জাতীয় সংহতি | বাংলা রচনা

বাংলা রচনা : মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক |

“নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান,
বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান।”— অতুলপ্রসাদ সেন


ভূমিকা: মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। আর আমাদের সমাজে কয়েকটি ব্যক্তি মিলে হয় পরিবার, পরিবার থেকে হয় গ্রাম ও শহর। এইভাবেই ক্রমে ক্রমে গড়ে ওঠে দেশ। পরিবারের উন্নতি ও কল্যাণ নির্ভর করে যেমন পরিবারের সকল সদস্যের আন্তরিক প্রচেষ্টার ওপর, দেশের সামগ্রিক কল্যাণও নির্ভর করে তেমন সেই দেশের সমগ্র জনগণের ঐক্য চেতনা ও একাত্ম -বোধের ওপর।

জাতীয় সংহতির স্বরূপ: জাতীয় সংহতি হল কোনো জাতির বা দেশের জনগণের আন্তরিক ঐক্যচেতনা বা ঐক্যানুভূতি। কোনো দেশের সকল মানুষ জাত-পাতের সীমা, ভৌগোলিক সীমা, ধর্ম ও ভাষার সীমা, আচার- ব্যবহার- পোশাক-পরিচ্ছদের সীমা, নানা বিশ্বাস ও সংস্কারের সীমা অতিক্রম করে নিজেদের মধ্যে যখন ঐক্যবোধ জাগিয়ে তোলে, তখনই বিকাশ ঘটে জাতীয় সংহতির।

জাতীয় সংহতির বাধা: জাতীয় ক্ষেত্রে অসংহতির পেছনে একাধিক কারণ বর্তমান। যেমন—সাম্প্রদায়িকতা, জাতিভেদ-প্রথা, বহু ভাষা, সংকীর্ণ প্রাদেশিকতা, বহুদলপ্রথার গণতন্ত্র, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক অসাম্য, নিরক্ষরতা | এ ছাড়াও আছে হতাশাগ্রস্ত বৃহত্তর জনসমাজ, বেকারি, সমাজ বিরোধীদের প্রাদুর্ভাব, ক্ষমতালিপ্সা, বিদেশি শক্তির মদত প্রভৃতি। এই সকল বাধার এক বা একাধিক কারণের জন্য কোনো দেশের জাতীয় সংহতি বিনষ্ট হতে পারে।

অতীতে ও বর্তমানে জাতীয় সংহতি: অতীত কাল থেকেই ভারতবর্ষকে অখণ্ড ও সংহত করে গড়ে তোলার চেষ্টা চলেছে। অশোক, হর্ষবর্ধন, আকবর, সকলেই ভারতের ভূখণ্ডকে সংহত করে জাতীয় জীবনে ঐক্যস্থাপনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু তাঁদের সেই স্বপ্ন সফল হয়নি। এরপর পরাধীন ভারতবর্ষে মহাত্মা গান্ধি, নেতাজি প্রমুখ অনেক নেতা সংঘবদ্ধ হওয়ার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন এবং তখনই দেশের জাতীয় সংহতি কিছুটা
উজ্জ্বল হয়েছিল | ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধতার প্রেক্ষিতে দেশের প্রতিটি মানুষের মধ্যেই জাতীয়তাবোধ গড়ে উঠেছিল প্রবল – ভাবে। কিন্তু ইংরেজ শাসকেরা প্রশাসনিক স্বার্থে সেই জাতীয়তাবোধ খণ্ডিত করতে সচেষ্ট হন। তাঁদের কূট চক্রান্তের ফলে দ্বিখণ্ডিত হয়ে ভারত স্বাধীন হয়। স্বাধীনতার পরেও দাঙ্গাহাঙ্গামা ও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ থামেনি। বরং দিকে দিকে প্রবল হয়ে ওঠে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা| ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ যায়। এভাবেই স্বাধীন দেশে জাতীয় অসংহতি একটা বড়ো সমস্যারূপে দেখা দেয়| দিকে দিকে উগ্র প্রাদেশিকতাও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কোথাও কোথাও প্রবল হয়ে ওঠে পৃথক রাজ্যের বা দেশের দাবি। যেমন—কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, পশ্চিমবঙ্গে গোরখাল্যান্ড আন্দোলন, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে উপজাতিদের আন্দোলন প্রভৃতি। এইসব আন্দোলন আজ জাতীয় সংহতি বিনষ্ট করে জাতীয় জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে।

ধর্ম, ভাষা ও অর্থনৈতিক বৈষম্য: ধর্মগত, ভাষাগত এবং জাতি (Race)-গত বিরোধের জন্যই দেশের জাতীয় সংহতি দৃঢ়বদ্ধ হতে পারছে না। আছে জাতিভেদপ্রথা, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং কুসংস্কার। একদল লোক চরম দারিদ্র্যের মধ্যে ডুবে থেকে অপমান ও লাঞ্ছনা ভোগ করবে আর একদল দিন কাটাবে অর্থ- প্রাচুর্য ও বিলাসিতার মধ্যে—এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় জীবনে ঐক্য গড়ে ওঠা অসম্ভব।

উপসংহার: দেশের এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে সর্বাগ্রেই দরকার আদর্শ জাতীয় শিক্ষা পরিকল্পনা গ্রহণ করা। শিক্ষাই দূর করতে পারে ধর্মগত, ভাষাগত ও সংস্কৃতি – গত বৈষম্য। বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক। তাই সরকারি ও বেসরকারি উভয়পক্ষ থেকেই এ-বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। সর্বোপরি দেশের প্রতিটি নাগরিক – কেই দেশকে ভালোবেসে জাতীয় সংহতি রক্ষার প্রতি মনোযোগী হতে হবে| হীন- সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে ব্যাপক, উদার ও সংস্কারমুক্ত মানসিকতার মাধ্যমে উপলব্ধি করতে হবে—

“সকলের তরে সকলে আমরা,/প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *