মৃত্তিকা : উচ্চমাধ্যমিক ভূগোল | ষষ্ঠ পর্ব

উচ্চমাধ্যমিক ভূগোল (HS Geography) : মৃত্তিকা |

Content Topic :
➤ মাটির বর্ণ বিভিন্ন হওয়ার কারণ |
➤ এলুভিয়েশন ও ইলুভিয়েশনের পার্থক্য |
➤ আদি শিলার বিবর্তনে মাটির সৃষ্টি |
➤ মৃত্তিকা পরিলেখ বা প্রােফাইল |
➤ মৃত্তিকা পরিলেখের বৈশিষ্ট্য|
➤ মাটির স্তর বা হােরাইজন ও পরিলেখ বা প্রােফাইলের তুলনা |

মাটি নানা রঙের হওয়ার কারণ :


মাটি বিভিন্ন রঙের যেমন সাদা, লাল, বাদামি, ধূসর, হলুদ, কালাে ইত্যাদি হতে পারে। কখনাে কখনাে সবুজ আভাযুক্ত হয়।

মাটির রং নির্ভর করে一 [1] খনিজ ও জৈব পদার্থের প্রকার ও পরিমাণ, [2] জলনিকাশি ব্যবস্থা ও মাটিতে বায়ু চলাচল এবং [3] তাপমাত্রার ওপর। [4] খনিজ পদার্থের সঙ্গে জলের রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটলে বা জলের মাধ্যমে দ্রবীভূত পদার্থের অপসারণ ঘটলে কিংবা বায়ুজীবী জীবাণুর দ্বারা পচনক্রিয়া ঘটলে মাটি নানা রঙের হয়। যেমন মৃত্তিকায় জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে মৃত্তিকা কালাে রঙের হয়। নাতিশীতােয় অঞ্চলের চারনােজেম মৃত্তিকার রং কালাে। টাইটেনিয়াম অক্সাইড থাকলে মাটির রং হয় কালাে। লােহার পরিমাণ বেশি হলে মাটির রং লাল হয়। আবার আয়রন অক্সাইড আয়রন হাইড্রক্সাইডে পরিণত হলে মাটির রং হলদে হয়। যেখানে মাটিতে বেশি পরিমাণে খনিজ লবণ, চুনাপাথর, কোয়ার্টাজ থাকে সেখানে মাটির রং হয় সাদা ধূসর ও অনেক সময় জলপাই-সবুজ বর্ণের হয় |

এলুভিয়েশন ও ইলুভিয়েশনের পার্থক্য :
ধৌত প্রক্রিয়ায় মাটির উধ্বস্তর থেকে খনিজ পদার্থের নীচের দিকে গমনকে বলা হয় এলুভিয়েশন। তেমনি স্থানান্তরের মাধ্যমে কোনাে পদার্থের সঞ্চয় হল ইলুভিয়েশন। মাটি গঠনের এই দুই মৌলিক প্রক্রিয়ার মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। এগুলি হল一


এলুভিয়েশন : (১) এলুভিয়েশন পদ্ধতি মাটির ওপরের স্তরে ঘটে থাকে। (২) ধৌত প্রক্রিয়ায় মাটির শীর্ষস্তর থেকে দ্রবীভূত খনিজের অপসারণ ঘটে। (৩) মাটির উপরিস্তর খনিজশূন্য হয়ে পড়ে এবং স্তরের রং হালকা হতে থাকে। (৪) যান্ত্রিক ও রাসায়নিক পদ্ধতিতে এলুভিয়েশন ঘটে থাকে। এজন্য পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত দরকার। (৫) মাটির A স্তর গঠিত হয় |

