মাটি বা মৃত্তিকা : উচ্চমাধ্যমিক ভূগোল | তৃতীয় পর্ব

উচ্চমাধ্যমিক ভূগোল (HS Goography) : মৃত্তিকা

আলোচ্য বিষয় :
1.পৃথিবীর প্রধান মৃত্তিকা বলয়গুলির নাম উল্লেখ করে যে-কোনাে দুটি বলয়ের (ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা বলয় ও চারনোজেম মৃত্তিকা বলয়)বর্ণনা দাও |
2.সরলবর্গীয় বনাঞ্চলে সৃষ্ট অথবা আর্দ্রনাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের প্রধান মাটি (পডসল) |

ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা বলয় ও চারনোজেম মৃত্তিকা বলয় :

প্রশ্ন : আর্দ্র ক্রান্তীয় অঞ্চলে সৃষ্ট প্রধান বলয়িত মাটির ভৌগােলিক বণ্টন, উৎপত্তি ও বৈশিষ্ট্য আলােচনা করাে।

অথবা, পৃথিবীর প্রধান মৃত্তিকা বলয়গুলির নাম উল্লেখ করে যে-কোনাে দুটি বলয়ের বর্ণনা দাও |

অথবা,প্রেইরি তৃণভূমি অঞ্চলের সৃষ্ট মাটি অথবা চারনোজেম মাটির অবস্থান, উৎপত্তি ও বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে লেখাে।

উত্তর : পৃথিবীর প্রধান মৃত্তিকা বলয়গুলি প্রধান জলবায়ু অঞ্চলের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। নীচের ছকে তা দেখানাে হল一

জলবায়ু অঞ্চল : (1) আর্দ্র ক্রান্তীয় জলবায়ু (2) আর্দ্র নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু (3) শুঙ্কপরায় নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু (4) মরু জলবায়ু (5) মেরু জলবায়ু।

মৃত্তিকা বলয় : (১) ল্যাটেরাইট, লােহিত মৃত্তিকা (২) পডসল মৃত্তিকা (৩) চারনােজেম মৃত্তিকা (৪) সিরােজেম, চেস্টনাট, মরু মৃত্তিকা (৫) তুন্দ্রা মৃত্তিকা।

ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা বলয় : আর্দ-ক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলের একটি উল্লেখযােগ্য বলয়িত মাটি হল ল্যাটেরাইট।

অবস্থান : ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা আর্দ্র-ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলে বৃহত্তম মৃত্তিকা বলয় গঠন করেছে। মধ্য ভারত, মায়ানমার, ইন্দোচিন, দক্ষিণ-পূর্ব চিন, মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্ব অংশ ও উত্তর অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি স্থানে এই মৃত্তিকা লক্ষ করা যায়।

উৎপত্তি : (i) উচ্চ তাপমাত্রা (25 °সে.) ও 200 সেমি থেকে 250 সেমি বৃষ্টিপাতযুক্ত ক্রান্তীয় ও উপক্ৰান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলে এরূপ মৃত্তিকা গড়ে উঠেছে। (ii) অধিক বৃষ্টিপাতের দরুন ধৌত প্রক্রিয়ায় দ্রবীভূত পদার্থ (ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালশিয়াম, পটাশিয়াম প্রভৃতি) সম্পূর্ণভাবে মাটির ওপরিস্তর থেকে অপসারিত হয়ে যায়। (iii) মূল শিলা থেকে খনিজ সিলিকা (Mineral Silicates) বেরিয়ে যায় ও সেসকুইঅক্সাইড (Sesquioxide) রূপে লােহা ও অ্যালুমিনিয়ামের জারিত কণাগুলি মাটির উপরিস্তরে থেকে যায় ও ইটের মতাে গাঢ় লাল বর্ণ ধারণ করে (ল্যাটিন Later-এর অর্থ Brick)। (iv) জলযােজন (Hydration) বিক্রিয়ায় বিভিন্ন মাত্রায় লৌহ অক্সাইডের উপস্থিতিতে ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা লাল, হলুদ ও কমলা রঙের হয়ে থাকে।

