মৃত্তিকা : উচ্চমাধ্যমিক ভূগোল | দ্বিতীয় পর্ব

HS GEOGRAPHY SUGGESTION

আলোচ্য বিষয় :
1.মৃত্তিকা সৃষ্টির বিশেষ বা প্রাথমি প্রক্রিয়া |
2.মৃত্তিকা সৃষ্টির মৌলিক প্রক্রিয়া |
3.মৃত্তিকা সৃষ্টির নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া |

মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রাথমিক প্রক্রিয়া:


মৃত্তিকা সৃষ্টিতে যে সব প্রক্রিয়া প্রাথমিকভাবে সক্রিয় থাকে, তাদের মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রাথমিক প্রক্রিয়া বলে। মৃত্তিকা বিজ্ঞানী সাইমনসন মৃত্তিকা সৃষ্টির চারটি প্রাথমিক প্রক্রিয়ার উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হল-

১) সংযোজন : এই প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকার উপরের স্তরে জল, বায়ু, জৈব পদার্থ, খনিজ পদার্থ ও সূর্যতাপ সংযোজিত হয়।

২) অপসারণ :এই প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকা থেকে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে জল, ক্ষয়ের মাধ্যমে মৃত্তিকার উর্বরক দ্রব্য এবং জারণের মাধ্যমে মৃত্তিকাস্থিত জৈব পদার্থের জল ও কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডলের প্রবেশ করে।

৩) রূপান্তর : এই প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকা স্থিত খনিজ ও জৈব পদার্থের ভৌত ও রাসায়নিক রূপান্তর ঘটে।

৪) স্থানান্তর : এই প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকার খনিজ ও জৈব উপাদান সমূহ জলে দ্রবীভূত ও ভাসমান অবস্থায় মৃত্তিকা পরিলেখের এক স্তর থেকে আরেক স্তরে স্থানান্তরিত ও সঞ্চিত হয়।

মৃত্তিকা সৃষ্টির মৌলিক প্রক্রিয়া:


যেকোনো স্থানের সুস্পষ্ট স্তরযুক্ত প্রকৃত মৃত্তিকা সৃষ্টিতে যেসব প্রক্রিয়া অপরিহার্য, তাদের মৃত্তিকা সৃষ্টির মৌলিক প্রক্রিয়া বলে।মৃত্তিকা সৃষ্টির ক্ষেত্রে মৌলিক প্রক্রিয়াগুলি সব রকম পরিবেশে সক্রিয় থাকে। মৃত্তিকা সৃষ্টির ক্ষেত্রে চারটি মৌলিক প্রক্রিয়া কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে। সেগুলি হল-

১) জৈবকরণ বা হিউমিফিকেশন- মৃত্তিকার মধ্যে সংযোজিত বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহাবশেষ মৃত্তিকাস্থিত আণুবীক্ষণিক জীব দ্বারা জটিল জৈব রাসায়নিক পদ্ধতিতে বিয়োজিত ও পরিবর্তিত হয়ে যে গাঢ় কালচে বাদামী বর্ণের জৈব পদার্থ সৃষ্টি করে, তাতে হিউমাস বলে। আর যে জটিল জৈব রাসায়নিক পদ্ধতিতে উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহাবশেষ হিউমাসে পরিণত হয়, তাকে জৈব করণ বাই হিউমিফিকেশন বলে। এই প্রক্রিয়ায় আবহবিকারকৃত শিলাচূর্ণ বা রেগোলিথের সঙ্গে জৈব পদার্থের স্বাভাবিক সংযুক্তি ঘটে এবং রেগোলিথ মৃত্তিকাতে পরিণত হয়।

২)খনিজকরণ বা মিনারালাইজেশন- যে প্রক্রিয়ায় হিউমিফিকেশনের ফলে সৃষ্ট হিউমাস বায়ুর অক্সিজেন তারা জারিত হয়ে জল,কার্বন ডাই অক্সাইড এবং লোহা, ফসফরাস ইত্যাদি হিউমাস গঠনকারী খনিজ পদার্থের রূপান্তরিত হয়ে পুনরায় মৃত্তিকাতে মিশে যায়, তাকে খনিজকরণ বা মিনারালাইজেশন বলে।

৩)অধোগমন বা এলুভিয়েশন- যে প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকার খনিজ উপাদানগুলি জলে দ্রবীভূত অবস্থায় বা ভাসমান অবস্থায় মৃত্তিকার উপরিস্তর থেকে নিচের স্তরে অপসারিত হয়, তাকে অধোগমন বা এলুভিয়েশন বলে। এই প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকার ‘A’ স্তরের খনিজ উপাদানগুলি অপসারিত হয় বলে ‘A’ স্তরকে এলুভিয়াল স্তর বলা হয়। এই স্তরটি অম্লধর্মী হয়।

৪) সঞ্চায়ন বা ইলুভিয়েশন- যে প্রক্রিয়ায় এলুভিয়েশান প্রক্রিয়ার দ্বারা A’ স্তর অপসৃত খনিজ উপাদানগুলি নীচের ‘B’ স্তরে সঞ্চিত হয়, তাকে সঞ্চায়ন বা ইলুভিয়েশন বলে।এই প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকার ‘A’ স্তরের অপসৃত উপাদানগুলি ‘B’ স্তরে সঞ্চিত হয় বলে ‘B’ স্তরকে ইলুভিয়াল স্তর বলে।এই স্তরটি ক্ষারধর্মী হয়।

