ক্ষয়চক্র : গঠন ও প্রক্রিয়া| স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের ধারণা বা, ডেভিসের ক্ষয়চক্র মতবাদ : প্রথম পর্ব

ক্ষয়চক্র : গঠন ও প্রক্রিয়া (স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের ধারণা বা, ডেভিসের ক্ষয়চক্র মতবাদ): উচ্চমাধ্যমিক ভূগোল|(HS Geography)


১৮৯৯ সালে আমেরিকান ভূতত্ত্ববিদ উইলিয়াম মরিস ডেভিস (William Morris Davis) ভূমিরূপের ধারাবাহিক বিবর্তনে ক্ষয়চক্র ধারণাটির উদ্ভাবন করেন। এবং এই ধারণাকে তিনি বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেন।
তাঁর মতে, “Landscape is a function of Structure, Process and Stage”.
অর্থাৎ, ভূমিরূপ হল গঠন, প্রক্রিয়া ও পর্যায়ের সম্মিলিত পরিণতি।

ক্ষয়চক্রের নিয়ন্ত্রকঃ
ডেভিসের স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র ধারণার গতিপ্রকৃতি নির্ধারিত হয় প্রধানত তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যথা,

গঠন (Structure):- গঠন বলতে এখানে শিলার গঠন বিশেষত শিলার কাঠিন্য, সংযুক্তি, ভাঁজ, চ্যুতি, প্রবেশতা, প্রভৃতির সম্মিলিত অবস্থাকে বোঝানো হয়েছে।
প্রক্রিয়া (Process):- প্রক্রিয়া বলতে এখানে ভূপৃষ্ঠের ওপর ক্রিয়াশীল আবহবিকার, পুঞ্জিত ক্ষয়, নদী, হিমবাহ, বায়ুপ্রবাহ, সমুদ্রতরঙ্গ, ভূমিকম্প প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তিকে বোঝানো হয়েছে।
পর্যায় (Stage):- পর্যায়ে বলতে এখানে ভূমিরূপ ক্রমবিকাশের বিভিন্ন সময় বা অবস্থাকে বোঝানো হয়েছে।

ক্ষয়চক্রের শর্তসমূহঃ উইলিয়াম মরিস ডেভিস তাঁর ক্ষয়চক্র মতবাদে কতকগুলি পূর্ব শর্তের কথা উল্লেখ করেছেন—

১। ভূমির উত্থান খুব দ্রুতগতিতে ঘটবে এবং উত্থানপর্বে ক্ষয়কার্য বিশেষ হবে না।

২। সামগ্রিকভাবে অঞ্চলটি সমুদ্র সমতলের ওপর অবস্থান করবে।
৩। অঞ্চলটি কঠিন ও কোমল শিলার সমন্বয়ে গড়ে উঠবে।
৪। অঞ্চলটির প্রারম্ভিক ঢাল হবে সমুদ্রমুখী।
৫। অঞ্চলটি আর্দ্র জলবায়ুর অন্তর্গত হবে।
৬। ক্ষয়চক্র চলাকালীন ভূভাগ অনড় বা স্থির অবস্থায় থাকবে।
৭। ক্ষয়ের শেষ সীমা পর্যন্ত নদী নিম্নক্ষয় করতে থাকবে এবং অঞ্চলটি ক্ষয়সীমা বরাবর সমপ্রায়ভূমিতে পরিণত হবে।
৮। নদীর কার্য, আবহবিকার, পুঞ্জিত ক্ষয় প্রভৃতি বহির্জাত প্রক্রিয়াগুলি একসঙ্গে ভূমিরূপের বিবর্তনে অংশগ্রহণ করবে।

ক্ষয়চক্রের বিভিন্ন পর্যায়ঃ William Morris Davis -এর মতে সম্পূর্ণ ক্ষয়চক্র পদ্ধতি তিনটি সুস্পষ্ট অবস্থার মধ্যে আবর্তিত হয়।
A. যৌবন অবস্থা : ক্ষয়চক্রের যৌবন অবস্থায় নিম্নরূপ বৈশিষ্ট্যগুলি দেখা যায়—
১। এই অবস্থায় সমুদ্র অভিমুখী ঢাল অধিক বলে নদী দ্রুত নিম্নক্ষয় করে। এছাড়া, এই অবস্থায় নদীর মস্তকমুখী ক্ষয়কার্য লক্ষ্য করা যায়।
২। নদী উপত্যকায় নিম্নক্ষয় বেশি হওয়ায় নদী উপত্যকাগুলি সংকীর্ণ ‘V’ আকৃতির হয়।
৩। এই অবস্থায় দুটি নদীর মধ্যবর্তী জল- বিভাজিকা বিস্তৃত থাকে।
৪। নদীর গতিপথে জলপ্রপাত ও খরস্রোতের সৃষ্টি হয়।
৫। নদীগর্ভে বা নদী উপত্যকায় মন্থকূপের সৃষ্টি হয়।
৬। এই অবস্থায় নদীর গতিপথে ভূমিভাগ খাড়া ঢালযুক্ত হয়।

B. পরিণত অবস্থা : ক্ষয়চক্রের পরিণত পর্যায়ে যেসব বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়, সেগুলি হল নিম্নরূপ—
১। এই পর্যায়ে নদী উপত্যকায় নিম্নক্ষয়ের তুলনায় পার্শ্বক্ষয় বৃদ্ধি পায়।
২। নদী উপত্যকাগুলি প্রশস্ত বা প্রসারিত ‘V’ অক্ষরের মতো হয়।
৩। জলবিভাজিকা গুলি সুস্পষ্ট হয় এবং শৈলশিরার আকারে অবস্থান করে।
৪। এই পর্যায়ে নদীবাঁক বা মিয়েন্ডার-এর সৃষ্টি হয়।
৫। নদীর দুপাশে পলি সঞ্চিত হয়ে প্লাবনভূমির সৃষ্টি হয়।
৬। এই পর্যায়ে উত্থান পর্বের প্রাথমিক চিহ্নগুলি লোপ পায়। নদীগুলির নিম্নক্ষয়ের পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় নদীঢাল পর্যায়িত অবস্থায় পৌঁছায়।

C. বার্ধক‍্য অবস্থা : ক্ষয়চক্রের বার্ধক্য অবস্থায় নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ্য করা যায়—
১। এই পর্যায়ে নদীর ঢাল ভীষণভাবে কমে যায় বলে নদীর সঞ্চয়কার্যের প্রাধান্য দেখা যায়।
২। নদী উপত্যকাগুলি খুবই প্রশস্ত ও মৃদু ঢালযুক্ত হয়।
৩। এই পর্যায়ে নদী উপত্যকাগুলি প্রায় সমুদ্র সমতলে অবস্থান করে।
৪। নদীগুলি অত্যন্ত আঁকাবাঁকাভাবে সর্পিল গতিতে প্রবাহিত হয়।
৫। নদীবাঁক বৃদ্ধি পেয়ে এই পর্যায়ে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের সৃষ্টি হয়।
৬। এই পর্যায়ে সমপ্রায়ভূমির সৃষ্টি হয় এবং সমপ্রায়ভূমির ওপর কঠিন শিলায় গঠিত টিলা বা মোনাডনক দেখা যায়।

Rlearn Education