ভূমিরূপ গঠনকারী প্রক্রিয়াসমূহ: প্রথম পর্ব

উচ্চমাধ্যমিক ভূগোল (HS Geography): ভূমিরূপ গঠনকারী প্রক্রিয়াসমূহ


আলোচ্য বিষয় :
ভূমিরূপ গঠনকারী প্রক্রিয়া
পর্যায়ন কী ? বহির্জাত প্রক্রিয়ার পদ্ধতিগুলির আলােচনা
আরােহণ ও অবরােহণ পদ্ধতি সম্বন্ধে আলােচনা |


প্রশ্ন : ভূমিরূপ গঠনকারী প্রক্রিয়া বলতে কী বােঝ? পার্থিব প্রক্রিয়ার শ্রেণিবিভাগ করাে।

উত্তর : যেসকল পদ্ধতিতে ভৌত ও রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ভূমিরূপের পরিবর্তন ও বিবর্তন ঘটে থাকে, তাদের ভূমিরূপ গঠনকারী প্রক্রিয়া (Geomorphic Process) বলে। বিভিন্ন ভূতাত্বিক যুগে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বিভিন্ন ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়েছে। এই ভূমিরূপ গঠনকারী প্রক্রিয়াসমূহকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা一

[1] পার্থিব প্রক্রিয়া (Terrestrial Process),
[2] মহাজাগতিক প্রক্রিয়া (Extra-terrestrial Process),
[3] মনুষ্যজনিত প্রক্রিয়া (Man made Process) |

পার্থিব প্রক্রিয়ার শ্রেণিবিভাগ : পার্থিব প্রক্রিয়া ভূমিরূপ সৃষ্টিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে। পার্থিব প্রক্রিয়াকে পুনরায় দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

[1] অন্তর্জাত প্রক্রিয়া: পৃথিবীর অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধরনের অর্ধতরল পদার্থ রয়েছে। মূলত চাপ ও তাপের কারণে এসব পদার্থের ভৌত ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে ভূঅভ্যন্তর থেকে এক অন্তর্জাত শক্তির সৃষ্টি হয় (Endogenic Force)। তার প্রভাব ভূত্বকের ওপর পড়ে এবং বিভিন্ন পদ্ধতিতে আকস্মিক বা ধীর ভাবে ভূত্বকের পরিবর্তন ঘটায়। এসব পদ্ধতিকে একত্রে অন্তর্জাত প্রক্রিয়া বা Endogenic Process বলে।

অন্তর্জাত প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য: (১) অন্তর্জাত প্রক্রিয়া ভূত্বকে আকস্মিক বা ধীর দুভাবে কাজ করে থাকে। (২) অন্তর্জাত প্রক্রিয়ার ফল হল ভূসংক্ষোভ বা ভূবিপর্যয়। (৩) অন্তর্জাত প্রক্রিয়া মূলত পৃথিবী গঠনকারী বিভিন্ন উপাদান যেমন -ইউরেনিয়াম, থােরিয়াম প্রভৃতি তেজস্ক্রিয় মৌলিক পদার্থের দ্বারা ঘটে। (৪) গুরুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তরে পরিচলন স্রোত এবং ভূ-অভ্যন্তরস্থ শিলার সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া হয়ে থাকে।


[2] বহির্জাত প্রক্রিয়া: আবহবিকার, নদী, হিমবাহ, ভৌমজল প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তিসমূহ ভূপৃষ্ঠে অথবা ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি উপপৃষ্ঠীয় অংশকে সর্বদা ক্ষয়, পরিবহণ ও সঞ্চয় কাজের দ্বারা নগ্ন করে দিচ্ছে, ফলে ভূপৃষ্ঠে নানা ধরনের ভূমিরূপ গড়ে উঠেছে। প্রাকৃতিক শক্তির দ্বারা ভূপৃষ্ঠ কিংবা উপপৃষ্ঠীয় অংশের নগ্নীভবন পদ্ধতিকে বহির্জাত প্রক্রিয়া বা Exogenic Process বলা হয়।