গ) মৃত্তিকা সৃষ্টির নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া:


ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন অংশে বিশেষ বিশেষ প্রাকৃতিক পরিবেশে জলবায়ু ও স্বাভাবিক উদ্ভিদের ভিত্তিতে এক একটি নির্দিষ্ট মৃত্তিকা সৃষ্টির ক্ষেত্রে যে সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে, তাকে মৃত্তিকা নির্দিষ্ট বা বিশেষ সৃষ্টির প্রক্রিয়া বলে। মৃত্তিকা সৃষ্টি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়াগুলি হল-

১) ল্যাটেরাইজেশান-উষ্ণ আর্দ্র ক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলে মৃত্তিকা সৃষ্টির যে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়, তাকে ল্যাটেরাইজেশান বলে। এই প্রক্রিয়ায় উষ্ণ আর্দ্র ক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলে অধিক বৃষ্টিপাতের কারণে মৃত্তিকার উপরে স্তর থেকে বিভিন্ন ক্ষারকীয় দ্রবণীয় উপাদান তথা সিলিকা, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম ইত্যাদি অপসারিত হয় এবং মৃত্তিকা মধ্যস্থিত লৌহ ও অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড রূপে ভূপৃষ্ঠ বরাবর বিভিন্ন গভীরতায় সঞ্চিত হয়।এই প্রক্রিয়ায় ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়।

২) পডজলাইজেশন-শীতল নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু অঞ্চলে পডজল মৃত্তিকা সৃষ্টির বিশেষ প্রক্রিয়াকে পডজলাইজেশন বলে। এই প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকার উপরিস্তর থেকে বিভিন্ন দ্রবণীয় ক্ষারীয় পদার্থ তথা ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং লৌহ ও অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড ধৌত প্রক্রিয়ার নীচের স্তরে অপসারিত হয়। আর মৃত্তিকার উপরিস্তর সিলিকা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।এই প্রক্রিয়ায় পডজল মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়।

৩) ক্যালসিফিকেশান-মৃত্তিকা সৃষ্টিতে যে প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকা পরিলেখের কোন অংশে ক্যালসিয়াম কার্বনেটের সঞ্চয় ঘটে, তাকে ক্যালসিফিকেশান বলে। এই প্রক্রিয়ায় প্রধানত নাতিশীতোষ্ণ তৃণভূমি ও মরুপ্রায় অঞ্চলে ক্যালসিয়াম কার্বনেট কার্বনিক অ্যাসিড মিশ্রিত জলে দ্রবীভূত হয়ে ক্যালসিয়াম বাই কার্বনেটে পরিণত হয় এবং অনুস্রাবন রত জলের সঙ্গে অধোগামী হয়। কিন্তু নিম্নস্থিত স্তরের অধিক তাপমাত্রা এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের প্রভাবে ক্যালসিয়াম বাই কার্বনেট পুনরায় ক্যালসিয়াম কার্বনেটে পরিণত হয় মৃত্তিকা স্তরে সঞ্চিত হয়। এই প্রক্রিয়ায় চারনোজেম ও চেস্টনাট মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়।

৪) স্যালিনাইজেশন-উষ্ণ ও শুষ্ক মরু প্রায় অঞ্চলে মৃত্তিকা স্তরের মধ্যে ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম প্রভৃতি লবণ সঞ্চিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে স্যালিনাইজেশন বলে। এই প্রক্রিয়ায় উষ্ণ ও শুষ্ক মরুপ্রায় অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ জলে দ্রবীভূত লবণ কৈশিক প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকার উপরের স্তরে উঠে আসে এবং সূর্যের তাপে ওই জল বাষ্পীভূত হওয়ার ফলে মৃত্তিকার উপরিস্তরে লবণ সঞ্চিত হয়। ফলে মৃত্তিকার উপরে স্তর লবণাক্ত হয়ে পড়ে। এই প্রক্রিয়ায় সোলোনচাক মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়।

৫) অ্যালকালাইজেশন-মৃত্তিকা সৃষ্টির যে বিশেষ প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকার কর্দম জোটে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম ইত্যাদি আয়নের তুলনায় সোডিয়াম আয়ন অধিক সঞ্চিত হয়, তাকে অ্যালকালাইজেশন বলে। প্রধানত মরু ও মরু প্রায় অঞ্চলে এই প্রক্রিয়া কার্যকর হয়। এই প্রক্রিয়ায় সোলোনেজ মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়।

৬) গ্লেইজেশান-জলমগ্ন নিম্নভূমি বা আর্দ্র ও শীতল তুন্দ্রা জলবায়ুর জলাভূমি অঞ্চলে মৃত্তিকায় অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকার কারণে জারনের পরিবর্তে বিজারণ প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে গ্লেইজেশান বলে।এই প্রক্রিয়ায় প্রধানত নিম্ন জলাভূমি অঞ্চলের মৃত্তিকার উপর জল জমে থাকায় মৃত্তিকায় অক্সিজেনের যোগান খুব কম হয়। ফলে অক্সিজেনের অভাবে জীবাণুদের স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হয়ে জৈব পদার্থের জারণের পরিবর্তে বিজারণ ঘটে। এই প্রক্রিয়ায় ধূসর বর্ণের গ্লেই মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়।

Rlearn Education