ইলুভিয়েশন : (১) ইলুভিয়েশন পদ্ধতি মাটির নীচের স্তরে ঘটে থাকে। (২) মাটির নিম্নস্তরে দ্রবীভূত খনিজের সঞ্চয় ঘটে। (৩) মাটির নীচের স্তর খনিজসমৃদ্ধ হয় এবং মাটির রং গাঢ় হয়। (৪) ইলুভিয়েশনের বৈশিষ্ট্য নির্ভর করে এলুভিয়েশনের প্রকৃতি ও পদ্ধতির ওপর। (৫) মাটির B স্তর গঠিত হয় |

আদি শিলার বিবর্তনে মাটির সৃষ্টি :
আদি শিলা মাটি গঠনের একটি মূল উপকরণ। এই শিলা বিবর্তিত হয়ে মাটিতে পরিণত হয়। মৃত্তিকা বিজ্ঞানী Mohr 1969 খ্রিস্টাব্দে বিবর্তনের দীর্ঘ সময়কে পাঁচটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন এবং কীভাবে মাটি গঠিত হয় তা দেখিয়েছেন। নীচের সারণিতে তা উল্লেখ করা হল一

(১) প্রারম্ভিক : অপরিবর্তিত আদি শিলা।

(২) তরুণ : শিলাস্তরে আবহবিকারের শুরু।

(৩) যৌবন : সহজে পরিবর্তনযােগ্য খনিজ পদার্থের বিয়ােজন। ধীর আবহবিকারযােগ্য খনিজের পর্যাপ্ত উপস্থিতি এবং কর্দম কণার পরিমাণ বৃদ্ধি।

(৪) বার্ধক্য : অত্যন্ত প্রতিরােধকারী খনিজ ব্যতীত সমস্ত খনিজ এই পর্যায়ে বিয়ােজিত হয়।

(৫) পরিণত : এই অবস্থায় মাটি গঠন প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটে। মাটি সুসম্পন্ন স্তরবিশিষ্ট হয় এবং এর পরিলেখ সুস্পষ্ট হয়।

মৃত্তিকা পরিলেখ বা প্রােফাইল :
ভূপৃষ্ঠ থেকে নীচের দিকে আদি শিলা পর্যন্ত পরপর মাটির সুবিন্যস্ত স্তরসমূহের উল্লম্ব প্রস্থচ্ছেদকে মাটির পরিলেখ বা প্রােফাইল বলে। হিউমিফিকেশন, খনিজকরণ, এলুভিয়েশন ও ইলুভিয়েশন প্রভৃতি মৃউৎপাদী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অবিন্যস্ত রেগােলিথের মধ্যে চূর্ণীকৃত ও বিয়ােজিত শিলাসমূহ অনুভূমিকভাবে বিন্যস্ত হয়ে জন বা স্তর তৈরি করে। রুশ বিজ্ঞানী ডকুচেভ (V. V. Dokuchaev) প্রথম স্তরায়ন তথা মৃত্তিকা পরিলেখের কথা উল্লেখ করেন।

মৃত্তিকা পরিলেখের বৈশিষ্ট্য :
প্রতিটি পরিণত মৃত্তিকার পরিলেখে দুটি স্তর খুবই স্পষ্ট। এগুলি হল- [1] জৈবিক স্তর ও [2] খনিজ স্তর।

[1] জৈবিক স্তর : মৃত্তিকা পরিলেখের ওপরের স্তরটি জৈব পদার্থে সমৃদ্ধ। এই স্তরের ওপরের অংশ বা স্তরটি অবিয়োজিত জৈব পদার্থে ঢাকা থাকে। এই স্তরটি O1 বা A00 স্তর নামে পরিচিত। এর ঠিক নীচের স্তরটি আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে বিয়ােজিত। এই স্তরটি O2 বা A0 স্তর নামে পরিচিত। এই স্তরগুলি সাধারণত বনভূমি অঞ্চলে দেখা যায়।

[2] খনিজ স্তর : মৃত্তিকা পরিলেখে খনিজ স্তরকে তিনটি উপস্তরে ভাগ করা হয়। এগুলি হল—