বহির্জাত প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য: (১) এটি একটি অত্যন্ত ধীর প্রক্রিয়া। (২) এই প্রক্রিয়াগুলি অন্তর্জাত প্রক্রিয়াজনিত ভূমিরূপের ওপর কাজ করে ছােটো ছােটো ভূমিরূপ গড়ে তােলে। (৩) এই প্রক্রিয়াগুলির প্রয়ােজনীয় শক্তি মূলত বায়ুমণ্ডল ও সূর্য থেকে আসে। (৪) ভূগাঠনিক ক্রিয়ায় সৃষ্ট ভূমির ঢাল (Slope of gradient) থেকেও এই প্রক্রিয়া শক্তি পেয়ে থাকে।

প্রশ্ন : পর্যায়ন কী? বহির্জাত প্রক্রিয়ার পদ্ধতিগুলি আলােচনা করাে।

উত্তর : 1876 খ্রিস্টাব্দে G. K. Gilbert সর্বপ্রথম ‘Grade’ শব্দটি ব্যবহার করেন।

চেম্বারলিন (Chamberlin) ও স্যালিসবারি (Salisbury)-এর মতে পর্যায়ন বলতে বহির্জাত প্রক্রিয়াসমূহের সম্মিলিত ক্ষয় ও সঞ্চয় কাজের মাধ্যমে উঁচুনীচু ভূভাগকে অর্থাৎ ভূমির উপরিভাগের অনিয়মিত রূপরেখাকে (Surface Irregularities) একটি সাধারণ তল বা পৃষ্ঠে (Common level) নিয়ে আসাকে বােঝায়। এখানে সাধারণ তল বা পৃষ্ঠ বলতে ক্ষয়ের শেষ সীমাকে (Base level of Erosion) বোঝায়।

সুতরাং ক্ষয়ের শেষ সীমার সাপেক্ষে ভূপৃষ্ঠের সমতলীকরণ হল পর্যায়ন। মূলত অবরােহণ (Degradation) ও আরােহণ (Aggradation) প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই ভূমিভাগের পর্যায়ন ঘটে থাকে। এই দুই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী প্রধান এজেন্টগুলি হল নদী, বায়ু, হিমবাহ, সমুদ্রতরঙ্গ, ভৌমজল প্রবাহ, ভর সঞ্চলন প্রভৃতি। তবে কিছু জৈবিক প্রক্রিয়া ও আবহবিকার ক্ষয় ও সঞ্চয়কাজে সাহায্য করে।

বহির্জাত প্রক্রিয়ার পদ্ধতিসমূহ :

[1] ক্ষসাধন বা অবরােহণ প্রক্রিয়া: আবহবিকার, ভর-অপচয় বা পুঞ্জিত ক্ষয় (Mass Wasting), ক্ষয়ীভবন, নগ্নীভবন, নদী, হিমবাহ, বায়ুপ্রবাহ প্রভৃতি ভূত্বকের বাইরের প্রক্রিয়াসমূহ ভূপৃষ্ঠের উঁচু স্থানসমূহকে ক্রমাগত ক্ষয় করে এবং সমতল ভূমিতে পরিণত করে নতুন ভূমিরূপ গঠন করে। একে অবরােহণ প্রক্রিয়া বলে।

[2] আরােহণ বা স্তূপীকরণ প্রক্রিয়া: নদী, হিমবাহ, বায়ুপ্রবাহ, ভৌমজল, সমুদ্রস্রোত, সমুদ্রতরঙ্গ প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তির সঞ্চয়কার্যের ফলে নতুন নতুন ভূমিরূপ গঠিত হয়। একে আরােহণ বা স্তূপীকরণ প্রক্রিয়া বলে।

[3] জৈবিক প্রক্রিয়া : বিভিন্ন উদ্ভিদ এবং প্রাণী ক্ষয় ও সঞয়কার্যের মাধ্যমে ভূমিরূপের যে পরিবর্তন ঘটায়, তাকে জৈবিক প্রক্রিয়া বলে।

প্রশ্ন : আরোহণ ও অবরোহন কাকে বলে ? এদের সংক্ষেপে আলোচনা করো |

উত্তর :

