ক্ষয়চক্র : গঠন ও প্রক্রিয়া (চতুর্থ পর্ব)

উচ্চমাধ্যমিক ভূগোল : ক্ষয়চক্র : গঠন ও প্রক্রিয়া

আলোচ্য বিষয় :

  • কিং-এর শুষ্ক অঞ্চলের ক্ষয়চক্রের ধারণা|কিং-এর পাদ সমতলীকরণ মতবাদ
  • পেডিপ্লেনের সৃষ্টি
  • ডেভিসের ত্রয়ী
  • মরু ক্ষয়চক্রে দৃশ্যমান বিভিন্ন ভূমিরূপ ৷
  • নিক বিন্দুর গঠন|
  • বাজাদার বৈশিষ্ট্য|
  • বােলসন বা প্লায়া|
  • পেডিমেন্ট ও বাজাদার পার্থক্য |
  • নিক পয়েন্ট অঞ্চলে জলপ্রপাত সৃষ্টির কারণ|

কিং-এর শুষ্ক অঞ্চলের ক্ষয়চক্রের ধারণা|কিং-এর পাদ সমতলীকরণ মতবাদ :
এল.সি.কিং দক্ষিণ আফ্রিকার বিস্তীর্ণ মরু ও মরুপ্রায় অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করে 1948 খ্রিস্টাব্দে ভূমিরূপের বিবর্তন সম্পর্কিত মতবাদ প্রকাশ করেন। তার মতে পর্বত ঢালের পশ্চাদপসরণেই ফলেই পাদসমভূমি গঠিত। পর্যায়ক্রমে যৌবন, পরিণত ও বার্ধক্যের মধ্য দিয়ে মরু ও মরুপ্রায় অঞ্চলে পাদসমভূমি গঠিত।

(১) যৌবন পর্যায় : পূর্ববর্তী পাদসমভূমি উত্থানের মধ্য দিয়ে মরু অঞ্চলের ক্ষয়চক্র শুরু হয়। ভূমির উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই অঞ্চলের নদীগুলি নিম্নক্ষয়ের মাধ্যমে খাড়া পাড়বিশিষ্ট উপত্যকা গঠন করে। পরবর্তী কালে নদীর নিম্নক্ষয়ের মাত্রা কমে গেলে উপত্যকার খাড়া ঢালের সর্বত্র সমানভাবে আবহবিকার প্রক্রিয়া দ্রুত কাজ করতে থাকে। ফলে ঢালের দ্রুত পশ্চাদপসরণের সঙ্গে সঙ্গে পর্বতেরও পশ্চাদপসরণ ঘটে। তখন পর্বতের সম্মুখভাগে এক সমতলপৃষ্ঠের সৃষ্টি হয়। একে পেডিমেন্ট বলে। পেডিমেন্ট ক্রমাগত প্রসারিত হলে অন্তর্বর্তী জলবিভাজিকা সংকীর্ণ হয়ে পাহাড়ের রূপ ধারণ করে। একে ইনসেলবার্জ বলে। ইনসেলবার্জ গােলাকার হলে তাকে বাের্নহার্ট বলে।

(২) পরিণত পর্যায় : নদী এই পর্যায়ে তার নিম্নক্ষয়ের ক্ষমতা হারায়। পেডিমেন্টগুলি খুব বেশি বিস্তৃত হওয়ায় কিছু কিছু ইনসেলবার্জ অবলুপ্ত হয়। ফলে পেডিমেন্টগুলি সংযুক্ত হয়ে বিস্তীর্ণ সমপ্রায় ভূমি বা পেডিপ্লেন সৃষ্টি হয়।

(৩) বার্ধক্য পর্যায় : এই পর্যায়ে অধিকাংশ ইনসেলবার্জ বিলুপ্ত হয়। ভূমির বন্ধুরতা তেমন থাকে না। একাধিক পেডিপ্লেন যুক্ত হয়ে অসংখ্য অবতল ঢালযুক্ত বিস্তীর্ণ পেডিপ্লেন গঠিত হয়।

