নবম শ্রেণীর ভৌতবিজ্ঞান | পৃষ্ঠটান
পৃষ্ঠটানের ধারণা :
তরল পদার্থের একটি বিশেষ ধর্ম হল যে, যেকোনো তরল পদার্থের তরলের অনুগুলির পারস্পরিক আকর্ষণ অর্থাৎ সংসক্তির (cohesive force) জন্য তরলের মুক্ত পৃষ্ঠে একটা টান ক্রিয়া করে—যার জন্য তরল তার মুক্তপৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল সর্বদা কমানোর চেষ্টা করে। তরলে মুক্তপৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল সংকোচনের এই প্রবণতাকে পৃষ্টটান বলে।
সুতরাং, তরলের পৃষ্ঠ সর্বদাই টান দেওয়া রবারের পর্দার মতো আচরণ করে এবং সংকুচিত হবার চেষ্টা করে।
পৃষ্ঠটানের পরিমাপ :

চিত্রানুসারে কোনো তরলের মুক্তপৃষ্ঠের ওপর একটি রেখা AB কে কল্পনা করো। তরলপৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল সংকোচনের প্রবণতার জন্য AB রেখার একদিকের অণুগুলি অন্য দিকের অণুগুলি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরে সরে যেতে চায়। ফলে P অংশ Q অংশের ওপর এবং Q অংশ P অংশের ওপর সমপরিমাণ বল AB রেখার সঙ্গে লম্বভাবে পৃষ্ঠ তলের স্পর্শক বরাবর প্রয়োগ করে। AB রেখার প্রতি একক দৈর্ঘ্যে প্রযুক্ত এই প্রকার বলের পরিমাণই হল তরলের পৃষ্ঠ টান।
যদি কাল্পনিক রেখার দৈর্ঘ্য = l হয় এবং ক্রিয়াশীল বলের মান = F হয়, তবে পৃষ্ঠাটান (S) = F/l
এখন যদি l = 1 হয় তবে S= F.
সংজ্ঞা : তরলের মুক্তপৃষ্ঠে একটি কাল্পনিক রেখার প্রতি একক দৈর্ঘ্যে ওই রেখার সঙ্গে লম্বভাবে পৃষ্ঠতলের স্পর্শক বরাবর এবং রেখার উভয় পাশে যে বল ক্রিয়া করে তাকে ওই তরলের পৃষ্ঠটান বলা হয়।
পৃষ্ঠ টানের একক :
CGS পদ্ধতিতে একক = ডাইন / সেমি
SI পদ্ধতিতে একক = নিউটন / মিটার |
পৃষ্ঠটানের মাত্রা : পৃষ্ঠ টান = MT-2
পৃষ্ঠটান সম্পর্কিত কয়েকটি উদাহরণ :
[1] জলের উপর দিয়ে হাল্কা কীটপতঙ্গ (যেমন- মশা, মাকড়সা ইত্যাদি) হেঁটে চলাচল করে।
লক্ষ্য করলে দেখা যায়, যেসব জায়গায় এদের পা জলের উপরে আছে, সেই স্থান গুলিতে জলের তল কিছুটা অবনমিত হয়, অর্থাৎ জলের পৃষ্ঠ, টান দেওয়া রবারের পর্দার মতো আচরণ করে। পৃষ্ঠটানের জন্যই এটা সম্ভব।
[2] বৃষ্টির জলের ফোঁটা গোলাকার কেন ?
বৃষ্টির জলের ফোঁটা গোলাকার হয়। কোনো নির্দিষ্ট আয়তনে গোলাকার পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল সর্বনিম্ন। জলবিন্দু বা বৃষ্টির জলের ফোঁটা এই পৃষ্ঠটানজনিত বলের জন্য সবসময় তাদের মুক্ত পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল সঙ্কুচিত করতে চায় বলেই জলবিন্দু বা বৃষ্টির জলের ফোঁটা গোলাকার হয়। তবে অভিকর্ষের প্রভাবে বড়ো জলের ফোঁটা একটু চ্যাপ্টা হয়
[3] জলের উপর দাড়ি কাটার ব্লেডের ভাসন এবং তার ব্যাখ্যা :
দাড়ি কাটার ব্লেড জলে ভাসার সময় ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যাবে যে,ব্লেডের নীচের জলতলটি সামান্য নেমে গেছে। জলের পৃষ্ঠটান জল-ব্লেডের স্পর্শতল বরাবর স্পর্শক- ভাবে ক্রিয়া করে। ব্লেডের সঙ্গে জলের সংস্পৰ্শ তলে প্রযুক্ত পৃষ্ঠটানজনিত বলের লব্ধি ওপরের দিকে ক্রিয়া করে এবং ব্লেডের ওজনকে প্রতিমিত করায় ব্লেড জলে
ভাসে।
[4] জলের উপর এক ফোঁটা তেল ফেললে তা জলের উপর ছড়িয়ে পড়ে।
কারণ : তেল অপেক্ষা জলের পৃষ্ঠটান বেশি এবং এই টানের ফলেই তেল জলের উপর ছড়িয়ে পড়ে। অন্যভাবে বলা যায় যে, তেল ও জল অণুগুলির মধ্যে ক্রিয়াশীল অসামঞ্জস্য বল; তেল অণুগুলির মধ্যে ক্রিয়াশীল সংসক্তি বল অপেক্ষা বেশি হয়। তাই তেল জলের উপর ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তেলের উপর এক ফোঁটা জল ফেললে সেটি সংকুচিত হয়ে যায়। কারণ জল অণুগুলির মধ্যে ক্রিয়াশীল সৎসক্তি বল, তেল ও জলের মধ্যে ক্রিয়াশীল আসান বল অপেক্ষা বেশি হয়।
[5] এক টুকরো কর্পূর জলে ফেললে তা এলোমেলোভাবে জলের উপর নড়াচড়া করে।
কর্পূর জলে দ্রবীভূত হলে জলের পৃষ্ঠটান কমে যায়। কর্পূরের অনিয়মিত আকারের জন্য এর বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন পরিমাণে দ্রবীভূত হয়। ফলে বিভিন্ন স্থানে পৃষ্ঠটানের হ্রাসও বিভিন্ন হয়। এরফলে কর্পূরের টুকরোর উপর বিভিন্ন দিক থেকে অসম টান ক্রিয়া করে এবং টুকরোটি এলোমেলোভাবে নড়াচড়া করে।
[6] প্রাচীনকালে ঝড়ের সময় সমুদ্রের ঢেউকে শান্ত করতে নাবিকেরা সুমদ্রের উপর তেল ঢেলে দিত।
তৈলাক্ত জল অপেক্ষা বিশুদ্ধ জলের পৃষ্ঠটান বেশি। বাতাসের অভিমুখে তেল অগ্রসর হলে ঢেউয়ের সামনের দিকে পৃষ্ঠটান কম এবং পিছন দিকে বিশুদ্ধ জলের পৃষ্ঠটান বেশি হয়। পিছনের এই পৃষ্ঠটান ঢেউকে খুব বেশি উঁচু হতে বাধা দেয়।