ক্ষয়চক্র : গঠন ও প্রক্রিয়া (দ্বিতীয় পর্ব )

উচ্চমাধ্যমিক ভূগোল (HS Geography) : ক্ষয়চক্র ➤ গঠন ও প্রক্রিয়া

আলোচ্য বিষয় :
স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র
ক্ষয়চক্রের ব্যাঘাত
মরু ক্ষয়চক্র সম্পর্কে ডেভিসের ধারণা |

স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র :
আমেরিকার ভূবিজ্ঞানী উইলিয়াম মরিস ডেভিস 1899 খ্রিস্টাব্দে ভূমিরূপের ধারাবাহিক বিবর্তনে ক্ষয়চক্রের ধারণাটি প্রথম প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, কোনাে অঞ্চলের ভূমিরূপ হল সেই অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক গঠন, ভূমিরূপ গঠনকারী ব্রিয়াশীল প্রক্রিয়াসমূহ এবং সময় বা পর্যায়ের ফলশ্রুতি। প্রতিটি ভূমিরূপেরই একটি নির্দিষ্ট জীবন ইতিহাস আছে। এই ইতিহাস ভূমিরূপের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস যার মধ্যে দিয়ে ভূমিরূপের এক সুশৃঙ্খল পর্যায়ক্রমিক ও শ্রেণিবদ্ধ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিবর্তন ঘটে থাকে। উত্থিত কোনাে ভূমিভাগের ক্ষয়কার্যের ফলে প্রাথমিক অবস্থা থেকে নির্দিষ্ট ক্রম অনুসারে কতকগুলি অন্তর্বর্তী পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছােনােকে ক্ষয়চক্র বলে। ভূপৃষ্ঠের প্রায় 70 শতাংশ ভূমির ভাস্কর্য নদীর স্বাভাবিক ক্ষয়কার্যের মাধ্যমে সাধিত হয় বলে একে স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র বলে। ভূমিরূপের ধারাবাহিক পরিবর্তনে ভূমিভাগের যেসব স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য গড়ে ওঠে, সেগুলিকে শ্রেণিবদ্ধ করার জন্য ডেভিস ক্ষয়চক্রটিকে যৌবন, পরিণত ও বার্ধক্য – এই তিনটি পর্যায়ে ভাগ করেন।

ক্ষয়চক্রের ব্যাঘাত :
ক্ষয়চক্র চলাকালীন সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান বা পতন হলে অথবা নদীর ক্ষয় করার ক্ষমতা হ্রাস অথবা বৃদ্ধি পেলে ক্ষয়চক্র নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই সম্পূর্ণ হয়ে যায় অথবা ক্ষয়চক্র সম্পূর্ণ হতে পারে না। ক্ষয়চক্রের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়। ক্ষয়চক্রের এইরূপ অবস্থাকে স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের ব্যাঘাত বা বিঘ্ন বলে। সমুদ্রপৃষ্ঠের আপেক্ষিক পতন ঘটলে তাকে ক্ষয়ের শেষ সীমার ঋণাত্মক পরিবর্তন বলে। এর ফলে ক্ষয়চক্র পুনরায় শুরু হয়। আবার, সমুদ্রপৃষ্ঠের আপেক্ষিক উত্থান ঘটলে তাকে ক্ষয়ের শেষ সীমার ধনাত্মক পরিবর্তন বলে। এর ফলে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই ক্ষয়চক্র শেষ হয়ে যায়।

মরু ক্ষয়চক্র সম্পর্কে ডেভিসের ধারণা :
উইলিয়াম মরিস ডেভিস সর্বপ্রথম মরু অঞ্চলে পর্যায়ক্রমিক ভূমিরূপ পরিবর্তনের ব্যাখ্যা দেন। এই অঞ্চলের ক্ষয়চক্রটি তিনটি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়।

