মৃত্তিকা : উচ্চমাধ্যমিক ভূগোল | চতুর্থ পর্ব

আলোচ্য বিষয় :
1.আবহবিকারের সঙ্গে মাটির উৎপত্তির সম্পর্ক
2.যান্ত্রিক আবহবিকারের ফলে আদি শিলার মৃত্তিকায় পরিণতি |
3. মৃত্তিকা গঠনে রাসায়নিক আবহবিকারের ভূমিকা |

মৃত্তিকা এবং আবহবিকার : উচ্চমাধ্যমিক ভূগোল (HS Geography)


আবহবিকারের সঙ্গে মাটির উৎপত্তির সম্পর্ক :
মাটির উৎপত্তিতে আবহবিকারের অবদান সবচেয়ে বেশি। যান্ত্রিক, রাসায়নিক ও জৈবিক আবহবিকারের ফলে আদি শিলা চূর্ণবিচূর্ণ ও বিয়ােজিত হয়ে মৃত্তিকা গঠন করে। আবহবিকারের ফলে প্রথম পর্বে রেগােলিথ সৃষ্টি হয়। মাটি গঠন প্রক্রিয়া পরবর্তী পর্যায়ে অর্থাৎ দ্বিতীয় পর্বে শুরু হয়। এই পর্বে হিউমিফিকেশন প্রক্রিয়ায় জীবাণুকুল মৃত উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহাবশেষকে পচন ক্রিয়ার মাধ্যমে হিউমাসে পরিণত করে। হিউমাস গঠনের সঙ্গে সঙ্গে খনিজকরণ প্রক্রিয়ায় জৈব-রাসায়নিক পদ্ধতিতে হিউমাস ও আবহবিকার জাত পদার্থ একত্রে নতুন খনিজের সৃষ্টি করে। এই দুটি প্রক্রিয়া চলাকালীন মাটির উপরিস্তর থেকে এলুভিয়েশন (Eluviation) পদ্ধতিতে দ্রবীভূত খনিজ ও অদ্রবীভূত মুক্ত মৌল মাটির নীচের স্তরে স্থানান্তরিত হয় এবং নিম্ন স্তরে ইলুভিয়েশন (Iluviation) প্রক্রিয়ায় ওইসব পদার্থ আবদ্ধ হয়। এভাবে মাটি গঠিত হয়।

আদি শিলাকে যান্ত্রিক আবহবিকার কীভাবে মাটিতে পরিণত করে :
উষ্ণতার পরিবর্তন, শিলাস্তরে চাপের হ্রাসবৃদ্ধি, আদ্রর্তার পরিবর্তন, জৈবিক কার্যাবলি প্রভৃতি কারণে ভূপৃষ্ঠের শিলাস্তর যান্ত্রিকভাবে চূর্ণবিচূর্ণ অর্থাৎ ভেঙে টুকরাে টুকরাে হলে তাকে যান্ত্রিক আবহবিকার বলে। যান্ত্রিক আবহবিকারে শিলা চূর্ণবিচূর্ণ হয় এবং পরিশেষে মাটিতে পরিণত হয়। যান্ত্রিক আবহবিকার বিভিন্নভাবে ঘটে থাকে一

(১) প্রস্তরচাই খণ্ডীকরণের মাধ্যমে : শিলা তাপের কুপরিবাহী। দিনেরবেলা প্রবল উয়তায় শিলার উপরিস্তর উত্তপ্ত হয়ে প্রসারিত হয় এবং রাত্রিবেলা তাপবিকিরণ করে সংকুচিত হয়। কিন্তু শিলার নিম্ন স্তরে সংকোচন বা প্রসারণ ঘটে না। এইভাবে ক্রমাগত অসম সংকোচন ও প্রসারণের কারণে শিলাস্তরে অসংখ্য উল্লম্ব ও অনুভূমিক ফাটলের সৃষ্টি হয় এবং এক সময় এই ফাটলবরাবর টুকরাে টুকরাে বিভিন্ন আকৃতির শিলাখণ্ড খুলে বেরিয়ে আসে। একেই প্রস্তরচাই খণ্ডীকরণ (Block Disintegration) বলে। এভাবে আদি শিলা চূর্ণবিচূর্ণ হয় ও মাটির উৎপত্তি ঘটে।

