ভৌমজলের কার্য ও সংশ্লিষ্ট ভূমিরূপ: প্রথম পর্ব

উচ্চ মাধ্যমিক ভূগোল ( HS Geography) : ভৌমজলের কার্য ও সংশ্লিষ্ট ভূমিরূপ


আলোচ্য বিষয় :
ভৌমজল এর সংজ্ঞা
ভৌমজলের গুরুত্ব
ভৌমজলের নিয়ন্ত্রকসমূহ
ভৌমজলের উৎস
জলপীঠ বা ভৌমজলস্তরের বিবরণ |

ভৌমজল : ভূ-অভ্যন্তরে কিংবা মৃত্তিকা, রেগােলিথ এবং শিলারন্প্রে যে জল অবস্থান করে, তাকে ভৌমজল বলে। ভৌমজলের প্রধান উৎস হল বৃষ্টি ও তুষারগলা জল।

ভৌমজলের গুরুত্ব :


[1] পানীয় জলের উৎস : ভৌমজল মানুষের পানীয় জলের প্রধান উৎস। গভীর ও অগভীর নলকূপ, কুয়াে থেকে আমরা পানীয় জল সংগ্রহ করি। প্রস্রবণের মধ্য দিয়ে নির্গত ভৌমজলও পানীয় হিসেবে অনেক সময় ব্যবহৃত হয়।

[2] কৃষি ও শিল্পকর্মের প্রসার : বহু অঞ্চলে ভৌমজলের সঞ্চয় নির্ভর কৃষিকাজ ও শিল্পকাজ গড়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গের বহুস্থানে গভীর ও অগভীর নলকূপের মাধ্যমে ভৌমজল উত্তোলন করে বহুফসলি শস্যের উৎপাদন সম্ভব হয়েছে।

[3] ভূতাপ বিদ্যুৎ উৎপাদন : উয় প্রস্রবণ ও গিজারের উত্তপ্ত ভৌমজলকে কাজে লাগিয়ে ভূতাপ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হয়েছে।

[4] জনবসতি স্থাপন : প্রস্রবণ থেকে নির্গত ভৌমজল জনবসতি গড়ে উঠতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পশ্চিমবঙ্গে শুশুনিয়া পাহাড়ের পাদদেশ থেকে প্রাপ্ত প্রস্রবণের জল ওই স্থানে জনবসতি গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে।

[5] পদের প্রলোজনীষ্ম পানীয় জলের জোগান : চুনাপাথর অঞ্চলের ভূপৃষ্ঠ শুষ্ক প্রকৃতির। এই অঞ্চলের তৃণই প্রধান উদ্ভিদ। পশুপালনের জন্য প্রয়ােজনীয় পানীয় জল এই অঞ্চলে গঠিত ভৌমজলের ভাণ্ডার থেকে সংগ্রহ করা হয়।

[6] রোগ নিরাময় গুণ : চুনাপাথরযুক্ত অঞ্চলে উয় প্রস্রবণের জলে কিছু কিছু রােগ নিরাময়কারী উপাদান থাকে। তাই, ওইসব স্থানে মানুষের সমাগম বাড়ে।

[7] পর্যটন শিল্পের প্রসার : চুনাপাথরে গঠিত অঞ্চলে কিছু বিশেষ ধরনের ভূমিরূপ গঠিত হয় যা পর্যটকদের আকর্ষণ করে। ফলে ওই অঞ্চলে বা স্থানে পর্যটন শিল্প গড়ে ওঠে।

[8] মরূদ্যানের সৃষ্টি : মরু অঞ্চলে একটি নির্দিষ্ট স্থানে বায়ুর দ্বারা বালুকারাশি অপসারিত হলে ভৌমজলপীঠ উন্মুক্ত হয়। ফলে মরুদ্যান সৃষ্টি হয় যা মানুষের চাষের কাজে ও বসতি স্থাপনে সাহায্য করে।

[9] নদীর জলের উৎস : নিত্যবহ নদীর জলের একটি উৎস হল প্রস্রবণ।

[10] পানীয় প্রস্তুতের কাঁচামাল : নরম পানীয় প্রস্তুত করতে বা খনিজ জল তৈরিতে ভৌমজল কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

ভৌমজলের নিয়ন্ত্রক সমূহ :

বৃষ্টির জল বা তুষারগলা জল চুইয়ে ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে ভূত্বকের উপপৃষ্ঠীয় স্তর সম্পৃক্ত হয়ে সৃষ্টি হয় ভৌমজলস্তর। ভৌমজলের পরিমাণ নির্ধারিত হয় অনুস্রাবণের মাত্রার ওপর। অনুস্রাবণের মাত্রা কতকগুলি প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রক ও মানুষের কার্যাবলির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এগুলি হল一

