মৃত্তিকা : উচ্চমাধ্যমিক ভুগোল | পঞ্চম পর্ব

Content Topic :
➤ মাটি কাকে বলে ?
➤ মাটির বিভিন্ন উপাদান|
➤ মৃত্তিকার ভৌত ধর্ম|
➤ মৃত্তিকার রাসায়নিক ধর্ম|

উচ্চমাধ্যমিক ভূগোল ( HS Geography) : মৃত্তিকা|

মাটি কাকে বলে ?

উত্তর : বহুকাল ধরে বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনক শিলার পরিবর্তনের ফলে ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে জৈব ও অজৈব পদার্থসমৃদ্ধ যে পাতলা ভঙ্গুর স্তর সৃষ্টি হয়, যা উদ্ভিদ জন্মানাের অনুকূল, তাকে মাটি বলা হয়। যেমন চারনােজেম, পডসল, চেস্টনাট ইত্যাদি।

মাটির বিভিন্ন উপাদানগুলির বর্ণনা:


উত্তর : পরিপূর্ণ মৃত্তিকা গঠনে চারটি প্রধান উপাদান লক্ষ করা যায়। এগুলি হল- খনিজ পদার্থ (45%), জৈব পদার্থ (5%), মৃত্তিকার জল (25%) ও মৃত্তিকার মধ্যে বাতাস (25% )।

(১) মৃত্তিকার খনিজ পদার্থ : মৃত্তিকা গঠনকারী খনিজগুলি প্রধানত অ্যালুমিনাে- সিলিকেট জাতীয়। মৃত্তিকায় উপস্থিত বিভিন্ন খনিজ উপাদানগুলি হল—ফেলসপার, অ্যাম্ফিবােল ও পাইরক্সিন, কোয়ার্টজ, অভ্র, লােহাজাতীয় ম্যাগনেশিয়াম প্রভৃতি।

(২) মৃত্তিকার জৈব উপাদান : গাছ ও অন্যান্য জীবের অবশিষ্টাংশ, জীর্ণ দেহ ও তাদের দেহাবশেষের মিশ্রণে উদ্ভূত জটিল পদার্থই মৃত্তিকার জৈব উপাদান। এই পদার্থগুলি সর্বদাই মৃত্তিকাতে বসবাসকারী জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়। এর ফলে জৈব উপাদানগুলি অনবরত ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর কণায় পরিণত হয়। মৃত উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহাবশেষ এবং জীবাণুর দেহকোশ মৃত্তিকার জৈব পদার্থের প্রধান উৎস। জৈব পদার্থ মৃত্তিকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অজৈব পদার্থকে দানাবদ্ধ করতে সাহায্য করে। এই জৈব পদার্থই ফসফরাস ও সালফারের প্রধান উৎস। জৈব পদার্থ মৃত্তিকার জীবাণু শক্তির মূল উৎস। জৈব পদার্থ না থাকলে মৃত্তিকাতে অনেক জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়া সংঘটিত হত না। মৃত্তিকার জৈব পদার্থকে দু-ভাগে ভাগ করা যায়- আংশিক বিশ্লেষিত জৈব পদার্থ ও হিউমাস।

প্রথম ভাগটি উদ্ভিদ ও প্রাণী দেহাবশেষের আংশিক বিশ্লিষ্ট ও সংশ্লেষিত জটিল উপাদান। উদ্ভিদ ও জীবাণুকুল তাদের খাদ্য, শক্তি ও বৃদ্ধির জন্য এই উপাদানের ওপর নির্ভরশীল। উত্তমরূপে বিশ্লিষ্ট ও সংশ্লেষিত জটিল জৈব উপাদানকে হিউমাস বলে।

মাটির কাদাকণা ও হিউমাস—উভয় উপাদানই কলয়েড অবস্থায় থাকে। কাদাকণা ও হিউমাস মৃত্তিকার ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মকে প্রভাবিত করে এবং এদের মাধ্যমে মৃত্তিকার অধিকাংশ বিক্রিয়া সংঘটিত হয়। খাদ্য মৌলগুলি ভূপৃষ্ঠের ওপরে থাকায় নীচে ধুয়ে চলে যায় না। উদ্ভিদ পুষ্টি হিসেবে এইসব মৌল সংগ্রহে সক্ষম হয়।

(৩) মৃত্তিকার জল : মৃত্তিকার আর একটি প্রধান উপাদান হল—জল। জল মৃত্তিকাকে দ্রবীভূত করে। উদ্ভিদ মৃত্তিকা থেকে জলের সাহায্যেই পুষ্টি মৌল সংগ্রহ করে। জল মৃত্তিকার ভৌত রাসায়নিক এবং জৈবিক প্রক্রিয়াগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে। মৃত্তিকাস্থিত জলে মৃত্তিকার লবণকণা দ্রবীভূত হয়। এই দ্রবণ ক্রিয়ার ফলেই উদ্ভিদ মৃত্তিকা থেকে শিকড়ের সাহায্যে পুষ্টিমৌল সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়।

