Requirements of Damodar valley corporation

Requirements of Damodar valley corporation | DVC

আলোচনার বিষয় :

1] দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন কি |

2] DVC গঠনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট |

3] DVC এর উদ্দেশ্য |

4] পরিকল্পণা রূপায়ণ |

5] উপকৃত অঞ্চল |

6] সমস্যা

7] উপসংহার |

Damodar valley corporation

দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন :

হুগলি নদীর একটি উপনদী হল দামোদর। 541 কিমি দীর্ঘ নদটি ঝাড়খণ্ডের (পালামৌ জেলা) ছোটোনাগপুর মালভূমির খামারপাত পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে প্রথমে দক্ষিণ-পূর্বে এবং পরে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে কলকাতার প্রায় 58 কিমি দক্ষিণে হুগলি নদীতে মিলিত হয়েছে। ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের প্রায় 13,425 বর্গকিমি অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত, কয়লা সম্পদে সমৃদ্ধ এই দামোদর অববাহিকার সামগ্রিক উন্নয়নের তাগিদেই জন্ম হয় ‘দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন’ (Damodar Valley Corporation) বা সংক্ষেপে DVC-এর।

DVC গঠনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট :

DVC গঠনের মূল প্রেক্ষাপট ছিল শত শত বছর ধরে দামোদর অববাহিকার বন্যার ভয়াবহ ইতিহাস। প্রতি বছর বন্যার ফলে এত ক্ষয়ক্ষতি হত যে দামোদরকে ‘দুঃখের নদ’ আখ্যা দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর এই বন্যাকে নিয়ন্ত্রণ করে দামোদর অববাহিকার আর্থ-সামাজিক উন্নতি ঘটাতে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ‘টেনেসি ভ্যালি অথরিটি’ (TVA)-এর অনুকরণে ‘দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন’ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র ও রাজ্য যৌথকমিটি। এই কমিটির নাম ছিল ‘বন্যা তদন্ত কমিটি’। এর পর ভারত সরকার ‘Central Technical Power Board’-এর হাতে এর দায়িত্ব দেন। এই বোর্ডের সদস্য W L Voorduin সর্বপ্রথম দামোদর উপত্যকার সামগ্রিক পরিকল্পনার একটি নকশা প্রস্তুত করেন। এই নকশা বাস্তবে রূপদানের উদ্দেশ্যে কেন্দ্র ও দুই রাজ্য (তৎকালীন বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গ) সরকারের মিলিত উদ্যোগে 1948 খ্রিস্টাব্দের 7 জুলাই একটি কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা হিসেবে ‘দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন’ (DVC) গঠিত হয়।

দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের উদ্দেশ্য :

এই কর্পোরেশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা এবং তা সাফল্য মণ্ডিত করা, যেমন—

(i) বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা,

(ii) জলসেচ ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি জলের সরবরাহ ও জলের নিষ্কাশন ব্যবস্থা সুদৃঢ় করা,

(ii) জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ করা,

(iv) জলপরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো,

(v) অরণ্যসৃজন ও মৃত্তিকাক্ষয় রোধ করা,

(vi) মৎস্যচাষ, জলক্রীড়া, আমোদ-প্রমোদ ইত্যাদির ব্যবস্থা করা এবং

(vii) সর্বোপরি দামোদর উপত্যকা অঞ্চলের অধিবাসীদের আর্থ-সামাজিক উন্নতি ঘটানো।

Requirements of Damodar valley corporation

পরিকল্পনা রূপায়ণ :

বন্যা নিয়ন্ত্রণ : দামোদর উপত্যকা পরিকল্পনার অন্যতম উদ্দেশ্য হল বন্যা নিয়ন্ত্রণ। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য দামোদর ও তার উপনদীগুলিতে ৪টি বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। এই বাঁধগুলি হল—তিলাইয়া, কোনার, মাইথন, পাঞ্চেৎ I ও II, বলপাহাড়ী, বার্মো ও আয়ার। এর মধ্যে প্রথম চারটি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা রূপায়িত হয় এবং অন্য চারটি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা স্থগিত থাকে | পরবর্তীকালে অবশ্য ঝাড়খন্ডে দামোদরের ওপর তেনুঘাট বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে এবং বেলপাহাড়ীতে বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে | নির্মিত পাঁচটি বাঁধ হল —