[1] বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও স্থায়িত্ব : বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও বণ্টনের প্রকৃতির ওপর ভৌমজলের পরিমাণ অনেকাংশে নির্ভরশীল। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি হলে এবং তা বহুদিন ধরে হতে থাকলে অনুস্রাবণের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। ফলে, ভৌমজলের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম হলে কিংবা অল্প সময় ধরে হলে অনুস্রাবণের মাত্রা কমে যায়। ফলে, ভৌমজলের সঞ্চয়ও কম হয়। শুষ্ক অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম এবং অল্প সময় ধরে বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে বলে ওই অঞ্চলে ভৌমজলের সঞ্চয়ও কম।

[2] শিলা বা মৃত্তিকার সচ্ছিদ্রতা ও প্রবেশ্যতা : শিলার খনিজ কণা ও মাটির কণা সংঘবদ্ধ ভাবে বিন্যস্ত হলেও এদের মধ্যে ফাক বা শূন্যস্থান থেকে যায়। ওই রন্ধ্র ছিদ্রপথ দিয়ে বায়ু, জল প্রভৃতি চলাচল করে। একটি নির্দিষ্ট আয়তন মৃত্তিকায় মােট মৃত্তিকা রন্দ্রের আয়তন ও মৃত্তিকার মােট আয়তনের অনুপাতকে সচ্ছিদ্রতা বলে। শিলার বা মৃত্তিকা রন্দ্রের ব্যাস বড়াে হলে জল সহজে ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে। রন্দ্রের মধ্য দিয়ে জলের চলাচল ক্ষমতাকে শিলা বা মৃত্তিকার প্রবেশ্যতা বলে। শিলা বা মৃত্তিকার সচ্ছিদ্রতা ও প্রবেশ্যতা ভৌমজল সঞ্জয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

[3] ভূমির ঢাল : ভূমির ঢাল বেশি হলে জল দ্রুত হারে নীচের দিকে গড়িয়ে যায়। ফলে ভূপৃষ্ঠের জল চুইয়ে মাটির নীচে বিশেষ প্রবেশ করতে পারে না। ভূমিরটাল কম হলে জল ধীরে ধীরে নীচের দিকে গড়িয়ে যায়। তাই এই অবস্থায় অনুস্রাবণের মাত্রা বাড়ে। ফলে ভূত্বকের উপপৃষ্ঠীয় স্তরে জলের সঞ্চয় বাড়ে।

[4] প্রবেশ্য শিলা স্তরের নীচে অপ্রবেশ্য শিলাস্তরের অবস্থান : প্রবেশ্য শিলার নীচে অপ্রবেশ্য শিলা অবস্থান করলে জলের নিম্নগামিতা বাধা পায়। ফলে অপ্রবেশ্য শিলার ওপর প্রবেশ্য শিলাস্তরে জল সঞ্চিত হয়ে ভৌমজলের সঞ্চয় বাড়ায়।

[5] বাষ্পীভবন : বাষ্পীভবনের মাত্রা বেশি হলে অনুস্রাবণের মাত্রা কমে। ফলে ভৌমজলের সঞ্চয়ও কমে। বাষ্পীভবনের মাত্রা কমলে ভৌমজলের পরিমাণ বাড়ে।

[6] ভূমি ব্যবহারের প্রকৃতি : কৃষিকাজের ফলে মাটি আলগা হয়, তাই অনুস্রাবণের মাত্রা বেড়ে যায় এবং ভৌমজলের সঞ্চয় বেশি হয়। শহর অঞ্চলে পাকা রাস্তা ও ঘরবাড়ির অবস্থানের জন্য জলের অনুপ্রবেশ ব্যাহত হয়। তাই, এই অঞ্চলে ভৌমজলের সঞ্চয় হয় না বললেই চলে।

ভৌমজলের উৎস :
[1] আবহিক জল : বায়ুমণ্ডলের জলীয়বাষ্প ঘনীভূত হয়ে ভূপৃষ্ঠে বৃষ্টি, তুষার প্রভৃতি রূপে নেমে আসার পর ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ভৌমজলের ভাণ্ডার গড়ে উঠলে তাকে আবহিক জল (Meteoric Water) বলে। আবহিক জলই ভৌমজলের প্রধান উৎস।

[2] সহজাত জল : জলে নিমজ্জিত পলির স্তুপ পাললিক শিলায় পরিণত হওয়ার সময় সমুদ্র বা হ্রদের কিছু পরিমাণ জল আবদ্ধ হয়ে পড়ে। একে সহজাত জল (Connate Water) বলে।

[3] উৎস্যন্দ জল : ম্যাগমার মধ্যে সঞ্চিত উত্তপ্ত ও খনিজ সমৃদ্ধ জল যখন অগ্ন্যুৎপাতের সময় ভূপৃষ্ঠে বেরিয়ে আসে, তখন তাকে উৎস্যন্দ জল (Juvenile Water) (‘উৎ’ শব্দের অর্থ ‘উত্থান’ এবং স্যন্দ শব্দের অর্থ ক্ষরণ) বলে।