(৪) মৃত্তিকার বায়ু : মৃত্তিকার বায়ু মৃত্তিকার মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে অবস্থান করে। মৃত্তিকার বায়ু স্থানীয় অবস্থার ওপর নির্ভরশীল। এই বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকে। মৃত্তিকায় যখন জলের পরিমাণ স্বাভাবিক থাকে, তখন এর আপেক্ষিক আদ্রর্তা প্রায় 100 শতাংশ হয়। এই আবদ্ধ বায়ুতে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বেশি, অক্সিজেনের পরিমাণ কম। বৃষ্টির জলে মৃত্তিকা রন্ধ্রগুলি ভর্তি হয়ে যায়। উদ্ভিদ মৃত্তিকা থেকে জল ব্যবহার করতে শুরু করলে এবং বাষ্পীভবনের ফলে জল কমতে শুরু করলে মৃত্তিকার মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রন্ধ্র গুলি আবার বায়ুতে পূর্ণ হয়ে যায়। বায়ুর এই গতিময়তা বন্ধ হলে কেবলমাত্র উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না, জীবাণু- কুলের অস্তিত্বকেও বিপন্ন করে। মৃত্তিকার বায়ু উদ্ভিদ ও জীবাণুকুলের জীবনধারণের পক্ষে অপরিহার্য।

মৃত্তিকার ভৌত ধর্ম :


মৃত্তিকার যেসব ধর্মগুলিকে চোখে দেখে চিহ্নিত করা যায় বা অনুভব করে বােঝা যায়, সেগুলিকে মৃত্তিকার ভৌত ধর্ম বলে। এগুলি হল一

মৃত্তিকার গ্রথন বা বুনন : মৃত্তিকার গ্রথন বা বুনন হল মৃত্তিকার ভৌত ধর্মগুলির মধ্যে অন্যতম। মৃত্তিকায় অবস্থিত বিভিন্ন আকৃতির নুড়ি, বালি, কাকর, পলি প্রভৃতির আনুপাতিক হারের ওপর মৃত্তিকার গ্রথন বা বুনন নির্ভর করে। যেমন- বেলেমাটিতে বালিকণার পরিমাণ বেশি থাকে, এঁটেল মাটিতে কাদার পরিমাণ বেশি থাকে।

মৃত্তিকার গঠন বা কাঠামাে : মৃত্তিকায় অবস্থিত বিভিন্ন আকৃতির নুড়ি, বালি, পলি প্রভৃতি পরস্পর সংযযাজিত হয়ে যে বিন্যাস প্রদর্শন করে, তাকে মৃত্তিকার গঠন বা কাঠামাে বলে।

মৃত্তিকার সচ্ছিদ্রতা : মৃত্তিকার জল ধারণক্ষমতা এবং বায়ু চলাচলের ক্ষমতা নির্ভর করে এর সচ্ছিদ্রতার ওপর। মৃত্তিকা সচ্ছিদ্র হলে উদ্ভিদের শিকড় মাটির গভীর অংশ থেকে তার প্রয়ােজনীয় জল সংগ্রহ করতে পারে।

মৃত্তিকার বর্ণ : মৃত্তিকায় লােহার পরিমাণ বেশি হলে মৃত্তিকার রং লাল হয় (লােহিত মাটি), মৃত্তিকায় জৈব পদার্থের পরিমাণ বেশি হলে মৃত্তিকার রং কালাে হয় (চারনােজেম মাটি) এবং মৃত্তিকায় কোয়ার্টজ, চুনাপাথর ও খনিজ লবণের পরিমাণ বেশি হলে মৃত্তিকা ধূসর বর্ণের হয় (পডসল মাটি)।

মৃত্তিকার আর্দ্রতা : মৃত্তিকা গঠনকারী কণার মধ্যস্থিত জলের অবস্থানকে মৃত্তিকার আর্দ্রতা বলে। মৃত্তিকায় জলের অবস্থানের প্রধান উৎস হল বৃষ্টিপাত।

মৃত্তিকার ঢাল : মৃত্তিকার ঢাল কম হলে ওই স্থানে মৃত্তিকার গঠন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়। অন্যদিকে, মৃত্তিকার ঢাল বেশি হলে ওইস্থানে মৃত্তিকার গঠন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই আবহবিকার ও ক্ষয়ীভবনের ফলে সৃষ্ট পদার্থসমূহ অন্যত্র অপসারিত হয়।

