উপসর্গ ও অনুসর্গ : বাংলা ব্যাকরণ

উপসর্গ বা আদ্যপ্রত্যয় হলো ভাষায় ব্যবহৃত কিছু অব্যয়সূচক শব্দাংশ যাদের নিজস্ব কোনো “অর্থ নেই, কিন্তু অর্থের দ্যোতনা তৈরির ক্ষমতা আছে”। উপসর্গ শব্দ বা শব্দমূলের শুরুতে বসে নতুন অর্থবহ শব্দ তৈরি করে, শব্দাংশের শুরুতে বসে না। উপসর্গ যুক্ত হলে কোনো শব্দের বিপরীত শব্দ তৈরি হয় অথবা অর্থের উৎকর্ষ বা সংকোচন হয়। ইংরেজিতে উপসর্গকে (suffix) বলে। উপসর্গ বদ্ধ রূপমূল (bound morpheme)

উপসর্গের প্রকারভেদ:

বাংলা ব্যাকরণে সংস্কৃত, বাংলা ও বিদেশী উপসর্গের বিচারে, উপসর্গ ৩ প্রকার।

এই উপসর্গগুলো হলো-

ক) তৎসম বা সংস্কৃত উপসর্গ,

খ) বাংলা উপসর্গ, ও

গ) বিদেশি উপসর্গ।


ক) তৎসম বা সংস্কৃত উপসর্গ

বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত সংস্কৃত উপসর্গ বিশটি; যথা- প্র, প্ররা, অপ, সম্‌, নি, অব, অনু, নির্‌, দুর্‌, বি, অধি, সু, উৎ, পরি, প্রতি, অভি, অতি, অপি, উপ, আ।

সংস্কৃত উপসর্গ একমাত্র ধাতুর অর্থাৎ ক্রিয়ার মূলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ গঠন করে । যেমন —

প্র – প্রখ্যাত, প্রশংসা, প্রগতি, প্রকাশ, প্রখর ইত্যাদি ।

পরা – পরাজয়, পরাক্রান্ত, পরামর্শ, পরাক্রম, পরাজিত ইত্যাদি ।

অপ – অপকর্ম, অপঘাত, অপচয়, অপহরণ, অপবাদ ইত্যাদি ।

সম্ – সমাদর, সংস্কার, সংগত, সংকলন, সংস্কৃত ইত্যাদি ।

নি – নিগ্রহ, নিয়োগ, নিহত, নিবাস, নিদান ইত্যাদি ।

অব – অবনতি, অবসর, অবসাদ, অবকাশ, অবগত ইত্যাদি ।

অনু – অনুতাপ, অনুগত, অনুমান, অনুভব, অনুরোধ ইত্যাদি ।

নিঃ – নির্ণয়, নির্গমন, নির্দেশ, নির্গত, নির্দয় ইত্যাদি ।

দুঃ – দুর্গম, দুর্মূল্য, দুর্ভিক্ষ, দুর্বল, দুর্লভ ইত্যাদি ।

বি – বিজয়, বিজ্ঞান, বিভাগ, বিখ্যাত, বিবাদ ইত্যাদি ।

অধি – অধিগ্রহণ, অধিকার, অভিযোগ, অধীন, অধিষ্ঠান ইত্যাদি ।

সু – সুকৃতি, সুধন্য, সুগম, সুলভ সুবোধ ইত্যাদি ।
উৎ (উদ) – উন্নতি, উৎকণ্ঠ, উচ্ছ্বাস, উদ্ধার, উল্লাস ইত্যাদি ।

পরি – পরিপূর্ণ, পরিপন্থী, পরিচয়, পরিশ্রম, পরিষ্কার ইদ্যাদি ।

প্রতি – প্রতিবাদ, প্রতিধ্বনি, প্রতিদান, প্রতিঘাট, প্রতিকার ইত্যাদি ।

অভি – অভিজ্ঞ, অভিশাপ, অভিযোগ, অভিযান, অভিজাত ইত্যাদি ।

অতি – অত্যাচার, অত্যধিক, অতিশয়, অতিভোজন, অতিরিক্ত ইত্যাদি ।

অপি – অপিনিহিতি, অপিধান ইত্যাদি ।

উপ – উপস্থিত, উপকার, উপভোগ, উপহার, উপনীত ইত্যাদি ।

আ – আকাঙ্ক্ষা, আবেগ, আবাস, আরক্ত, আমরণ আকণ্ঠ ইত্যাদি ।

খ) খাঁটি বাংলা উপসর্গ

বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত খাঁটি বাংলা উপসর্গ একুশটি; যথা- অ, অঘা, অজ, অনা, আ, আড়্‌, আন্‌, আব্‌, ইতি, উন্‌ (উনু, উনা), কদ্‌, কু, নি, পাতি, বি, ভর, রাম, স, সা, সু, হা।

বাংলা উপসর্গ যেকোনো বিশেষ্য বা বিশেষণ পদের পূর্বে যুক্ত হয়ে নতুন নতুন শব্দ তৈরি করে । যেমন—