(২) শঙ্কমােচনের মাধ্যমে : শিলা তাপের কুপরিবাহী হওয়ায় শিলাস্তরের বাইরের অংশ দিনেরবেলা তীব্র উষ্ণতায় প্রসারিত এবং রাতেরবেলায় সংকুচিত হয়। কিন্তু ভিতরের অংশ প্রসারিত ও সংকুচিত হতে পারে না। শিলাস্তরের বাইরের অংশে ক্রমাগত সম্প্রসারণ ও সংকোচনের কারণে স্তরগুলি পেঁয়াজের খােসার মতাে খুলে যায়। একেই শল্কমােচন বা গােলাকার (Exfoliation or Spheroidal) আবহবিকার বলে। পরবর্তীকালে বায়ুপ্রবাহে খুলে যাওয়া অংশগুলি অপসারিত হয়ে শিলাস্তরটি গােলাকৃতি রূপ ধারণ করে। মরুভূমি ও শুষ্ক অঞ্চলের কেলাসিত সমধর্মী শিলায় এই প্রকার আবহবিকার ঘটে এবং পরবর্তীকালে মাটির উৎপত্তি হয়।

(৩) ক্ষুদ্রকণা বিরণের মাধ্যমে : শিলা একাধিক খনিজের সমন্বয়ে গঠিত এবং খনিজগুলির বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতি ও রং ভিন্ন হয়। উষ্ণতার হ্রাসবৃদ্ধির জন্য খনিজগুলি বিভিন্ন হারে প্রসারিত ও সংকুচিত হয়। এ কারণে শিলায় প্রবল পীড়নের (Stress) সৃষ্টি হয় এবং একসময় শিলা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ণ্ডে পরিণত হয়। একেই ক্ষুদ্রকণা বিশরণ (Granular Disintegration) বলে। এই প্রক্রিয়ায় মূল শিলা থেকে প্রথমে বালুকা ও পরে জৈব পদার্থের সংযােজনে মাটি সৃষ্টি হয়।

(৪) কেলাস গঠনের মাধ্যমে : উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে ও উচ্চ অক্ষাংশের শীতল জলবায়ু অঞ্চলে দিনেরবেলায় বরফ গলা জল শিলার ফাটলে প্রবেশ করে। রাতে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে নামলে ওই জল বরফে পরিণত হয় এবং আয়তনে বেড়ে যায়। এর ফলে ফাটলের দু-পাশের দেওয়ালে প্রচণ্ড চাপ পড়ে। এভাবে দিন ও রাতে জলের ভৌত অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে ক্রমাগত শিলায় চাপ পরে ও ফাটল বৃদ্ধি পায় এবং অবশেষে শিলা চূর্ণবিচূর্ণ হয়। এই তীক্ষ্ণ শিলাখণ্ডগুলিকে স্ত্রী বা ট্যালাস বলে। এগুলি পর্বতের পাদদেশে জমা হয়ে বালুকাপূর্ণ মাটি গঠন করে।

(৫) শিলাস্তরে চাপ হ্রাসের মাধ্যমে : ভূগর্ভে গ্র্যানাইটজাতীয় শিলা ওপরের অন্য শিলাপ বা বিপুল পরিমাণ বরফের চাপে সংকুচিত থাকে। কিন্তু নানা কারণে ওপরের শিলাস্তূপ বা বরফ সরে গেলে নীচের ওই শিলা চাপ ও ভারমুক্ত হয়ে প্রসারিত হয় এবং শিলায় পীড়ন ও টানের সৃষ্টি হয়। এভাবে শিলায় ফাটল ধরে এবং আবহবিকার ঘটে ও পরে মাটি সৃষ্টি হয়। যেমন- অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের শিলাস্তূপ বিশাল বরফের চাপে সংকুচিত অবস্থায় রয়েছে।

(৬) জলের মাধ্যমে : জলের মাধ্যমে যান্ত্রিক আবহবিকার বিভিন্নভাবে ঘটে一
➤ জলস্রোতের ফলে সৃষ্ট বুদ্বুদের বায়ু শিলাফাটলে প্রবল চাপের সৃষ্টি করে এবং শিলায় আবহবিকার ঘটায়।
➤বর্ষার সময় শিলাছিদ্র জলে পূর্ণ হয় এবং গ্রীষ্মকালে শিলাছিদ্রের জল শুকিয়ে যায়। আদ্রতা ও শুষ্কতার পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনের ফলে শিলা ভেঙে টুকরাে টুকরাে (Flake) হয়ে যায়।
➤ মরু অঞ্চলে অতি উত্তপ্ত শিলার ওপর হঠাৎ বৃষ্টির জল পড়লে শিলা সংকুচিত হয় এবং ফেটে যায়। এভাবে আদি শিলা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে মাটিতে পরিণত হয়।

রাসায়নিক আবহবিকার কীভাবে মাটি গঠনে ভূমিকা পালন করে?


বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন গ্যাস (অক্সিজেন, কার্বন ডাইঅক্সাইড, জলীয় বাষ্প প্রভৃতি), ভূপৃষ্ঠের জল ও বিভিন্ন অম্লের উপস্থিতিতে শিলান্তর রাসায়নিকভাবে বিয়ােজিত হলে, তাকে রাসায়নিক আবহবিকার বলে। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এই রাসায়নিক আবহবিকার ঘটে এবং শিলা মাটিতে পরিণত হয়।

কার্বনেশন বা অঙ্গারযোজন : বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাইঅক্সাইডের (CO2,) সঙ্গে জলের রাসায়নিক সংযােগে সৃষ্ট কার্বনিক অ্যাসিড (H2CO3) শিলার খনিজের সঙ্গে বিক্রিয়া ঘটিয়ে শিলায় পরিবর্তন ঘটালে সেই প্রক্রিয়াকে কার্বনেশন বলে। বৃষ্টির জল বাতাসের কার্বন- ডাই-অক্সাইডের সঙ্গে মিশে সৃষ্টি হয় মৃদু কার্বনিক অ্যাসিড।

H2O + CO2 = H2CO3 + O3

এই কার্বনিক অ্যাসিড চুনাপাথর বা ক্যালশিয়াম কার্বনেটের সঙ্গে বিক্রিয়া ঘটিয়ে ক্যালশিয়াম বাইকার্বনেট তৈরি করে, যা সহজেই জলে দ্রবীভূত হয়।

CaCO3 + H2CO3 = Ca(HCO3) + CO2

চুনাপাথর, ফেলস্পার, হর্নব্লেন্ড প্রভৃতি খনিজের ওপরও এই প্রক্রিয়া কার্যকর হয় এবং চুনসমৃদ্ধ মাটির উৎপত্তি হয়। যেমন রেনজিনা, চারনােজম প্রভৃতি মাটি।

অক্সিডেশন বা জারণ : জল বা জলীয় বাষ্পের উপস্থিতিতে শিলামধ্যস্থ খনিজের সঙ্গে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন যুক্ত হলে তাকে জারণ বলে। ভূপৃষ্ঠে যেসব শিলার মধ্যে লােহা আছে সেখানেই এই প্রক্রিয়া ক্রিয়াশীল। তা ছাড়া অ্যাম্ফিবােল, পাইরক্সিন ও বায়ােটাইট খনিজের ওপরেও অক্সিডেশন কার্যকর হয়।

লােহা যখন ফেরাস অক্সাইডরূপে থাকে, তখন তা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু অক্সিডেশন প্রক্রিয়ায় যখন ফেরিক অক্সাইডে পরিণত হয় তা সহজে ভেঙে যায়, তাই শিলায় মরচে পড়ে।
4FeO + O2 = 2Fe2O3
ফেরাস সালফাইড এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফেরাস সালফেটে পরিণত হয়।
FeS + 2O2 = FeSO4
এভাবে লাল, হলুদ, বাদামি, ল্যাটেরাইট প্রভৃতি মাটি গঠিত হয়।

হাইড্রেশান : শিলাস্থ খনিজের সঙ্গে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জল যুক্ত হয়ে শিলার রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটলে তাকে হাইড্রেশন বলে। এই প্রক্রিয়ায় জলের অণুগুলি শিলামধ্যস্থ খনিজের অণুগুলির সঙ্গে যুক্ত হয়ে খনিজের গ্রন্থিবন্ধনগুলিকে আলগা করে তােলে। খনিজগুলির পারস্পরিক বন্ধন হ্রাস পাওয়ায় গৌণ খনিজগুলি নমনীয় হয়ে পড়ে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই হেমাটাইট লিমােনাইটে, অ্যানহাইড্রাইড জিপসামে এবং অলিভিন সার্পেন্টাইনে পরিণত হয় এবং পরবর্তীকালে লিমােনাইট বা জিপসাম-সমৃদ্ধ মাটি সৃষ্টি হয়।

2Fe2O3 + 3HO = 2Fe2O3, 3H2O

হাইড্রোলিসিস বা আর্দ্র বিশ্লেষণ : এটি রাসায়নিক আবহবিকারের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। জল হাইড্রোজেন (H+) এবং হাইড্রক্সিল (OH-) আয়নে ভেঙে গিয়ে খনিজের সঙ্গে বিক্রিয়া ঘটিয়ে রাসায়নিক আবহবিকার ঘটায়। ফেলস্পার এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই অ্যালুমিনােসিলিসিক অ্যাসিড ও পটাশিয়াম হাইড্রক্সাইডে পরিণত হয়। পুনরায় পটাশিয়াম হাইড্রোক্সাইড কার্বন -ডাই – অক্সাইডের সঙ্গে বিক্রিয়া করে পটাশিয়াম কার্বনেটে পরিণত হয়। এভাবে ক্যালশিয়াম ও পটাশিয়াম থেকে ক্ষারধর্মী মাটি সৃষ্টি হয়।

2KOH + CO2 = K2CO3 + H2O

Rlearn Education