যৌবন পর্যায় : মরু অঞ্চলে জলপ্রবাহজনিত ক্ষয়কার্যের মধ্য দিয়ে যৌবন অবস্থার সূচনা হয়। এই অঞ্চলে ক্ষয়চক্রের প্রারম্ভিক পর্যায়ে ভূমিরূপের যেসব বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় সেগুলি হল—
➛ ভূমির প্রারম্ভিক উত্থানে কতকগুলি পর্বতবেষ্টিত অববাহিকার সৃষ্টি হয়। এগুলির প্রত্যেকটিতে একটি করে কেন্দ্রমুখী জলনির্গম প্রণালী সৃষ্টি হয়।
➛ প্রত্যেক অববাহিকার তলদেশ সেই অঞ্চলের ক্ষয়ের শেষ সীমা হিসেবে কাজ করে।
➛ মরু অঞ্চলে বাষ্পীভবনের মাত্রা অত্যধিক হওয়ায় পৃষ্ঠপ্রবাহ কমে যায়।
➛ ক্ষয়কার্যের প্রাথমিক অবস্থায় ক্ষণস্থায়ী অনুগামী নদী পর্বতের ঢালে ‘v’ আকৃতির উপত্যকা গঠন করে।
➛ ক্ষয়িত পদার্থসমূহ পর্বতের ঢাল বেয়ে নেমে এসে উপত্যকার সামনে পলল শঙ্কু গঠন করে।
➛ অধিকাংশ নদীই পর্বতের ঢাল বেয়ে নেমে এসে পলল শঙ্কুতে হারিয়ে যায়।
➛ উপত্যকার তলদেশে চুঁইয়ে আসা জল সঞ্চিত হয়ে প্লায়া হ্রদ গঠিত হয়। নদীগুলি হ্রদ পর্যন্ত প্রবাহিত হলে নদী-বাহিত পলি প্লায়ার মধ্যে সঞ্চিত হয়। অস্থায়ী হ্রদগুলি শুকিয়ে গেলে লবণ সঞ্চিত হয়।
➛ অববাহিকায় আর্দ্র ও শুষ্ক ঋতু বিরাজ করলে হ্রদে পর্যায়ক্রমে পলি ও লবণ সঞ্চিত হয়।
➛ অববাহিকার উচ্চতা হ্রাসের সঙ্গে বৃষ্টির পরিমাণ কমে এলে, বায়ুর কার্য সক্রিয় হয়ে ওঠে।
➛ প্রবল বায়ুপ্রবাহের ফলে বালি ও নুড়ির আঘাতে ক্ষয়কার্য শুরু হয় এবং প্লায়ার জল বাষ্পীভূত হলে বায়ুর অবনমন প্রক্রিয়ায় বায়ু-তাড়িত হয়ে গর্তের সৃষ্টি হয়। তবে হ্রদে লবণের স্তর মােটা হলে সহজে এইরূপ গর্ত সৃষ্টি হতে পারে না।
➛ বায়ুবাহিত বালুকারাশি অববাহিকার যেখানে-সেখানে বালিয়াড়ি গঠন করে।
➛ স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের যৌবন অবস্থায় ভূমির আপেক্ষিক উচ্চতা বৃদ্ধি পায়, কিন্তু শুষ্ক অঞ্চলের ক্ষয়চক্রে উচ্চভূমির ক্ষয় এবং উপত্যকা ভরাটের মাধ্যমে আপেক্ষিক উচ্চতা বৃদ্ধির পরিবর্তে ক্ষয়চক্রের অগ্রগতির সাথে উচ্চতা হ্রাস পায়।