পেডিপ্লেনের সৃষ্টি :
L. C. King-এর মতে মরু বা মরুপ্রায় অঞ্চলের ক্ষয়চক্রের পরিণত অবস্থায় নদী তার নিম্নক্ষয় করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং পেডিমেন্টগুলি অধিক মাত্রায় বিস্তৃত হয়। কিছুকিছু ইনসেলবার্জ এই পর্যায়ে অবলুপ্ত হয়। ফলে ইনসেলবার্জের উভয় দিকের পেডিমেন্টগুলি সংযুক্ত হয়ে এক বিস্তীর্ণ সমভূমি বা পেডিপ্লেন সৃষ্টি হয়।

ডেভিসের ত্রয়ী :
ডেভিসের ধারণা অনুযায়ী, ‘Landscape is the function of structure, process and stage’। একে ডেভিসের ত্রয়ী বলা হয়। অর্থাৎ ভূমিরূপ হল গঠন, প্রক্রিয়া এবং পর্যায়ের সম্মিলিত ফল।

(১) গঠন : গঠন বলতে তিনি শিলার কাঠিন্য, সংযুক্তি, চ্যুতি, ভাজ, নতি, প্রবেশ্যতা প্রভৃতির সম্মিলিত অবস্থাকে বুঝিয়েছেন।

(২) প্রক্রিয়া : প্রক্রিয়া বলতে তিনি অন্তর্জাত শক্তি (ভূ-আলােড়ন, অগ্ন্যুৎপাত ইত্যাদি) এবং বহির্জাত শক্তি (আবহবিকার, পুঞ্জিত স্বালন এবং সমুদ্রতরঙ্গ,নদী, বায়ু, হিমবাহ প্রভৃতি)-কে বুঝিয়েছেন।

(৩) পর্যায় : পর্যায় বলতে ডেভিস ভূমিরূপ ক্রমবিকাশের সময় বা ব্যাপ্তিকালকে বুঝিয়েছেন। তিনি ভূমিরূপ পর্যায়কে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন- যৌবন পর্যায়, পরিণত পর্যায় ও বার্ধক্য পর্যায়।

মরু ক্ষয়চক্রে দৃশ্যমান বিভিন্ন ভূমিরূপ:
মরু ক্ষয়চক্রে দৃশ্যমান বিভিন্ন ভূমিরূপগুলি হল পেডিমেন্ট, বাজাদা, ইনসেলবার্জ, বায়ুতাড়িত অবনত ভূমিভাগ ইত্যাদি।

নিক বিন্দুর গঠন :
ভূমিরূপের পুনর্যৌবন লাভের ফলে নদীর দৈর্ঘ্য বরাবর মৃদু পুরাতন ঢাল ও নতুন খাড়া ঢালের সৃষ্টি হয়। এই দুই ঢালের সংযােগ বিন্দুতে যে খাঁজের সৃষ্টি হয়, তাই হল নিক বিন্দু।

বাজাদার বৈশিষ্ট্য :
✩ পেডিমেন্টের সম্মুখভাগে অবনমিত অংশে জলধারা বাহিত বিভিন্ন আকৃতির শিলাখণ্ড, নুড়ি, কাঁকর, বালি, পলি ও কাদা প্রভৃতি সঞ্চিত হয়ে বাজাদা সৃষ্টি হয়।

✩ বাজাদা মরু ও মরুপ্রায় অঞ্চলে গঠিত হতে দেখা যায়।

✩ এটি একটি সঞ্চয়জাত সমভূমি।

✩ বাজাদা অংশে ভূমির ঢাল খুবই কম। ভূমির ঢাল সামান্য উত্তল প্রকৃতির হয়।

বােলসন বা প্লায়া :
মরু অঞ্চলে স্থানে স্থানে পর্বতবেষ্টিত অবনমিত ভূমি অবস্থান করলে এর কেন্দ্রস্থলে একটি হ্রদের সৃষ্টি হয়। মরুভূমির মাঝে এইরুপ পর্বতবেষ্টিত হ্রদকে প্লায়া বলে। উ:-প: আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে একে বােলসন বলে। রাজস্থানের সম্বর হ্রদ প্লায়ার উদাহরণ।

