বর্জ্য ব্যবস্থাপনা : পরিবেশবিদ্যা | Environment Science

Content Topic :

1. বর্জ্য -এর ধারণা (Concept of waste ) |

2. বর্জ্য -এর বৈশিষ্ট্য (Charactersitics of Waste ) |

3. বর্জ্য -এর শ্রেণিবিভাগ (Classification of waste ) |

4. পরিবেশের উপর বর্জ্যের প্রভাব ( Effects of waste on Environment ) |

5. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (waste Management) |

6. বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি (Processes of waste Management ) |

পরিবেশ বিজ্ঞান |Environment Science

বর্জ্য -এর ধারণা (Concept of waste ) :

যে সমস্ত কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় উপাদানের উৎপাদক বা ব্যবহারকারীর কাছে কোন প্রয়োজন থাকে না কিংবা যেগুলিকে ব্যবহার করা যায় না, তাকে বর্জ্য বলে |

বর্জ্য -এর বৈশিষ্ট্য (Charactersitics of Waste ) :

  • বর্জ্য পদার্থের প্রভাবে পরিবেশ দূষণের সঙ্গে সঙ্গে বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য নষ্ট হয় ৷
  • বজ্যপদার্থ পরিবেশের ক্ষতিকারক হলেও উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অনেক বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করা সম্ভব |
  • বর্জ্য পদার্থ মূলত কঠিন , তরল ও গাসীয় – এই তিন ধরনের হয় |

বর্জ্য -এর শ্রেণিবিভাগ (Classification of waste ) :

A. অবস্থার ভিত্তিতে বর্জ্য পদার্থ :

[1]কঠিন বর্জ্য : যে সব বর্জা পদার্থ কঠিন বা সহজে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না, তাকে কঠিন বর্জ্য বলে | যেমন- শক্তিকেন্দ্র থেকে উড়ন্ত ছাই, খনি থেকে বিভিন্ন পদার্থ, কাগজ, কাঠ, কাঁচ, বিভিন্ন প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য ইত্যাদি |

[2]তরল বর্জ্য: যে সকল পরিত্যক্ত বা অবাঞ্ছিত তরল পদার্থ পরিবেশের ক্ষতিসাধন করে তাকে তরল বর্জ্য বলে। তরল বর্জ্য জলাশয়ে ইউট্রোফিকেশন প্রক্রিয়া সংঘটনে সাহায্য করে।
উদাহরণ: জলে ভাসমান পলিমাটির কলয়েড, শৌচালয়ের নোংরা জল, কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে ব্যবহৃত রাসায়নিক মিশ্রিত দূষিত জল, ডিটারজেন্ট মিশ্রিত নোংরা জল, খনিজ তেল, গ্রিজ, চর্বি আলকাতরা ইত্যাদি।

[3] গ্যাসীয় বর্জ্য: যে সকল গ্যাসীয় বা বায়বীয় উপাদান বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক উৎস থেকে সৃষ্টি হয়ে পরিবেশের অবনমন ঘটায় তাকে গ্যাসীয় বর্জ্য বলে।
উদাহরণ: কলকারখানা ও যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া, গ্যাস, অগ্ন্যুৎপাতজনিত নির্গত গ্যাস দাবানল থেকে উৎপন্ন গ্যাস ইত্যাদি।

B. বিষক্রিয়ার ভিত্তিতে বর্জ্য পদার্থ :

[1] বিষাক্ত বর্জ্য: যে সমস্ত বর্জ্য জীবদেহের ক্ষতিসাধন করে অর্থাৎ পরিবেশে বিষক্রিয়া ঘটায় তাকে বিষাক্ত বর্জ্য বলে।
উদাহরণ: সিসা, জিঙ্ক, আর্সেনিক, DDT, BHC, ALDRIN ইত্যাদি হল বিষাক্ত বর্জ্য।