[4] মহাসাগরীয় জল : অনেক সময় সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে সমুদ্রের জল শিলার মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে ভূ-অভ্যন্তরে ভৌমজলের সৃষ্টি করে। একে মহাসাগরীয় বা সামুদ্রিক জল (Oceanic Water) বলে।

জলপীঠ বা ভৌমজলস্তরের বিবরণ:
ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগ থেকে ভূ-অভ্যন্তরে অপ্রবেশ্য শিলাস্তর পর্যন্ত বিস্তৃত জলবাহী স্তরকে সম্পৃক্ততার ভিত্তিতে- [1] ফ্রিয়েটিক জলস্তর এবং [2] ভাদোস জলস্তরে ভাগ করা হয়।

ফ্রিয়েটিক জলস্তর :

ভূ-অভ্যন্তরে মৃত্তিকা ও প্রবেশ্য শিলান্তরের যে-অংশ জলে সম্পৃক্ত থাকে তাকে ফ্রিয়েটিক স্তর বলে। এই জলস্তর থেকে মানুষের তৈরি কূপে জল সঞ্চারিত হয় বলে এই স্তরকে ফ্রিয়েটিক জলস্তর বলে। জলপীঠের স্থায়িত্ব অনুযায়ী এই স্তরকে স্থায়ী সম্পৃক্ত স্তর এবং সাময়িক সম্পৃক্ত স্তরে ভাগ করা হয়।

[1] স্থায়ী সম্পৃক্ত স্তর : যে জলপীঠের নীচে জলবাহী স্তর সারাবছর সম্পৃক্ত অবস্থায় থাকে, এমনকি শুষ্ক ঋতুতেও জলস্তর জলপীঠের নীচে নামে না তাকে স্থায়ী সম্পৃক্ত স্তর (Zone of Permanent Saturation) বলে। এই স্তরের জলপীঠ অবনত ভূভাগে প্রকাশিত হলে হ্রদ, জলাশয় ইত্যাদি সৃষ্টি হয়।

[2] সাময়িক সম্পৃক্ত স্তর : বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের ফলে ভৌমজল স্তরে জলের সরবরাহ বেড়ে গেলে জলপীঠ ওপরের দিকে উঠে আসে। আবার শুষ্ক ঋতুতে জলপীঠ নীচে নেমে যায়। এইভাবে ওঠানামা সীমার মধ্যবর্তী অংশকে সাময়িক সম্পৃক্ত স্তর বা পরিবর্তনশীল সম্পৃক্ত স্তর বা সবিরাম সম্পৃক্ত স্তর (Periodic Saturated Zone) বলে। নলকূপটি সাময়িক স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত হলে শুষ্ক ঋতুতে নলকূপ থেকে জল পাওয়া যায় না।

ভাদোস জলস্তর :

ভূপৃষ্ঠ থেকে জলপীঠ পর্যন্ত বিস্তৃত উপপৃষ্ঠীয় স্তরের যে-অংশ কখনও সম্পৃক্ত হয় না, জল কেবলমাত্র ওই স্তরের মধ্য দিয়ে অভিকর্ষজ টানে নীচে সম্পৃক্ত স্তরে পৌঁছােয়, তাকে ভাদোস জলস্তর বলে। ভাদোস জলস্তর কখনও সম্পৃক্ত হয় না বলে একে অসম্পৃক্ত স্তর বলে। প্রকৃতিগত পার্থক্য অনুযায়ী ভাদোস স্তরকে তিনটি উপবিভাগে ভাগ করা হয়- মৃত্তিকা জলস্তর, কৈশিক স্তর এবং মধ্যবর্তী মৃত্তিকা বায়ুস্তর।

[1] মৃত্তিকা জলস্তর : এটি ভাদোস স্তরের একেবারে ওপরের অংশ। গাছের শিকড় মাটির নীচে যতদূর পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারে, সেই গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত ভাদোস স্তরকে মৃত্তিকা জলস্তর বলে।

[2] কৈশিক স্তর : মৃত্তিকারন্ধ্রগুলি সরু সরু নল দ্বারা পরস্পর যুক্ত থাকে। এদের কৈশিক নল বলে। মৃত্তিকার পৃষ্ঠটান বাড়লে ভৌমজল – পীঠ থেকে জল ওই নল বেয়ে ওপরের দিকে উঠে আসে এবং মাটির প্রতিটি কণাকে বেষ্টন করে তাদের গায়ে লেগে থাকে। একে কৈশিক জল বলে। এটি ভাদোস স্তরের সর্বনিম্ন অংশ।

[3] মধ্যবর্তী মৃত্তিকা বায়ুস্তর : মৃত্তিকা জলস্তর ও কৈশিক জলস্তরের মধ্যবর্তী অংশে এই স্তর বিস্তৃত। ভাদোস স্তরের এই অংশে জল ও মৃত্তিকার মধ্যে বায়ু আবদ্ধ অবস্থায় থাকে।

Rlearn Education