(২) পরিণত পর্যায় : বৃষ্টিপাতের অভাবে বায়ুর কার্য বেশি সক্রিয় হলে পরিণত পর্যায় শুরু হয়। ভূমির উচ্চতা ও বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ভীষণভাবে কমে যায় বলে, এই পর্যায়ের প্রথম ভাগেই জলপ্রবাহের দ্বারা নগ্নীভবন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। ক্ষয়চক্রের প্রারম্ভিক পর্যায় থেকেই বায়ু সক্রিয় থাকলেও পরিণত পর্যায়ে এটি প্রাধান্য বিস্তার করে। এই পর্যায়ে সৃষ্ট ভূমিরূপগুলির বৈশিষ্ট্য—
➛ ক্ষয়ের মাধ্যমে পর্বর্তটালের পশ্চাদপসরণ ঘটে।
➛ এই পর্যায়ে জলবিভাজিকা ভীষণ তীক্ষ্ হয়। এদের মধ্যবর্তী উপত্যকাগুলি প্রশস্ত হয় এবং উপত্যকা ভরাট হয়ে উঁচু হতে থাকে।
➛ পর্বত ঢালের পশ্চাদপসরণের ফলে এর সম্মুখে এক বিস্তৃত সমভূমি সৃষ্টি হয় যা দুটি অংশে বিভক্ত। ঢালের নিম্নাংশে পর্বত বিধৌত নুড়ি, কাঁকর, বালি প্রভৃতি সঞ্চিত হয়ে যে সমভূমি সৃষ্টি হয় তাকে বাজাদা বলে।

➛ বাজাদার শেষপ্রান্ত পলি ও লবণ দ্বারা আবৃত থাকে। পর্বতের পাদদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত সমভূমির উর্ধ্বাংশ পেডিমেন্ট নামে পরিচিত। এই শিলা-কর্তিত সমভূমি পাতলা পলির স্তর দ্বারা আবৃত থাকতে পারে অথবা আবরণহীনও হতে পারে।
➛ এই পর্যায়ে নদীগুলির একসঙ্গে সংযুক্ত – করণের ফলে এই অঞ্চলের একটি মাত্র ক্ষয়সীমা সমগ্র অঞ্চলটির ক্ষয়কার্যকে নিয়ন্ত্রণ করে।
➛ পর্বতগুলি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান করে, এগুলিকে ইনসেলবার্জ বলে।

(৩) বার্ধক্য পর্যায়: ভূমিরূপ বিবর্তনে জলের কাজ যখন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে কেবল বায়ুর কাজ চলতে থাকে, তখন থেকে বার্ধক্য পর্যায় শুরু হয়। এই পর্যায়ে ভূমিরূপের বৈশিষ্ট্য—

➛ এই পর্যায়ের শেষদিকে উচ্চভূমি খুব বেশি মাত্রায় নগ্ন হয়ে পড়ে। কোনাে কোনাে স্থানে ক্ষয়প্রতিরােধী শিলা পেডিমেন্ট ও বাজাদার মাঝে অবস্থান করে। একে ইনসেলবার্জ বলে।
বায়ুতাড়িত গর্ত ও বালিয়াড়ির সংখ্যা এই পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি হয়।
➛ প্লায়ার সমস্ত পলি বায়ুর দ্বারা অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়ে লােয়েস ভূমি গঠন করে।
➛ ক্ষয়িত পদার্থসমূহ স্থানান্তরিত হলে মরু সমভূমির উচ্চতা প্রারম্ভিক উচ্চতা অপেক্ষা অনেক কম হয়।
➛ মরু অঞ্চলে ভৌমজলস্তরই ভূমিক্ষয়ের শেষ সীমাকে নির্দেশ করে।
➛সবশেষে পাতলা আবরণযুক্ত শিলাময় সমপ্রায় ভূমি গঠিত হয়। একে পেডিপ্লেন বলে। এ অবস্থা চলতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না নতুন ক্ষয়চক্রের সূচনা হয়।

সমালােচনা: ডেভিসের মরু অঞ্চলের ক্ষয়চক্রের ধারণাটি কেবলমাত্র পর্বতবেষ্টিত মরু অঞ্চলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। পৃথিবীর অন্যান্য মরু অঞ্চলের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয়। এই কারণে ডেভিসের শুষ্ক অঞ্চলের ক্ষয়চক্র মতবাদটি সর্বজনগ্রাহ্য নয়।

Rlearn Education