A হােরাইজন বা ক্ষরিত স্তর : জৈবিক স্তরের ঠিক নীচের স্তরটি A হােরাইজন নামে পরিচিত। এই স্তরটি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম মৃত্তিকা কণা দ্বারা গঠিত। এই স্তরটি খনিজ ও জৈব পদার্থে সমৃদ্ধ। দ্রবীভূত পদার্থসমূহ এই স্তর থেকে এলুভিয়েশন অর্থাৎ ধৌত প্রক্রিয়ায় নীচের স্তরে ক্ষরিত বা অপসারিত হয়। তাই এই হােরাইজনকে ক্ষরিত বা ধৌত স্তর (Zone of Eluviation) বলে। তাই এই স্তর সূক্ষ্ম কর্দমকণা ও খনিজ শূন্য হয়ে পড়ে। এই স্তরের মাটির রং হালকা হয়।

B হােরাইজন বা সঞ্চয় স্তর : A স্তরের নীচের স্তর B হােরাইজন নামে পরিচিত। ধৌত প্রক্রিয়ায় A হােরাইজনের অতিসূক্ষ্ম কর্দমকণা ও দ্রবীভূত পদার্থসমূহ অপসারিত হয়ে B হােরাইজনে সঞ্চিত হয়। এই স্তরে A স্তরের বাহিত পদার্থসমূহ সঞ্চিত হয় বলে, এই স্তরকে পুষ্টি মৌলের ভাণ্ডার বলা হয়। এই স্তরের মাটির রং গাঢ় হয়।

C হােরাইজন বা শিলাচূর্ণ স্তর : মৃত্তিকা পরিলেখের সর্বনিম্ন স্তরটি C স্তর বা C হােরাইজন নামে পরিচিত। এই স্তরটি আংশিক বা সম্পূর্ণ শিলাচূর্ণ দ্বারা সৃষ্ট। এই স্তরটি আদি শিলা ও মৃত্তিকার মধ্যে সংযােগসাধনকারী স্তর।

মাটির স্তর বা হােরাইজন ও পরিলেখ বা প্রােফাইলের তুলনা :
মাটির স্তর বা হােরাইজন : (১) ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে বিস্তৃত স্বল্প বেধসম্পন্ন পাতলা অথচ সুস্পষ্ট এক-একটি বিভাজিত অংশ হল স্তর। এটি দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতাসমন্বিত আয়তন নির্দেশ করে। (২) মাটির স্তর গঠিত হয় মৌলিক প্রক্রিয়াগুলির ক্রিয়াশীলতা ও সময়ের সাপেক্ষে পরিণতি লাভের ওপর। (৩) পরিণত মাটিতে A, B ও C-এই তিনটি প্রধান স্তরকে পৃথক ও স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়। (৪) প্রত্যেকটি স্তরের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম লক্ষ করা যায়। (৫) কেবলমাত্র একটি স্তরের গভীরতাকে নির্দেশ করে। (৬) এটি মাটির ত্রিমাত্রিক স্থানগত অবস্থা।

মাটির পরিলেখ বা প্রোফাইল : (১) মাটির গভীরে আদি শিলা থেকে ভূপৃষ্ঠ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের উল্লম্ব প্রস্থচ্ছেদ হল পরিলেখ। এটি সব স্তরের গভীরতার রৈখিক অবস্থা নির্দেশ করে। (২) পরিলেখ নির্ভর করে মাটির স্তর গঠনের ওপর এবং স্তরের স্থায়িত্বের ওপর। (৩) মাটির স্তর সুগঠিত ও দৃঢ় হলে পরিলেখ সুস্পষ্ট হয় এবং সব স্তরকে পাওয়া যায়। (৪) পরিলেখ থেকে প্রস্থচ্ছেদ বরাবর মাটির সব স্তরের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম জানা যায়। (৫) সব স্তরের গভীরতা বা বেধকে নির্দেশ করে। (৬) এটি মাটির একমাত্রিক স্থানগত অবস্থা।

Rlearn Education