আরােহণ (Aggradation):
যে প্রক্রিয়ায় নদীর ক্ষয়জাত ও পরিবাহিত সমস্ত পদার্থের পুঞ্জীভবন (Accumulation) ও সঞ্চয় (Deposition) ঘটে থাকে তাকে নদীর আরােহণ (Aggradation) বলে।

কারণ : নদীর আরােহণ ঘটে থাকে নদীর বিস্তৃত মৃদু ঢাল অংশে এবং প্লাবনভূমিতে ঢাল খুব কম হওয়ায় বােঝা অপসারণের হার অপেক্ষা পলি দ্রুত নদীগর্ভে থিতিয়ে পড়ে। কোনাে কারণে নদীতে বােঝার পরিমাণ বেড়ে গেলে নদীর বােঝা বহনক্ষমতা কমে যায়। তখন নদীগর্ভে পলি সঞ্চিত হয়। নদীবক্ষ ভরাট হতে হতে অনেক চর-এর সৃষ্টি হয়। তখন নদীর জল অনেকগুলি শাখায় ভাগ হয়ে বিভিন্ন খাতে বইতে থাকে, যাকে নদীর প্রতিসারী প্রবাহ (Divergent Flow) বলা হয়। এর ফলে নদীর বহনক্ষমতা আরও কমে যায় ও সঞ্চয় প্রক্রিয়া ঘটে থাকে।

ফলাফল : ভূমির ঢাল হ্রাস পায় ও সমভূমি গঠিত হয় বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়জাত ভূমিরূপ যেমন দ্বীপ, পলিগঠিত শঙ্কু, স্বাভাবিক বাঁধ, প্লাবনভূমি ইত্যাদি গড়ে ওঠে।

অবরােহণ (Degradation):
বহির্জাত প্রক্রিয়াসমূহের মধ্যে যেসব প্রক্রিয়া ভূপৃষ্ঠের উঁচু স্থানগুলিকে নগ্ন করার (Denudate) মাধ্যমে নিম্ন ক্ষয়ের শেষ সীমায় নিয়ে আসে অর্থাৎ ভূমিভাগের উচ্চতার হ্রাস ঘটায় তাকে অবরােহণ (Degradation) বলে। আবহবিকার, ভর অপসারণ বা পুঞ্জিত স্খলন (Mass Wasting) ও ক্ষয়সাধন—অবরােহণে প্রধান ভূমিকা পালন করে। তবে নদীর ক্ষয়কাজের ফলে অবরােহণ সবচেয়ে বেশি হয়। তাই অবরােহণ বলতে সাধারণত নদীর ক্ষয়কাজকে বােঝায়। নদী যান্ত্রিক (ঘর্ষণ, অবঘর্ষ, লম্ফদান) ও রাসায়নিক (দ্রবণ) প্রক্রিয়ায় ক্ষয় করে থাকে।

কারণ : অবরােহণের মাত্রা নির্ভর করে নদীর শক্তির (Energy) ওপর ও ভর সঞলনের পরিমাণের ওপর। আবহবিকার এই প্রক্রিয়াগুলিকে পরােক্ষভাবে সাহায্য করে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, তাপমাত্রার হ্রাসবৃদ্ধি, উচ্চতা, ভূমির ঢাল, শিলার ধরন, মাটির প্রকৃতি, উদ্ভিদ আচ্ছাদনের পরিমাণ, অববাহিকার, ভূ-আলােড়নজনিত উত্থান এবং বর্তমানে প্রবলভাবে মানুষের প্রভাব ইত্যাদি প্রধান নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে।

ফলাফল বা প্রভাব : ভূমির উত্তল ও অবতল ঢাল তৈরি হয়, ঢালের পশ্চাৎ অপসারণ ঘটে এবং এর মান বেড়ে যায়। বিভিন্ন প্রকার ক্ষয়জাত ভূমিরূপ তৈরি হয়। ভূপৃষ্ঠের উঁচুনীচু অবস্থা ক্রমশ মসৃণতা লাভ করে।

Rlearn Education