বৈশিষ্ট্য :

(১) মরু অঞ্চলে হঠাৎ প্রবল বেগে বৃষ্টিপাত হলে পর্বতবেষ্টিত অঞ্চলে যে কেন্দ্রমুখী জলনির্গম প্রণালী গড়ে ওঠে তার মাধ্যমে প্লায়াতে জল সঞ্চিত হয়।
(২) বছরের অধিকাংশ সময় প্লায়া শুষ্ক থাকে।
(৩) শুষ্ক প্লায়ার উপরিভাগ লবণের আবরণে ঢাকা থাকে।

পেডিমেন্ট ও বাজাদার পার্থক্য :
পেডিমেন্ট : (১) পেডিমেন্ট দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। ‘পেডি’ শব্দের অর্থ পাদদেশ এবং ‘মেন্ট’ শব্দটি এসেছে মাউন্ট থেকে, যার অর্থ পাহাড়। সাধারণ অর্থে পেডিমেন্ট কথার অর্থ হল পাহাড়ের পাদদেশের সমভূমি। (২) উচ্চভূমির সম্মুখভাগের পশ্চাৎ অপসারণের ফলে উচ্চভূমির সম্মুখভাগ সমান্তরালভাবে কর্তিত হয়ে পেডিমেন্ট সৃষ্টি হয়। (৩) পেডিমেন্টগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রস্তর খণ্ড, বালি ও পলি দ্বারা আবৃত থাকতে পারে, আবার উন্মুক্তও থাকতে পারে। পেডিমেন্টগুলি মৃদু ঢালে বিস্তৃত। ভূমিভাগ অবতল প্রকৃতির। (৪) আবহবিকার, পুঞ্জিত স্বলন, জলধারা ও বায়ুপ্রবাহ- এগুলির যৌথ কার্যের ফলে পেডিমেন্ট সৃষ্টি হয়।

বাজাদা : (১) পেডিমেন্টের সম্মুখভাগে সঞ্চয়জাত যে সমভূমি গঠিত হয় তাকে বাজাদা বা বাহাদা বলে। (২) মরু অঞ্চলে পেডিমেন্টের সম্মুখভাগের অবনমিত অংশে জলধারা-বাহিত বিভিন্ন আকৃতির শিলাখণ্ড, নুড়ি, কাঁকর, বালি, পলি ও কাদা প্রভৃতি সঞ্চিত হয়ে বাজাদা সৃষ্টি হয়। (৩) বাজাদা সঞ্চয়জাত সমভূমি। এই অংশে ভূমির ঢাল এত কম যে একে সমভূমি বলে মনে হয়। ভূমির ঢাল সামান্য উত্তল প্রকৃতির। (৪) জলধারার কার্যের ফলে পেডিমেন্টের সম্মুখে শিলাখণ্ড, কাঁকর, বালি ও পলি সঞ্চিত হয়ে বাজাদার সৃষ্টি হয়।

নিক পয়েন্ট অঞ্চলে জলপ্রপাত সৃষ্টির কারণ:
(১) চাল : নিক বিন্দুতে উর্ধ্ব উপত্যকার পুরােনাে মৃদু ঢালের সঙ্গে নিম্ন উপত্যকার নতুন খাড়াটলের মিলন ঘটে, যা জলপ্রপাত সৃষ্টির জন্য আদর্শ।
(২) স্কন্ধভূমি : দুই উপত্যকার সংযােগস্থলে ঢালের বিচ্যুতিজনিত একটি স্কন্ধভূমি গড়ে ওঠে। এই স্কন্ধভূমির খাড়া ঢাল জলপ্রপাত সৃষ্টির পক্ষে সহায়ক।
(৩) মস্তকমুখী ক্ষয় : নিক বিন্দুতে নদীর মস্তকমুখী ক্ষয় দ্রুত হয়, যা জলপ্রপাত সৃষ্টির অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।

Rlearn Education