অ – অচেনা, অজানা, অকাজ, অবেলা, অফুরন্ত ইত্যাদি ।

আ – আচমকা, আকাল, আগাছা, আকাট ইত্যাদি ।

অনা – অনাবৃষ্টি, অনামুখ, অনাদর, অনাচার ইত্যাদি ।

কু – কুদৃষ্টি, কুকাজ, কুজন, কুসঙ্গ, কুকথা ইত্যাদি ।

সু – সুজন, সুন্দর, সুখবর, সুনজর ইত্যাদি ।

না – নারাজ, নামঞ্জুর, নাবালক ইত্যাদি ।

নি – নিখরচা, নিটোল, নির্জলা ইত্যাদি ।

বি – বিপদ, বিপথ, বিদেশ, বিজাত ইত্যাদি ।

পাতি – পাতিলেবু, পাতিহাঁস ইত্যাদি ।

হা – হাঘরে, হাহুতাশ, হাভাতে ইত্যাদি ।

ভর – ভরপেট, ভরদুপুর, ভরসন্ধে ইত্যাদি ।

রাম – রামদা, রামছাগল, রামধোলাই ইত্যাদি ।

গ) বিদেশী উপসর্গ

বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত বিদেশী উপসর্গের মধ্যে ফারসি ও ইংরেজি উপসর্গই বেশি দেখ যায়। কিছু উদাহরণ-

ফারসি উপসর্গের উদাহরণ- আম্‌, কার, খাস, সে (তিন), গর্‌, দর্‌, না (লা), নিম্‌, ফি, বর, ব, বদ্‌, বে, বাজে, হর্‌।

ইংরেজি উপসর্গের উদাহরণ- ফুল, সাব, হাফ, হেড।

গর – গরহাজির, গরহজম, গরমিল ইত্যাদি ।

ফি – ফিরোজ, ফিবছর, ফিহপ্তা, ফিসন ইত্যাদি ।

বদ – বদমেজাজ, বদহজম, বদনাম ইত্যাদি ।

বে – বেদখল, বেরসিক, বেনজির, বেকায়দা, বেইমান ইত্যাদি ।

হর – হরদিন, হররোজ, হরবোলা ইত্যাদি ।

নিম – নিমরাজি, নিমফুল ইত্যাদি ।

খাস – খাসমহল, খাসকামরা, খাসতালুক ইত্যাদি ।

হেড – হেডক্লার্ক, হেডমাস্টার, হেডপণ্ডিত ইত্যাদি ।

ফুল – ফুলমোজা, ফুলহাত, ফুলবাবু ইত্যাদি ।

হাফ – হাফহাতা, হাফপ্যান্ট, ইত্যাদি ।

আম – আমজনতা, আমদরবার ইত্যাদি ।

অনুসর্গ :
যে সব শব্দখণ্ড শব্দ বা ধাতুর আগে যুক্ত হয়ে ধাতু বা শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটায় তাকে বলে উপসর্গ। আর যে সকল শব্দ বা অব্যয় বাক্যের মধ্যে বিশেষ্য বা সর্বনামের পরে আলাদাভাবে বসে বিভক্তির কাজ করে তাকে বলা হয় অনুসর্গ। এদের অন্যান্য নাম পরসর্গ, কর্মপ্রবচনীয় (post position)।

প্রকারভেদ:
অনুসর্গ কোন পদের পরে বসে বাক্যের সাথে ওই পদকে সম্পর্কিত করতে পারে, তার প্রকৃতি বিচার করে ৩টি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।

১. বিশেষ্য অনুসর্গ : এই জাতীয় বিশেষ্য পদের পরে বসে। যেমন–
i) প্রাণের চেয়ে প্রিয়
ii ) ছাদের উপর খোলা আকাশ

২. সর্বনাম উপসর্গ : এই জাতীয় সর্বনাম পদের পরে বসে।

যেমন– i) আমার চেয়ে সে বড়। ii ) ওর কাছে বইটি আছে।

৩. বিশেষণ উপসর্গ : এই জাতীয় বিশেষণ পদের পরে বসে। যেমন–
i) মন্দের চেয়ে একটু ভালো

ii) খারাপের চেয়ে খারাপ

উপসর্গ আর অনুসর্গের পার্থক্য
ক. অনুসর্গ বিভক্তির মতো ব্যবহৃত হলেও, উপসর্গ বিভক্তির মতো ব্যবহৃত হয় না।
খ. উপসর্গ স্বাধীন পদ হিসেবে বাক্যে ব্যবহৃত হতে পারে না, অনুসর্গ কিন্তু বাক্যে পৃথকভাবে বসতে পারে।
গ. অনুসর্গের নিজস্ব অর্থ থাকলেও, উপসর্গের কোনো অর্থ নেই।
ঘ. অনুসর্গ শব্দের পরে পৃথকভাবে বসে আর উপসর্গ শব্দের সঙ্গে বিভক্তির মতো যুক্ত হয়ে বসে।

Rlearn Education