বিজ্ঞান ও কুসংস্কার [ মাধ্যমিক—’05 ]
ভূমিকা :
বহু বছর বেকারির পর সরকারি সংস্থায় একটা চাকরি প্রায় হবে হবে—কপালে মিষ্টি দইয়ের ফোঁটা একটা বিকট হাঁচি দিলেন। হাঁচিতে গভীর বিশ্বাস হল যখন চাকরিটা হল না। টেস্ট পরীক্ষার আগের রাতে ভৌতবিজ্ঞানের একটা কম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে চোখ বুলোচ্ছিলাম। একটা টিকটিকি বলল টিক্ টিক্—অর্থাৎ ভৌতবিজ্ঞান প্রশ্নপত্রে এটি থাকছেই। আগাগোড়া প্রশ্নোত্তরটি মুখস্থ করে নিলাম। এল না। বুঝলাম, ওটা ছিল টিকটিকির টিটকিরি। এমনি অভয় সংস্কারে আমাদের যুগযুগান্তরের বিশ্বাস। মিলে গেলে বিশ্বাস গভীরতর হয়; না মিললে সন্দেহ জাগে; তবুও এদের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। বিজ্ঞান বলছে, এসব কুসংস্কার। কারণ ভিন্ন কোনো কার্যই হয় না। তবুও মানুষের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হয়নি। বিজ্ঞানে রয়েছে মানুষের অসীম শ্রদ্ধা, কিন্তু কুসংস্কারে সে আস্থা হারায়নি।
বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কুসংস্কার : অনেকে বলেন, অজ্ঞতা থেকেই কুসংস্কারের জন্ম, কুসংস্কারের প্রতি বিশ্বাস। কিন্তু এও তো সত্যি, জ্ঞানীগুণী বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি কুসংস্কারের ফাঁদে বন্দি। বিশেষ বিশেষ লেখক বিশেষ বিশেষ বারে লেখা শুরু করেন। প্রযোজক নতুন ছবির মহরত করেন পাঁজি-পুথিতে শুভক্ষণ দেখে। রাজনৈতিক নেতারা নির্বাচনি কাগজ জমা দেওয়ার আগে পুরোহিত ডেকে আনেন, শুভক্ষণ দেখে দেওয়ার জন্য। ব্যবসায়ী কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন পাঁজি- পুথিতে শুভদিন দেখে ও দেবতার পূজা করে। রসায়ন, পদার্থবিদ্যার ডক্টরেটও হাত বাড়িয়ে দেন জ্যোতিষের দিকে; রত্নাদি ধারণ করেন। মাঠে নামার আগে মাঠ প্রণাম করেন অধিকাংশ ফুটবলার। বিশেষ খেলার দিনে বিশেষ জার্সি ও বুট না হলে কেউ কেউ ঠিকমতো খেলতে পারবেন না ভাবেন। পুঁটিমাছ ও দই খেয়ে পরীক্ষা দিতে যাবেন পরীক্ষার্থী—এটি শুভ—কিন্তু ডিম ও আলু নৈব নৈব চ–চূড়ান্ত অশুভ।
বিজ্ঞানের প্রচেষ্টার পাশাপাশি কুসংস্কারের রাজত্ব : মানুষ তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও কৌতূহল এবং পর্যবেক্ষণ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের কত নিগূঢ় সত্যের দ্বার দিয়েছে খুলে। দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ আর গবেষণাকে মূলধন করে জড় ও জীবন প্রকৃতির কত গূঢ় রহস্যই না উদ্ঘাটিত করেছে। বিজ্ঞান লক্ষ্মীর অকৃপণ প্রসাদে আজ বিশ্বের প্রতিটি দ্বার আমাদের
সামনে উন্মুক্ত। জনমুখী করার প্রচেষ্টা চলছে। তবুও অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আজও আমরা প্রচলিত লোকাচার প্রথাগত নানা কুসংস্কারের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারিনি। এগুলির বিজ্ঞানসম্মত বাস্তবতা নেই, তবু আজও বিরিঞ্চি বাবার মতো ভণ্ড, সাধু, তুকতাক, জলপড়া, চালপোড়া, ঘটি-বাটি চালানো ঝাড়ফুঁক, ঝাটাপেটা, ওঝা—এদের দাপটে রাজত্ব চলছে সমাজে। আশ্চর্য হলেও সত্যি, উচ্চ-শিক্ষিত সমাজও এসবের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনি। আজও তাই সারাদেশ উত্তাল হয়ে ওঠে গণেশমূর্তির দুগ্ধ সেবনে।
—————————————————
আরও দেখো : দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের অবদান
—————————————————
কুসংস্কারের আস্থার কারণ : বিজ্ঞানবুদ্ধির এক প্রগতি, যুক্তি-তর্কে মানুষের এত আস্থা ও বিভিন্ন সংস্থাসমূহে এত প্রচার-প্রদর্শনী সত্ত্বেও আজও কেন বিশ্বজুড়ে কুসংস্কারের এত প্রভাব? এর উত্তরে বলা যায়, বিজ্ঞান যতই বিস্ময়ের জাদু দেখাক, মানবজীবনের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণে তার ক্ষমতা এখনও সীমিত। বিজ্ঞান ইচ্ছে করলে কোনো পরীক্ষার্থীকে সফল করিয়ে দিতে পারে না। কোনো খেলায় কে জয়ী হবে, কে পরাজিত হবে তা বলে দেবে বিজ্ঞানের কোন্ মন্ত্র? ডাক্তার যখন জবাব দিয়ে যান, রোগীর আত্মীয়স্বজন তখন দেবতার কাছে মানত করে। ডাক্তারের জবাবই তো বিজ্ঞানের পরাজয়।
উপসংহার : অন্ধবিশ্বাসের অচলায়তনকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া সম্ভবপর নয় অতি সহজে। তবু দেশজুড়ে বিজ্ঞান মঞ্চ, জন- বিজ্ঞান জাঠার আন্দোলন শুরু হয়েছে। আশাপ্রদ এই আন্দোলনের প্রভাব। অভিনয়ের মাধ্যমে ভাঁওতাবাজির স্বরূপ জাঠার সদস্যরা তুলে ধরছেন; আগ্রহশীল মানুষের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন, পথসভা, সঙ্গীত, স্লাইড প্রদর্শন ইত্যাদি করছেন। বিজ্ঞানমনস্ক আমরা আশাবাদী, একদিন কুসংস্কারের সুরক্ষা ও অন্ধত্বের লৌহকপাট উৎপাটিত হয়ে বাস্তব সত্যের আলোকপ্রভা উদ্ভাসিত হবে। প্রয়োজন কেবল গণঅংশগ্রহণ, গণ-আন্দোলন ও কর্মমুখী প্রচার।
[…] আরও দেখো : বিজ্ঞান ও কুসংস্কার […]
[…] করো |2. বিজ্ঞান ও কুসংস্কার|উত্তর- এখানে ক্লিক করো […]