[2] বিষহীন বর্জ্য: যে সমস্ত বর্জ্য পদার্থ পরিবেশ বা জীবজগতের ওপর বিষক্রিয়া ঘটায় না তাকে বিষহীন বর্জ্য বলে। জৈব্য অবশিষ্টাংশ এবং জীবদেহ নির্গত এই সমস্ত বর্জ্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৃত্তিকার উর্বরতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
উদাহরণ: গৃহস্থালির বিভিন্ন সবজি ও ফলের খোসা, গাছের পাতা, গৃহপালিত প্রাণীদের বিষ্ঠা ইত্যাদি।

C. উৎসের ভিত্তিতে বর্জ্য পদার্থ

[1] গৃহস্থালির বর্জ্য: গৃহস্থালির কাজে ব্যবহারের পর যেসব বর্জ্য পদার্থ আশে পাশে নিক্ষেপ হয় তাকে গৃহস্থালির বর্জ্য বলে। পরিবেশে যাবতীয় বর্জ্যের মধ্যে গৃহস্থালির বর্জ্যের পরিমাণ সর্বাধিক হয়।

উদাহরণ: খাবারের অবশেষ, রান্নাঘরের আবর্জনা, শাক-সবজি ও ফলমুলের অব্যবহৃত অংশ, কাগজ, কার্ডবোর্ড, প্লাস্টিক, জামাকাপড় ইত্যাদি।
[2]শিল্প বর্জ্য: বিভিন্ন শিল্প কারখানা থেকে নির্গত বর্জ্যকে বলা হয় শিল্পজাত বর্জ্য। এই প্রকার বর্জ্য কারখানা থেকে কঠিন, তরল, গ্যাসীয় আকারে নির্গত হয়। এগুলি বিষাক্ত, অবিষাক্ত কিংবা জৈব বা অজৈব হিসাবে পরিবেশে মিশ্রিত হয়।লৌহ ইস্পাত শিল্প থেকে নির্গত স্ল্যাগ, ও ধূলিকণা; রাসায়নিক শিল্প থেকে নির্গত বিষাক্ত বর্জ্যা, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত ‘ফ্লাই অ্যাস, বিভিন্ন শিল্প থেকে নির্গত পারদ, সীসা, আর্সেনিক, ইত্যাদি।

[3]কৃষিজ বর্জ্য : কৃষিজ ফসল তোলা বা সংগ্রহের পর অবশিষ্টাংশ কঠিন ও তরল বর্জ্য পদার্থসমূহকে কৃষিজ বর্জ্য বলে। এই প্রকার বর্জ্য মূলত স্বল্প সময়ে বিয়োজিত হয়ে যায়। তবে এই প্রকার বর্জ্য অপেক্ষাকৃত কম পরিবেশ দূষণ (রাসায়নিক দ্রব্য ব্যতীত) ঘটায়।
উদাহরণ: খড়, ধানের তুষ, আখেড় ছিবড়া, গৃহপালিত প্রাণীর বিষ্ঠা, কৃষিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার, কীটনাশক ইত্যাদি|

[4] পৌরসভার বর্জ্য: শহর, নগর ও বিভিন্ন পৌর এলাকায় সংগৃহীত বর্জ্য পদার্থকে বলা হয় পৌরসভার বর্জ্য।গ্রামের থেকে পৌরসভার গৃহস্থালির বর্জ্যের পরিমাণ অনেক বেশি হয়। ভারতীয় শহরে গড়ে 500 গ্রাম/জন বর্জ্যের সৃষ্টি হয়ে থাকে।
উদাহরণ: পৌর অঞ্চলের গৃহস্থালির বর্জ্য, নির্মাণ কাজ ও তার ধ্বংসপ্রাপ্ত বর্জ্য, পয়ঃ- প্রনালীর বর্জ্য, রাস্তার বর্জ্য ইত্যাদি।
[5] চিকিৎসা সংক্রান্ত: মানুষের রোগ নিরাময়ের জন্য চিকিৎসার পর যেসব বর্জ্য পদার্থ পরিবেশে নির্গত হয় তাকে চিকিৎসা সংক্রান্ত বর্জ্য বলে। সাধারণত হাসপাতাল বা নার্সিংহোম সংলগ্ন অঞ্চলে এই প্রকার বর্জ্য বেশি সৃষ্টি হয়ে থাকে। এই প্রকার বর্জ্যের 90% হল অসংক্রামক বর্জ্য এবং 10% বর্জ্য হল সংক্রমক প্রকৃতির।
উদাহরণ: প্লাস্টিক, ওষুধের ফয়েল, বর্জিত সূচ, সিরিঞ্জ, ছুরি, কাঁচি, ব্লেড, তুলো, গজ ইত্যাদি।