বৈশিষ্ট্য : (i) ইলুভিয়াল স্তরে ক্ষারকীয় পদার্থ স্থানান্তরিত হওয়ায় এই মাটি আম্লিক চরিত্রের। (ii) প্রচুর বৃষ্টিপাতের জন্য জৈব দেহাবশেষ দ্রুত পচে যায় ও অপসারিত হয়ে যায়। এজন্য জৈব পদার্থের সঞ্চয় কম হয়। (iii) সেসকুইঅক্সাইড ক্রমশ জমাট বেঁধে ভূত্বকের উপরিভাগে এক কঠিন স্তর বা ডিউরিক্রাস্ট (Duricrust) গঠন করে। (iv) মাটির কাঠামোে মৌচাকের মতাে (Honeycomb) হয়। (v) এই মাটি অনুর্বর ও কৃষিকাজের অনুপযুক্ত। জলসেচ ও সার প্রয়ােগের মাধ্যমে চা, কফি, রবার ও বাদাম চাষ করা হয়। গ্রামাঞলে রাস্তাঘাট ও গৃহনির্মাণে এই মাটি ব্যবহৃত হয়।

চারনোজেম মৃত্তিকা বলয় : প্রেইরি তৃণভূমি অঞ্চলের প্রধান মাটি হল চারনোজেম। এটি একপ্রকার আঞ্চলিক মাটি। প্রায় শুষ্ক ও নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু অঞ্চলে চারনাজেম মৃত্তিকা গড়ে ওঠে। 75 সেমি থেকে 125 সেমি বৃষ্টিপাতযুক্ত নাতিশীতোষ্ণ তৃণভূমি অঞ্চলে এরূপ মৃত্তিকার উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছে।

অবস্থান : ইউক্রেনের স্তেপ, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেইরি, মধ্য চিনের সমভূমি, দক্ষিণ কোরিয়া ও মঙ্গোলিয়ার তৃণভূমিতে চারনােজেম মৃত্তিকা দেখা যায়।

উৎপত্তি : (i) শুষ্ক গ্রীষ্মকাল ছাড়া অন্য সময়ে জীবাণুঘটিত কাজের জন্য প্রচুর পরিমাণে জৈব ও অজৈব অম্ল সৃষ্টি হয়। (ii) ধৌত প্রক্রিয়ায় কেবলমাত্র দ্রবীভূত লবণ মাটির নীচের স্তরে চলে যায়। (iii) শুষ্ক ঋতুতে ক্যালশিয়াম কার্বনেট ও জিপসাম মাটির একটি নির্দিষ্ট স্তরে সঞ্চিত হয়। (iv) এর ফলে স্বল্প ক্ষারকীয় অবস্থায় মাটি গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। (v) এই অবস্থায় হিউমাস ও হিউমাসজাতীয় পদার্থের প্রচুর সঞ্চয় ঘটে। ফলে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায় (প্রায় 15%)। (vi) ক্যালশিয়াম জাতীয় হিউমাস বেশি থাকায় মাটির রং কালাে হয়।

বৈশিষ্ট্য : (i) মন্টমেরােলােনাইটের অবস্থানের জন্য এর জল ধারণক্ষমতা ও উর্বরতা বেশি হয়। (ii) এই মাটির স্বল্প পরিবর্তিত রূপ হল প্রেইরি মৃত্তিকা। (iii) চারনােজেম ও প্রেইরি মৃত্তিকা কৃষিকাজের জন্য আদর্শ। এই মাটিতে গম চাষই প্রধান। এ ছাড়া ভুট্টা ও অন্যান্য পশুখাদ্য উৎপন্ন হয়।

পডসল মৃত্তিকা :


প্রশ্ন : সরলবর্গীয় বনাঞ্চলে সৃষ্ট অথবা আর্দ্রনাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের প্রধান মাটি (পডসল) সম্বন্ধে যা জানাে লেখাে | অথবা, পডসল মাটির বণ্টন, উদ্ভব ও বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে আলােচনা করাে |

