জলনির্গম প্রণালী : দ্বিতীয় পর্ব

উচ্চমাধ্যমিক ভূগোল (HS Geography) :

Topic :

  • গঠনের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন নদী নকশা|
  • জাফরিরূপী নদী নকশা গঠনের নিয়ন্ত্রকসমূহ|
  • কেন্দ্রবিমুখ ও সমান্তরাল জলনির্গম প্ৰণালীর নিয়ন্ত্রক ভূমিরূপসমূহ|
  • বৃক্ষরূপী নদী নকশার শ্রেণিবিভাগ|
  • বৃক্ষরূপী জলনির্গম প্রণালীর উৎপত্তিতে নিয়ন্ত্রণকারী উপাদানসমূহ|

গঠনের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন নদী নকশা :

কখনাে কখনাে নদী নিম্নস্থ শিলার গঠনকে এড়িয়ে নিজের প্রবাহ বজায় রাখে। এদের গঠনের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন নদী বলা হয়। এ ধরনের দুটি নদী নকশার উল্লেখ করা হল।

(১) পূর্ববর্তী নদী নকশা : ভূমিভাগের ধীর উত্থানের সঙ্গে তাল রেখে কোনাে কোনাে নদী ভূভাগকে গভীরভাবে কেটে নিজের প্রবাহকে বজায় রাখে। অর্থাৎ ভূভাগ যতটা উখিত হয় নদীও তাকে ততখানি গভীর করে কাটে। সুতরাং, ভূমির উত্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্য ঘটিয়ে যেসব নদী তাদের পূর্বেকার প্রবাহ পথ বজায় রাখে তাদের পূর্ববর্তী নদী বলে। এই পূর্ববর্তী নদী তার উপনদীর সাথে যে জলনির্গম প্রণালী তৈরি করে তাকে পূর্ববর্তী নদী নকশা বা পূর্ববর্তী জলনির্গম প্রণালী বলা হয়। উত্থান ও নিম্নক্ষয় একসঙ্গে ঘটায় এসব নদী গভীর গিরিখাত তৈরি করতে পারে। উদাহরণ—সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্র, অরুণ, তিস্তা প্রভৃতি নদী হিমালয় অংশে গভীর গিরিখাত সৃষ্টি করে পর্বতশ্রেণিকে আড়াআড়িভাবে কেটে অতিক্রম করেছে।

(২) অধ্যারোপিত নদী : সমুদ্রগর্ভ থেকে জেগে ওঠা ভূভাগ নবীন পাললিক শিলাস্তরে মােড়া থাকে। নবীন ভূতাত্ত্বিক গঠনের সঙ্গে সামঞ্জস্য ঘটিয়ে ওই ভূভাগের ওপর নদী ব্যবস্থার বিকাশ ঘটে। সুদীর্ঘকাল যাবৎ নদীর ক্ষয়- কার্যের ফলে নবীন যুগের শিলাস্তর পুরাে – পুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং নীচের প্রাচীন যুগের ভিন্ন গঠনের শিলাস্তর ভূপৃষ্ঠে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। অর্থাৎ ভিন্ন গঠনযুক্ত প্রাচীন শিলাস্তরের ওপর নবীন স্তরের ভূতাত্ত্বিক গঠনের সঙ্গে সামঞ্জস্যকারী নদী ব্যবস্থা অধ্যারােপিত হয়। নদী প্রাচীন ওই ভূতাত্ত্বিক গঠনকে এড়িয়ে নিজের পূর্বেকার প্রবাহ বজায় রাখে। গঠনের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন নদী নকশাকে অধ্যারােপিত নদী নকশা বলে। উদাহরণ—প্রারম্ভিক পর্যায়ে অসমতল লাভা ভূমির ওপর প্রবাহিত চম্বল নদী বর্তমানে অন্য গঠনযুক্ত মালভূমির কায়মুর, রেওয়া ও ভাণ্ডার ভৃগুতটকে অবজ্ঞা করে ও কেটে প্রবাহিত হচ্ছে।

জাফরিরূপী নদী নকশা গঠনের নিয়ন্ত্রকসমূহ :
যে নদী ব্যবস্থায় প্রধান ও অপ্রধান সমস্ত নদী পরস্পর সমকোণে মিলিত হয়ে খড়খড়ি বা ঝিল্লিযুক্ত জালিকার মতাে যে নদী নকশা গঠন করে, তাকে জাফরিরূপী নদী নকশা বলে। এই ধরনের নদী নকশা গঠনের প্রধান নিয়ন্ত্রকগুলি নিম্নে আলােচনা করা হল一

  • পরস্পর কঠিন ও কোমল শিলা দ্বারা সজ্জিত সমনতি সম্পন্ন উথিত ভূভাগের অবস্থান।
  • কোনাে বড় ভাজের প্রান্তদেশের সমনতি গঠনের কঠিন শিলার ওপর অনুগামী নদী এবং কোমল শিলার ওপর পরবর্তী নদীর সৃষ্টি।
  • ফালির আকারে পরপর কঠিন ও কোমল শিলা দিয়ে তৈরি সমান্তরাল চ্যুতিরেখার অবস্থান।
  • সমান্তরালভাবে এবং পরস্পর লম্বভাবে ছেদকারী দারণ বা ফাটল ও জোড়মুখের অবস্থান।

কেন্দ্রবিমুখ জলনির্গম প্ৰণালীর নিয়ন্ত্রক ভূমিরূপসমূহ :