1) তিলাইয়া বাঁধ (1953) ➞ বরাকর নদী |

2) কোনার বাঁধ (1955) ➞ কোনার নদী |

3) মাইথন বাঁধ (1957) ➞ বরাকর নদী |

4) পাঞ্চেৎ বাঁধ (1959)➞ দামোদর নদী |

5) তেনুঘাট বাঁধ (1973)➞ দামোদর নদী |

জলসেচ : দামোদর অববাহিকায় জলসেচের জন্য DVC-এর তত্ত্বাবধানে 1955 খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় দামোদর নদীর ওপর দুর্গাপুর ব্যারেজ (সেচবাঁধ) নির্মিত হয়। এর দৈর্ঘ্য 692 মিটার এবং উচ্চতা 12 মিটার। দুর্গাপুর ব্যারেজ থেকে দুদিকে দুটি খাল কাটা হয়েছে। বাঁদিকের খালটি 136.8 কিমি দীর্ঘ এবং তা ত্রিবেনীর কাছে হুগলি নদীতে মিশেছে। আর ডানদিকের খালটি 88.5 কিমি দীর্ঘ। এই দুই প্রধান খাল থেকে বহু শাখা খাল খনন করে দামোদরের নিম্ন অববাহিকার কৃষিক্ষেত্র গুলিতে জলের সরবরাহ করা হয়। এই সেচখালগুলির মোট দৈর্ঘ্য 2,494 কিমি। বর্তমানে তিলাইয়া বাঁধ থেকেও খাল কেটে জলসেচ করা হচ্ছে। এ ছাড়া DVC জলসেচের প্রসারের জন্য মাইক্রো লিফ্ট জলসেচ ব্যবস্থা, গভীর কুয়ো খনন প্রভৃতি কাজ করে চলেছে।

বিদ্যুৎ উৎপাদন : সুলভ জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে অনুমান করে DVC মাইথন, পাঞ্জেৎ ও তিলাইয়া- এই তিনটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে। কিন্তু এই তিনটি কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা মাত্র (60 + 80 + 4) = 144 মেগাওয়াট। তাই কয়লা সম্পদে সমৃদ্ধ দামোদর উপত্যকায় DVC আরো চারটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে। এগুলি হল বোকারো (630 MW), চন্দ্রপুরা (750 MW), দুর্গাপুর (350) MW) এবং মেজিয়া (840 MW)। DVC -এর এই জলবিদ্যুৎ ও তাপবিদ্যুৎ ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব রেলপথে ব্যবহৃত হয়।

পরিবহণ : দুর্গাপুর ব্যারেজ থেকে কাটা খাল দুটিতে DVC জলপথ পরিবহণের ব্যবস্থা করেছে। বামদিকের খালপথের মাধ্যমে দুর্গাপুর ও রানিগঞ্জ কয়লাখনি অঞ্চল এবং কলকাতা শিল্পাঞ্চলের মধ্যে কয়লা ও শিল্পজাত দ্রব্য আদানপ্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

মৎস্যচাষ : DVC নির্মিত বাঁধগুলির পশ্চাতের জলাধারে প্রচুর মৎস্যচাষ করা হয়।

আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন : এই উন্নয়ন প্রকল্পে DVC নির্মিত গৃহীত কর্মসূচিগুলি–

(i) শিক্ষা : শিশু ও বয়স্ক শিক্ষার ব্যবস্থা, মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তিপ্রদান, গ্রামীণ গ্রন্থাগার স্থাপন প্রভৃতি নানা শিক্ষামূলক কর্মসূচি রূপায়ণ করা হয়েছে।

(ii) স্বাস্থ্য : স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণের উদ্দেশ্যে গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন, হোমিওপ্যাথি ডিসপেনসারি স্থাপন, ঔষধালয় স্থাপন, মোবাইল ক্লিনিক, পালস্ পোলিয়ো দূরীকরণ, ক্যানসার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, মা-শিশু যত্নের জন্য সংগঠিত ক্যাম্প প্রভৃতি কাজ DVC করে আসছে।