উত্তর : সরলবর্গীয় বনাঞ্চলের প্রধান মাটি হল পডসল।এটি একপ্রকার বলয়িত বা আঞ্চলিক মাটি। এই মাটির অবস্থান, উৎপত্তি ও বৈশিষ্ট্যগুলি হল一

পডসল মৃত্তিকার অবস্থান বা বণ্টন : আর্দ্র নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর অন্তর্গত সরলবর্গীয় বনভূমি অঞ্চলে পডসল মৃত্তিকা বলয় গড়ে ওঠে। ইউরােপ ও এশিয়ায় এই বলয়টি উত্তরে তুন্দ্রা ও দক্ষিণে স্তেপ জলবায়ুর মধ্যে সীমাবদ্ধ। কানাডার তৈগা বনভূমি অঞ্চলে এবং ভারতে হিমালয়ের সরলবর্গীয় অরণ্যাঞ্চলে এই মৃত্তিকা দেখা যায়। দক্ষিণ গােলার্ধে এইরূপ মৃত্তিকার অবস্থান প্রায় দেখা যায় না।

পডসল মৃত্তিকার উৎপত্তি বা উদ্ভব : শীতল ও আর্দ্র নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু অঞ্চলে বৃষ্টিপাত (50 থেকে 100 সেমি) ও উয়তা (3 °সে. থেকে 10 °সে.) অনেক কম। এখানে বাষ্পীভবন অপেক্ষা বৃষ্টিপাত বেশি, জলবায়ু শীতল ও আর্দ্র প্রকৃতির। এই পরিবেশে সরলবর্গীয় উদ্ভিদ প্রচুর জন্মায়। আর্দ্র পরিবেশের জন্য ধৌত প্রক্রিয়া বেশি হয় এবং ধাতব ক্যাটায়নগুলি জলের সাথে মাটির নীচে চলে যায়। ফলে উপরের স্তরের অম্লতা বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে উদ্ভিদের দেহাবশেষ পচে একটি অম্লধর্মী জৈবস্তর সৃষ্টি হয়। মৃত্তিকার উপরের স্তরের অপসৃত পদার্থ যথা লােহা ও অ্যালুমিনিয়াম-এর অক্সাইড এর নীচের স্তরে সঞ্চিত হয়। কাদার সঙ্গে কিছু সূক্ষ্ম পলি থাকায় B স্তরটি জমাট বেঁধে যায় ও অপেক্ষাকৃত অপ্রবেশ্য হয়। এই স্তরটি শুকিয়ে শক্ত হয়ে হার্ডপ্যান তৈরি করে। মাটির ওপরের স্তরে কেবলমাত্র সিলিকার একটা আস্তরণ থেকে যায়। সিলিকার পরিমাণ বেশি থাকায় মাটি ধূসর ছাই রঙের হয় (রুশ শব্দ Solaর অর্থ হল Ash)। মাটি গঠনের এরূপ প্রক্রিয়াকে পডসলিকরণ (Podsolisation) বলে।

পডসল মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্য : (১) পডসল মাটির A, B ও C এই তিনটি স্তর অতি সুস্পষ্ট। A স্তরের ওপরের অংশ থেকে সেসকুই- অক্সাইড ও হিউমাস জাতীয় পদার্থ অপসারিত হয় বলে এই স্তর সাধারণত হালকা অথবা ধূসর ছাই রঙের হয়। B স্তরে সেসকুইঅক্সাইড ও হিউমাস সঞ্চিত হওয়ায় এই স্তরের রং গাঢ় বাদামি হয়। (২) পডসল মৃত্তিকার তিনটি স্তরই (A, B, C) আম্লিক। (৩) মাটির pH মান 5 পর্যন্ত হয়। (৪) এটি ধূসর বর্ণের। কখনাে কখনাে বাদামি বর্ণেরও হয়। (৫) এইরূপ মাটির উর্বরাশক্তি কম। এই মাটিতে শণ, যব, ওট, সয়াবিন ও ভুট্টার চাষ হয়।

Rlearn Education