[6] তেজস্ক্রিয় বর্জ্য: যে সকল বর্জ্য থেকে তেজস্ক্রিয় পদার্থ নির্গত হয় তাকে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য বলে। পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনে কেন্দ্র, পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ কেন্দ্র এবং পারমাণবিক চুল্লি থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় পদার্থ এই প্রকার বর্জ্যের উৎস। এগুলি পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গে মানবশরীর, অন্যান্য প্রাণী ও কৃষিকাজে মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
উদাহরণ: ইউরেনিয়াম 234, নেপটুনিয়াম 237, প্লুটোনিয়াম 234, রেডিয়ান 226 ইত্যাদি।

পরিবেশের ওপর বর্জ্যের প্রভাব :

Effects of Waste on Environment

[1] জলের ওপর প্রভাব:

বর্তমানে সমুদ্র, নদী, পুকুর, জলাশয় প্রভৃতি হল বর্জ্য পদার্থ নিক্ষেপের অন্যতম স্থান। শহর বা শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন প্রকার তরল বর্জ্য, কৃষিক্ষেত্রে থেকে নির্গত বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক তরল বর্জ্য জলাশয়কে দূষিত করে। এর ফলে জলজ প্রাণীদের মৃত্যু ঘটেছে। জলজ বাস্তুতন্ত্রের বিপর্যয়ের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
[2] বায়ুর ওপর প্রভাব:

কলকারখানা ও যানবাহন থেকে নির্গত গ্যাসীয় বর্জ্য, বিভিন্ন জৈব পদার্থ পচনের ফলে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস বায়ুতে মিশে বায়ুদূষণের মাত্রাকে বহুগুন বৃদ্ধি করেছে |

[3] মাটির ওপর প্রভাব:

বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক যেমন—কীটনাশক, ডিটারজেন্ট পাউডার মাটিতে মিশ্রিত হয়ে মৃত্তিকা দূষণ ঘটায়। এছাড়া চিকিৎসার বিভিন্ন বর্জ্য পদার্থ, প্রাণীদের মূল-মূত্র ,আবর্জনা, বিভিন্ন কলকারখানা থেকে নির্গত বহু পদার্থ মৃত্তিকায় যুক্ত হয়ে ভূমি দূষণ ঘটায়। এর ফলে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়া প্রভৃতি সক্রিয় হয়ে ওঠে।


[4] স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব:

চিকিৎসাসংক্রান্ত কঠিন বা পদার্থ থেকে টাইফয়েড, জন্ডিস, আন্ত্রিক প্রভৃতি রোগ হয়ে পারে। এছাড়া সংক্রামক বর্জ্যের প্রভাবে কৃমি, কুকুর রোগ, টিটেনাস, হেপাটাইটিস-বি, চর্মরোগ প্রভৃতি দেখা দিতে পারে।

[5] জল নিকাশিতে বাধা: শহরাঞ্চলের নর্দমাগুলির মুখগুলিতে বিভিন্ন বিভিন্ন প্রকার কঠিন বর্জ্য পদার্থ জমা হয়ে বর্ষাকালে জল নিকাশিতে বাধার সৃষ্টি করে। ফলে শহরাঞ্চলে বসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলি জলমগ্ন হয়ে পড়ে।

[6] দৃশ্যদূষণ: আমাদের চারপাশে কঠিন আবর্জনা বা বর্জ পদার্থ দৃশ্যদূষণ ঘটায়। ফলে পরিবেশের সৌন্দর্য হানি ঘটে।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (waste Management) :

