মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র | মাধ্যমিক ইতিহাস

মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র | মাধ্যমিক ইতিহাস সাজেশান

ভূমিকা: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ব্রিটিশবিরোধী মহাবিদ্রোহ অত্যন্ত তীব্র হয়ে ওঠে এবং ভারতে ইংরেজ শাসনের ভিতকে কাঁপিয়ে দেয়। এই বিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।

[1] সিপাহিদের বিদ্রোহ:

স্যার জন লরেন্স, জন সিলি, চার্লস রেক্স প্রমুখ ইউরোপীয় ঐতিহাসিক এবং অক্ষয়কুমার দত্ত, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কিশোরীচাঁদ মিত্র, দাদাভাই নওরোজি প্রমুখ ভারতীয় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁদের মতে, এই বিদ্রোহে যোগদানকারী বিভিন্ন গোষ্ঠীর লক্ষ্য ছিল নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধি করা। এই বিদ্রোহে সারা ভারতের সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ যোগ দেয়নি। দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি বড়ো অংশ বিদ্রোহকে সমর্থন করেনি। শিখ ও গোরখা সেনারা বরং বিদ্রোহের সময় ইংরেজদের সহায়তা করেছিল। কিশোরীচাঁদ মিত্র বলেছেন, “এই বিদ্রোহ ছিল একান্তভাবেই সিপাহিদের অভ্যুত্থান।”

[2] সামন্তদের বিদ্রোহ:

রজনীপাম দত্ত, রমেশচন্দ্র মজুমদার, সুরেন্দ্রনাথ সেন, মানবেন্দ্রনাথ রায় প্রমুখ ১৮৫৭-র বিদ্রোহকে রক্ষণশীল ও সামন্ত- তান্ত্রিক শক্তিগুলির অভ্যুত্থান বলে অভিহিত করেছেন। তাঁদের মতে, নানা সাহেব, লক্ষ্মীবাই, কুনওয়ার সিং প্রমুখ সামন্তশ্রেণির মানুষ এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন।এটি ছিল ভারতের সনাতনপন্থীদের শেষ বিদ্রোহ | ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন যে, এই বিদ্রোহ ছিল ক্ষয়িম্বু অভিজাত শ্রেণি ও মৃতপ্রায় সামন্তশ্রেণির ‘মৃত্যুকালীন আৰ্তনাদ’ |

[3] জনসাধারণের অংশগ্রহণ:

নর্টন, ম্যালেসন, বল, জন কে প্রমুখ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে একটি ‘গণবিদ্রোহ’
হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। এমনকি ড. সুরেন্দ্রনাথ সেন এই বিদ্রোহে সামন্ত নেতাদের নেতৃত্বের কথা স্বীকার করেও তাঁর ‘১৮৫৭’ গ্রন্থে বলেছেন যে, এই বিদ্রোহ শেষপর্যন্ত নানা স্থানে গণবিদ্রোহের আকার নেয়। ভারতের এক বৃহৎ অঞ্চল, যথা—. পশ্চিম বিহার থেকে পূর্ব পাঞ্জাব পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে বিদ্রোহ বিস্তার লাভ করে। অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও এই অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, কারিগর, স্বেচ্ছায় এই বিদ্রোহে যোগ দেয়।

[4] জাতীয় বিদ্রোহ:

ঐতিহাসিক আউট্রাম, ডাফ, রবার্টসন,
টোরি দলের নেতা ডিসরেলি, সমাজতন্ত্রবিদ কার্ল মার্কস প্রমুখ এই বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন। ঐতিহাসিক শশীভূষণ চৌধুরী বলেছেন যে, এটি ছিল সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জাতীয় যুদ্ধ। তাঁদের মতে, মুজাফফরনগর, বিহার ও উত্তরপ্রদেশে সিপাহিদের সঙ্গে সংযোগ ছাড়াই অসামরিক লোকজন ও জমিদারশ্রেণির ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন সক্রিয় হয়ে ওঠে। সিপাহিরা
সিংহাসনচ্যুত মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করলে দেশবাসীর মনে দেশপ্রেমের মনোভাব জেগে ওঠে।

[5] স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম পদক্ষেপ:

বিপ্লবী বিনায়ক দামোদর সাভারকার (বীর সাভারকার) ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন। এ ছাড়া কার্ল মার্কস, এঙ্গেল্‌স, পি সি জোশী, অশোক মেহতা, অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক সুশোভন সরকার প্রমুখ ১৮৫৭-র বিদ্রোহকে
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন।

[6] সর্বস্তরে ব্যাপক প্রভাব:

ভারতের জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকগণ এই বিদ্রোহের ব্যাপকতা লক্ষ করে একে মহাবিদ্রোহ নামে অভিহিত করেন। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় একে মহান বিপ্লব বলে অভিহিত করেছেন। এরিক স্টোক্স বলেছেন যে, এই বিদ্রোহ ছিল ভারতে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনের শেষ অধ্যায়।এই আন্দোলনে ইংরেজদের বিতাড়নের কথা ভাবা হয়েছিল।

উপসংহার:

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে
বিভিন্ন পণ্ডিত বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করলেও এসব দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধেও বিভিন্ন যুক্তি দেওয়া হয়। যেমন: ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারবলেছেন, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের তথাকথিত প্রথম জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম — প্রথম নয়, জাতীয় নয় এবং স্বাধীনতা সংগ্রামও নয়। ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ এই বিদ্রোহের গণচরিত্র অস্বীকার করে বলেছেন, বিদ্রোহে যত সংখ্যক সৈন্য যোগ দিয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি সৈন্য বিদ্রোহ দমনে ইংরেজদের সাহায্য করেছিল। এজন্যই বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব হয় | অধ্যাপক এরিক স্টোক্স, বেইলি প্রমুখ মনে করেন যে, এই বিদ্রোহে স্থানীয় কৃষকদের প্রতিরোধ, জাতীয় প্রতিরোধ প্রভৃতি বিভিন্ন ধারা-উপধারার সংমিশ্রণ ঘটেছিল।

Rlearn Education