বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ

Madhyamik History Suggestion| মাধ্যমিক ইতিহাস সাজেশান

বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলন :

ভূমিকা: ঔপনিবেশিক শাসনকালে বাংলার হিন্দু জনগোষ্ঠীর একটি বড়ো অংশই ছিল নিম্নবর্ণের দলিত হিন্দু। এই সময় বাংলার দলিত হিন্দুদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ভুক্ত। ১৮৭২ থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সারা বাংলাজুড়ে নমঃশূদ্র আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

[i] আন্দোলনের কারণ: ঔপনিবেশিক শাসনকালে বিভিন্ন কারণে বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।

(1) সামাজিক অমর্যাদা: উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নমঃশূদ্রদের অস্পৃশ্য বলে মনে করত এবং তাদের ঘৃণার চোখে দেখত।

(2) সীমাহীন দারিদ্র্য: দারিদ্র্য ছিল নমঃশূদ্রদের নিত্যসঙ্গী। কৃষিকাজ ছিল তাদের প্রধান পেশা। এ ছাড়া তারা মাছ ধরা, তঁত বোনা, অন্যের বাড়ি ও জমিতে দিনমজুরের কাজ করা প্রভৃতি অত্যন্ত কম আয়ের পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিল।

(3) অর্থনৈতিক শোষণ: দরিদ্র নমঃশূদ্রদের ওপর জমিদার ও সরকারের তীব্র শোষণ চলত। সার্বিক দুর্দশা অশিক্ষা,অচিকিৎসা, সামাজিক অমর্যাদা নমঃশূদ্রদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল।

[ii] আন্দোলনের পথে যাত্রা: নমঃশূদ্র সম্প্রদায় নিজেদের আর্থসামাজিক দুরবস্থা দূর করার উদ্দেশ্যে সামাজিক আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনে বিভিন্ন সময় নেতৃত্ব দেন হরিচাদ ঠাকুর, গুরুচাঁদ ঠাকুর, রাজেন্দ্রনাথ মণ্ডল, মুকুন্দবিহারী মল্লিক, বিরাটচন্দ্র মন্ডল, যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, প্রমথরঞ্জন ঠাকুর প্রমুখ নমঃশূদ্র নেতা।

[iii] আন্দোলনের সূচনা: ফরিদপুর- বাখরগঞ্জ অঞ্চলে ১৮৭২ – ৭৩ খ্রিস্টাব্দে একটি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নমঃশূদ্র আন্দোলনের সূচনা হয়। এখানে এক বিশিষ্ট নমঃশূদ্র নেতার মায়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে উচ্চবর্ণের লোকজন আসতে অস্বীকার করে। এরপর নমঃশূদ্ররা উচ্চবর্ণের সঙ্গে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। তারা উঁচু জাতের কৃষিকাজ, ঘর ছাওয়া বা অন্যান্য কাজ করতে অস্বীকার করে।

[iv] মতুয়া ধর্মের প্রসার: নমঃশূদ্র নেতা শীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর অনুগামীদের মধ্যে মতুয়া নামে এক ধর্মীয় ভাবধারার প্রচার করে নমঃশূদ্রদের ধর্মীয় আদর্শে ঐক্যবদ্ধ করেন। মতুয়া ধমকে কেন্দ্র করে নমঃশূদ্র ঐক্যবদ্ধ করেন৷ মতুয়া ধর্মকে কেন্দ্র করে নমঃশূদ্র আন্দোলন সক্রিয় হয়ে ওঠে। হরিচাদের পুত্র গুরুচাদ ঠাকুর নমঃশূদ্রদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পরামর্শ দেন।

[v] চেতনার জাগরণ: হরিচাঁদ ঠাকুর ও তার পুত্র গুরুচাদ ঠাকুর উপলদ্ধি করেন যে, নমঃশূদ্রদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার খুবই জরুরি। তাই তারা আন্দোলনের বার্তা গ্রামগঞ্জের নমঃশূদ্রদের মধ্যে প্রচার করেন। তারা সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নমঃশূদ্রের যাত্রাগান, পালাগান, সাপ্তাহিক ‘মুষ্ঠি সংগ্রহ প্রভৃতি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেন। এর ফলে নমঃশূদ্রদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।

———————————————————

আরও দেখুন : মাধ্যমিক বাংলা সাজেশান 2024

বাংলা প্রতিবেদন রচনা

নীলবিদ্রোহের কারণ , বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব

———————————————————

[v] নমঃশূদ্র সংগঠন: নমঃশূদ্র সংগঠনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘নমঃশূদ্র ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’, ‘উন্নয়নী সভা (১৯০২ খ্রি.), ‘বেঙগল নমঃশূদ্র অ্যাসোসিয়েশন (১৯১২ খ্রি.), ‘নিখিলবঙ নমঃশূদ্র সমিতি (১৯২৬ খ্রি.), ‘বেঙাল ডিপ্রেসড ক্লাসেস অ্যাসোসিয়েশন’ বা ‘বঙ্গীয় দলিত শ্রেণি সমিতি’ (১৯২৬ খ্রি.) প্রভৃতি। এসব সংগঠনের উদ্যোগে বিভিন্ন স্থানে নমঃশূদ্রদের সম্মেলনের আয়োজন হয়।

[vii] রাজনৈতিক দাবি: নমঃশূদ্ররা ক্রমে রাজনৈতিকভাবেও বিভিন্ন দাবিদাওয়া জানাতে থাকে।

(1) ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গভঙকে তারা সমর্থন করে। (2) তারা নিজেদের সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানায়।(3) লন্ডনে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে (১৯৩০-৩২ খ্রি.) আইনসভায় বেশিসংখ্যক দলিত প্রতিনিধি গ্রহণের দাবি জানানো হয়।(4) আম্বেদকরের পৃথক নির্বাচনের দাবি এবং সরকারের সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ নীতিকে তারা সমর্থন করে।

উপসংহার: নমঃশূদ্রদের দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে বাংলার দলিতরা বেশ কিছু রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার লাভ করতে সক্ষম হয়। তবে দেশভাগের সময় নমঃশূদ্র নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল নমঃশূদ্রদের পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার আবেদন জানালেও শ্রীশ্রীহরিচাদ ঠাকরের উত্তরসুরি প্রমথরঞ্জন ঠাকুরের নেতৃত্বে নমঃশূদ্রদের একটি বড়ো অংশ মাতৃভূমি ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় আশ্রয় গ্রহণ করে। এরপর নমঃশূদ্ররা পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের শিকার হলে এবং পশ্চিমবঙ্গে নিঃস্ব-রিক্ত উদ্বাস্তু জীবনের সম্মুখীন হলে তাদের আন্দোলনে ভাটা পড়ে।

দ্রুত দেখে নিন :

মাধ্যমিক বাংলা সাজেশান 2024

মাধ্যমিক ইতিহাস সাজেশান 2024

Rlearn Education