(iii) বনসৃজন : দামোদর উপত্যকা অঞ্চলের মৃত্তিকাক্ষয় ও পরিবেশ দূষণ রোধের জন্য DVC বনসৃজনের ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়। বিশেষত গ্রামের মানুষদের আর্থিক সচ্ছলতা ফেরাতে সামাজিক বনসৃজন প্রকল্প DVC কর্তৃপক্ষ হাতে নেয়।

(iv) বিনোদন : বাঁধের পশ্চাতের জলাধার গুলিতে বিনোদনের উদ্দেশ্যে DVC জলক্রীড়া ও আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা করে। এ ছাড়া বহু যুব ক্লাব গঠনের মধ্য দিয়ে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সংগঠিত করে।

(v) অন্যান্য : এ ছাড়া স্থানীয় অধিবাসীদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের (সেলাই, ছাপার কাজ, মাশরুম উৎপাদন, খেলনা তৈরি, খাবার সংরক্ষণ প্রভৃতি) ব্যবস্থা করা, কৃষকদের আধুনিক কৃষিকাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া, রাস্তাঘাট তৈরি, জলনিকাশি ব্যবস্থা, পয়ঃপ্রণালীর উন্নয়ন, নিরাপদ পানীয় জল সরবরাহ প্রভৃতি উন্নয়নমূলক কাজ DVC করে থাকে।

Requirements of Damodar valley corporation

উপকৃত অঞ্চল :

DVC দ্বারা দামোদর উপত্যকা পরিকল্পনা রূপায়িত হওয়ার ফলে ঝাড়খণ্ডের হাজারিবাগ, পালামৌ, রাঁচি, ধানবাদ, সাঁওতাল পরগনা ও পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, বর্ধমান, হুগলি, পুরুলিয়া, হাওড়া প্রভৃতি জেলা এবং তৎসংলগ্ন শিল্পাঞ্চল নানা দিক থেকে উপকৃত হয়ে চলেছে।

সমস্যা :

(i) DVC নির্মিত বাঁধের জলাধারগুলি ক্রমশ পলিসঞ্চয়ে অগভীর হয়ে পড়েছে। ফলে, বর্ষার সময় প্রায়ই অতিরিক্ত জলের চাপ থেকে বাঁধগুলিকে রক্ষার জন্য জল ছাড়া হয়, যা কৃত্রিম বন্যার সৃষ্টি করে।

(ii) জনবসতি বৃদ্ধি এবং খনিজ আহরণ ও শিল্পের প্রসারে দামোদর অববাহিকার অরণ্য দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।

(iii) অর্ধশতাব্দী পুরোনো বাঁধগুলির সংস্কার ও লকগেটগুলির মেরামতি অত্যন্ত প্রয়োজন।

(iv) দামোদর উপত্যকা পরিকল্পনা অঞ্চলের পরিবহণ সমস্যা ও অদক্ষ শ্রমিক খনি ব্যাবসাকে ক্রমশ অলাভজনক করে তুলছে।

(v) নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে যত্রতত্র বস্তি গজিয়ে উঠছে, দিন দিন অসামাজিক কাজকর্মের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

উপসংহার :

DVC তার পরিকল্পনা রূপায়ণের মধ্য দিয়ে দামোদর উপত্যকা অঞ্চলকে ভারতের একটি অনন্য পরিকল্পিত অঞ্চলের রূপ দিয়েছে। দামোদরের উচ্চ অববাহিকা খনিজ সম্পদে এবং নিম্ন অববাহিকা কৃষিজ সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়ায় DVC দ্বারা দামোদর উপত্যকা অঞ্চলের উন্নয়ন দ্রুতগতিতে ত্বরান্বিত হয়ে চলেছে। কিছু সমস্যা থেকে গেলেও আগামী দিনে DVC দ্বারা আরো উন্নত ও প্রযুক্তিগত পরিকল্পনা ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এই অঞ্চল উন্নতির শীর্ষে পৌঁছোবে বলে আশা করা যায়।

Rlearn Education