পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলন
পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার এক ছোট্ট গ্রাম নকশালবাড়ি থেকে নকশাল আন্দোলনের নামকরণ হয়। ১৯৬৭ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) বা সিপিআই(এম)-এর এক অংশের নেতৃত্বে এই নকশালবাড়ি গ্রাম থেকেই শুরু হয় এক হিংসাত্মক কৃষক আন্দোলনের।
এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন চারু মজুমদার, কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল প্রমুখ। এই আন্দোলনের প্রতিপাদ্য ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ভূমিহীন কৃষকদের হাতে জমির মালিকানা তুলে দেওয়া। ১৯৬৭ সালের মে মাসে জমির মালিকানা নিয়ে বিবাদে এক ভাগচাষী জোতদারের লেঠেল বাহিনীর হাতে আক্রান্ত হয়।
এরপর কৃষক নেতাদের ধরতে গ্রামে পুলিশ এলে তারা আক্রান্ত হয়, মৃত্যু হয় এক পুলিশ ইন্সপেক্টরের। এই ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তে বিভিন্ন জায়গায় গরিব মানুষ এই আন্দোলনে যোগ দিতে শুরু করে। কৃষক এবং উপজাতি- দের নিয়ে সরকার ও উঁচু শ্রেণির মানুষকে সরিয়ে সশস্ত্র উপায়ে ক্ষমতা দখলের মাও সে তুঙের ভাবনায় অনুপ্রাণিত ছিল নকশাল আন্দোলন। চারু মজুমদার এই নকশাল ভাবধারার প্রধান প্রবক্তা। এই বিষয়ে বিখ্যাত তাঁর ‘আটটি দলিল।
নকশাল আন্দোলনের নেতারা সকলেই
সিপিআই(এম)-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৭ সালে গঠিত যুক্তফ্রন্ট সরকারে সিপিআই(এম) যোগ দিলে মতাদর্শের প্রশ্নে এক অংশের নেতৃত্বের সঙ্গে অন্য অংশের বিরোধ বাধে। ১৯৬৭ সালের শেষ ভাগে সুশীতল রায় চৌধুরির নেতৃত্বে বিরোধী অংশ অল ইন্ডিয়া কোঅর্ডিনেশন কমিটি অব কমিউনিস্ট রেভলিউশনারিজ গঠিত হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৯ সালের ২২ এপ্রিল লেনিনের জন্মদিনে প্রতিষ্ঠিত হয় কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট)।
১৯৭০-এর দশকের শুরুতে কলকাতার হার সমাজের মধ্যে নকশাল আন্দেলন প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। স্কুল, কলেজের পড়ুয়ারা এই আন্দোলনে যোগ দিতে শুরু করে। ছাত্ররা শহর ছেড়ে গ্রামে যেতে থাকে আন্দোলনের ডাকে। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার ডাক দেয় নকশাল আন্দোলন। কিন্তু ক্রমে চারু মজুমদার খতমের রাজনীতির কথা ঘোষণা করলে আন্দোলন বিপক্ষে যেতে শুরু করে। এই রাজনীতিতে প্রয়োজনে শ্রেণি শত্রুর, ব্যক্তি হত্যার রাজনীতি আমদানি করা হয়। কলকাতায় ভাঙা পড়ে বহু মনীষীর মূর্তি, শ্রেণি শত্রুর নামে খুন হয়ে যায় এমনকি গরিব পুলিশ কনস্টেবল। খুনের তালিকা থেকে জোতদার জমিদার ছাড়াও ব্যবসায়ী, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বাম ও দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকও বাদ যায়নি।
১৯৭২ সালে মুখ্যমন্ত্রী হন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। তিনি ভয়াবহ আক্রমণ নামিয়ে আনেন নকশাল-আন্দোলনের ওপর। একদিকে পুলিশ, সামরিক বাহিনী অন্যদিকে অন্যান্য রাজনৈতিক দল নির্বিচারে হত্যালীলা চালায়, নামিয়ে অন্য হয় এক চূড়ান্ত অত্যাচারের সময়কাল। অসংখ্য যুবক-যুবতী বলি হয় এই আন্দোলন দমনের যুপকাষ্ঠে। নকশাল আন্দোলনের মধ্যেও অনুপ্রবেশ ঘটে সমাজ বিরোধীদের। নকশালপন্থীরা মানবাধিকার
লঙ্ঘনের অভিযোগ জানালে প্রশাসন পাল্টা যুক্তি দেয়, রাজ্যে কার্যত গৃহযুদ্ধ চলছে, আর যুদ্ধে গণতন্ত্রের কোনো স্থান নেই।
সিপিআই(এমএল) দলের মধ্যেও চারু
মজুমদারের খতম রাজনীতির বিরোধিতা শুরু হয়। মতাদর্শের দ্বন্দ্বে ১৯৭১ সালে প্রথম ভাঙন ধরে দলে। সত্যনারায়ণ সিং চারু মজুমদারের মতেরবিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ১৯৭২ সালে চারুমজুমদার পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন, আলিপুর জেলে তাঁর মৃত্যু হয়। এর পর নকশাল আন্দোলন আরও বিভক্ত হতে থাকে।
১৯৭১ সালের জুলাই মাসে রাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসনের সুযোগ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অতি সঙ্গোপনে সেনা পুলিশ সহযোগে ‘অপারেশন স্টিপলচেজ’ চালানোর নির্দেশ দেন।
এই ‘অপারেশন’এ অসংখ্য নকশাল কর্মী- নেতা নিহত হয়, কারারুদ্ধ হয় ২০,০০০ সন্দেহভাজন, নকশাল কর্মী। এই অপারেশনে আধা সামরিক বাহিনীও ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে নকশাল মতাদর্শ নানা ভাগে বিভক্ত। এর প্রধান বিভাজন একদিকে সংসদীয় রাজনীতি মেনে নির্বাচনে অংশ নেওয়া সিপিআই (এমএল) অন্যদিকে হিংসার পথে চলা কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)। সাম্প্রতিক কালে মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সবথেকে ভয়াবহ আক্রমণটি ঘটে ছত্তিশগড়ের দান্তেওয়াড়ায়, ২০১০ সালে মাওবাদী এই আক্রমণে ৭৬ জন সিআরপিএফ কর্মী ও আট মাওবাদীর মৃত্যু হয়।