মৃত্তিকার জল ধারণক্ষমতা : একটি নির্দিষ্ট আয়তনের মৃত্তিকা যে পরিমাণ জল তার নিজের মধ্যে ধরে রাখতে পারে, সেই পরিমাণকে ওই মৃত্তিকার জল ধারণক্ষমতা বলে। বালি, পলি ও কাদা মাটির জল ধারণক্ষমতা আলাদা আলাদা।

মৃত্তিকার সংকোচন ও প্রসারণক্ষমতা : অধিক তাপমাত্রায় মৃত্তিকা সংকুচিত হয় আবার কম তাপমাত্রায় মৃত্তিকা প্রসারিত হয়। মৃত্তিকার সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে মৃত্তিকার রন্দ্রের সংখ্যা বাড়ে ও কমে।

মৃত্তিকার তাপমাত্রা : মৃত্তিকার তাপমাত্রার ওপর বীজের অঙ্কুরােদ্গম ও মৃত্তিকাস্থ জীবাণুদের বেঁচে থাকা প্রভৃতি নির্ভর করে। মৃত্তিকা পরিলেখের যত নীচের দিকে যাওয়া যায় তাপমাত্রা তত কমতে থাকে।

মৃত্তিকার বায়ু ও বায়ু চলাচল : মৃত্তিকার মধ্যস্থিত ফাঁকা স্থানগুলি জল বাদ দিয়ে বায়ু দ্বারা পূর্ণ থাকে। মৃত্তিকা থেকে বায়ুমণ্ডলে এবং বায়ুমণ্ডল থেকে মৃত্তিকায় বায়ুর চলনকে বায়ু চলাচল বলে।

মৃত্তিকার সংশক্তি : মৃত্তিকায় অবস্থিত কাদা কণার পরস্পরকে আকর্ষণ করে ধরে রাখার ক্ষমতাকে মৃত্তিকার সংশক্তি বলে।

মৃত্তিকার আসঞ্জন বল : মৃত্তিকার কণার পৃষ্ঠদেশে জল লেগে থাকার ক্ষমতাকে মৃত্তিকার আসঞ্জন বল বলে।

মৃত্তিকার রাসায়নিক ধর্ম :


মৃত্তিকার যে সমস্ত গুণাগুণ কেবলমাত্র রাসায়নিক পরীক্ষার দ্বারা নিরূপণ বা নির্ণয় করা সম্ভব সেই সমস্ত গুণাগুণকে মৃত্তিকার রাসায়নিক ধর্ম বলা হয়। মৃত্তিকার প্রধান রাসায়নিক ধর্মগুলি হল (i) মৃত্তিকার আয়ন বিনিময় ক্ষমতা, (ii) মৃত্তিকার বিক্রিয়া, (iii) উদ্ভিদের পুষ্টিমৌল, (iv) জৈব পদার্থ ইত্যাদি। রাসায়নিক ধর্ম অনুসারে মৃত্তিকা তিন ধরনের হয়ে থাকে一

আম্লিক মৃত্তিকা : মৃত্তিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক ধর্ম অম্লত্ব। বেশি বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলে মৃত্তিকার ওপরের স্তর থেকে দ্রবীভূত ক্যালশিয়াম মৃত্তিকার নীচের স্তরে চলে যায়। ফলে এরূপ মৃত্তিকার অল্পত্ব বৃদ্ধি পায়। আম্লিক মৃত্তিকায় হাইড্রোজেন আয়নের পরিমাণ বেশি হয় এবং মৃত্তিকার pH-এর মান 7-এর কম হয়।

ক্ষারকীয় মৃত্তিকা : ক্ষারকীয়তাও মৃত্তিকার অন্যতম রাসায়নিক ধর্ম। মৃত্তিকায় চুনজাতীয় পদার্থের পরিমাণ বেশি হলে মৃত্তিকার ক্ষারকীয়তা বৃদ্ধি পায়। ক্ষারীয় মৃত্তিকায় হাইড্রক্সিল আয়নের পরিমাণ বেশি হয় এবং মৃত্তিকার pH-এর মান 7-এর বেশি হয়।

প্রশমিত মৃত্তিকা : মৃত্তিকায় অম্লত্ব ও ক্ষারকীয়তার পরিমাণ সমান হলে সেই মৃত্তিকাকে প্রশমিত মৃত্তিকা বলে। প্রশমিত মৃত্তিকার pH-এর মান 7 হয়। কৃষিকাজের পক্ষে এরূপ মৃত্তিকা সর্বাধিক উপযােগী।

Rlearn Education