশ বসু এই কলেজেই ছাত্রজীবনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। ওই সময়ে ড. মহেন্দ্রলাল সরকার ‘Indian Association for the Cultivation of Science’ প্রতিষ্ঠা করেন।

বাঙালির বিজ্ঞান সাধনায় এই সময়ে দুটি ধারা পরিলক্ষিত হয়—প্রথমত, বিজ্ঞান বিষয়ক বিবিধ রচনা। রচয়িতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ। দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগে মৌলিক গবেষণা। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগে খ্যাতনামা বাঙালি বিজ্ঞানী—

জগদীশচন্দ্র বসু :

বাঙালি বিজ্ঞানীদের অন্যতম আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। তিনিই প্রথম বেতার তরঙ্গ উৎপাদনের যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত ইতালির মার্কনির ভাগ্যে ওই সম্মান জোটে। তিনি ‘ক্রেসকোগ্রাফ’ যন্ত্র আবিষ্কার করেন ও প্রমাণ করেন যে উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। তাঁর রচনা ‘অব্যক্ত’ বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। পরাধীন ভারতে বৈজ্ঞানিক গবেষণার স্বার্থে তিনি ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির।’

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় :

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এদেশে নব্যরসায়নের প্রথম আচার্য। ১৮৯৫ সালে তিনি মারকিউরাস নাইট্রাইট আবিষ্কার করেন। বাঙালিকে রসায়নের প্রয়োগগত ক্ষেত্রেও নিপুণ করতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড-ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস।

সত্যেন্দ্রনাথ বসু-মেঘনাদ সাহা :

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যাসয়ের দুই কৃতী ছাত্র সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও মেঘনাদ সাহা—পদার্থ বিদ্যায় বাংলা মায়ের দুই গর্ব। প্রখ্যাত পদার্থবিদ ও গণিতজ্ঞ সত্যেন্দ্রনাথের ‘প্লাঙ্ক সূত্র ও কোয়ান্টাম প্রকল্প” নামে একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ পাঠ করে স্বয়ং আইনস্টাইন মুগ্ধ হন এবং তিনি নিজেই সেটিকে জার্মান ভাষায় অনুবাদকরে জেইটবারে ফিজিক পত্রিকায় প্রকাশ করেন। সেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিই আজ ‘বোস- আইনস্টাইন তত্ত্ব’ নামে সমাদৃত।
সত্যেন্দ্রনাথের সহপাঠী মেঘনাদ সাহা বিখ্যাত হয়ে আছেন তার উল্লেখযোগ্য গবেষণা ‘থিওরি অব থারমাল আয়নাইজেশন’-এর জন্য। মেঘনাদ সাহার স্মরণীয় কীর্তি ‘ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’ বর্তমানে পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

প্রশান্তচন্দ্র মহালনবীশ :

প্রশান্তচন্দ্র মহালনবীশ পদার্থবিদ্যার ছাত্র হলেও, তাঁর অক্ষয় কীর্তি রেখে গেছেন স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে। পরিসংখ্যানবিদ হিসেবে রামচন্দ্র বসু, সমরেন্দ্রনাথ রায়ের নাম উল্লেখ করা যায়।

উপেন্দ্র ব্রহ্মচারী :

কালাজ্বরের প্রতিষেধক ইউরিয়া স্টিবামাইন আবিষ্কার করে উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী বিখ্যাত হয়ে আছেন বাঙালির হৃদয়ে। এছাড়াও অন্য খ্যাতনামা বাঙালি বিজ্ঞানীরা হলেন—রসায়নবিদ জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, ডা. রাধাগোবিন্দ কর, দেবেন্দ্রমোহন বসু, মনস্তত্ত্ববিদ গিরিন্দ্রশেখর বসু প্রমুখ।

বিজ্ঞানের বর্তমান প্রজন্ম :

বোম্বাই-এর ‘Bhabha Atomic Research Center’ (BARC) কলকাতার সল্টলেকে একটি শাখা খুলেছে। এই কেন্দ্রের বাঙালি বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ ফল এখন দেহে যে-কোনো ধরনের টিউমার শনাক্ত করতে পারে। কলকাতায় গড়ে উঠেছে ‘সেন্ট্রাল গ্লাস অ্যান্ড সেরামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট।’ এখানে প্রধান প্রধান কাজের দায়িত্বে আছেন বাঙালি বিজ্ঞানীরাই। প্রতিরক্ষা, মহাকাশ গবেষণা প্রযুক্ত এবং আলোকীয় যন্ত্রপাতি (Optical Instruments) নির্মাণের জন্য বিভিন্ন রকমের কাজ তৈরির পাইলট প্লান্ট পরিচালনার দায়িত্বে নিযুক্ত আছেন। বিধাননগর এসেছে ভ্যারিয়েবল এনার্জি সাইক্লোটন যন্ত্র। উন্নততর ‘Computer’- এর সাহায্যে নানা বিষয়ে গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চলেছেন ড. বিকাশ সিনহা ও তাঁর সহযোগীরা। টেস্টটিউবে ভ্রূণ তৈরি করে বরফে বাঁচিয়ে রাখার পদ্ধতি প্রথম আবিষ্কার করেন বাঙালি বৈজ্ঞানিক ডা. সুভাষ মুখার্জি।

উপসংহার :

অতীতে বাঙালি যেভাবে বিজ্ঞানচর্চা করেছিল, মধ্যযুগীয় অন্ধকারে তা হারিয়ে গেলেও ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি চিন্তাবিদরা তা পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছেন। বাঙালির প্রতিভার অভাব কোনো দিনও ছিল না, কিন্তু পরাধীন দেশের মানুষ বলে বাঙালি প্রতিভা বিশ্বজয়ী গৌরব অর্জন করেনি। আজ স্বাধীন ভারতে বাঙালি তরুণ বিজ্ঞান গবেষণায় সাফল্য লাভের জন্য বিদেশে পাড়ি জমানোটাই অবশ্যকরণীয় মনে করেন। জাতীয় বিজ্ঞান গবেষণার পরিকল্পনা ও রূপায়ণের জন্য চাই স্বদেশভাবনার প্রোজ্জ্বল তরুণ-মানস।

Rlearn Education