উনিশ শতকের প্রথমার্ধে সতীদাহ প্রথা বিরোধী প্রচেষ্টা| মাধ্যমিক ইতিহাস

প্রশ্ন : উনিশ শতকের প্রথমার্ধে সতীদাহ প্রথা বিরোধী প্রচেষ্টাগুলির পরিচয় দাও । রামমোহন রায় কী ভাবে সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলনকে সাফল্যমন্ডিত করেন ? ( মাধ্যমিক 2020)

উত্তর :

ভূমিকা: খ্রিস্টপূর্ব যুগ থেকেই ভারতীয় হিন্দুসমাজে সতীদাহ প্রথার প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ খ্রিস্ট- পূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ কালে পাঞ্জাবে এই প্রথার প্রচলন ছিল। গুপ্তযুগের সাহিত্য,‘রাজতরঙ্গিনী’, মঙ্গলকাব্য প্রভৃতিতেও এই প্রথার উল্লেখ আছে। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দিক থেকে সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে উদ্যোগ নেওয়া হয়। মুঘল যুগে হুমায়ুন, আকবর,ঔরঙ্গজেব প্রমুখ মুঘল সম্রাট এই প্রথা বন্ধের চেষ্টা করেন।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে সতীদাহপ্রথা বিরোধী প্রচেষ্টা:


উনিশ শতকের প্রথমার্ধ থেকে সতীদাহ প্রথাবিরোধী প্রচেষ্টার কিছু কিছু উদ্যোগ দেখা যায়—

[i] কেরির অভিজ্ঞতা: ইংল্যান্ড থেকে ভারতে আগত ব্যাপটিস্ট মিশনারি উইলিয়াম কেরি ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে একটি হিন্দু নারীর সতীদাহ বা সহমরণের জ্বলন্ত দৃশ্য দেখে কম্পিত হয়ে ওঠেন। তিনি স্থির করেন যে, এই প্রথা বন্ধের লক্ষ্যে তিনি প্রয়াস চালিয়ে যাবেন। উইলিয়াম কেরি ও তার দুই সহযোগী মার্শম্যান ও উইলিয়াম ওয়ার্ড ব্রিটিশ প্রশাসনের উপরের স্তরে ঘুরে ঘুরে সতীদাহপ্রথা বন্ধের বিষয়ে আর্জি জানাতে থাকেন। তারা সতীদাহপ্রথার নিষ্ঠুরতা সবিস্তারে লিখে এই প্রথা বন্ধের অনুরোধ করে গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলির কাছে আর্জি জানান। কিন্তু তাদের উদ্যোগ সফল হয়নি।

[ii] সরকারি নির্দেশিকা: সতীদাহপ্রথা জোর করে বন্ধ করার জন্য সরকার ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে পুলিশদের নির্দেশ দেয়। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে একটি নির্দেশে বলা হয় যে, পুলিশকে যেন সতীদাহের খবর দেওয়া হয়।

[iii] পুস্তিকা প্রকাশ: সতীদাহপ্রথার বিরোধিতা করে কেরি ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে একটি বই প্রকাশ করেন। কিন্তু এই উদ্যোগ সত্ত্বেও বাংলায় সতীদাহপ্রথার প্রকোপ বেড়ে চলে।

রামমোহন রায়ের উদ্যোগে সতীদাহপ্রথা-বিরোধী আন্দোলন:


উনিশ শতকে সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো ও সাফল্যমণ্ডিত আন্দোলন গড়ে তোলেন রাজা রামমোহন রায়।

[i] সূত্রপাত: রামমোহন রায় ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূত্রপাত করেন| শ্মশানে ঘুরে ঘুরে তিনি মৃতের বাড়ির লোকজনকে এই কুপ্রথার বিরুদ্ধে বোঝানোর চেষ্টা চালিয়ে যান। তার প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম সমাজের সদস্যরাও এ কাজে তাকে সহায়তা করেন।

[ii] পুস্তিকা প্রকাশ: রামমোহন সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে ‘সহমরণ বিষয় প্রবর্তক ও নিবকের সম্বাদ’ নামে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। তিনি ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। তিনি হিন্দুশাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন যে, শাস্ত্রে কোথাও সতীদাহের কথা নেই ।

[iii] আবেদন: রামমোহন ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে সতীদাহপ্রথার অবসানের দাবি করে ভারতের বড়োলার্ট লর্ড বেন্টিঙ্ককে আবেদন করেন। কিন্তু চার্লস মেটকাফ তখন বেন্টিঙ্ককে বোঝান যে, সতীদাহপ্রথা বন্ধ করলে ভারতীয়রা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে।

[iv] আইন পাস: লর্ড বেন্টিঙ্ক ভারতীয়দের বিদ্রোহের ভয় থেকে বিধবাদের দুর্বিষহ জীবন নিয়ে বেশি ভাবিত ছিলেন। তাই তিনি রামমোহনের আবেদনে সাড়া দিয়ে ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আইন জারি করেন এবং সতীদাহের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা করেন।

উপসংহার: সতীদাহপ্রথা নিষিদ্ধ আইন বাংলা ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রদেশেও প্রসারিত হয়। কিন্তু এই আইনের বিরুদ্ধে কয়েক হাজার হিন্দু সরকারকে জানায়। যে, সরকার তাদের ধর্মীয় প্রথায় হস্তক্ষেপ করেছে। কিন্তু লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিল আইনটিকে বহাল রাখে।

Rlearn Education