বর্জ্য পদার্থ পরিবেশের গুনগত মানের অবনমন ঘটায়। তাই পরিবেশের অবনমন রোধ, মানব শরীরে বিভিন্ন রোগের হাত থেকে মুক্তি, জীববৈচিত্র্য রক্ষা ইত্যাদির উদ্দেশ্যে বর্জ্যের যথাযথ সদ্ব্যবহার, বর্জ্য পদার্থের পুনর্ব্যবহার, নতুন সম্পর্ক সৃষ্টি ইত্যাদির সম্মিলিত প্রক্রিয়াকে বলা হয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় 3R এবং 4R এর গুরুত্ব অপরিসীম।

1. বর্জ্যের পরিমাণগত হ্রাস (Reduce) |

2. বর্জ্যের পুনর্ব্যবহার (Reuse) |

3. বর্জের পুর্নবীকিরন (Recycle)|

4. প্রত্যাখান (Refuse) |

আরও দেখুন : বর্জ্য ব্যবস্থাপনার 4R পদ্ধতি

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি (Processes of waste Management ) :

[1] বর্জ্য পৃথকীকরণ:

এই প্রক্রিয়ায় পচনশীল, অপচনশীল ও দূষিত বর্জ্যকে পৃথক করা হয়।বর্জ্য পৃথকী করনের মাধ্যমে জৈব ভঙ্গুর বর্জ্য (যে বর্জ্য অনুজীব দ্বারা বিয়োজিত হয়)যেমন—উদ্ভিজ দ্রব্য, খাদ্য দ্রব্যের অবশেষ,প্রাণীজাত অবশেষ ইত্যাদি পুনর্নবীকরণের মাধ্যমে মিশ্রসারে পরিণত করা যায়। বর্তমানে কেরল রাজ্যে উন্নত প্রযুক্তি- বিদ্যার সাহায্যে প্লাস্টিকের দ্রব্য থেকে অশোধিত তেল উৎপাদন করা হচ্ছে।

[2] ভরাটকরণ:

ভরাটকরণ পদ্ধতিতে একটি বিশাল গর্তে গৃহস্থালি ও পৌরসভার বর্জ্য আবর্জনাকে ফেলে তার ওপর মাটির স্তর চাপা দেওয়া হয়। এই বর্জ্য আবর্জনার পচনে যে হিউমাস তৈরি হয় তা কৃষিকাজে ব্যবহৃত হয়।

[3] কম্পোস্টিং:

প্রাকৃতিকভাবে জৈব বর্জ্যের বিয়োজনের প্রক্রিয়াকে বলা হয় কম্পোস্টিং। এই পদ্ধতিতে বিপজ্জনক জৈব বর্জ্যকে নিরাপদ মিশ্রসারে পরিণত করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় কৃষিজ বর্জ্যা ও অন্যান্য জৈব বর্জ্য পচিয়ে সার তৈরি করা হয়।

[4] নিষ্কাশন:

এই পদ্ধতিতে নিকাশি নালার মাধ্যমে নর্দমার ময়লা জল ও অন্যান্য তরল বর্জ্যের সুষ্ট বিলি ব্যবস্থা করা যায়। বর্তমানে এই নিষ্কাশন প্রথায় সমুদ্রেও বর্জ্য নিক্ষেপ করা হয়। গবেষণায় জানা গিয়েছে উপকূল থেকে 300 কিমি দূরে এবং 10,000 ফুট গভীরে বর্জ্য পদার্থ নিক্ষেপ করলে পরিবেশের কোনও ক্ষতি হয় না।

[5] স্ক্র্যাবার:

বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের একটি যান্ত্রিক পর্ব হল স্ক্র্যাবার। কলকারখানা, শক্তিকেন্দ্র থেকে যে ধোঁয়া নির্গত হয় সেখানে যে বিষাক্ত গ্যাসীয় বর্জ্য নির্গত হয়, স্ক্রাবার যান্ত্রিক পদ্ধতিতে তা ধৌত করে দূষকগুলির নিয়ন্ত্রণ করে।

Rlearn Education