  • উত্থিত গম্বুজ,
  • শঙ্কু জাতীয় আগ্নেয়গিরি,
  • অবশিষ্ট পাহাড় বা টিলা,
  • বিচ্ছিন্ন উচ্চভূমি
  • তীক্ষ্ণ শঙ্কু আকৃতির পাহাড়,
  • গ্রানাইট শিলার বস (Boss) ও ব্যাথােলিথের উন্মুক্ত অংশ দ্বারা গঠিত উচ্চভূমি প্রভৃতি।
  • উদাহরণ—ছছাটোনাগপুর মালভূমির পরেশনাথ পাহাড়ের জলনির্গম প্রণালী, হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের কোকো ক্রেটার (Koko Crater) প্রভৃতি।

সমান্তরাল জলনির্গম প্ৰণালীর নিয়ন্ত্রক ভূমিরূপসমূহ :

  • খুব খাড়া ঢালু ভূভাগ,
  • কুয়েস্তার নতিঢাল,
  • হগব্যাক (Hog back),
  • খুব কাছাকাছি অবস্থিত একাধিক সমান্তরাল চ্যুতি,
  • একনত অথবা সমন্ত ভাজ এবং
  • সমুদ্রের সাম্প্রতিক পিছু হঠার ফলে সৃষ্ট উপকূলীয় সমভূমি প্রভৃতি।
  • শেল বা কাদাপাথরের খাড়া ঢালে সাধারণত সমান্তরাল নদী নকশা ভালােভাবে গড়ে ওঠে। উদাহরণ- বিন্ধ্যের ভূগুঢাল।

বৃক্ষরূপী নদী নকশার শ্রেণিবিভাগ :

(১) উপ-বৃক্ষরূপী নদী নকশা : বৃক্ষরূপী নদী নকশার একটি পরিবর্তিত রূপ হল উপ-বৃক্ষরূপী নদী নকশা। অনেকসময় মূলনদীর দুদিকে অববাহিকার শিলাস্তরের ক্ষয়প্রতিরােধ ক্ষমতা সমান থাকে না একদিকে বেশি এবং অন্যদিকে কম হয়। এরকম হলে বৃক্ষরূপী নদী নকশা সৃষ্টিকারী মূলনদীর দুদিকে উপনদীর সংখ্যা ও বিস্তার সমান হয় না। তখন তাকে উপবৃক্ষরূপী নদী নকশা বলে।

নিয়ন্ত্রক : স্বল্প নতি সম্পন্ন (10° -20°) সূক্ষ্ম গ্ৰথন যুক্ত একনত গঠনের শিলাস্তরের ওপর এরূপ নদী নকশা গড়ে ওঠে। তবে মাঝারি ঢালের ভূভাগও একটি প্রধান নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে। উদাহরণ—মৃদু দোলানাে উপকূলীয় সমভূমি এবং হিমবাহ সৃষ্ট ‘টিল’ (Till) সমভূমিতে উপ-বৃক্ষরূপী নদী নকশা দেখা যায়।

(২) পিনেট নদী নকশা : এটিও বৃক্ষরূপী নদী নকশার এক পরিবর্তিত রূপ। বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপনদী সূক্ষ্মকোণে মিলিত হয়ে পাখির পালকের রেখার (Feather Line) মতাে দেখতে যে নদী নকশা গড়ে তােলে তাকে পিনেট নদী নকশা বলে। এই নদী নকশায় উপনদীগুলি খুব কাছাকাছি অবস্থান করে।

নিয়ন্ত্রক : অনুভূমিকভাবে শায়িত সমধর্মী শিলা যা অতি সহজে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় (যেমন কর্ম জাতীয় পলিস্তর) সেই ধরনের গঠনযুক্ত অঞ্চলে এই ধরনের নদী নকশা গড়ে ওঠে। উদাহরণ গঙ্গা অববাহিকা ও চম্বল অববাহিকা, কলােরাডাে মালভূমি অংশের বেসিন ও রেঞ্জ অঞ্চল প্রভৃতি।

বৃক্ষরূপী জলনির্গম প্রণালীর উৎপত্তিতে নিয়ন্ত্রণকারী উপাদানসমূহ :

(১) মৃদুটাল যুক্ত সমতল ভূপৃষ্ঠ এধরনের নদী নকশা গঠনের সহায়ক হয়।
(২) অনুভূমিক বা প্রায় অনুভূমিক একনত গঠনের সমধর্মী পাললিক শিলা কিংবা ফাটহীন নিরেট সুবিস্তৃত আগ্নেয় শিলার ওপর নদীগুলি ডালপালার মত বিস্তৃত হয়।
(৩) শিলার গ্রথন, প্রবেশ্যতা, কাঠিন্য ও ক্ষয় প্রতিরােধ ক্ষমতা সর্বত্র একই রকম হয়।
(৪) এরূপ জলনির্গম ব্যবস্থায় বাস্তবিকই শিলার গঠনগত নিয়ন্ত্রণ উল্লেখযােগ্যভাবে কম থাকে। এমনকি, ওপরের শিলাস্তরকে সম্পূর্ণ ক্ষয় করে কখনাে কখনাে নদী নীচের ভাঁজ গঠন বা জটিল রূপান্তরিত শিলার ওপর অধিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও নিজের পূর্বেকার প্রবাহ বজায় রাখে।

Rlearn Education